আমাদের কথা খুঁজে নিন

   

নবীজির বিদায় হজ্জ ভাষণ



তাঁকে উঠতে দেখে সবার গুঞ্জন থেমে গেল। একই মাঠে এক লাখ মানুষ উপস্থিত আছেন, অথচ কারও কোন সারা শব্দ টের পাওয়া যাচ্ছে না। সবার কান শুনতে উদগ্রীব, প্রিয় নবী হযরত মুহাম্মদ(সঃ) কী বলেন তা শোনার জন্য।
একটি উটের পিঠে চেপে আরাফাতের বিশাল সমতল ময়দানে প্রিয় নবীজি (সঃ) একবার সমবেত জনতার উদ্দেশ্যে দৃষ্টি বুলালেন। তাঁর চোখ জুড়িয়ে গেল।

লক্ষাধিক মুসলমান আজ জড়ো হয়েছেন দুই টুকরো কাপড়ে নিজেদের শরীর জড়িয়ে। সবার কন্ঠে উচ্চারিত হচ্ছে একই বাক্য, "লাব্বায়েক আল্লাহুম্মা লাব্বায়েক!"
"আমি এসেছি, ও আল্লাহ! আমি তোমার দরবারে হাজির হয়েছি!"
আনন্দে তাঁর মন ভরে গেল। তাঁর চোখে কী ভেসে উঠলো দীর্ঘ বাইশ বছরের সংগ্রামময় দিনগুলোর দৃশ্য? শুরুর দিকে নিজের গোত্রের লোকেদেরই বিরোধিতা। তারপরে ধীরে ধীরে পুরো শহরের বিরুদ্ধাচরণ। মুসলমানদের একঘরে করে রাখা।

একসময়ে তাঁর প্রাণ নাশের শঙ্কা জাগলে প্রিয় সঙ্গী আবুবক্করকে(রাঃ) সাথে নিয়ে মাতৃভূমি মক্কা ছেড়ে মদিনায় হিযরত। তারপরেও তাঁদের প্রতি মক্কাবাসীর প্রতিহিংসা কমে না। বদর এবং ওহুদের যুদ্ধে এবং আরও ভিন্ন ভিন্ন ঘটনায় শহীদ হতে হলো প্রিয় সাহাবী হযরত হামযাহ(রাঃ) সহ আরও কত সাহাবীকে! সব সংগ্রাম, ত্যাগ, সহনশীলতা শুধু মাত্র আজকের এই দিনটির জন্যই! গোত্রে গোত্রে লড়াই বন্ধ হোক। মানুষে মানুষে ভেদাভেদ দূর হোক। বিশ্বে শান্তি প্রতিষ্ঠা হোক।


"লাব্বায়েক আল্লাহুম্মা লাব্বায়েক!"
তিনি বুঝতে পারছেন, পৃথিবীতে তাঁর আগমনের উদ্দেশ্য সম্পন্ন হয়েছে। এবার তাঁর বিদায়ের পালা। বিদায়ের আগে, এত মুসলমানকে একসাথে পেয়ে আবেগে তাঁর মন ভরে উঠছে। অবশেষে তিনি সমবেত জনতার উদ্দেশ্যে বলতে শুরু করলেন।
"হে মানব জাতি! তোমরা আমার কথা শোন! এরপর এই স্থানে, তোমাদের সাথে আমি আর একত্রিত হতে পারবো কিনা জানি না।


হে মানুষ! আল্লাহ বলেন, 'হে মানব জাতি! তোমাদেরকে আমি এক পুরুষ ও এক নারী থেকে সৃষ্টি করেছি। এবং তোমাদেরকে সমাজ ও গোত্রে ভাগ করে দিয়েছি। যেন তোমরা পরষ্পরের পরিচয় জানতে পারো। অতএব শুনে রাখো, মানুষে মানুষে কোন ভেদাভেদ নেই। আরবের উপর কোন অনারবের, অনারবের উপর কোন আরবের শ্রেষ্ঠত্য নেই।

তেমনি সাদার উপর কালোর, কিংবা কালোর উপর সাদার কোন শ্রেষ্ঠত্য নেই। তোমাদের মধ্যে সেই ব্যক্তিই আল্লাহর কাছে সবচেয়ে বেশি সম্মান, ও মর্যাদার অধিকারী - যে আল্লাহকে ভালবাসে!'
হে মানুষ! শুনে রাখো, অন্ধকার যুগের সকল বিষয় ও প্রথা আজ থেকে বিলুপ্ত হলো। যাহিলি যুগের রক্তের দাবীও রোহিত করা হলো।
হে মানুষ! শুনে রাখো, অপরাধের দায়িত্ব কেবল মাত্র অপরাধীর ওপরই বর্তায়, পিতা তার পুত্রের জন্য, আর পুত্র তার পিতার অপরাধের জন্য দায়ী নয়।
হে মানুষ! তোমাদের রক্ত, তোমাদের সম্মান, তোমাদের সম্পদ পরষ্পরের জন্য চিরস্থায়ীভাবে পবিত্র ও নিরাপদ করা হলো।

যেমন আজকের এই দিন, আজকের এই মাস, এই শহর সকলের জন্য পবিত্র ও নিরাপদ!
হে মানুষ! তোমরা ঈর্ষা ও হিংসা বিদ্বেষ থেকে দূরে থাকবে। ঈর্ষা ও হিংসা মানুষের সকল সৎ গুণকে ধ্বংশ করে।
হে মানুষ! নারীদের সম্পর্কে তোমাদের আমি সতর্ক করে দিচ্ছি। তাঁদের সাথে নিষ্ঠুর আচরণ করোনা। তাঁদের উপর যেমন তোমাদের অধিকার রয়েছে, তেমনি তোমাদের উপর তাঁদেরও অধিকার রয়েছে।

সুতরাং, তাঁদের কল্যানের দিকে সবসময়ে খেয়াল রেখো।
হে মানুষ! অধীনস্থদের সম্পর্কে সতর্ক হও। তোমরা নিজেরা যা খাবে, তাঁদেরও তা খাওয়াবে। নিজেরা যা পড়বে, তাঁদেরও তা পড়াবে। শ্রমিকের শরীরের ঘাম শুকানোর আগেই, তাঁর মজুরি পরিশোধ করবে।


হে মানুষ! ঈমানদার সেই ব্যক্তি, যার হাত ও মুখ থেকে, অন্যের সম্মান, ধন সম্পদ ও প্রাণ নিরাপদ। সে নিজের জন্য যা পছন্দ করে, অন্যের জন্যও তাই পছন্দ করে।
হে মানুষ! ঈমানদারেরা পরষ্পরের ভাই। সাবধান! তোমরা একজন আরেকজনকে হত্যা করার মত কুফরী কাজে লিপ্ত হয়োনা।
হে মানুষ! শুনে রাখো! আজ থেকে বংশগত শ্রেষ্ঠত্য বা কৌলিন্যপ্রথা বিলুপ্ত করা হলো।

কুলীন বা শ্রেষ্ঠ সেই, যে বিশ্বাসী ও মানুষের উপকার করে।
হে মানুষ! ঋণ অবশ্যই ফেরত দিতে হবে। বিশ্বস্ততার সঙ্গে প্রত্যেকের আমানত রক্ষা করতে হবে। কারও সম্পত্তি, সে যদি স্বেচ্ছায় না দেয়, তবে তা অপর কারোর জন্যে হালাল নয়। তোমরা কেউ দুর্বলের ওপর অবিচার করো না।


হে মানুষ! জ্ঞানীর কলমের কালী, শহীদের রক্তের চেয়েও মূল্যবান! জ্ঞানার্জন প্রত্যেক নরনারীর জন্য ফরয! কারন, জ্ঞান মানুষকে সঠিক পথ দেখায়। জ্ঞানর্জনের জন্য, প্রয়োজনে তোমরা সুদূর চীনে যাও!
হে মানুষ! তোমরা তোমাদের প্রভুর ইবাদত করবে! নামাজ কায়েম করবে, যাকাত আদায় করবে, রোজা রাখবে, হজ্জ করবে। আর সঙ্গবদ্ধভাবে নেতাকে অনুসরণ করবে। তাহলে তোমরা জান্নাতে দাখিল হতে পারবে।
হে মানুষ! শুনে রাখো, একজন কুশ্রী কদাকার ব্যক্তিও যদি তোমাদের নেতা মনোনিত হয়, যতদিন পর্যন্ত সে আল্লাহর কিতাব অনুসারে তোমাদের পরিচালিত করবে, ততদিন পর্যন্ত তার আনুগত্য করা তোমাদের অবশ্য কর্তব্য।


হে মানুষ! শুনে রাখো, আমার পর আর কোন নবী নেই।
হে মানুষ! আমি তোমাদের কাছে দুটো আলোকবর্তিকা রেখে যাচ্ছি। যতদিন তোমরা এই দুটো অনুসরন করবে, ততদিন তোমরা সত্য পথে থাকবে। এর একটি হলো আল্লাহর কিতাব! দ্বিতীয়টি হলো আমার জীবন দৃষ্টান্ত!
হে মানুষ! তোমরা কখনই ধর্ম নিয়ে বাড়াবাড়ি করোনা। কারন অতীতে বহু জাতি ধর্ম নিয়ে বাড়াবাড়ি করার কারণে ধ্বংশ হয়ে গেছে।


হে মানুষ! প্রত্যেককেই শেষ বিচারের দিনে সকল কাজের জন্য হিসেব দিতে হবে। অতএব সাবধান হও।
হে মানুষ! তোমরা যারা এখানে হাজির আছো আমার বাণীকে সবার কাছে পৌছে দিও!"
এরপর তিনি জনতার উদ্দেশ্যে জিজ্ঞেস করলেন, "হে মানুষ! আমি কী তোমাদের কাছে আল্লাহর বাণী পৌছে দিয়েছি?"
সবাই একসাথে জবাব দিল, "হ্যা!"
তিনি আবারও একই প্রশ্ন করলেন, "হে মানুষ! আমি কী তোমাদের কাছে আল্লাহর বাণী পৌছে দিয়েছি?"
এবারও সবাই একই জবাব দিল, "হ্যা!"
তিনি তৃতীয়বার একই প্রশ্ন করলেন, "এরপর নবীজি বললেন, "হে আল্লাহ! তুমি সাক্ষী থাকো! আমি আমার সকল দায়িত্ব পালন করেছি!"
এবারও সবার জবাব একই, "হ্যা!"
এরপর নবীজি আল্লাহকে উদ্দেশ্য করে বললেন, "হে আল্লাহ! তুমি সাক্ষী থাকো! আমি আমার সকল দায়িত্ব পালন করেছি!"

সোর্স: http://www.somewhereinblog.net     দেখা হয়েছে বার

এর পর.....

অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।