আমাদের কথা খুঁজে নিন

   

দীপ নেভে নাই মহানায়িকার

বাংলা চলচ্চিত্রের ‘স্বপ্নে দেখা রাজকন্যা’ ছিলেন সুচিত্রা সেন। পঞ্চাশ ও ষাটের দশকে বাংলা চলচ্চিত্রের স্বর্ণযুগে যে মহানায়িকার আবির্ভাব তিনি সুচিত্রা সেন। অভিনয়, ব্যক্তিত্ব ও সৌন্দর্যে তিনি হয়ে উঠেছিলেন কিংবদন্তি।

সুচিত্রা সেনের চেয়ে সুন্দরী বা তার চেয়ে প্রতিভাবান অভিনেত্রী বাংলা চলচ্চিত্রে যে আসেননি তা নয়। কিন্তু তাকে ঘিরে যে রোমান্স ও রহস্যের বাতাবরণ ছিল, তা একান্ত ও একমাত্র তারই।

সুচিত্রা সেন যখন পর্দায় তার ভুবনমোহিনি হাসি দিয়ে দর্শককে মোহিত করতেন তখন দর্শকের মনে হত এই নারী যেন ধুলো-কাদার বিশ্বের নয়। এ যেন ধরাছোঁয়ার বাইরের জগৎ থেকে আসা এক অধরা স্বপ্ন। তিনি যে চরিত্রগুলোতে অভিনয়ের জন্য খ্যাতি পেয়েছেন সেগুলোও যেন গড়পরতা চরিত্র থেকে একটু আলাদা। হয়তো কিছুটা অবাস্তবও। যেমন ‘সাগরিকা’ সিনেমার তরুণী সাগরিকা।

পঞ্চাশের দশকে এক ধনী নারী, তদুপরি মেডিকেল কলেজের ছাত্রী, বিশাল এক বাড়িতে একাই থাকেন। তিনি প্রখর ব্যক্তিত্বময়ী। সেইসঙ্গে আবার প্রেমের জন্য সর্বস্ব ত্যাগ করতে প্রস্তুত।

‘হারানো সুর’ সিনেমার ড. রমা। যিনি অ্যামনেশিয়ার রোগী উত্তম কুমারকে কলকাতা থেকে নিয়ে যান প্রত্যন্ত পাহাড়ি এলাকা পলাশপুরে।

সেখানে চিকিৎসার জন্য তাকে বিয়ে করেন। আবার তার পূর্ব স্মৃতি ফিরিয়ে আনার জন্য কলকাতায় উত্তমের বাড়িতে সামান্য গভর্নেস সেজে থাকেন।

সপ্তপদীর অ্যাংলো ইন্ডিয়ান মেয়ে রিনা ব্রাউন যে দ্বিতীয় মহাযুদ্ধে আসামে মেডিকেল কোরের নার্স। কিংবা বিপাশা চলচ্চিত্রের পাঞ্জাবি ও বাঙালি বাবামায়ের সন্তান বিপাশা যে একা থাকে এবং প্রেমিককে খুঁজে বের করতে ভারতবর্ষের বিভিন্ন এলাকা একাই চষে বেড়ায়। অথবা ব্রাহ্মণকন্যা ইদ্রাণী যে সমাজের কোনো অনুশাসনই প্রায় মানে না।

এই চরিত্রগুলো পঞ্চাশ ও ষাট দশকের বাঙালি সমাজের সামাজিক বাস্তবতায় যতই অবাস্তব বা অসম্ভব মনে হোক না কেন সুচিত্রা সেন যখন সেই চরিত্রে পর্দায় আবির্ভূত হয়েছেন তখন দর্শকের তাকে মেনে নিতে কোনো দ্বিধা জাগেনি। কারণ সুচিত্রা সেন মানেই তো গতানুগতিক জীবনের বাইরে কোনো রহস্যময়ী অধরা নারী। তিনি তো আমাদের ঘরের পাশের মিষ্টি মেয়েটি নন, তিনি মায়াবন বিহারিণী ও স্বপনচারিণী।

সুচিত্রা সেনের পারিবারিক নাম ছিল রমা দাশগুপ্ত। ১৯৩১ সালের ৬ এপ্রিল বাংলাদেশের পাবনা জেলায় জন্মগ্রহণ করেন তিনি।

তার বাবা করুণাময় দাশগুপ্ত ছিলেন স্থানীয় স্কুলের প্রধানশিক্ষক। মায়ের নাম ইন্দিরা দেবী। পাবনাতেই তার শিক্ষাজীবন শুরু হয়।

১৯৪৭ সালে ঢাকার  অভিজাত পরিবারের সদস্য শিল্পপতি আদিনাথ সেনের পুত্র  দিবানাথ সেনের সঙ্গে তার বিয়ে হয়। ১৯৫২ সালে তিনি কলকাতার চলচ্চিত্র অঙ্গনে প্রবেশ করেন।

‘শেষ কোথায়’ চলচ্চিত্রের মাধ্যমে রূপালি পর্দায় তার যাত্রা শুরু হলেও ছবিটি মুক্তি পায়নি।

১৯৫৩ সালে উত্তম কুমারের বিপরীতে অভিনীত ‘সাড়ে চুয়াত্তর’ তার প্রথম মুক্তিপ্রাপ্ত ছবি। ছবিটি ব্যবসা সফল হয়। তবে সেটি ছিল কমেডিনির্ভর ছবি এবং এর মূল আকর্ষণ ছিলেন ভানু বন্দোপাধ্যায়। ১৯৫৪ সালে মুক্তিপ্রাপ্ত ‘অগ্নিপরীক্ষা’ ছবিকে তার ক্যারিয়ারের টার্নিং পয়েন্ট বলা হয়।

  এ ছবিতেই উত্তম কুমার ও সুচিত্রা সেন বাংলা সিনেমার  ক্ল্যাসিক রোমান্টিক জুটিতে পরিণত হন।

বাংলা সিনেমার দর্শক যেন তখনই প্রথম অনুভব করতে পারল রোমান্টিক সিনেমা কাকে বলে। একের পর এক হিট সিনেমা। উত্তম-সুচিত্রার পর্দা রোমান্স দেখার জন্য সিনেমা হলে দর্শকের ঢল। কতরূপেই না দর্শক হৃদয় জয় করেছেন তারা।

সাগরিকার ‘সাগরিকা’, গৃহদাহতে ‘অচলা’, রাজলক্ষ্মীতে ‘রাজলক্ষ্মী’, পথের দাবীতে ‘রমা’। হারানো সুর, শাপমোচন, চন্দ্রনাথ, ত্রিযামা, সবার উপরে, ইন্দ্রাণী, শিল্পী, পথে হলো দেরী, রাজলক্ষ্মী ও শ্রীকান্ত, কমললতা, গৃহদাহ, পথের দাবী, সবার উপরে, সপ্তপদী-- উত্তম-সুচিত্রা মানেই হিট ছবি।

তবে সুচিত্রা সেন নিজেকে প্রমাণ করতে চেয়েছিলেন উত্তম ছাড়া। তিনি দেখতে চেয়েছিলেন উত্তম কুমার ছাড়া তিনি সাফল্য পান কি না। পঞ্চাশের দশকে যে সিনেমাগুলোতে অভিনয় করেছিলেন তিনি তার অধিকাংশেরই নায়ক উত্তম কুমার।

উত্তম ছাড়া তার অভিনীত অন্য সিনেমা তেমন সাফল্য পায়নি। অবশ্য হিন্দি ভাষায় নির্মিত ‘দেবদাস’-এ তিনি দীলিপ কুমারের বিপরীতে পার্বতী চরিত্রে অভিনয় করে সাফল্য পেয়েছিলেন। হিন্দিভাষী দর্শক বাঙালি পারুকে সাদরে গ্রহণ করেছিল। কিন্তু সে সিনেমায় চন্দ্রমুখীরূপী বৈজয়ন্তী মালাও তো ছিলেন।

বাংলায় উত্তম ছাড়া কি তার সাফল্য নেই তাহলে? কিন্তু তিনি বিশ্বাস করতেন দর্শক তাকে উত্তম ছাড়াও গ্রহণ করবে।

এ কথা প্রমাণ করতেই যেন  ১৯৫৯ সালে তিনি অভিনয় করলেন ‘দীপ জ্বেলে যাই’ সিনেমায়। এখানে তিনি হাসপাতালের নার্স রাধা। মেন্টাল ওয়ার্ডের নার্স তিনি। পুরো কাহিনিই মূলত নায়িকাকেন্দ্রিক। নায়ক বসন্ত চৌধুরীকে সুস্থ করে তোলার জন্য রাধার অভিনয়, তার ভালোবাসা এবং শেষপর্যায়ে নিজেই মানসিকভাবে বিপর্যস্ত হয়ে পড়া।

এসব কিছু বাস্তব করে তোলার জন্য বাংলায় তখন সুচিত্রা ছাড়া দ্বিতীয় কোনো অভিনেত্রী ছিলেন না।

এরপর ১৯৬৩  সালে ‘সাত পাকে বাঁধা’। এর মধ্যে অবশ্য তিনি উত্তম কুমারের বিপরীতে অভিনয় করেছেন চাওয়া পাওয়া, বিপাশা, সপ্তপদীতে। তিনটিই হিট সিনেমা।

তবে সাতপাকে বাঁধার অর্চনা চরিত্রে তিনি অনন্য সাধারণ অভিনয় করেন।

অর্চনা ধনী পরিবার থেকে আসা এমন এক মেয়ে যে দরিদ্র প্রেমিক-স্বামীকে যেমন ভালোবাসে তেমনি উপেক্ষা করতে পারে না নিজের বাবা-মাকেও। প্রেম ও পরিবারের দ্বন্দ্বে বিপর্যস্ত অর্চনাকে পর্দায় সার্থক করে তুলেছিলেন সুচিত্রা।   সাতপাকে বাঁধা চলচ্চিত্রের জন্য ১৯৬৩ সালে মস্কো চলচ্চিত্র উৎসবে সেরা অভিনেত্রীর সম্মাননা অর্জন করেন তিনি। সে বছরটিই যেন ছিল তার সাফল্যের বছর।

১৯৬৩ সালেই মুক্তি পায় তার অভিনীত ‘উত্তর ফাল্গুনী’।

এ সিনেমায় যেন নিজেকেই ছাড়িয়ে যান তিনি। এখানে তিনি ছিলেন দ্বৈত চরিত্রে। তার অভিনয় ছিল অনন্য। দেবযানী, পান্না বাই ও সুপর্ণা। তিনটি চরিত্র, তিন নারীর জীবন।

সুচিত্রা প্রমাণ করলেন তিনি শুধু সুন্দরী ও সুঅভিনেত্রীই নন, তিনি মহানায়িকা। তিনি ১৯৬৬ সালে হিন্দি চলচ্চিত্র মমতার জন্য সেরা অভিনেত্রীর ফিল্ম ফেয়ার পুরস্কার পান। মমতা গল্পটি বাংলা উত্তর ফাল্গুনীরই হিন্দি রিমেক।

১৯৭২ সালে সুচিত্রা সেন পদ্মশ্রী খেতাবে ভূষিত হন। ১৯৭৪ সালে তার অভিনীত হিন্দি ছবি ‘আঁধি’ ব্যাপকভাবে প্রশংসিত হয়।

এই সিনেমায় অভিনয়ের জন্য তিনি ফিল্মফেয়ার পুরস্কারে সেরা অভিনেত্রীর মনোনয়ন পান। আর তার বিপরীতে অভিনয়ের জন্য সঞ্জীব কুমার সেরা অভিনেতার পুরস্কার জয় করেন।

‘আঁধি’তে তিনি ছিলেন ‘আরতি দেবী’ নামে এক রাজনৈতিক নেত্রীর ভূমিকায় যিনি একই সঙ্গে ব্যক্তিত্বময়ী, দৃঢ়, কঠোর আবার প্রেমময়ী ও কোমল। বলা হয়ে থাকে ইন্দিরা গান্ধীর ছায়া অবলম্বনে আরতি দেবীকে নির্মাণ করা হয়েছিল। সুচিত্রা ছাড়া আরতি দেবীর চরিত্রটি ভারতের অন্য কোনো অভিনেত্রী এত সফলভাবে রূপায়িত করতে পারতেন কিনা সন্দেহ।

সৌমিত্র চট্টোপাধ্যায়ের বিপরীতে দত্তা, অশোক কুমারের বিপরীতে হসপিটাল তার বিখ্যাত সিনেমা। সত্যজিৎ রায় তাকে দেবী চৌধুরাণীতে কাস্ট করতে চেয়েছিলেন। কিন্তু সুচিত্রার সঙ্গে শিডিউল মেলেনি। দেবী চৌধুরাণী তাই নির্মাণ করেননি সত্যজিৎ রায়। পরবর্তীতে অবশ্য অন্য পরিচালক দেবী চৌধুরাণী নির্মাণ করেন এবং তাতে সুচিত্রাই প্রধান চরিত্রে অভিনয় করেন।

তিনি অনেক নায়কের বিপরীতেই অভিনয় করেছেন, খ্যাতি পেয়েছেন। কিন্তু উত্তম কুমারের বিপরীতেই তিনি ছিলেন সবচেয়ে সার্থক। আজও তাই বাংলা চলচ্চিত্রের সেরা রোমান্টিক জুটি বলতে উত্তম-সুচিত্রাকেই বোঝায়।

সুচিত্রা সেনের ব্যক্তি জীবন নিয়ে দর্শকের কৌতূহল ছিল অপার। কিন্তু খ্যাতির শীর্ষে অবস্থান করার সময়ও সুচিত্রা সেন ব্যক্তি জীবনকে সযতেœ লুকিয়ে রাখতেন লোকচক্ষু থেকে।

মিডিয়ায় তিনি কখনও সরব ছিলেন না। তাকে ঘিরে কোনো স্ক্যান্ডাল যেন না থাকে সে বিষয়েও তিনি ছিলেন সচেষ্ট। শুটিং শেষ করেই তিনি যেন চলে যেতেন নিজের রহস্যময় জগতে।

১৯৭৮ সালে চলচ্চিত্র জগতকে বিদায় জানান তিনি। আত্মনিয়োগ করেন রামকৃষ্ণ মিশনের সেবায়।

ব্যক্তিজীবনে তিনি ছিলেন অনেকটাই খেয়ালি। দিবানাথ সেনের সঙ্গে তার বিবাহিত জীবনও খুব সুখের হয়নি। তারা বিচ্ছিন্নভাবে বসবাস করতেন। দিবানাথ সেনের মৃত্যুর পরও তাদের দাম্পত্যজীবন সম্পর্কে কোনো কথাই মিডিয়ায় প্রকাশ করেননি সুচিত্রা। তার একমাত্র সন্তান মুনমুন সেন ও দুই নাতনি রিয়া ও রাইমাও চলচ্চিত্রজগতেরই বাসিন্দা।

তবে তারা সুচিত্রার মতো খ্যাতি পাননি।

সুচিত্রা সেনকে শেষ জনসম্মুখে দেখা গিয়েছিল উত্তম কুমারের মৃত্যুর পর তার শবযাত্রায়। এর পর আর কখনও তাকে দেখা যায়নি। তিনি কখনও কোনো জনসমাগমে অংশ নেননি। জনসম্মুখে আসতে হবে বলে ২০০৫ সালে ভারতের রাষ্ট্রীয় সম্মাননা দাদা সাহেব ফালকে পুরস্কার প্রত্যাখ্যান করেন তিনি।

২০১২ সালে ভারতের পশ্চিম বঙ্গ সরকার রাজ্যের সর্বোচ্চ সম্মাননা বঙ্গ বিভূষণে ভূষিত করে সুচিত্রা সেনকে।

তিনি নায়িকা ছিলেন এবং নায়িকা চরিত্রেই অভিনয় করেছেন। পার্শ্বচরিত্রে তাকে কখনও দেখা যায়নি। তার তরুণীমূর্তিই দর্শকস্মৃতিতে অম্লান। সুচিত্রা সেন ছিলেন মোহময়ী, চিরকালের প্রেমিকা এবং রহস্যময়ী।

মহানায়িকা হয়েই তাই তিনি বেঁচে থাকবেন বাংলা চলচ্চিত্রের দর্শক হৃদয়ে। তার জ্বেলে যাওয়া দীপ চিরদিন দর্শকের মনে জাগরুক থাকবে।


সোর্স: http://bangla.bdnews24.com

অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।