আমাদের কথা খুঁজে নিন

   

ব্যাংক লুটের রহস্য উদঘাটন

দুর্ধর্ষ ব্যাংক লুটের নায়ক হাবিব ওরফে সোহেলের স্বপ্ন ছিল অনেক। লুটের পাঁচ বস্তা টাকার ওপর হাত রেখে স্বপ্ন বাস্তবায়নে ভবিষ্যৎ পরিকল্পনাও এঁটেছিলেন তিনি। লুটের টাকায় প্রথম তিনি বিরাট বাড়ি কিনতে চেয়েছিলেন রাজধানী ঢাকায়। ঘুরে বেড়াতে কিনতে চেয়েছিলেন দামি গাড়ি। বড় বড় ব্যবসায় টাকা লগি্ন করারও পরিকল্পনা ছিল তার।

কিন্তু দুই বছরের সব চেষ্টাই বৃথা হয়ে যায় র্যাবের কাছে টাকাসহ ধরা পড়ে যাওয়ার পর। গ্রেফতারের পর র্যাবের কাছে সোহেল বারবার তার আফসোসের কথা জানিয়েছেন। বলেছেন, 'দীর্ঘ দুই বছরের শ্রম সব পণ্ড হয়ে গেল। নিশ্চিত জীবন হাতের মুঠোয় পেয়েও ধরে রাখতে পারিনি। জীবনে আর কোনো স্বপ্ন নেই।

নেই কোনো ভবিষ্যৎ পরিকল্পনাও। '

মঙ্গলবার রাতে র্যাব সদর দফতরে কথা হয় সোহেলের সঙ্গে। তার বক্তব্যে উঠে এসেছে ব্যাংক লুটের পরিকল্পনা, বাস্তবায়ন ও গ্রেফতারের আদ্যোপান্ত। এদিকে ব্যাংক লুটের এ ঘটনায় একমাত্র সোহেল সরাসরি জড়িত থাকলেও র্যাবের সন্দেহ বড় কোনো চক্র জড়িত রয়েছে। সেই চক্রের সন্ধানে কাজ করছে র্যাবের বেশ কয়েকটি টিম।

র্যাবের একটি সূত্র বলেছে, ব্যাংকের কয়েকজন জড়িত থাকার ব্যাপারে তাদের কাছে তথ্য রয়েছে। কিশোরগঞ্জ পুলিশ বলেছে, এ ব্যাপারে চার মহিলাসহ ১৭ জনকে আটক করা হয়েছে। চার মহিলার মধ্যে হাবিবের দুই প্রেমিকাও রয়েছেন। পটুয়াখালীর লেবুখালির হাবিব ওরফে সোহেল দুই বছর ধরে বসবাস করছেন কিশোরগঞ্জে। তিনি পলি ক্যাবলস ও শাহীন ক্যাবলস কোম্পানিতে দীর্ঘ ১৫ বছর চাকরি করেন।

চাকরিরত অবস্থায় কিশোরগঞ্জের সাদিয়া আক্তারকে বিয়ে করেন। ২০০৮ সালে চাকরি ছেড়ে দিয়ে শ্রমিক পেশায় দুবাই চলে যান। ২০১১ সালে দুবাই থেকে উপার্জিত ৭ লাখ টাকা নিয়ে দেশে ফেরত আসেন হাবিব। তবে পটুয়াখালীতে তার বাড়িটি নদী ভাঙনে বিলীন হয়ে যাওয়ায় কিশোরঞ্জের নগুয়ায় তিনি থাকতে শুরু করেন। তার সঙ্গে পরিবারের কারোরই যোগাযোগ ছিল না।

শুক্রবার সোনালী ব্যাংক থেকে ১৬ কোটি ৪০ লাখ টাকা চুরি হয়। মঙ্গলবার বিকালে রাজধানীর শ্যামপুর থেকে চুরির ঘটনায় জড়িত হাবিব ওরফে সোহেল এবং তার সহকারী ইদ্রিসকে গ্রেফতার করে র্যাব। এ সময় তাদের কাছ থেকে ১৬ কোটি ১৯ লাখ ৫৬ হাজার ৬৪ টাকা উদ্ধার করা হয়। গ্রেফতার হাবিব জানান, 'ব্যাংক থেকে পাঁচ বস্তা টাকা নিজ ঘরে আনার পরও বিশ্বাস হয়নি পাঁচ বস্তা টাকার মালিক আমি। টেনশনে ঘুমুতে পারিনি।

অজানা আশঙ্কা কাজ করছিল। ভাবছিলাম, টাকাগুলো আসল নাকি সাদা কাগজ। বারবার বস্তার মুখ খুলে দেখেছি, টাকাগুলো ঠিক আছে কি না। বিভিন্ন সংবাদপত্র ও টেলিভিশনের খবরে ফলাও করে প্রচার হওয়ার কারণে আমি ঘাবড়ে যাই। মানসিকভাবে ভেঙে পড়েছিলাম।

'

সোহেল জানান, 'দুই বছর আগে সোনালী ব্যাংকে চুরির পরিকল্পনা করি। এর অংশ হিসেবে নিজের নাম গোপন করে সোহেল নামে ব্যাংকের পাশে একটি টিনশেড বাড়ি ভাড়া নিই। বাড়িটি প্রথমে ভাড়া দেওয়া হয়নি। বাড়ির কেয়ারটেকারের সঙ্গে সখ্য গড়ে তুলি। একপর্যায়ে কেয়ারটেকার ওই বাড়ির আরেক ভাড়াটিয়াকে সরিয়ে দিয়ে আমাকে ভাড়া দেন।

বাড়িটি ভাড়া নেওয়ার পর দেড় বছর ধরে সুড়ঙ্গ তৈরির কাজ শুরু করি। বহু কষ্ট করেছি। এ কাজের জন্য দিনের বেলাকেই বেছে নিই। ' সোহেল জানান, 'বাড়ি থেকে ব্যাংকের ভল্টের মাপজোক নিয়ে খোঁড়ার পরও সুড়ঙ্গটি অন্যদিকে চলে যায়। মাসখানেক আগে সুড়ঙ্গের মাথা ওপরে বের করে দেখি সেটা ব্যাংকের বারান্দা।

ওই বারান্দায় পুরনো চেয়ার-টেবিল রাখা ছিল। ফলে বিষয়টি কেউ টের পায়নি। পরে আবার মাপজোক নিয়ে নতুন পথে সুড়ঙ্গ খোঁড়া হয়। শুক্রবার সন্ধ্যায় সুড়ঙ্গ গিয়ে ঠেকে ব্যাংকের ভল্টরুমে। এ সময় ওপরে একটি স্টিলের আলমারি ছিল।

' সোহেল জানান, 'জগ দিয়ে আলমারিটি সরানোর ব্যবস্থা করি। পরে শাবল দিয়ে ঠেলে ঠেলে কোনোমতে ভেতরে ঢুকে পড়ি। এরপর নিজেই আলমারি সরিয়ে যাতায়াতের রাস্তা প্রশস্ত করি। ভস্তায় ভরে টাকা নিয়ে আসি। এক হাজার টাকার বস্তা হয় তিনটি এবং পাঁচ শ টাকার বস্তা হয় দুটি।

' শনিবার সকালেই কয়েক দফা রিকশা পাল্টে টাকার বস্তাগুলো একটি চালের আড়তে নিয়ে যান। সেখানে দুটি দোকান থেকে দুই শ এবং এক শ করে তিন শ বস্তা পাইজাম চাল কেনেন। পরে চুরির টাকা ও চালের বস্তা ঢাকায় আনার জন্য ১২ হাজার টাকায় একটি ট্রাক ভাড়া করেন। পুলিশ যাতে ট্রাকটিকে সন্দেহ না করে সে জন্য ট্রাকের সামনে 'বিশ্ব জাকের মঞ্জিলের উরসের কাজে ব্যবহৃত' লেখা একটি ব্যানার টাঙিয়ে দেন।

সোহেল আরও জানান, 'ট্রাকচালকের সহকারী কোনোভাবে বুঝতে পারেন চালের বস্তার সঙ্গে অবৈধ কিছু আছে।

সে কারণে চালকের সহকারী বিভিন্ন অজুহাতে চালককে গাড়ি থামাতে বলেন। ওই ট্রাকচালকের সহকারী পথে একাধিক নির্জন স্থানে ট্রাক থামিয়ে র্যাব-পুলিশের ভয় দেখিয়ে টাকা দাবি করেন। আমি দফায় দফায় ৭ লাখ টাকা দিয়ে মুখ বন্ধ করি তার। শনিবার সন্ধ্যায় ট্রাকটি শ্যামপুরে পেঁৗছায়। এরপর বাসা খুঁজতে খুঁজতে একপর্যায়ে শ্যামপুরের কদমতলীতে তনয় ভিলা নামের ওই বাড়িতে টু-লেট লেখা দেখে মালিকের সঙ্গে কথা বলি এবং সাড়ে ৮ হাজার টাকা নগদ দিয়ে ছয় তলার বাসাটি ভাড়া নিই।

পরে ওই বাসায় পাঁচ বস্তা টাকা ও আট বস্তা চাল নামিয়ে রেখে সব চালের বস্তা আটরশির উদ্দেশে পাঠিয়ে দিই। কিন্তু র্যাব কোথা থেকে খবর পেয়েছে জানি না। '

হাবিবের দুই বান্ধবী : ব্যাংক লুটের ঘটনায় জড়িত বাস্তবের এই খলনায়ক পরিকল্পনা বাস্তবায়নে প্রেমের ফাঁদে জড়িয়ে ফেলেছিলেন দুই তরুণীকে। এদের একজন সোনালী ব্যাংকের ওই শাখায় কর্মরত কর্মকর্তা ইয়াসমিন সুলতানা (২৩)। তার সঙ্গে প্রায় দুই বছর ধরে সোহেলের প্রেমের সম্পর্ক রয়েছে বলে পুলিশি জিজ্ঞাসাবাদে ওই তরুণী স্বীকার করেছেন।

হোসেনপুর উপজেলায় বাড়ি হলেও চাকরির সুবাদে শহরের ভাড়া বাসায় একাকী ওই তরুণী বসবাস করতেন। অন্যজন স্থানীয় সরকারি গুরুদয়াল কলেজের তৃতীয় বর্ষের ছাত্রী সাবিনা আক্তার (২০)। তার বাড়ি নেত্রকোনার কেন্দুয়া উপজেলায়। ঘটনার পর পরই পুলিশ বাসা ভাড়া নেওয়ার ক্ষেত্রে সহযোগিতাকারী স্থানীয় ব্যবসায়ী সেলিমের স্ত্রী নার্গিস আক্তারকে আটক করে। পরে বিভিন্ন মাধ্যমে পাওয়া তথ্যের ভিত্তিতে সোহেলের কথিত এ দুই প্রেমিকাকেও আটক করে।

তদন্তসংশ্লিষ্টদের ধারণা, ব্যাংক কর্মকর্তা প্রেমিকা ইয়াসমিন সুলতানার সঙ্গে পরিচয়কে কাজে লাগিয়ে সোহেল ওই শাখার কয়েকজন কর্মকর্তা-কর্মচারীর সঙ্গে সখ্য গড়ে তোলেন। পরে পরিকল্পনা বাস্তবায়নে তাদেরও কাজে লাগান।

র্যাব সূত্র জানায়, গ্রেফতার হওয়ার পর সোহেল ও তার সহযোগী ইদ্রিসকে মঙ্গলবার রাতেই মামলার তদন্ত কর্মকর্তা কিশোরগঞ্জ সদর থানার ওসি আবদুল মালেকের কাছে হস্তান্তর করা হয়। এ সময় মামলার আলামত হিসেবে উদ্ধার হওয়া টাকাও তাকে বুঝিয়ে দেওয়া হয়। কিন্তু নিরাপত্তার কারণে তদন্ত কর্মকর্তা ওই টাকা বা আসামিকে র্যাব সদর দফতরে রাখেন।

গতকাল সকালে সোনালী ব্যাংক কর্তৃপক্ষের কাছে টাকাগুলো হস্তান্তর করে আসামি দুজনকে নিয়ে কিশোরগঞ্জের উদ্দেশে রওনা দেন। তদন্তকারী সূত্র জানায়, এ চুরির ঘটনার সঙ্গে ব্যাংকের বেশ কয়েকজন সম্পৃক্ত রয়েছেন বলে সন্দেহ করা হচ্ছে। আসামিকে জিজ্ঞাসাবাদ করা হলে এ ঘটনায় আরও কে কে জড়িত সে সম্পর্কে নিশ্চিত হওয়া যাবে।

২২ ফুট ঘিরে এখনো কৌতূহল : ২২ ফুট সুড়ঙ্গ নিয়ে কৌতূহলের শেষ নেই কিশোরগঞ্জে। তিন দিন ধরে কিশোরগঞ্জের রথখোলার এ সুড়ঙ্গই ছিল আলোচনার কেন্দ্র, ছিল নানা জল্পনা-কল্পনা।

গত রবিবার সুড়ঙ্গের হদিস মেলার পর থেকে একনজর দেখার আশায় ভোর থেকে গভীর রাত পর্যন্ত অসংখ্য নারী-পুরুষ ভিড় করেন ঘটনাস্থলে। নিরাপত্তা বাহিনীর কঠোর নিরাপত্তায় সেখানে পেঁৗছানো সাধারণের পক্ষে অনেকটা অসম্ভব হলেও হাল না ছাড়া মানুষের সংখ্যাও নেহাত কম ছিল না। কাউকে কাউকে দেখা গেছে নিরাপত্তা বাহিনী ও সোনালী ব্যাংকের ঊধর্্বতন কর্মকর্তা থেকে শুরু করে রাজনৈতিক নেতাদের সুপারিশ নিয়ে এসেছেন সুড়ঙ্গ দেখার শখ মেটাতে।

 

 

অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।

প্রাসঙ্গিক আরো কথা
Related contents feature is in beta version.