আমাদের কথা খুঁজে নিন

   

শোষণের হাতিয়ার সাম্প্রদায়িকতা



১৭৫৭ সালে বৃটিশ সা¤্রাজ্যবাদ ভারতীয় উপমহাদেশ দখলের পর থেকে কিভাবে ঔপনিবেশিক দেশটিতে শাসন ও শোষণে মাত্রা বাড়িয়ে দিয়ে দমিয়ে রাখা যায় এই নিয়ে নানা পরিকল্পনা আটে। এর জন্য যে অস্ত্রটি দিয়ে সফলকাম হয় সেটি হচ্ছে সাম্প্রদায়িকতা। শোষণ, লুন্ঠন ছাড়াও অমানসিক অত্যাচার, নির্যাতনের পরও এর বিপরীতে যাতে করে সকল শ্রেণী পেশার মানুষ ঐক্যবদ্ধ হয়ে আন্দোলন গড়ে তোলতে না পারে সেই পরিকল্পনা স্বরুপ এ মহাদেশে হিন্দু, মুসলমান সহ বিভিন্ন ধর্মীয় গোষ্ঠীর সম্প্রীতির বন্ধনকে উগ্রসাম্প্রদায়িকতাকে কাজে লাগিয়ে বিছিন্ন করে দেয়। ভারতীয় ঔপনিবেশকালে বিভিন্ন সময়ে অঞ্চল ভিত্তিক স্বদেশী আন্দোলন, নীল বিদ্্েরাহ, হাজং বিদ্্েরাহ, তেভাগা আন্দোলন সহ যে ছোট ছোট বিদ্রোহ গড়ে উঠে তা বানচাল করে দেওয়ার জন্য ব্রিটিশরা এই অস্ত্রটিকেই সুপরিকল্পিত ভাবে ব্যবহার করেছে। ১৯ শতকে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের প্রাককালে যে জাতীয় মুক্তি, স্বাধীনতার সংগ্রাম শুরু হয় সেই সংগ্রামকে একটি উগ্রসাম্প্রদায়িক উসকানির মধ্যে ফেলে দিয়ে মূল বিষয়কে এড়িয়ে ভিন্ন দিকে ধাবিত করে হিন্দু-মুসলমানের জন্য ভারত-পাকিস্তান নামে দুটি রাষ্ট্রে বিভক্ত করে দেয়।

কিন্তু ব্রিটিশ সা¤্রাজ্যবাদের রেখে যাওয়া সেই সাম্প্রদায়িক ক্যন্সার অর্ধ যুগ পেড়িয়ে গেলেও আজ পর্যন্ত আমাদের রাষ্ট্র ব্যবস্থা তা দূর করতে পারেনি। যখনই কোন সংকটময় পরিস্থিতির সৃষ্টি হয়েছে তখনই একটি মহল এই সাম্প্রদায়িক ক্যন্সারকে ঢাল হিসেবে ব্যবহার করে দু¤্রজাল সৃষ্টি করে ফায়দা লুটার চেষ্টা করে। হোক তা রাজনৈতিক কিংবা অর্থনৈতিক। আজকে যখন দেশে একটি রাজনৈতিক সংকট বিরাজ করছে তখন এই (সাম্প্রদায়িক হামলা) ঘটনারই পূনরাবৃত্তি ঘটছে। দশম জাতীয় সংসদ নির্বাচনকে কেন্দ্র করে নির্বাচনের রুপরেখা নিয়ে সরকারি দল এবং বিরোধী দলের মধ্যে একটি সংঘাতময় পরিবেশের সৃষ্টি হয়েছে।

এই সংঘাতের মধ্যে পরে প্রাণ হারাচ্ছে দেশের সাধাারণ মানুষ। নির্বাচনের রুপরেখা নিয়ে দেশী-বিদেশি তীব্র মত পার্থক্য থাকা সত্ত্বেও গত ৫ জানুয়ারী তা সম্পন্ন হওয়ার পরপরই দেশের সংখ্যালঘু জনগোষ্ঠী এবং ক্ষুদ্র নৃ-গোষ্ঠীর বাড়ি ঘরে হামলা, ভাঙ্গচুর, আগুন, লুটপাট, ধর্ষণ, এমনকি নিহতের মত নিশংস ঘটনাও ঘটছে। এমতাবস্থায় কিছু কিছু অঞ্চলের মানুষজন হামলার শিকার হয়ে ঘর-বাড়ি ছেড়ে অন্যত্র পাড়ি জমিয়েছেন। এছাড়াও অনেক অঞ্চলের মানুষ কখন হামলা হয় সেই ভয়েই দিনাতিপাত করছেন। যেমনটি আমাদের সবচেয়ে বেশি মনে করিয়ে দেয় ১৯৪৭’র দেশ ভাগ, ১৯৭১’র সালের যুদ্ধ, ১৯৯২ সালে বাবরি মসজিদ ভাঙ্গার সময়কার বর্বর চিত্রের ইতিহাস।

যার দরুণ অনেক সংখ্যালঘু হিন্দু জনগণ পৈত্রিক ভিটামাটি ছেড়ে অসহায় হয়ে দলবেধে পার্শ্ববর্তী রাষ্ট্র ভারতে পারি জমায়। আজকের এই সংখ্যালঘু জনগোষ্টীর উপর হামলার জন্যে আওয়ামীলীগ ও বিএনপি-জামায়াত একেঅপরকে দোষারোপ করে কাঁদা ছোঁড়াছোঁড়ি করছে। কিন্তু আমরা যদি গণমাধ্যম গুলোর দিকে চোখ রাখি তাহলে দেখা যাবে এসব ঘটনার নেপত্যে কোথাও বিএনপি-জামায়াত কোথাও আওয়ামীলীগ আবার কোথাও এরা সবাই জড়িত। যেমনটি আমরা রামু, উখিয়ায় দেখেছি। কিন্তু এসব ঘটনার কোন দৃষ্টান্তমূলক বিচার আজও আমরা প্রত্যক্ষ করিনি।

বরাবরই রাজনৈতিক বিচার বিবেচনায় তা এড়িয়ে যাওয়া হয়েছে। যার দরুন এই ঘটনা গুলো বারবার ঘটাতে সাহস পাচ্ছে সুবিধাণে¦ষী মহল। আজকেও সারা দেশে যে হামলা হচ্ছে তাতে উভয় রাজনৈতিক সংগঠনের দিকেই আঙ্গুল উঠছে। সাম্প্রদায়িক চেতনা মূলত সামন্ততান্ত্রিক সমাজের একটি বৈশিষ্ট্য। আমাদের এই রাষ্ট্র ব্যবস্থা এখনও সম্পূর্ণ রুপে সামন্ততান্ত্রিক ব্যবস্থা থেকে বের না হতে পারার কারণেই সাম্প্রদায়িক এই চেতনা আজও সমাজের রন্ধ্রে রন্ধ্রে বিরাজ করছে।

আর তাই স্বার্থন্বেষী মহল এই বিষয়কে (সাম্প্রদায়িকতা) কাজে লাগানোর মধ্য দিয়ে তাদের অসৎ স্বার্থ হাসিল করতে স্বচেষ্ট হচ্ছে। কিন্তু আজকে যারা এই বিষয়টাকে এড়িয়ে যাওয়ার চেষ্টা করছেন, এখানে একটি প্রশ্ন থেকে যায় তারা কী নিতান্তই ‘শাক দিয়ে মাছ ঢাকা’র চেষ্টা করছেন না ? আমাদের রাষ্ট্র ব্যবস্থা পুঁজিবাদের বিকাশ হওয়ার তকমা লাগালেও এখনও পর্যন্ত ভাড়ী শিল্পের বিকাশ ঘটাতে পারেনি। বিশেষ করে এর প্রয়োজনেই আমাদের শিক্ষা ব্যবস্থায়ও সম্পূর্ণ বিজ্ঞান ভিত্তিক ছোঁয়া লাগেনি। নয়া উপনিবেশিক রাষ্ট্র হওয়ায় যে সরকারই ক্ষমতায় আসুক না কেন তারা যেহেতু সা¤্রাজ্যবাদীদের আশির্বাদ নিয়ে ক্ষমতায় আসীন হয় সেহেতু তাদের পক্ষেও ভাড়ী শিল্প স্থাপন কার সম্ভব নয়। আর তাই সমাজ তথা রাষ্ট্র ব্যবস্থায় সাম্প্রদায়িক চেতনার বিষয়টিও জগদল পাথরের মত চেপে বসে রয়েছে।

এই সুযোগে সাম্প্রদায়িক রাজনৈতিক সংগঠন গুলোও বারবার মাথা চড়া দিয়ে উঠছে। বিএনপি-আওয়ামীলীগ প্রগতিশীলতার ধুয়া তুললেও মূলত তারা প্রতিক্রিয়াশীলতার ভেতর থেকে বের হয়ে আসতে পারছেনা। বিভিন্ন প্রতিক্রিয়াশীল সংগঠনের সাথে জোট করে এবং প্রচার প্রচারনা চালিয়ে এর মধ্যেই ঘুরপাক খাচ্ছে। তাই তারা সংগঠন গত ভাবে আলাদা হলেও একই উদ্দেশ্য এবং শ্রেণীর রাজনীতি করে আসছে। যেখানে দেখা যায় শিল্প প্রধান দেশগুলোতে বিজ্ঞান শিক্ষায় ধর্ম সংগঠনের প্রভাব কমে এসেছে।

তাছাড়া সে সকল রাষ্ট্রে এধরনের কোন ঘটনা ঘটতে লক্ষ্য করা যায় না। প্রতিবারই দেখা যায় সংখ্যালঘু জনগোষ্ঠীর উপর হামলার প্রেক্ষিতে কিছু দিন মানববন্ধন, মিছিল, সভা, সেমিনারে বক্তব্য দেওয়ার মধ্য দিয়েই বিশিষ্ট ব্যক্তি, সামাজিক, সাংস্কৃতিক, রাজনৈতিক সংগঠনে কার্যক্রমের ইতিটানতে। এবারও তার ব্যতিক্রমটি ঘটবে বলে অনুমান করা যাচ্ছে না। আমরা যদি একটু ইরাকের দিয়ে তাকাই তাহলে দেখতে পাই মার্কিন সা¤্রাজ্যবাদ সেখানে এত হত্যাযঙ্গ চালানোর পরও তাদের দমাতে না পেরে শেষ পর্যন্ত শিয়া-সুন্নিদের মধ্যে সাম্প্রদায়িক দাঙ্গা বাজিয়ে দিয়ে একটি অরাজক পরিবেশে সৃষ্টি করে শোষণ, লুন্ঠন চালিয়ে যাচ্ছে।
আমাদের দেশের সংখ্যালঘু জনগণ সব সময় আশঙ্কার মধ্যে থাকে।

সংখ্যাগুরু জনগণ হোক সেটা ন্যায় বা অন্যায় সব সময় সংখ্যালঘুদেরকেই দমিয়ে রাখার চেষ্ঠা করে। যেমনটি আমরা দেখেছি রানা প্লাজা ধসে পরার পর যে চাঞ্চল্যকর একটি তথ্য বের হয়ে আসে। সেটি হচ্ছে রানা প্লাজা যেখানে গড়ে উঠে সেই জায়গাটি কোন একজন সংখ্যালঘু ব্যাক্তির। সোহেল রানা সেটা দখলই করেনি বরং কখন তাকে মেরে ফেলে সেই ভয়ে পালিয়ে বেড়াতে হয়েছে সংখ্যালঘু মানুষটিকে। এমনটি যে কেবল রানা প্লাজার ক্ষেত্রে হয়েছে শুধু তাই নয় আমাদের দেশের অধিকাংশ জায়গায় এমন ঘটনা অহরহই ঘটছে।

যা কেবল আমাদের মিড়িয়াতে স্থান করে নেয়নি যার ফলে বিশিষ্টজনের আলোচনায়ও স্থান পায়নি। অনেক জায়গায় তারা স্বাধীনভাবে মত প্রকাশ পর্যন্ত করতে পারে না। সাম্প্রদায়িকতা এই বেড়াজাল যেন আমাদের সমাজটাকে খুড়ে খুড়ে খাচ্ছে। আজকেও উগ্রসাম্প্রদায়িকতার ধুয়া তুলে জাতিকে বিভক্ত করার চেষ্ঠা চলছে। দেশের মানুষ যাতে করে এই সংকটময় পরিস্থিতিতে এককাতারে এসে দাঁড়াতে না পারে সেই উদ্দেশ্যে জনগণের দৃষ্টি অন্যদিকে ফেরানোর জন্য এই অপচেষ্টা চলছে।

সাম্প্রদায়িক হামলার ঘটনায় আইন শৃঙ্খলা বাহিনীকে প্রতিবার গ্রেফতার-মামলা করতে দেখা যায়। এবারও তাই করা হচ্ছে। কিন্তু আমাদের মনে রাখতে হবে শুধু মাত্র গ্রেফতার-মামলা করে এই বিষয়ের সমাধান টানা সম্ভব নয়। আজকে সমাজের প্রতিটি স্তরে এর বিরুদ্ধে প্রতিবাদ গড়ে তোলা প্রয়োজন। উগ্রসাম্প্রদায়িকতার কবর রচনা করতে যথাযথ ব্যবস্থা গ্রহণ করে রাষ্ট্র তথা আর্থ-সামাজিক অবস্থার আমূল পরিবর্তন প্রয়োজন।

নচেত এই ধরনের সাম্প্রদায়িক হামলার ঘটনা বারবারই ঘটতে থাকবে। আর এই সুযোগে স্বার্থন্বেষী মহল তাদের অপকর্ম চালিয়ে যাবে। শত মায়া কান্না করলেও কোন সমাধান টানা সম্ভব নয়।

অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।

প্রাসঙ্গিক আরো কথা
Related contents feature is in beta version.