আমাদের কথা খুঁজে নিন

   

আমাড় ফাঁসী চাই!!!



একদল শরণার্থীর স্রোত ঢাকায় প্রবেশ করলো চুয়াত্তরের সেপ্টেম্বর নাগাদ। সম্ভবত এদের সামনে ঢাকায় আসা ছাড়া আর কোন পথ খোলা ছিল না। গ্রামে ওরা বিভিন্ন লতা-পাতা খেতে পারতো, পাখি শিকার করে কিংবা কচ্ছপের ডিম চুরি করে খেতে পারতো, আবার চাইলে কলা গাছ কেঁটে এর মধ্যে সাদা অংশটুকু খেতে পারতো। ঢাকায় এই সুবিধা ছিল না। এরপরও যখন তারা আসলো বুঝতে হবে নিশ্চয়ই কোন সমস্যা ছিল।



কিন্তু তারা কেন ঢাকায় চলে আসতে বাধ্য হলো, আমি নিজেকে জিজ্ঞেস করলাম, এইগুলো কি ময়না মিয়ার ভাষ্যমতে পাকিস্তানের দোসরদের ষড়যন্ত্রেরই একটা অংশ? আমার মাথায় বেশ কিছু উত্তর আসলো। প্রথমত, এরা সম্ভবত ভূমিহীন। এরা সম্ভবত ভাসমান নাগরিকদের একটা অংশ, তাই ঢাকায় চলে আসার সিদ্ধান্ত নিতে এদের তেমন একটা বেগ পেতে হয়নি। দ্বিতীয়ত, আমার মনে হলো এরা আসলে ঠিক কোন উদ্দেশ্য নিয়ে ঢাকায় আসে নি। বছরের পর বছর এইভাবেই তারা শহর থেকে শহরে, গ্রাম থেকে গ্রামে ঘুরে বেড়িয়েছে।

স্বাধীনতার আগেও এদের একই অবস্থা ছিল, এখনও তাই আছে। ঘুরতে ঘুরতেই এখন ঢাকায় চলে এসেছে। তৃতীয়ত, তারা মৃত্যুর ভয়ে চলে এসেছে। প্রতিদিন মানুষ মরছে। তারা মৃত্যুর হাত থেকে বাঁচতে ঢাকায় আশ্রয় নিয়েছে।

ওদের ধারণা ঢাকায় মানুষের ভিড়ে ওদেরকে মৃত্যু খুঁজে পাবে না। চতুর্থত, তারা অকারণে মরতে চায় না। এখন তারা স্বাধীন দেশের নাগরিক। স্বাধীনভাবে আরও কিছুদন বাঁচতে চায়।
আমি আমার প্রতিটা উত্তর ভালোভাবে বিবেচনা করে দেখলাম, ততক্ষণ পর্যন্ত যতক্ষণ না পর্যন্ত আমি প্রকৃত উত্তরটা পাই।

এটা যদি অন্য কোন সময় হত আর এইভাবে শরণার্থীর স্রোত ঢাকায় চলে আসতো আমি হয়তো ঠিক এইভাবে চিন্তা করতাম না। আমার দৃঢ় বিশ্বাস এরা একদিন বাধ্য হয়েই রাস্তায় নেমে আসবে।

তারা চাচ্ছিলো শেখ মুজিবের কাছে আসতে, যতটা সম্ভব। এইটাই সম্ভবত মূল কারণ, আমি ভাবলাম। হ্যাঁ, এইজন্যেই তারা এসেছে।

তারা তো তাঁরই সন্তান, তারা তাদের দুঃখ-কষ্টের কথা জানাতে এসেছে। শেখ মুজিবের দৃষ্টি আকর্ষনের জন্যে এর চেয়ে ভালো কোন উপায় কি আছে? একদম তার বাসার কাছেই অবস্থান নেয়া, প্রতিদিন তার বাসার আশেপাশের জমিতে মৃতদের লাশ দাফন করা, বাড়ির সামনেই তাঁর বিরুদ্ধে স্লোগান দেয়া, আর তাঁকে জানানো যে তার মিথ্যা আশ্বাসে মৃত্যুর মিছিল থামছে না। তারা কিভাবে তাঁর উপর আর নির্ভর করতে পারে? সে তো তাদের বারবার প্রতিশ্রুতি দিয়েও তাদের দেখতে যাননি। তাই তারাই চলে এসেছে।
আমি তাদের অভিবাদন জানানোর পক্ষে।

তারা শক্ত মেরুদন্ডের মানুষ। তারা বিশাল দুরত্বের পথ পাড়ি দিয়েছে এই দুর্ভিক্ষের মধ্যেও। তারা সহসাই তার বাড়ির সামনে ভিড় করবে। হতে পারে তারা আমন্ত্রিত অতিথি নয়। তবে অবশ্যই তারা তাদের কথা বলবেই।



আমি যদি গ্রামে থাকতাম আর এমন দুর্ভিক্ষ শুরু হত, আমি কি এইভাবে ঢাকায় আসার সাহস করতাম? আমি নিজেকেই নিজে জিজ্ঞাসা করলাম। আমি কি অনাহারে মৃত্যুর পর আমার লাশ নিয়ে কুকুর-শকুনের কামড়া-কামড়ির ব্যাপারে নিশ্চিত হয়েও এইভাবে এত দূরের পথ পাড়ি দিয়ে এসে খোলা আকাশের নিচে তাঁবু টানিয়ে বসে পড়তে পারতাম। আমার সামনে কি আরও কিছু করার উপায় থাকতো, আমার খাবার কেউ কেড়ে নিলে তাকে হত্যা করতে পারতাম। সবারই তো বেঁচে থাকার অধিকার আছে। সবার জীবনেরই মূল্য আছে নিজের কাছে।



আমি ক্লান্ত হয়ে পড়লাম। যখনই আমি নিজেকে এই প্রশ্নগুলো জিজ্ঞেস করতাম, আমি ক্লান্ত হয়ে পড়তাম। শ্বাস নিতে সমস্যা হত। নিজেকে ঠিক রাখতে পারতাম না। আমি নূর হোসেনের সাথে ময়না মিয়ার সভাগুলোতে যেতাম, যদিও আমি জানতাম আমি একটা গভীর খাঁদে নিপতিত হচ্ছে।



শুধু ১৯৭৪ সালে শেখ মুজিবের স্বাধীন বাংলাদেশে দেড়কোটি মানুষ মারা যায়। সংখ্যাটা কত বড় ছিল? পাকিস্তানিরা নয়মাসের মুক্তিযুদ্ধে যত মানুষ মেরেছিলো তার পাঁচগুণ। আমাদের ইতিহাসে কোন দূর্যোগে এত মানুষ মারা পড়েনি। এই উপমহাদেশের কোন নিষ্ঠুর রাজা-মহারাজা এত মানুষের মৃত্যুর কারণ হয়নি। কোন ধর্মীয় সহিংসরা, মহামারি রোগ কিংবা যুদ্ধ- এত মানুষের মৃত্যু নিশ্চিত করতে পারেনি।




( পৃষ্ঠা-১১৫-১১৭ | সেই কালো কোট )

অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।