আমাদের কথা খুঁজে নিন

   

ত্রিভকালের প্রান্তরে; চ্যাপ্টার ২: রং

The only person u should try to be better than, is the person u were yesterday.

বিছানায় চুপ চাপ দুজন জড়াজড়ি করে শুয়ে আছি, কোনো কথা বলছি না। আমার দম বন্ধ হয়ে আসছে কিছুটা। তাই মুখ দিয়ে নিঃশ্বাস নেওয়ার চেষ্টা করছি। চাইলে গুঁজে রাখা মুখ বের করে সহজেই নিঃশ্বাস নিতে পারি, কিন্তু নিঃশ্বাস নিতে ইচ্ছে করছে না। এভাবেই বুকের মধ্যে ঘাপটি মেরে শুয়ে থাকতে ইচ্ছে করছে।

২৪ ঘন্টাই তো নিঃশ্বাস নেই, দুই ঘন্টার জন্য না হয় একটু না ই নিলাম। তন্দ্রা হঠাত করে বলে উঠলো
- কিরে এভাবে ষাঁড়ের মতো নিঃশ্বাস নিচ্ছিস কেনো ?
- ষাঁড়ের মতো নিঃশ্বাস নিতে আমার ভালো লাগে, তাই এরকম ফোঁস ফোঁস করে নিঃশ্বাস নিতাছি। তোর কোনো সমস্যা আছে ? আমার দেহ আমার নাক আমার নিঃশ্বাস, আমি যেভাবে খুশী নিবো। তুই বলার কে ?
তন্দ্রার বাম হাত আমার পিঠের উপর ছিলো। স্বশব্দে একটা থাপ্পড় খাওয়ার পর প্রথমে আওয়াজ পেলাম তারপর একটা চিনচিনে ব্যাথা।

আমি জানতাম আলোর গতি শব্দের চাইতে হাজার হাজার গুণ বেশী। আলোর গতি যেখানে প্রতি সেকেন্ডে ২৯৯,৭৯১,৮১৯ মিটার যেতে পারে সেখানে শব্দ মাত্র ৩২১ মিটার যেতে পারে। আর আজ বুঝতে পারলাম থাপ্পড়ের ব্যাথার চাইতে শব্দের গতি কিছুটা বেশী। হুড়মুড় করে বিছানায় বসে তন্দ্রার দিকে তাকিয়ে বললাম
- অই তুই আমারে মারলি কিসের জন্য ?
- তুই বেয়াদবি করছিস কিসের জন্য !! কুত্তা !!
‘কুত্তা’ শব্দটা শোনার আগেই দেখলাম তন্দ্রা মুখে একদলা থুতু এনে আমার দিকে ছুড়ে মারলো। প্রস্তুত ছিলাম না দেখে পুরোটাই আমার মুখে এসে পড়লো।

হাত দিয়ে মুছে নাকের কাছে শুঁকে দেখলাম গন্ধ আছে নাকি। এটা যদি গল্প, উপন্যাস বা সিনেমা হতো তাহলে হয়তো এই থুথুতে কোনো গন্ধ থাকতো না। কিন্তু আফসোসের বিষয় হচ্ছে এটা গল্প ও উসন্যাসের কোনো দৃশ্য না। আর তাই নাকের কাছে আনার পর থুথুর কড়া কটু গন্ধ নাকে এসে লাগলো। আমি তার দিকে তাকাতেই সে বলল
- আর করবি আমার সাথে খারাপ ব্যাবহার ?
আমি কিছু না বলে তাকিয়ে রইলাম তার দিকে।

সে জানে এই তাকিয়ে থাকার মানে কি। তাই হয়তো ভয়ে ভয়ে আবার বলল
- ওই তুই এভাবে তাকায়া কি দেখতাছস ? দিমু আবার থুতু ? দিলাম কিন্তু এখন... আবার তাকায়া আছে... তুই কি থুতু খাওয়ার জন্য আমার দিকে এভাবে তাকায়া আছস ? মনে করছস আমি খুব ভয় পাবো... হ্যাহ, তোরে দেইক্ষা আমি ভয় পাবো !! ...বাবু চোখ সরা, ...আমি কিন্তু এখন কেঁদে দিবো।
মেয়েটার একটা অদ্ভুত বদ অভ্যাস ছিলো। আমি জানতাম সে ‘কেঁদে দিবো’ বলছে, তো কেঁদে দিবেই। আর কেঁদে দিলে তখন আরো কিছু মাইর আর থুথু গায়ে পরার এক অপার সম্ভাবনা রয়েছে।

তাই আর কথা না বাড়িয়ে জড়িয়ে ধরলাম তাকে। জড়িয়ে ধরলাম তাকে বুঝ দেওয়ার জন্য নয় বরং থুথুর হাত থেকে নিজেকে রক্ষা করার জন্য। জড়িয়ে ধরা অবস্থায় সে চাইলেও আমার গায়ে থুথু মারতে পারবে না। পিঠের মধ্যে হয়তোবা কিছু চড় থাপ্পড় খেতে হতে পারে। কিন্তু তা থুতুর চাইতে অনেক অনেক ভালো...
ফুপিয়ে ফুপিয়ে বলে উঠলো
- তুই চলে যাবি কখন ?
- এইতো আর ১৫ মিনিট পর।

না হয় ৬ টার মধ্যে চাঁদপুর পৌছাতে পারবো না। আর ৬ টার মধ্যে পৌছাতে না পারলে বাসায় জেনে যাবে যে আমি ঢাকা থেকে লঞ্চে করে আসিনি, এসেছি কুমিল্লা হয়ে বাসে করে। আর সেটা জানতে দেওয়া কি ঠিক হবে ?
চাঁদপুরে লঞ্চ দিয়ে আসছি বললেও ‘মা’ আমাকে দেখেই বুঝতে পারতো যে কথাটা মোটেও সত্য নয়। আর তাছাড়া বর্ষাকালে বৃষ্টিতে ভিজতে ভিজতে সাদা শার্টে তন্দ্রার জামার লাল রঙ লেপ্টে থাকার কারণে মায়ের বুঝতে অসুবিধা হয় না যে আমি যাত্রাকালে কারো না কারো সাথে ডলাডলি করে আসছি। তাই মা ও চুপ করে জামার দিকে তাকিয়ে থাকতো, আর আমিও মায়ের দৃষ্টি লক্ষ্য করে নিজের শার্টের দিকে তাকিয়ে ভ্যবলা মার্কা রাগ নিয়ে বলতাম
‘চাঁদপুরের লঞ্চগুলো এতো বাজে হয়েছে যে শার্টও ঠিকভাবে পড়ে শান্তি নেই...’
এইধরণের খোড়া যুক্তি দেখিয়ে মায়ের দিকে আর তাকাতাম না।

কারণ তাকালেই আমি মায়ের চোখের ভাষা বুঝে ফেলবো, আর বুঝে ফেললেই সমস্যা। যদিও আমার মায়ের শাসনামল কাল ততদিনে শেষ হয়ে গিয়েছে, তারপরও তো সে আমাদের বাসার বিগেডিয়ার জেনারেল। আর জেনারেল এর চোখাচোখি করতে কার ভালো লাগবে বলেন ?
ততোদিনে আমাদের সম্পর্কের অফিশিয়ালি ৩ বছর চলে, আর আনঅফিসিয়ালি মাত্র ১ বছর। আসলে তন্দ্রা যখন তন্দ্রাপু ছিল। তখনই দুই পরিবারের সম্মিলিত প্রচেষ্ঠায় আমাদের সম্পর্ক ছিন্ন করতে হয়।

প্রথমদিকে চলে যাই, তাহলে হয়তো কিছুটা বুঝতে পারবেন আপনারা।
আসলে প্রথম যেবার তিনি এসেছিলেন চাঁদপুরে তখন আমার মনে হয়নি প্রেম করবো, ছাঁদে বসে বসে দুজনে গল্প করবো বা আমি উনার প্রেমে পড়বো। ‘উনি’ করে বলছি কারণ তখন আমি তাকে ‘আপনি আপনি’ করেই সম্ভোধন করতাম। যেহেতু সেই সময়কার কথা বলছি, তাই ‘উনি’ ‘উনি’ করে বলাই শ্রেয়। তাহলে আপনারা হয়তো কিছুটা ধরতে পারবেন আমার সেই সময়ের অনূভুতিগুলো।

আর জন্মদিনের গিফটও প্রথম যেবার এসেছিল সেবার দেইনি আমি। কারণ তখনো সে আমার কাছে একটা ‘মাল’ ছিল। কিন্তু সে যে ‘মাল’ না তা প্রথম বুঝতে পেরেছিলাম সেদিন, যেদিন সে ৩ মাসের ছুটি শেষে চলে গিয়েছিল চাদপুর ছেড়ে।
দিনটি ছিলো শুক্রবার, আর তখন আমি জুম্মার নামাজ মিস দিতাম না। নামাজের জন্য অজু করার আগ দিয়ে দেখলাম ব্যাগ গোছগাছ করে তন্দ্রাপু সিড়ি দিয়ে নামছে।

সবার কাছ থেকে বিদায় নিয়ে যাচ্ছে। আমি তখনো বুঝতে পারেনি যে সিড়িতে দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে কথা বলা মানুষটা আমার ভিতরেও অবস্থান গেড়ে নিয়েছে শক্তভাবে। বুঝলাম তখন যখন আমি অজু করছিলাম বাথরুমে... মানুষের শরীরে যে ঠিক কি পরিমান চোখের জল থাকে সেদিন আমি হাড়ে হাড়ে বুঝতে পেরেছিলাম। নামাজ পড়া বাদ দিয়ে রাস্তায় রাস্তায় ঘুড়ে বেড়াতে লাগলাম...
দিন দিন আমার অবস্থা খারাপ হতে শুরু করে দিলো। তাই একদিন ভাবলাম যে করেই হোক উনার ফোন নাম্বারটা কালেক্ট করতেই হবে।

কায়দা করে তিন তলায় থাকা তন্দ্রাপু’র আত্মীয়ের মোবাইল ঘেটে উনার বাবার মোবাইল নাম্বার বের করলাম। কলেজের এক পরিচিত মেয়েকে দিয়ে তার বাবাকে ফোন করালাম। সে বলল সে তন্দ্রার ফ্রেন্ড, নাম্বারটা হারিয়ে ফেলেছে দেখে ফোন করতে পারছে না তন্দ্রাকে। তন্দ্রাপু’র বাবাও তাকে ভালো মানুষের মতো ফোন নাম্বারটি দিয়ে দিলো।
এরপর সাহস করে মেসেজ পাঠানো শুরু করলাম।

কল করলে কল ব্যাক করে চুপ করে থাকতাম। এভাবে যেতে যেতে একদিন সে আমাকে ফোনে বলল,
“আমি জানি তুমি কে, আমি আজ চাঁদপুরে আসছি... এসেছি তোমার এসব ফাইজলামি বের করতেছি... তুমি পাইছোটা কি ? যখন তখন ম্যাসেজ পাঠাও, ফোন করে কথা বলো না। দাঁড়াও আমি আসতেছি...”
মানুষ নাকি যখন খুব নার্ভাস হয়ে যায় অথবা খুব ভয় পায় অথবা খুব উদ্বিগ্ন হয়ে পরে কোনো বিষয়ে, অথবা যখন সে ভাবতে থাকে ‘এখন আমি কি করবো’ বা ‘এখন আমার কি হবে’ অথবা ‘এখন আমাকে কে বাঁচাবে?’ তখন তার ভয়ের চোটে ডায়রিয়া তে আক্রান্ত হওয়ার সম্ভাবনা শতকার ৬৫ ভাগ। আমার এখনো মনে আছে, আমি শুভ্রকে ফোন করে ঘটনা বলার সময় পেটের মধ্যে একটা ডাক শুনতে পাই। ডাক শুনে মনে হলো সে আমাকে কিছু বলতে চাচ্ছে ইঙ্গিতে... হয়তো বলতে চাচ্ছে ‘আইজ তোর খবর আছে’।


দিনটি ছিলো ২১শে জুলাই, ২০০৫। স্পষ্টভাবে মনে থাকার কারণ হচ্ছে সেদিন আমার বোনের জন্মদিন ছিলো। তন্দ্রাপু অবশ্য জন্মদিন উপলক্ষ্যে আসেনি, এসেছিল অন্য কোনো কারণে, হয়তোবা বেড়াতে। আর এদিকে আমি অপেক্ষা করছিলাম আমার অন্তিম বিচারের জন্য। বার বার মনে হচ্ছিল এই বুঝি আমার মা কমান্ডো স্টাইলে ডাক দিবে।

আমিও দৌড় দিয়ে তার কাছ এসে না থেমে দরজা খুলে দৌড়ের স্পিড বাড়িয়ে দিয়ে চাঁদপুরের ডাকাতিয়া নদীতে ঝাপ দিবো।
- সাগর !!
- জ্বি আম্মু আসি...
- সাগ...র
- আসতেছি আম্মু
- কইরে সা......গ......র !!
- আসতেছিইইইইইইই
আমার মা আবার অধর্য্য টাইপের একজন মানুষ। তার কাছে সুপার সনিক গতিতে না পৌছানো পর্যন্ত তিনি ডাকতেই থাকবেন। এখন ব্যাথরুমে আছি, না খাইতেছি, না হাতের ব্যায়াম করতেছি এগুলো দেখার বিষয় না। যে অবস্থাতেই থাকি না কেনো, আমাকে ছুটে যেতে হবে তার কাছে।


- জ্বী আম্মু ?
- তোর সুমিদি আসছে
(সুমি নামটা আমার পছন্দ না, কারণ বাংলাদেশের শতকরা ৭০ ভাগ মেয়ের নাম ‘সুমি’। আপনি বাংলাদেশের প্রতিটি জেলার প্রতিটি গলিতে কমপক্ষে ২ জন হলেও সুমি নামের মেয়ে পাবেন। আপনি কলেজে উঠেছেন, এক মেয়েকে পছন্দ হয়েছে- সেই মেয়ের একজন বান্ধবী অবশ্যই পাবেন যার নাম হবে ‘সুমি’। আমার ধারণা ‘সুমি’ নামের সন্তানের বাবা মা নিজেদের দৌনন্দিন কাজে এতো ব্যস্ত থাকে যে সন্তানের নাম কি দিবে তাতে সময় নষ্ট না করে ‘আইচ্ছা যা নাম দিয়া দিলাম সুমি’ নীতিতে রেখে দেয়। তাই তন্দ্রা কখনোই আমার কাছে সুমি ছিলো না।

সে আগা গোড়ায় ‘তন্দ্রা’ আমার কাছে। )
- ও আপু এসেছেন তাহলে!! এতোদিন পর মনে হলো আমাদের কথা (আসলে এগুলো হইতেছে গিয়া আপনার খাজুরে কথা বার্তা। *’খাজুরে আলাপ’ কথাটা আসছে আরবের খেজুর থেকে, সেই সময়ের মানুষ খেজুর খাইতে খাইতে উটের হিসাব নিকাশ বার বার করতো। সেখান থেকে এসেছে খাজুরে আলাপ। )
- হম... কেমন আছো তুমি ?
- হ্যাঁ আপু ভালো আছি।

আপনি কেমন আছেন ?
- খারপ থাকার কি কোনো কারণ আছে ? (লক্ষণ ভালো ঠেকতেছে না, এখনই হয়তো কথাটা তুলবে। এর আগেই আমার চম্পট মারা উচিত)
- আম্মু তৃষাপু কই! দেখতেছি না যে ?
এরপর তৃষা তৃষা (বোন আমার পিঠাপিঠি ছিলো, তাই নাম ধরেই ডাকতাম) করতে করতে স্থান ত্যাগ করি আমি।

তন্দ্রাপু কিন্তু কিছুই বলে নাই কাউকে। এতে আমি হয়তো আশকারা পেয়ে মাথায় উঠে গিয়েছিলাম। আর তাই আমার থেকে একডজন বই নেওয়ার সময় আমি বইয়ের ফাকে কায়দা করে আমার জীবনের প্রথম চিঠিটি তাকে পাঠাই।

প্রথম চিঠি প্রথম লেখা অনুভূতি, প্রথম ভালো লাগা, প্রথম বাংলা সিনেমার নায়ক হওয়ার চেষ্টা, রিকশাওয়ালার প্রেম... যা ই বলেন না কেনো। সেই চিঠি লেখার অনুভূতি কখনোই আপনারা বুঝতে পারবেন না... কোনোদিনও না...

অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।