আমাদের কথা খুঁজে নিন

   

ভোট জবাই

১. চারদিকে ঘনকুয়াশা। নির্বাচনের আগের রাত। প্রায় সাড়ে ৮টা। তীব্র শীত। তিনটি গাড়ি কুয়াশা কেটে এগিয়ে এলো। গাড়ির নম্বর-ঢাকা মেট্রো-চ ৫৩-০৯৬০, ঢাকা মেট্রো-১১-৯৭৩৫, ঢাকা মেট্রো-চ ১৩-০৪৫৯ ও হাজী মক্কা ট্রাভেলস মিনিবাস। বাস থেকে নামল কমপক্ষে ৩০ জন বহিরাগত সন্ত্রাসী। উঠল টুকুর ভাই ১৬ বছর ধরে মেয়র পদ দখলে রাখা আবদুল বাতেনের তিনতলা বাড়িতে। নির্বাচনের দুই দিন আগে থেকে যানচলাচল বন্ধ। কিন্তু এ গাড়িগুলো এলো কীভাবে? খবর পাওয়ার সঙ্গে সঙ্গে পুলিশকে জানানো হলো। জানানো হলো র্যাবকে, বিজিবিকে। তারা অতিশয় ভদ্রভাবে বললেন, বিষয়টি তারা দেখছেন। কিছুই যখন হলো না, প্রায় এক ঘণ্টা পর বেড়া কলেজে অবস্থানরত সেনাবাহিনীর কর্মকর্তার সঙ্গে দেখা করে তাদের বিশেষভাবে জানালাম এসব সন্ত্রাসীর বিরুদ্ধে ব্যবস্থা না নিলে নির্বাচন নিরপেক্ষ, সুষ্ঠু হবে না। সেনা কর্মকর্তা শুনলেন। তাকিয়ে থাকলেন। তারপর বললেন, দেখি পেট্রোল পার্টি পাঠানো যায় কিনা। ইতোমধ্যে বিষয়টি আন্দাজ করে সন্ত্রাসীরা স্বরাষ্ট্র প্রতিমন্ত্রীর বাড়িতে আশ্রয় নেয়। তখন তাদের ধরে কে? খাওয়া-দাওয়া করে ব্লুপ্রিন্ট মোতাবেক বিভিন্ন জায়গায় সন্ত্রাসীরা চলে যায়।

২. ভোট শুরু হওয়ার আগে ঘনকুয়াশায় সকাল ৯টায় স্বরাষ্ট্র প্রতিমন্ত্রীর কথিত এপিএস দোলনের নেতৃত্বে পাইকরহাটি শহিদনগর উচ্চ বিদ্যালয়ে প্রায় ২০ জন সশস্ত্র সন্ত্রাসী নিয়ে হামলা চালায়। ভোটকক্ষের কয়েকটি বুথে প্রবেশ করে বই নং ২৩৩১, ২৩৩২, ২৩৫১ ছিনিয়ে নিয়ে সিল মেরে ব্যালট বাঙ্ েঢুকিয়ে দেয়। এসব ব্যালটের অপর পৃষ্ঠায় কোনো অফিসারের সহি-স্বাক্ষর নেই। তালা মার্কার পোলিং এজেন্টকে পিস্তল ঠেকিয়ে রাখে। তার মধ্যে সে চিৎকার করলে জনগণ এগিয়ে আসে। আধা ঘণ্টা বারবার মোবাইল করে র্যাব, বিজিবিকে পাওয়া গেলে তারা সেখানে যায় এবং সন্ত্রাসীরা তাদের দখল ছেড়ে দেয়। এরপর তারা বীরদর্পে সাটিয়াকোলা মাদ্রাসা, বরাট কেন্দ্র, মেহেদীনগর, কাবারিকোলা, শ্রীধরকোলা এলাকায় গিয়ে এজেন্টদের বের করে দিয়ে নৌকা মার্কায় বেপোরোয়া ভোট কেটে বাঙ্ েঢুকায়। কোথায় পুলিশ, র্যাব বা কোথায় বিজিবি?

৩. পৌর মেয়র আবদুল বাতেনের নেতৃত্বে হাড়িয়া, চরপাড়া, ভুলবাড়িয়া, ডহরজানি, ধুলাউড়ি মাদ্রাসায় তার সন্ত্রাসী বাহিনী নিয়ে কর্তব্যরত সহকারী পুলিশ সুপারকে দিয়ে তালা মার্কার মিন্টুসহ এজেন্টদের গলাধাক্কা দিয়ে বের করে দেয় এবং সেখানে ভোট কাটার মচ্ছব শুরু হয়। একইভাবে স্বরাষ্ট্র প্রতিমন্ত্রীর বড় ছেলে আশিক শামস রঞ্জনের (১৪৬ কোটি ৪৩ লাখ টাকা রাজস্ব লুটপাট করেছে বলে কথিত) নেতৃত্বে মিয়াপুর স্কুল অ্যান্ড কলেজ, সামান্যপাড়া, বিষ্ণুপুর, ক্ষেতুপাড়া, খালইভরা প্রাথমিক বিদ্যালয় ভোটকক্ষে আগ্নেয়াস্ত্র উঁচিয়ে তালা মার্কার এজেন্টদের বের করে দেয় এবং নির্বিচারে সন্ত্রাসী বাহিনী দিয়ে ভোট কাটতে থাকে।

৪. স্বরাষ্ট্র প্রতিমন্ত্রীর ছোট ছেলে নাসিফ শামস রনি চাকলা ইউনিয়নে ফারুকের সন্ত্রাসী দল নিয়ে চাকলা বিদ্যালয়, পাচুরিয়া মাদ্রাসা, নতুন ভারেঙ্গা ও পূর্ব শ্রীকণ্ঠদিয়ায় এক দারোগার স্ত্রী হাবিবা জোরপূর্বক তালা মার্কার এজেন্টদের বের করে দিয়ে ভোট কেটে নেয়। চাকরিরত দারোগার স্ত্রীর কীর্তিকলাপে নিশ্চয়ই তার স্বামীর প্রমোশন হবে সন্দেহ নেই।

৫. সবচেয়ে আশ্চর্যের বিষয় হলো- এই ভোট কাটার ক্ষেত্রে রেকর্ড করেছেন স্বরাষ্ট্র প্রতিমন্ত্রী স্বয়ং। তিনি আতাইকুলা এলাকার সন্ত্রাসী বাহিনীর প্রধান কোরবান আলীকে সঙ্গে নিয়ে আড়িয়াডাঙ্গী ভোটকেন্দ্রে ঢুকে পড়েন। এজেন্ট টিটুকে অপহরণ করে পুলিশের গাড়িতে তুলে দেন। তিন মাইল দূরে এসে তাকে রাস্তায় ফেলে দেয়। অন্য এজেন্টের গলা চেপে ধরে তাকে তার সঙ্গীয় সন্ত্রাসীরা পিস্তল ঠেকিয়ে রাখে। তিনি তার দল মিলে ছয়টি বুথের বারোটি বই (প্রতিটি বই একশ পাতার) নিয়ে কেটে বাঙ্ েঢুকিয়ে দেয়। একইভাবে বৃহস্পতিপুর সেন্টারে তার বাহিনীসহ ঢুকে পাঁচটি বই কেটে বাঙ্ েঢুকিয়ে দেয়।

৬. এরকম প্রায় ৪০টি সেন্টারে সরাসরি শুধু এজেন্ট নয় প্রিসাইডিং অফিসারদের পিস্তল ঠেকিয়ে ভোট ডাকাতির নেতৃত্ব দিয়েছেন স্বরাষ্ট্র প্রতিমন্ত্রী, দুই পুত্র, ভাই বাতেন, তার কথিত তিন এপিএস, হালিম, চোদ্দ, বাবুল, টুটুল, মুকুল, জিয়া, সালাম, ইসরাফিল, চাঁদ, সেলিম, লিটন মোল্লা, কল্লোল, বাবুল (নন্দনপুর), লতিফ, শফিক, ইকবাল, আশরাফ মেম্বার, আজাদ, আসাদ, পল্টন, জহুরুল মাস্টার, সরওয়ার, মন্ত্রী, টুটুল, জামাল, জরিফ, রঞ্জু, ইউনুস মাস্টার, লালু, সাত্তার, শামীম, নজরুল, পিনচু, আমজাদ প্রমুখ সন্ত্রাসী বাহিনী। এরূপ ৪০টি সেন্টারে ভোট ডাকাতির মাধ্যমে স্বরাষ্ট্র প্রতিমন্ত্রী ও তার সন্ত্রাসী বাহিনী আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর ছত্রছায়ায় ৩৩ হাজার ৫৭৭টি ভোট জবাই করে বাঙ্ েঢুকিয়ে দেয়। যার গড় ৮৩৯ এবং তালার গড় ৩০০ মাত্র। ৪২টি সেন্টারে কারচুপির মাধ্যমে অর্থাৎ এজেন্টদের বের করে দিয়ে সন্ত্রাসীরা সেখানে পালাক্রমে একেকজন ১০-১৫টি ভোট দিয়েছে। এসব জায়গায় তালার গড় ভোট ৩৫০ এবং নৌকার গড় ভোট ৪৬১। অন্য ৩৫টি সেন্টারে গড় ফলাফল তালা ৫৪২ ভোট ও নৌকা ৩৯২ ভোট।

৭. উল্লেখ্য, বেলা সাড়ে ১১টায় সাঁথিয়ায় রিটার্নিং অফিসার বরাবর এসব কেন্দ্রে চলমান ভোট ডাকাতির অভিযোগ দিয়েছি। কোনো কার্যকর ব্যবস্থা নেওয়া হয়নি। সিভিল প্রশাসন চেষ্টা করলেও আইনশৃঙ্খলা বাহিনী সেভাবে সক্রিয় ছিল না বলে প্রতীয়মান হয়েছে। আইনশৃঙ্খলা বাহিনী সন্ত্রাসীদের ধরেও কার নির্দেশে ছেড়ে দিয়েছে তা জনগণের কাছে প্রশ্নের উদ্রেক করেছে। ভোটের আগের রাতে তালা মার্কার এজেন্টদের পুলিশ বাড়িছাড়া করেছে। অভিযোগে কোনো কাজ হয়নি। এমনকি ভোট ডাকাতির এসব ঘটনা রিটার্নিং অফিসার ও প্রধান নির্বাচন কমিশনারকে জানিয়ে ভোট ডাকাতির সেন্টারগুলো স্থগিত করার আবেদন জানিয়েছিলাম ওইদিন বিকাল ৩টার মধ্যে। কিন্তু কোনো কার্যকর ব্যবস্থা গ্রহণ করা হয়নি। প্রধানমন্ত্রী ও নির্বাচন কমিশন জাতিকে প্রতিশ্রুতি দিয়েছিলেন ভোট নিরপেক্ষ হবে। আমি দেখতে চেয়েছিলাম আসলে তাদের মুখের কথা ও বাস্তবতা এক কিনা? সেই চ্যালেঞ্জ নিয়ে আমি ভোটে দাঁড়িয়েছিলাম। প্রমাণ হয়েছে এই ৬৮ পাবনা-১ নির্বাচনী এলাকায় জনগণ হুমকি-ধমকি, ভয়-ভীতি, সন্ত্রাস ও প্রতারণার শিকার হয়েছি। সংখ্যালঘুদের ব্যাপক চাপের মুখে রাখা হয়েছে। এমনকি মারপিট করা হয়েছে। এভাবে স্বরাষ্ট্র প্রতিমন্ত্রী প্রধানমন্ত্রীর প্রতিশ্রুতি লণ্ডভণ্ড করেছেন। সরকার, নির্বাচন কমিশন এবং সর্বোপরি প্রধানমন্ত্রীর ভাবমূর্তিতে অমোচনীয় কালিমালিপ্ত করেছেন। জনগণের ভোটকে জবাই করেছেন তারই স্বরাষ্ট্র প্রতিমন্ত্রী। এই দায় ও দায়িত্ব কে বহন করবে?

লেখক : রাজনীতিবিদ, সাবেক তথ্য প্রতিমন্ত্রী ও বাহাত্তরের

খসড়া সংবিধান কমিটির অন্যতম সদস্য।


এর পর.....

অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।

প্রাসঙ্গিক আরো কথা
Related contents feature is in beta version.