আমাদের কথা খুঁজে নিন

   

'গৃহপালিত' বিরোধী দলে কি শেষ রক্ষা হবে?

দশম জাতীয় সংসদের সদস্যরা ৯ জানুয়ারি সকালে শপথ নিয়ে ফেলেছেন। কি করে তারা এই শপথ নিলেন, আর স্পিকারই বা কি করে তাদের শপথ পড়ালেন তা নিয়ে আলোচনার ঝড় বইছে। বাংলাদেশ সংবিধানের ১২৩(৩) অনুচ্ছেদে বলা আছে, 'সংসদ-সদস্যদের সাধারণ নির্বাচন অনুষ্ঠিত হইবে (ক) মেয়াদ-অবসানের কারণে সংসদ ভাঙিয়া যাইবার ক্ষেত্রে ভাঙিয়া যাইবার পূর্ববর্তী নব্বই দিনের মধ্যে; এবং (খ) মেয়াদ-অবসান ব্যতীত অন্য কোন কারণে সংসদ ভাঙিয়া যাইবার ক্ষেত্রে ভাঙিয়া যাইবার পরবর্তী নব্বই দিনের মধ্যে। তবে শর্ত থাকে যে, এই দফায় (ক) উপ-দফা অনুযায়ী অনুষ্ঠিত সাধারণ নির্বাচনে নির্বাচিত ব্যক্তিগণ, উক্ত উপ-দফায় উলি্লখিত মেয়াদ সমাপ্ত না হওয়া পর্যন্ত সংসদ সদস্যরূপে কার্যভার গ্রহণ করিবেন না। '

সেই অনুযায়ী দশম জাতীয় সংসদের সদস্যরা নবম সংসদের মেয়াদকালে দায়িত্ব নিতে পারেন না।

একটি সংসদ বলবৎ থাকতে একই সঙ্গে আরেকটি সংসদ গঠিত হয় কী করে তার কোনো আইনি ব্যাখ্যা এখনো সরকার দিতে পারেনি। নির্বাচন কমিশনও এ ব্যাপারে সন্দিগ্ধ। জটিলতা বেড়েছে সংসদ নির্বাচনের গেজেট প্রকাশ করার পর। পর্যবেক্ষকরা বলছেন, সরকারি চাপেই ইসি গেজেট প্রকাশে বাধ্য হয়েছে। এদিকে গেজেট প্রকাশের তিন দিনের মধ্যে নির্বাচিত সংসদ সদস্যদের শপথের ব্যাপারে সাংবিধানিক বাধ্যবাধকতা আছে।

কিন্তু আগের সংসদ বহাল রেখে নতুন সংসদ সদস্যদের শপথের পর একটি আসনে একই সময়ে দুজন সংসদ সদস্য থাকায় জটিলতা সৃষ্টি নিয়ে নির্বাচন কামিশনও চিন্তিত ছিল বলে জানা গেছে। বেসরকারি ফলাফলের গেজেট কতদিনের মধ্যে প্রকাশ করতে হবে গণপ্রতিনিধিত্ব আদেশ (আরপিও) বা প্রচলিত আইনের কোথাও সরাসরি তা বলা নেই। তাই তড়িঘড়ি করে গেজেট প্রকাশ করা ইসির জন্য বাধ্যতামূলক ছিল না। সংবিধানের ১৪৮ (৩) অনুচ্ছেদ অনুযায়ী শপথ নেওয়ার পরপরই সংসদ সদস্যরা কার্যভার গ্রহণ করেছেন বলে ধরে নেওয়া হবে। বিষয়টি এখন সংবিধানের ১২৩ (৩) (খ) অনুচ্ছেদের সঙ্গে সাংঘর্ষিক হয়ে গেছে।

উল্লেখ্য, সাংবিধানিক এই স্পষ্ট নির্দেশ মাথায় রেখে নির্বাচনের তফসিল ঘোষণার আগে আইনমন্ত্রী শফিক আহমেদের বাসায় সরকারের পদস্থ কর্মকর্তাদের একটি বৈঠক হয়েছিল এবং তাতেই নবম সংসদ বহাল রেখে দশম সংসদ নির্বাচনের সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়েছিল। নব নির্বাচিতরা ২৪ জানুয়ারির পর শপথ নেওয়াই সঙ্গত বলে মত দেওয়া হয়েছিল সেই বৈঠকে। কিন্তু সংবিধান, আইন, রীতি কোনো কিছুই মান্য করা হয়নি। লীগ সরকার ও শাসক লীগের এ সিদ্ধান্তের কারণ একেবারে দুর্বোধ্য নয়। এ নির্বাচন নিয়ে দেশে-বিদেশে হাসি-বিদ্রূপ চলছে।

গ্রহণযোগ্যতা শূন্যের কোঠায়। আরও ১৫ দিনে এই সংসদ নিয়ে হঠাৎ কি হয়ে যায় তা নিয়ে নিদারুণ শঙ্কা-ভীতি থেকে ক্ষমতাসীনরা অবিমৃস্যকারী সিদ্ধান্ত নিয়ে শপথের আয়োজন করেছেন বলে স্পষ্টই বোঝা যায়।

দেশে এমন একটা নির্বাচন হলো যাতে দেশের প্রেসিডেন্ট, প্রধানমন্ত্রী, বিরোধীদলীয় নেত্রী, স্পিকার, প্রধান বিচারপতি, প্রধান নির্বাচন কমিশনার কারও ভোট ছিল না, ভোট দেওয়ার প্রয়োজন হয়নি। তারাও নিজেদের পছন্দমতো প্রার্থী বাছাই করার সুযোগ পাননি। বিনা ভোটে এমপি হয়ে গেছেন ১৫৩ জন- ৩০০ সরাসরি নির্বাচিত সদস্যের ৫১ শতাংশ।

এতে সংবিধান স্পষ্টতই লঙ্ঘিত হয়েছে। ১৪৭ আসনের যে নির্বাচন হয়েছে তাও প্রহসন বলেই মনে হয়েছে। ৫ জানুয়ারির ওই 'খুচরা' নির্বাচনে প্রদত্ত ভোটের হার জানাতে নির্বাচন কমিশন সময় নিয়েছেন দুই দিন। এ বিলম্বের কারণ বুঝতে না পারার মতো বোকা নয় মানুষ। দেশের মানুষ চেয়েছিল সব দলের অংশগ্রহণের মাধ্যমে একটি গ্রহণযোগ্য নির্বাচন হোক, জনদরদী, সৎ ও প্রকৃত রাজনীতিবিদরা সংসদে আসুক, দুর্নীতি-দুঃশাসনের অবসান হয়ে সুনীতি ও সুশাসন প্রতিষ্ঠিত হোক এবং অর্থবহ গণতন্ত্রের ফুল ফুটুক দেশে।

কিন্তু তা হতে দিলেন না ক্ষমতাসীনরা, বিরোধী দল পারল না ক্ষমতাসীনদের তেমন একটা নির্বাচনে বাধ্য করতে। বিনা ভোটে ১৫৩ জন এবং নামকাওয়াস্তে ভোটে যে ১৪৭ জন সংসদে ঢুকছেন তারা কারা, তা তো জানা গেছে নির্বাচন কমিশনে জমা দেওয়া তাদের হলফনামা থেকে। নতুন সংসদ ও নতুন সরকারের এ যাত্রাকে নির্মোহ পর্যবেক্ষকরা বলছেন, দুর্নীতি ও দুঃশাসনের নবযাত্রা।

ঘোষণা দেওয়া হয়েছে, আজ বিকালে নতুন মন্ত্রিসভা শপথ গ্রহণ করবে। ইতোমধ্যে রাষ্ট্রপতি সংসদে সংখ্যাগরিষ্ঠ দলের নেতা হিসেবে আওয়ামী লীগ সংসদীয় দলের নেতা শেখ হাসিনাকে সরকার গঠনের জন্য আমন্ত্রণ জানিয়েছেন।

বলা হচ্ছে, এ সরকার দশম জাতীয় সংসদে নির্বাচিতদের সরকার। দশম সংসদ নির্বাচন নিয়ে দেশ-বিদেশে তুমুল বিতর্কের কথা শুরুতেই উল্লেখ করেছি। কাঙ্ক্ষিত ও গ্রহণযোগ্য নির্বাচন এটি হয়নি, এ ব্যাপারে আওয়ামী লীগের অন্ধ অনুরাগী, বেনিফিশিয়ারিরা ছাড়া বাদবাকি সবাই একমত। সবাই বলছেন, এটা কোনো নির্বাচন হয়নি; নির্বাচনের নামে হয়েছে একটা প্রহসন। প্রধান বিরোধী দলসহ নির্বাচন কমিশনে নিবন্ধিত ৪২টি রাজনৈতিক দলের মধ্যে ৩০টি দলই তাতে অংশগ্রহণ করেনি।

নির্বাচনকালীন সরকারব্যবস্থা, নবম সংসদ বহাল রেখে দশম সংসদ নির্বাচনের উদ্দেশ্যমূলক আয়োজন ও সবার জন্য লেভেল প্লেয়িং ফিল্ড না থাকার প্রতিবাদে তারা এ নির্বাচনকে শাসক লীগের নীলনকশার সাজানো নির্বাচন বলে অভিহিত করে তা বর্জন করেছে। এর আগে জাতীয় নির্বাচন অনুষ্ঠানের পরপরই নির্বাচনের নিরপেক্ষতা ও গ্রহণযোগ্যতার স্বীকৃতি জানিয়ে বিজয়ী দলের নেতাকে অভিনন্দন জানিয়ে বার্তা পাঠাত সব বন্ধুরাষ্ট্র। কিন্তু এবারের 'পোকা খাওয়া' দশম সংসদ নির্বাচনের কেউ-ই অভিনন্দন জানায়নি। এমন কি বাংলাদেশে একটা সেক্যুলার সরকারের একান্ত আকাঙ্ক্ষা থেকে শেখ হাসিনার নেতৃত্বাধীন সরকারের অধীনে একটা অস্বাভাবিক এঙ্ক্লুসিভ নির্বাচনের পক্ষে যে ভারত দৃঢ় ও উলঙ্গ অবস্থান নিয়েছিল এবং বৈরী বিশ্বকে বশ মানানোর জন্য যে কোনো ধরনের নির্বাচনের মাধ্যমে গঠিত কথিত সেক্যুলার সরকারের পক্ষে দূতিয়ালি করার আশ্বাস দিয়েছিল, সেই ভারত সরকারও কোনো অভিনন্দন জানায়নি। এমন একটি 'নির্বাচনের' মাধ্যমে গঠিত সংসদ সদস্যদের নিয়ে যে মন্ত্রিসভা আজ শপথ নেবে দেশ-বিদেশে সেই সরকারের গ্রহণযোগ্যতা ও মর্যাদাও হবে এই সংসদের মতোই।

দশম জাতীয় সংসদ নির্বাচন বলতে আমরা সারা দেশের ৩০০ সংসদীয় আসনের নির্বাচনকেই বুঝব। বাংলাদেশের সংবিধানের ৬৫(২) অনুচ্ছেদে স্পষ্ট করে নির্দেশ আছে, 'একক আঞ্চলিক নির্বাচনী এলাকাসমূহ হইতে প্রত্যক্ষ নির্বাচনের মাধ্যমে আইনানুযায়ী নির্বাচিত তিনশত সদস্য লইয়া এবং এই অনুচ্ছেদের (৩) দফায় কার্যকরতাকালে উক্ত দফায় বর্ণিত সদস্যদিগকে (সংরক্ষিত মহিলা আসনের সদস্য) লইয়া সংসদ গঠিত হইবে, সদস্যগণ সংসদ সদস্য বলিয়া অভিহিত হইবেন। ' পাঠক, লক্ষ্য করুন, ১৫৩ 'একক আঞ্চলিক নির্বাচনী এলাকা' থেকে 'প্রত্যক্ষ নির্বাচনের মাধ্যমে আইনুযায়ী নির্বাচিত'- সংবিধান নির্দেশিত এই অতীব গুরুত্বপূর্ণ ও অপরিহার্য বিষয়টিকে অবজ্ঞা করা হয়েছে। ১৫৩ আসন মোট আসনের ৫১ শতাংশ। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা নিজের মুখেই বলেছেন, 'সর্বদলীয়' সরকারে (সংবিধানে এই ধরনের কোনো সরকারের ব্যবস্থা নেই) অংশগ্রহণকারীদের মধ্যে সমঝোতার ভিত্তিতে প্রার্থী দেওয়ার ফলে এত বেশি সংখ্যক প্রার্থী বিনা প্রতিদ্বন্দ্বিতায় নির্বাচিত হয়েছেন।

বিএনপি 'সর্বদলীয়' সরকারে এলে তাদের সঙ্গেও সমঝোতা হতো। এর মানে কি? বিএনপি একমত হলে বাকি ১৪৭ একক আঞ্চলিক নির্বাচনী এলাকায়ও প্রত্যক্ষ নির্বাচন_ যাকে অনেকেই বলছেন কলঙ্কের নির্বাচন হতো না। ৩০০ আসনে আমরা 'অটো' এমপি পেয়ে যেতাম। যে নির্বাচনে ৫১ শতাংশ আসন আপস-সমঝোতার মাধ্যমে 'আমরা আর মামুরা'_ এদের মধ্যে বাটোয়ারা হয়ে যায়, তাকে কীভাবে 'প্রত্যক্ষ নির্বাচন' আর অটো এমপিদের নির্বাচিত এমপি বলা যাবে? এদের নিয়েই গঠিত হচ্ছে নির্বাচিত গণতান্ত্রিক (!) সরকার। এই ১৫৩ আসনের জনগণ তাদের পছন্দের প্রার্থী বাছাই করার সুযোগই পেল না।

অথচ এটা তাদের গণতান্ত্রিক সাংবিধানিক অধিকার। জনগণকে তাদের এই অধিকার থেকে বঞ্চিত করা কতটা আইনসিদ্ধ হয়েছে তা দেখার জন্য আমাদের অপেক্ষা করতে হবে। বিনা প্রতিদ্বন্দ্বিতায় নির্বাচিত হওয়ার ব্যাপারে আইনগত বাধা আমাদের সংবিধান আরোপ করেনি এবং বিনা প্রতিদ্বন্দ্বিতায় নির্বাচিত হওয়ার নজির আমাদের দেশেই আছে। ষষ্ঠ সংসদ নির্বাচনে ৪৯ জন বিনা প্রতিদ্বন্দ্বিতায় নির্বাচিত হয়েছিলেন। কিন্তু ওই পরিমাণ সদস্য নিয়ে সরকার গঠন করে ফেলা সম্ভব ছিল না।

তখন এমন কথা সাবেক প্রধানমন্ত্রী খালেদা জিয়া বলেননি, আপস-সমঝোতার মাধ্যমে ওই ৪৯ আসনের প্রার্থীরা বিনা প্রতিদ্বন্দ্বিতায় জিতে গেছেন। কিন্তু এবার ১৫৪ আসন পেয়ে (এক আসনে মামলা করে এক প্রার্থী তার প্রার্থিতা ফিরে পাওয়ার পর তা ১৫৩ তে নেমে আসে) সমঝোতার মাধ্যমে ভাগাভাগি হয়ে যাওয়ার কথা স্বয়ং প্রধানমন্ত্রী বলেছেন। এ ব্যাপারে কোনো আইনি লড়াই বাধলে আইন ও সংবিধান বিশেষজ্ঞরা বিবেচনা করবেন সংবিধান অনুযায়ী এই ১৫৩ আসনের অটো এমপিদের নির্বাচন আইনসিদ্ধ কিনা? আইন ছাড়াও এসব ক্ষেত্রে নৈতিকতা ও গ্রহণযোগ্যতার বিষয় খুবই গুরুত্বপূর্ণ। এদিক বিবেচনায় ১৫৩ অটো এমপির বিষয়টি প্রশ্নবোধক চিহ্নের মধ্যেই থেকে যাবে। অথচ এদের নিয়েই সরকার গঠনের সক্ষমতা অর্জন করে ফেলেছিলেন লীগ সভানেত্রী শেখ হাসিনা।

গত ৫ জানুয়ারি 'একক আঞ্চলিক নির্বাচনী এলাকাসমূহ' থেকে 'প্রত্যক্ষ নির্বাচনের' মাধ্যমে নির্বাচিত যে ৩০০ সংসদ সদস্য নিয়ে বাংলাদেশের দশম জাতীয় সংসদ গঠিত হওয়ার কথা, সেই পূর্ণাঙ্গ নির্বাচন কিন্তু হয়নি, হয়েছে ১৪৭ আসনের 'খুচরা' নির্বাচন। তাই ৫ তারিখের জাতীয় সংসদ নির্বাচনকে কি পূর্ণাঙ্গ নির্বাচন বলা যাবে? এই খুচরা নির্বাচনটাও ১৪৭ আসনের জনগণ কীভাবে নিয়েছে ভোট গ্রহণের দিনই তো বোঝা গেছে, দেখা গেছে মিডিয়ার সৌজন্যে। প্রিন্ট মিডিয়া তো পরদিন ৬ জানুয়ারি ধসিয়ে দিয়েছে সরকার ও 'জিনের বাদশাহ' অভিধাপ্রাপ্ত প্রধান নির্বাচন কমিশনারসহ গোটা নির্বাচন কমিশনকে। ৪৯টি কেন্দ্রে একটি ভোটও না পড়ায় বোঝা যায় নির্বাচনটা কেমন হয়েছে এবং ভোটারের উপস্থিতি কেমন ছিল? বিরোধী দলের ভাষ্য অনুযায়ী ভোটারের উপস্থিতি ছিল ৪%-৫%। নির্মোহ পর্যবেক্ষকদের দৃষ্টিতে এই সংখ্যা ১৩%-১৫%।

এই পরিসংখ্যান ৫ তারিখে না হলেও ৬ জানুয়ারি সকালেই দিতে পারত নির্বাচন কমিশন। সন্ধ্যায় প্রধানমন্ত্রী সংবাদ সম্মেলনেও প্রদত্ত ভোটের হার জানাতে পারলেন না সাংবাদিকদের। বললেন সময় লাগবে। হিসাব করে নির্বাচন কমিশন তা জানাবে। প্রধান নির্বাচন কমিশনারও সময় চাইলেন।

কিন্তু ৭ জানুয়ারি তিনি বিস্ময়ের বোমা ফাটিয়ে প্রথমে বললেন ৩৯.৪৪ শতাংশ ভোট পড়েছে, পরে আরেক কোঁত দিয়ে বললেন, থুক্কু, ৪০.৫৬ শতাংশ! প্রধানমন্ত্রী এবং প্রধান নির্বাচন কমিশনার প্রদত্ত ভোটের হার জানাতে যখন অযথা সময় চেয়ে নিলেন, তখনই মানুষ বলাবলি শুরু করেছিল যে, ইলেকশন ইঞ্জিনিয়ারিংয়ের শেষ কাজটি সম্পন্ন করা এখনো বাকি আছে। তবে ভোটের দিনই এদিকে-সেদিকে কানাঘুষা চলছিল যে, ভোট প্রদানের হার ৪০ শতাংশের ওপর ও পঞ্চাশ শতাংশের নিচে দেখানোর একটা চিন্তা আছে সরকারি মহলের মাথায়। ওই দিন রাতে বিভিন্ন বেসরকারি টেলিভিশন চ্যানেলের 'টকশো'তে আলোচকদের কেউ কেউ তেমন ইঙ্গিত দিয়েছিলেন। দুইবার দুই ঘোষণায় নির্বাচন কমিশন সেই রকম পরিসংখ্যানই দিল। কিন্তু তাদের দেওয়া এবং সরকার সমর্থিত সেই পরিসংখ্যান দেশের মানুষ এবং উৎসাহী বিদেশিদের কাছে গ্রহণযোগ্য হয়েছে বলে মনে হয় না।

তা বোঝা গেছে তাদের তাৎক্ষণিক প্রতিক্রিয়ায়। নির্বাচন কমিশন একটা চালাকি করেছে। রাজধানী ঢাকায় তারা ভোটের হার কম দেখিয়ে মফস্বল এলাকায় ভোটের হার এমন দেখিয়েছে যে, স্থানীয় জনগণ তাতে হতবাক হয়ে গেছে। কেউ কেউ মন্তব্য করেছেন, 'জিনের বাদশাহ' সিইসির পাঠানো জিনেরা বোধহয় এত ভোট কাস্ট করে গেছে। জিন তো অদৃশ্য; তাই জনগণ তা দেখতে পায়নি।

ভোটের এই হার নিয়েও সর্বত্র হাসি-ঠাট্টা চলছে। বিস্ময়কর ব্যাপার হচ্ছে, এমন একটা নির্বাচন নিয়েও বড়াই করছেন লীগ সরকারের মন্ত্রী-মিনিস্টাররা। অন্যদের কথা বাদ দিলাম; তোফায়েল আহমেদের মতো একজন প্রবীণ রাজনীতিবিদও বলেছেন, এ নির্বাচন নাকি সুষ্ঠু ও গ্রহণযোগ্য হয়েছে! অবশ্য তিনি ভোটার টার্ন আউট সম্পর্কে কিছু বলেননি। ড. হাছান মাহমুদ নামক একজন মন্ত্রীসহ সরকারের বেশ ক'জন দায়িত্বশীল ব্যক্তি বলেছেন, জনগণ নাকি তাদের আগামী পাঁচ বছরের জন্য ম্যান্ডেট (!) দিয়েছে। সবর্নাশ! এটা যদি লীগ সরকার এবং শাসক লীগের নীতিনির্ধারণী সিদ্ধান্ত হয়, তাহলে আগামী পাঁচ বছরই কি হত্যা, সন্ত্রাস, হানাহানি আর নৈরাজ্যের রাজনীতি অব্যাহত থাকবে? মন্ত্রী-মিনিস্টার এবং আতিনেতা-পাতিনেতাদের কথায় কান না দিলেও প্রধানমন্ত্রীর বক্তব্যকে তো উড়িয়ে দেওয়া যায় না।

৭ জানুয়ারি তার মুখ থেকে বেরিয়ে এসেছে একটি উদ্বেগজনক বক্তব্য। ৫ জানুয়ারির নির্বাচন ঠেকাতে পারেননি বলে তিনি বিরোধীদলীয় নেতা বেগম খালেদা জিয়াকে চুপ থাকতে বলেছেন। তার এ বক্তব্যের অন্তর্নিহিত সুর কিন্তু হাছান মাহমুদদের বক্তব্যেরই সমর্থনসূচক বলে মনে হয়। এটা অবশ্যই উদ্বেগের।

বর্তমান উদ্ভূত পরিস্থিতিতে আলোচনা ও সমঝোতা ছাড়া শান্তিপূর্ণ সমাধানের কোনো ভিন্ন পথ নেই।

বিবদমান রাজনৈতিক পক্ষসমূহকে, বিশেষ করে আওয়ামী লীগ ও বিএনপিকে এ সত্য উপলব্ধি করে অতি শীঘ্র সংলাপ শুরু করতে হবে। সরকারকে সংলাপ করতে হলে 'গৃহপালিত' বিরোধী দলের সঙ্গে নয়, বিএনপি ও সে দলের নেতা বেগম খালেদা জিয়ার সঙ্গেই করতে হবে। বেগম জিয়া যে কোনো সময় সংলাপে যেতে তার ইচ্ছার কথা ব্যক্ত করেছেন। এটা শুভ ও সঠিক রাজনৈতিক সিদ্ধান্ত। এ ব্যাপারে তার পুত্র ও দলের সিনিয়র ভাইস চেয়ারম্যান তারেক রহমান সরকারকে অবৈধ বলে এ সরকারের সঙ্গে আলোচনার কিছু নেই বলে যে বক্তব্য দিয়েছেন, তা সংশোধন করা দরকার।

নতুন সরকারের গ্রহণযোগ্যতা দেশ দুনিয়ায় প্রশ্নবিদ্ধ, এটা ঠিক, কিন্তু আইনসিদ্ধও বটে- যেমন ছিল ১৫ ফেব্রুয়ারি '৯৬-এর নির্বাচনে গঠিত ষষ্ঠ সংসদ ও সেই সরকার। শান্তির জন্য একটা ইনক্লুসিভ গ্রহণযোগ্য নির্বাচন অতি দ্রুত অনুষ্ঠানের জন্য সরকারের সঙ্গেই আলোচনা করতে হবে। এ ব্যাপারে সরকারকেই দ্রুত উদ্যোগ নিতে হবে।

১০ জানুয়ারি বঙ্গবন্ধুর স্বদেশ প্রত্যাবর্তন দিবসে সোহরাওয়ার্দী উদ্যানের জনসভায় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বিরোধী দলকে উদ্দেশ করে যেসব কথা বলেছেন, তাতে মনে হবে, দেশে এতদিন যে রাজনৈতিক সংকট বিরাজ করেছিল, ৫ জানুয়ারির নির্বাচনের পর তা কেটে গেছে। হিংসা-হানাহানি, হত্যা-সন্ত্রাসের রাজনীতি থেকে জাতি মুক্তি পাবে।

পর্যবেক্ষকরা কিন্তু তা মনে করছেন না। তারা এমনও বলছেন, প্রধানমন্ত্রী ধমকের সুরে যে বক্তব্য দিয়েছেন কঠোর ব্যবস্থা গ্রহণের, তা কার্যকর করার সক্ষমতা গত সরকার আমলে যেমন তার ও তার সরকারের ছিল না, এবার তা আরও সঙ্কুচিত হয়ে যাবে। তার গত সরকারের একটি নৈতিক ভিত্তি ছিল। মানুষ মনে করে কারচুপি না করলেও সেই নির্বাচনে আওয়ামী লীগই জিততো এবং শেখ হাসিনাই সরকার গঠন করত। তবে বিএনপি যে ২৯ সিট পাওয়ার দল নয়, তাও মানুষের বিবেচনায় ছিল; তারা ভেবেছিল বিএনপি ১০০ প্লাস-মাইনাস আসন পাবে।

এবার মানুষের মাইন্ডসেট সম্পূর্ণ বিপরীত দেখা গেছে। ফেয়ার একটা নির্বাচন হলে এবার বিএনপিই জিতে সরকার গঠন করত এবং জনগণ আওয়ামী লীগকে ধসিয়ে দিত। কাজেই হাস্যকর এ 'নির্বাচনের' (বিনা ভোটেই ১৫৩ আসন দখল করে সরকার গঠনের মতো সংখ্যাগরিষ্ঠতা অর্জন) মাধ্যমে গঠিত সরকার হবে জনসমর্থনের দিক থেকে খুবই দুর্বল এবং নৈতিকতার বিবেচনায় একটি হাঁটু কাঁপা সরকার। বেগম খালেদা জিয়া এখন সংসদে বিরোধী দলে নেই সত্য, তিনি বিএনপির চেয়ারপারসন তো আছেন। এখানে কোনো প্রকার ইঞ্জিনিয়ারিং করে তাকে সরানোর উপায় নেই।

সাংবিধানিক কোনো পদ-পদবি ছাড়া এরকম অবস্থানে থেকেই তিনি স্বৈরাচার এরশাদের ভিত্তি কাঁপিয়ে দিয়েছিলেন- শেখ হাসিনা '৮৬ সালের পাতানো নির্বাচনে এরশাদের সঙ্গে হাত মেলানোর পরও। বরং আজ থেকে নতুন করে যে লাগাতার অবরোধের ডাক দিয়েছে ১৮ দলীয় জোট, তাতে গণদুর্ভোগ অব্যাহত থাকবে বলে মনে হয়। প্রশ্নবিদ্ধ একটি নির্বাচন ও জনগণের বিশেষ করে সংখ্যালঘুদের জানমালের নিরাপত্তা বিধানে ব্যর্থতার কারণে এ সরকারের ওপর প্রবল আন্তর্জাতিক চাপেরও সম্ভাবনা দেখা দিয়েছে; এমনকি নিষেধাজ্ঞার কবলেও পড়ে যেতে পারে আমাদের প্রিয় স্বদেশ। যুক্তরাষ্ট্র, যুক্তরাজ্য, কানাডা, জাপান, চীন, রাশিয়া, ইউরোপীয় ইউনিয়ন, জাতিসংঘসহ প্রায় সারা বিশ্ব এর মধ্যেই যে প্রতিক্রিয়া ব্যক্ত করেছে তা রীতিমতো উদ্বেগের। প্রধানমন্ত্রী এবং তার বিনা ভোটে নির্বাচিত সরকার (সরকার গঠন করার সংখ্যাগরিষ্ঠ ১৫৩ আসনে কোনো নির্বাচনই হয়নি) যত দ্রুত জাতীয় বৈরী পরিস্থিতি এবং আন্তর্জাতিক সমীকরণ উপলব্ধি করবেন ততই দেশ, জাতি ও গণতন্ত্রের মঙ্গল হবে।

তা না হলে আবারও ওয়ান-ইলেভেনের মতো পরিস্থিতি সৃষ্টি হতে পারে। ভারত বাংলাদেশে সেনা সমর্থিত সরকারের সঙ্গেও কাজ করতে প্রস্তুত বলে যে বার্তা পাওয়া গেছে তা গুরুত্বহীন ভাবার কোনো কারণ নেই।

লেখক : সাংবাদিক, কলামিস্ট।

ই-মেইল :kazi.shiraz@yahoo.com 

 

 

অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।

প্রাসঙ্গিক আরো কথা
Related contents feature is in beta version.