আমাদের কথা খুঁজে নিন

   

এখনো স্বপ্ন দেখি

আমার বিয়ের সময়ের কথা আজ খুব মনে পড়ছে। ১৯৯০ সাল, ২১ সেপ্টেম্বর অরুণ চৌধুরীর সঙ্গে আমার আশীর্বাদ হলো। তখন ভারত আর বাংলাদেশে বাবরী মসজিদ নিয়ে তোলপাড় চলছে। একই সঙ্গে দেশে চলছে স্বৈরাচারবিরোধী গণআন্দোলন। সারা দেশের সনাতন ধর্মাবলম্বীদের মনে তখন অনেক ভয়, কী হয় কী হয়। তবু এর মধ্যে আমাদের বিয়ের আয়োজন চলতে লাগল। বিয়ের সব আয়োজন মা করছেন, নিজ হাতে সব সামলে নিচ্ছেন, হাতে শাঁখা, কপালে সিঁদুর। ওই অস্থির সময়েও মায়ের কখনো মনে হয়নি শাঁখা সিঁদুর সরিয়ে রাখার কথা। আমাদেরও মনে হয়নি কখনো। ৩ ডিসেম্বর আমাদের বিয়ে। একই সঙ্গে দেশে চলছে দাঙ্গা, স্বৈরাচারবিরোধী গণআন্দোলন আর কারফিউ। অরুণরা সপরিবারে পুরান ঢাকার পাতলা খান লেনের এক হোটেলে এসে উঠল। শাহাদাত চৌধুরী, ইমদাদুল হক মিলন, আবেদ খানসহ অনেকের উপস্থিতিতে বিয়ে হলো। ৫ ডিসেম্বর ছিল ফুলশয্যা। স্বৈরাচার পতনের আনন্দে দেশ তখন উত্তাল, বিজয় মিছিলে। এই পুরো সময়টা আমার জীবনে অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। একই সঙ্গে আমার সংসার যাত্রা আর প্রিয় মাতৃভূমি বাংলাদেশের গণতন্ত্রের পথে যাত্রা শুরু হলো। কিন্তু এই পুরো সময়টা খুব আতঙ্কে কাটত। সাম্প্রদায়িক দাঙ্গার ভয়ে। যে কোনো ইস্যুতে সবার আগে আঘাত নেমে আসে সনাতন ধর্মাবলম্বীদের ওপর। এক সময় প্রতিবাদ প্রতিরোধ হতো, এখন আর তাও হয় না, শুধু পালিয়ে বাঁচার চেষ্টা। জন্মের পর থেকে এভাবেই বাংলাদেশে আমরা বেড়ে উঠেছি, ভয়ে আতঙ্কে কাটিয়েছি। কিন্তু কখনো মনে হয়নি এদেশ ছেড়ে যাওয়ার কথা, শাঁখা-সিঁদুর লুকিয়ে রাখার কথাও মনে হয়নি। এবারও নির্বাচনের পরে সারা দেশে আবার নির্যাতন নেমে এলো সনাতন ধর্মাবলম্বীদের ওপর। সেদিন হরতাল-অবরোধের মধ্যেও আমি ছেলেকে নিয়ে বের হলাম। আমার ছেলে অরণ্য প্রতীক চৌধুরী এখন সিএ পড়ছে। আমি প্রতিদিন তাকে একটি ফার্মে নামিয়ে দিয়ে কাজে যাই। সেদিনও যাচ্ছিলাম। গাড়িতে যখন যাচ্ছি, হঠাৎই ছেলে বলল, 'মা, শাঁখাটা খুলে রাখা যায় না?'

শুনে বুকটা হাহাকার করে উঠল। আমি বড় হয়েছি পুরান ঢাকায়। বড় হয়েছি একটি অসাম্প্রদায়িক পরিবেশে। মানুষে মানুষে কোনো দিন ভেদ করতে শিখিনি। শিখেছি সব ধর্ম মতকে সম্মান করতে। আমাদের বাড়ির সব অনুষ্ঠান আয়োজনে যেমন সব ধর্ম মতের মানুষ আসতেন, আমরাও সবার সঙ্গে মিশেছি সব সময়। এমনকি বিয়ের পর যে পরিবারকে আপন ভেবে নিয়েছি, আমার শ্বশুর, শাশুড়ি, স্বামীসহ তাদের পুরো পরিবারও সংস্কৃতিমনা, আধুনিক ও অসাম্প্রদায়িক। আজ যখন আমার ছেলে বলল শাঁখা খুলে ফেলার কথা, তখন বুঝতে পারি কী পরিমাণ আতঙ্ক নিয়ে বড় হচ্ছে আমার সন্তান। তখন বুঝতে পারি আমার সন্তান নিজেকে এই দেশে নিরাপদ ভাবতে পারছে না।

অথচ এই দেশকেই ভালোবেসে এসেছি আজীবন। বাংলাদেশকে নিয়ে গর্ব করেছি আজীবন। আমার যা কিছু তা বাংলাদেশ নিয়ে। আমি কখনো বিদেশি কোনো টিভি চ্যানেল দেখি না। আমার বাড়ির কেউই দেখে না। আমার পরিচিত কেউ দেখলে আমার কষ্ট হয়। আমার ফেসবুকের সব স্ট্যাটাসে একটা নিবেদন সব সময় থাকে, 'দেশের নাটক দেখুন, দেশের টিভি চ্যানেল দেখুন।' ধর্মের কারণে মাতৃভূমিকে আপন করে নিতে, মায়ের মতো ভালোবাসতে কখনো এতটুকু দ্বিধা হয়নি। সব সময়ই জেনে এসেছি বাংলাদেশ আমার দেশ, আমার মা। আজ যখন আমার সন্তানের চোখে এই ভয় দেখি, তখন বুঝতে পারি সারা দেশের অসংখ্য সনাতন ধর্মাবলম্বী শিশু-কিশোরের মনোভাব। নির্যাতিত মানুষগুলোর মনোভাব। খুব কষ্ট লাগে, খুব। নিজের দেশকে নিয়ে, দেশের মানুষকে নিয়ে স্বপ্ন দেখা তবু আমার থামে না। আমি এখনো স্বপ্ন দেখি এই দেশের প্রতিটি শিশু, সে যে ধর্মেরই হোক, সবাই দেশকে ভালোবাসবে, দেশের মানুষকে ভালোবাসবে, দেশকে নিয়ে গর্ব করবে, স্বপ্ন দেখবে দেশকে নিয়ে। আমি এখনো স্বপ্ন দেখি আগামীর বাংলাদেশ হবে অসাম্প্রদায়িক বাংলাদেশ। যে দেশে শুধু ধর্ম মতের অমিলের জন্য কেউ কাউকে নির্যাতন করবে না, বাড়িঘর জ্বালিয়ে দেবে না, ধর্ষিত হবে না কোনো নারী। বাংলাদেশ তো আমারও দেশ, আমাদের সবার দেশ। আমি এখনো স্বপ্ন দেখি। -লেখক : নাট্যকার, পরিচালক।

অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।

প্রাসঙ্গিক আরো কথা
Related contents feature is in beta version.