আমাদের কথা খুঁজে নিন

   

বিষয়বিদ্যাঃ পেছনের কিছু কথা

কিভাবে যেন বড় হয়ে গেলাম।

‘ফেনমেনলজি’ বা বিষয়বিদ্যা

‘শুরুর তিন’ নিয়ে প্রথম কিস্তিতে কথা শুরু করেছিলাম। পাশ্চাত্য দর্শনে তাদের গুরুত্ব বিশেষ ভাবে ধরা পড়তে শুরু করে ‘ফেনমেনলজি’ (phenomenology) নামে দার্শনিক আন্দোলন শুরু হবার গোড়ার দিকে। ‘ফেনমেনলজি’র সহজ বাংলা কি করা যায়? সেটা ভাবতে বসে শব্দবন্ধটি কিভাবে পয়দা হয়েছিল তার কিছুটা হদিস নেওয়া দরকারি মনে হোল।

‘ফাইনোমেনন’ আদিতে গ্রিক শব্দ, এর আক্ষরিক অনুবাদ হতে পারে হাজিরা দেওয়া, হাজির হওয়া, কোন কিছুর উপস্থিতি ঘটা, কোন কিছু ইন্দ্রিয়গত ভাবে ভেসে ওঠা, কোন কিছুর ‘আছে’ হয়ে ওঠা, ইত্যাদি।

আর ‘লোজস’ (logos) ব্যবহার ভেদে ‘শব্দ’, ‘বাক্য’, ‘জ্ঞান’, ‘যুক্তি’, ‘প্রজ্ঞা’ ইত্যাদি নানান অর্থ জ্ঞাপন করে।

আদি গ্রিক ভাষায় ‘ফেনমেনলজি’ শব্দটির দেখা পাওয়া যায় না। দুটো শব্দ মিলিয়ে তাদের তৈয়ারি হওয়াটা অনেক পরের ঘটনা। দুইয়ের এই প্রকার এক শব্দে বাঁধুনি নতুন। সম্ভবত ১৮ শতকের জর্মন দেশে লেখালিখিতে প্রথম দেখা দিতে শুরু করে।

পণ্ডিতদের কাছ থেকে জানা যায় শব্দবন্ধটির ব্যবহার সাবলীল ভাবেই শুরু হয়েছিল। লেখক ওর দ্বারা কী বোঝাতে চাইঝেন তা বুঝতে খুব বেগ পেতে হোতনা। যারা ব্যবহার করছিলেন তারাও হয়তো ধরে নিয়েছিলেন এর অর্থ পাঠকেরা বুঝতে পারবে। খুব একটা বেগ পেতে হবে না। জর্মন দেশে আঠারো শতকের মাঝামাঝি সময় থেকে এর ব্যবহার অনেকেই করেন।

শব্দটি ব্যবহারে ব্যবহারেই পরিচিত হয়ে ওঠে। মার্টিন হেইডেগার মনে করতেন জর্মন দার্শনিক ক্রিশ্চিয়ান উলফের (Christian Wolff, 1679 – 1754) অনুসারীদের হাত দিয়েই শব্দটি পরিচিতি পেতে শুরু করে। উলফ বিখ্যাত হয়েছিলেন লাইবনীৎজের (Gottfried Wilhelm Leibniz, 1646 – 1716) চিন্তাকে সুশৃংখল ভাবে পেশ করার প্রতিভা দেখিয়ে। তবে তিনিই প্রথম জর্মন দার্শনিক যিনি ল্যাটিন ভাষায় না লিখে তার দার্শনিক চিন্তা নিজের মাতৃভাষা জর্মনে লিখেছিলেন।

তবে ‘ফেনমেনলজি’ শব্দটি যার কারণে জনপ্রিয় হয়েছিল তিনি হেগেল (Wilhelm Friedrich Hegel, 1770 – 1831)।

হেগেল তাঁর দর্শনকে ইম্মেনুয়েল কান্টের (Immanuel Kant, 1724 – 1831) দর্শন থেকে আলাদা দেখাতে চেয়েছেন। তাঁর বিখ্যাত বইয়ের ইংরেজি অনুবাদের নাম ‘ফেনমেনলজি অব দ্য স্পিরিট’ (Phenomenology of the Spirit)। হেগেলের কাছে তাঁর দর্শন ছিল ‘চেতনার অভিজ্ঞতার বিজ্ঞান’। এতে তিনি ‘ফেনমেনলজি’ বলতে কী বোঝাতে চেয়েছেন তার খানিক ইঙ্গিত আমরা পাই।

এডমুন্ড হুসার্ল যখন তাঁর দর্শনকে ‘ফেনমেনলজি’ বলে পেশ করতে শুরু করলেন তখন হেগেল তাঁকে অনুপ্রাণিত করেছিল কিনা বোঝা মুশকিল।

তবে দুইজনের ব্যবহার দুই রকম অর্থে। দুইজনের চিন্তার পার্থক্যও কম নয়। দুজনের দার্শনিক প্রশ্নও একরকম ছিল না। দর্শনের জগতে দুইজনে ভিন্ন ভিন্ন ভাবে যে প্রশ্ন মীমাংসার দায় বোধ করেছিলেন সেখানেও ফারাক আছে। সে ফারাক ব্যাখ্যায় আগামি কোন এক কিস্তিতে আমরা ফিরে আসব।

তবে এটাও বোঝা যায় তারা দুজনেই যে বিষয়ে আগ্রহী ছিলেন সেটা হোল ভাবনার প্রক্রিয়া। কিম্বা আরও সহজ ভাবে আমরা কিভাবে চিন্তা করি সেই রহস্য উদ্ঘাটন। আমরা যখন কোন কিছু নিয়ে ভাবি তখন আমাদের চিন্তায় সেটা কিভাবে চিন্তার ‘বিষয়’ হয়ে ওঠে এবং তার সঙ্গে আমাদের সম্পর্কের নানান ধরণকে কিভাবে ব্যাখা করা যায় সেটা বোঝার জন্যই দুজনে সমান তৎপর ছিলেন।

এই যে ‘কিছু’ নিয়ে চিন্তা -- সেটা যে কোন কিছুই হতে পারে। মাটি লোহা, ফুল, ফল, জীব অণুজীব বা এই ধরণের অন্যান্য বস্তুপদার্থ, কিম্বা আল্লাহ, পরকাল, ব্রহ্মাণ্ড, এক, বহু ইত্যাদি ভাবপদার্থ।

এমনকি ইচ্ছা, কামনা, কল্পনা, বাসনা ইত্যাদি আকাঙ্ক্ষা জাতীয় কল্পপদার্থ। এইসবই নিশ্চয়ই শেষ নয়। তারপরও আরও অনেক ‘কিছু’ চিন্তার বিষয় হতে পারে। যেমন, বীরত্ব, বাৎসল্য, ভয়ংকর, মাধুর্য্য, প্রেম, বিরহ ইত্যাদি রসপদার্থ। আরও তালিকা পেশ করা যায়, নতুন শ্রেণিকরণও হতে পারে।

আমরা তো নানান ছাইপাশ ভাবি। ফলে যা কিছুই আমাদের ভাবনার ‘বিষয়’ হয় সেই সকল বিষয়ের ‘ বিষয়’ হয়ে ওঠার বিদ্যাকে বলা যায় ফেনমেনলজি। বিষয়বিদ্যা। বাংলায় যদি আমরা সহজ ভাবে চিন্তার চর্চা করতে চাই, তাহলে অনুবাদও যথাসম্ভব সহজ হওয়া দরকার। আর, চিন্তার চর্চা মানেই ভাবুকতার চর্চা, দর্শন, ইত্যাদি।



তো, আমরা ফেনমেনলজির বাংলা অনুবাদ রাখলাম ‘বিষয়বিদ্যা’। অর্থাৎ কোন কিছু আমাদের মনে বা চিন্তায় কিভাবে চিন্তার ‘বিষয়’ হিশাবে হাজির হয় সেই বিদিত হয়ে ওঠার প্রক্রিয়াকে যে বিদ্যা বা বিজ্ঞান ব্যখ্যা করে তাকে আমরা ‘বিষয়বিদ্যা’ বলব। একে বিষয়বিজ্ঞানও বলা যেত। সে কারণে অদলবদল করে দুটোই আমরা ব্যবহার করতে পারি। কিন্তু ‘বিজ্ঞান’ শব্দটি প্রথমত ইংরাজি সায়েন্স শব্দের অনুবাদ হিশাবে ব্যবহার হয়, আর ‘সায়েন্স’ সম্পর্কে আমাদের ধারণার মধ্যে অনেক গোঁড়ামি ও অপরিচ্ছন্নতা আছে।

তবে বায়োলজি বা প্রাণবিজ্ঞান বললে যেভাবে নৈর্ব্যক্তিক বিজ্ঞানের একটা ভাব থাকে, ফেনমেনলজিও সেই অর্থে প্রত্যক্ষ অভিজ্ঞতার বর্ণনা হিসাবেই গড়ে উঠেছে। কিন্তু এর বিষয়ের গভীরতা ও বিস্তার বহুদূর ছাড়িয়ে গিয়েছে, ছড়িয়েও গিয়েছে। বিজ্ঞান ও দর্শন উভয় পরিমণ্ডলই ফেনমেনলজির অন্তর্গত। যে কোন বিষয় সম্পর্কে বিদিত হয়ে ওঠার যে বিজ্ঞান তাকে তাহলে বিষয়বিদ্যা বলাই অনেক শ্রেয়। যা কিছুই আমাদের চিন্তার ‘বিষয়’ হয় – আগে হয়েছে এবং ভবিষ্যতেও হবে – তার ‘বিদিত’ হয়ে ওঠার প্রক্রিয়া অনুসরণ, বর্ণনা, পর্যালোচনা ও ভাবনার যে বিজ্ঞান তাকে বলা যায় ‘বিষয়বিদ্যা’।



প্রথাগত অর্থে আমরা যাকে বিজ্ঞান বলি, বিষয়বিদ্যা সেই অর্থে বিজ্ঞান নয়, কারন এ হচ্ছে বিজ্ঞানের বিজ্ঞান। যে বিজ্ঞানকে আমরা এখন বিশেষ ভাবে চিনি ও জানি সে বিজ্ঞানও বিষয়বিদ্যার অন্তর্গত, কিন্তু বিজ্ঞান হিসাবে তাদের হয়ে ওঠার ঘটনা বর্ণার বিজ্ঞান হিসাবে । যেমন, গণিত, জ্যামিতি, কমপিউটার শাস্ত্র, পদার্থবিজ্ঞান, উদ্ভিদ বিজ্ঞান, রসায়নশাস্ত্র, ভূতত্ত্ব, রাষ্ট্রবিজ্ঞান, সমাজতত্ত্ব, ধর্মতত্ত্ব ইত্যাদি। এই সকল বিজ্ঞানের কাছে তাদের বিজ্ঞানের ক্ষেত্র ও সীমা সুনির্দিষ্ট ও ইতোমধ্যেই চিন্তার অধীত বা অধীনস্থ। এ কারণে এদের বলা হয় অধীত বিজ্ঞান বা পজিটিভ সায়েন্স (positive science) কিন্তু বিষয়বিদ্যা অধীত বিজ্ঞানের অন্তর্গত নয়।

অধীত বিজ্ঞান নিজে কিভাবে একটি বিশেষ শাস্ত্র হিসাবে গড়ে উঠল, কিম্বা তার গবেষণার সুনির্দিষ্ট ক্ষেত্রগুলো কিভাবে চিন্তার বিষয়ে পরিণত হোল – সেই দিক গুলো নিয়ে ভাবাভাবি করে না। মানে, এই দিকগুলো প্রথাগত বিজ্ঞানের বিষয় নয়। কিন্তু এগুলো বিষয়বিদ্যার অন্তর্গত। যেমন চিন্তার বিশেষ ধরণ হিসাবে গণিতের ভিত্তি কি ধরণের অনুমান বা স্বতঃসিদ্ধ প্রস্তাবের ওপর দাঁড়িয়ে রয়েছে – তার সম্ভাবনা ও সীমা কোথায়। ধর্মতত্ত্ব যে বিশ্বাসকে সত্য জ্ঞান করে গড়ে উঠেছে সেই বিশ্বাসের গোড়ায় চিন্তার বিশেষ প্রক্রিয়া, স্বভাব বা ধরণ কোথায় কিভাবে কাজ করে? তার পরিসর বা দিগন্তকে চিহ্নিত করা যায় কিভাবে? ইত্যাদি।

অধীত বিষয়ই শুধু নয়, যা এখনও চিন্তার বিষয়ে পরিণত হয় নি, চিন্তা এখনও যাকে অধীত বিজ্ঞানে পরিণত করে নি, সেই অচিন্ত্যনীয় বিষয় নিয়েও চিন্তা কিভাবে ভাবে সেইসব কিছুই বিষয়বিদ্যার অন্তর্গত। আসলে একালে দর্শনেরই আরেক নাম বিষয়বিদ্যা।

এই বিষয়বিদ্যা বা বিষয়বিজ্ঞানেরই আমরা হদিস নিতে চাই। এই বিজ্ঞান গড়ে ওঠার পেছনে বিজ্ঞানের পরিমণ্ডলে কিম্বা বিস্তৃত অর্থে চিন্তার জগতে যে পরিস্থিতি বিদ্যমান ছিল তার কিছু খোঁজখবর নেওয়া যাক।

প্রকৃতি বিজ্ঞান ও তার দৃষ্টিভঙ্গীর আধিপত্য

আধুনিক বিজ্ঞানের আবির্ভাবকাল মোটামুটি ১৬ থেকে ১৭ শতকের মধ্যে ধরা হয়।

অর্থাৎ সেই সময় যখন গণিত, পদার্থবিজ্ঞান, জ্যোতিষবিজ্ঞান, প্রাণবিজ্ঞান, চিকিৎসা শাস্ত্র, রসায়ন শাস্ত্র ইত্যাদি নানান দিক থেকে প্রকৃতিকে প্রত্যক্ষ ভাবে জানবার তীব্র তাগিদের শুরু। সাধারণ ভাবে এই সকল বিজ্ঞানকে এক নামে ‘প্রকৃতি বিজ্ঞান’ নামে অভিহিত করা হয়। বলাবাহুল্য, এতে বিজ্ঞান আর কৃৎকৌশলের ক্ষেত্রে শুধু বিপ্লব ঘটে নি, মানুষের চিন্তার জগতেও এক বিশাল বিপ্লব ঘটে যায়। আমাদের আলোচনার জন্য সেই দিকটাই বিশেষ গুরুত্বপূর্ণ। সে বিপ্লবের সার কথা হচ্ছে মানুষের ইন্দ্রিয়গ্রাহ্য বা প্রত্যক্ষ বিষয়ই কেবল সত্য।

যা আমাদের অভিজ্ঞতার বাইরে, তার সত্যাসত্য নির্ণয় অসম্ভব। অর্থাৎ যে সব বিষয়কে আমরা ওপরে বস্তুপদার্থের তালিকায় ফেলেছি তাদের ইন্দ্রিয়প্রত্যক্ষ ভাবে দেখে ও জেনে যে বিজ্ঞান গড়ে উঠেছে সেই বিজ্ঞানই সত্যের একমাত্র হকদার হয়ে ওঠে। সেই সত্যকে জানবার জন্য প্রকৃতি বিজ্ঞানের হাতে যে যুক্তি ও বুদ্ধির অভ্যাস গড়ে উঠেছে এবং তার সঙ্গে সঙ্গতিপূর্ণ পদ্ধতি ও প্রকরণ – সেই সবই সত্য নির্ণয়ের একমাত্র পদ্ধতি বা বৈজ্ঞানিক পদ্ধতি বলে স্বীকৃতি পেতে পারে। ইউক্লিডের জ্যামিতি, নিউটনের পদার্থ বিজ্ঞান ও ফ্রান্সিস বেকনের বৈজ্ঞানিক পদ্ধতির সূত্র ধরে যে বিজ্ঞানচিন্তার উদ্ভব ঘটেছিল তা এই সময় আরও বিকশিত হোল।

কিভাবে আমরা সার্বজনীন ও অনস্বীকার্য সত্য জানি সেটা ১৭ শতকের শেষে ইম্মেনুয়েল কাণ্ট (১৭২৪ – ১৮০৪) আমাদের যুক্তি দিয়ে বোঝাতে চাইলেন।

সেটা করতে গিয়ে দেখালেন, জ্ঞানকর্তা হিসাবে এই জগৎ আমাদের জ্ঞানের বিষয় বটে, তবে এই জগতকে যেভাবে আমরা আমাদের বাইরে আছে বলে জানি তা পুরোটা ঠিক না। যখনই আমরা কিছু ‘জানি’ বলে দাবি করি, সেটা জ্ঞানপ্রক্রিয়ার মধ্য দিয়ে গঠিত হয়ে ওঠা সত্য। সেই জানার প্রক্রিয়ায় আমরা আমাদের যুক্তি বা বুদ্ধি থেকেও এমন কিছু উপাদান বা শর্ত যোগ করি যা আমাদের বাইরের জিনিস নয় -- যে বিষয় জানছি তার মধ্যে সেই উপাদান বা শর্ত নাই বা থাকে না। বরং সেইসব আমাদের বিশুদ্ধ বুদ্ধির দেওয়া বা বুদ্ধির দ্বারা আরোপিত। যেমন বস্তুকে যখন আমরা প্রত্যক্ষ ভাবে উপলব্ধি করি তখন তাকে বিশেষ সময়ে বা বিশেষ কালে উপলব্ধি করি।

আমার সামনে এখন আমি একটি বই দেখছি, জানাল দিয়ে গাছ দেখছি, গাড়ি দেখছি। এই সবই বিশেষ সময়ে এবং বিশেষ কালে আছে। কিন্ত এই বিশেষ সময় বা কাল তাদের গুণের অন্তর্ভূক্ত নয়। যে অর্থে আমার বইয়ের প্রচ্ছদ নীল, বইটি কাগজ ও কালি দিয়ে ছাপা। যে গাছ আমি দেখছি সেটা সবুজ, তার পাতা আছে, কাণ্ড আছে।

যে গাড়ি দেখছি তার চাকা আছে, সামনে হেড লাইট আছে। বই, গাছ বা গাড়ীর বিভিন্ন বৈশিষ্ট বা গুণকে বই, গাছ বা গাড়ির গুণ বলতে পারছি, বলতে পারছি যে তাদের মধ্যেই এই বৈশিষ্ট বা গুণগুলো ‘আছে’। কিন্তু ঠিক একই ভাবে বলতে পারছি না যে-সময় আর যে-জায়গায় তারা আছে সেই সময় ও জায়গাও তাদের গুণ, তাদের গুণের অন্তর্গত। দেশ ও কাল বস্তুর বৈশিষ্ট বা গুণের অন্তর্গত নয়। কান্ট বলছেন, জানার প্রক্রিয়ায় আমাদের বুদ্ধি এইসব বাইরের অস্তিত্বমান সত্তার ওপর আরোপ করে।

এই আরোপন সেই সকল সত্তাকে জানার শর্ত।

অর্থাৎ দেশ বা কাল বস্তুর গুণ নয়, সেটা আমরা আমাদের বিশুদ্ধ বুদ্ধি থেকেই আরোপ করি। দেশকালের শর্ত ছাড়া আমাদের পক্ষে কোন বস্তু উপলব্ধি করা অসম্ভব। কোন কিছুর উপলব্ধি করার অর্থ তাকে বিশেষ দেশকালে উপলব্ধি করা। কিন্তু তার পরেও আমরা ততোটুকুই জানি জগত যতোটুকু আমাদের কাছে ধরা দেয় (phenomenon) , আর, তার বিপরীতে, অধরা (noumenon) থেকে যায় আরেক জগত।

গ্রিক ভাষায় আদিতে ‘ফেনমেনা আর ‘নুমেনা’ বলতে ঠিক যা বোঝাতো কান্টের ব্যবহারে তার অর্থভেদ ঘটেছে বলে অনেক দার্শনিক সমালোচনা করেছেন। আরেকজন জর্মন দার্শনিক শোপেনহাওয়ারেরও সমালোচনা আছে কাণ্টের এই ব্যবহারে। কান্ট নিজের পরিভাষাও ব্যবহার করেছেন। জ্ঞানকর্তার কাছে যে সত্যপদার্থ ধরা দিল তাকে কান্ট বললেন thing for itself বা জ্ঞানকর্তার কাছে ধরা দেওয়া বস্তুপদার্থ। , আর জ্ঞানকর্তার বাইরে যে বস্তু নিজের মতোই রয়ে গেল তাকে বললেন thing in itself ।



কান্ট দেখাতে চেয়েছিলেন ইউক্লিডিয় জ্যামিতি, গণিত আর নিউটনীয় বিজ্ঞানের মধ্য দিয়ে বিজ্ঞান যা জানে তা কেন সার্বজনীন ও অনস্বীকার্য সত্য হয়ে আমাদের কাছে হাজির হয়। সেটা দেখাতে গিয়ে তিনি প্রমাণ করতে চেয়েছিলেন মানুষ সার্বজনীন ও অনস্বীকার্য সত্য জানতে সক্ষম। কিন্তু ততোটুকুই জগত আমাদের কাছে ধরা দেয় যতোটুকু তা জ্ঞানকর্তা হিসাবে আমাদের বুদ্ধির কাছে ধরা পড়ে – এই ধারণার ফাঁক দিয়ে দর্শনে নানান ভাবাদর্শিক ধারার উদ্ভব ঘটে। যেমন, জগত সম্পর্কে আমরা পুরাপুরি জানতে পারি না। বুদ্ধির ক্ষমতা কিম্বা মানুষের জ্ঞানের ক্ষমতা সীমিত।

অতএব বুদ্ধি ও যৌক্তিক বিচারের ওপর ভিত্তি করে সত্যের নির্ণয় সম্ভব নয়। এ ধরণের নানান সংশয়বাদ এবং একই সঙ্গে নানান মিস্টিক বা মরমি চিন্তাভাবনার প্রাবল্য দেখা দেয়। আমাদের আলোচনার জন্য সেইসব গুরুত্বপূর্ণ নয়। মিস্টিসিজম বা মরমিবাদ বলতে বাংলাদেশে আমরা যে সকল চিন্তাভাবনা দেখি যদি তাদের সিরিয়াসলি নিতে চাই তো দেখব যে তাদের প্রত্যেকটির গোড়াতেই এই অনুমান কাজ করে। যেমন, দুনিয়ায় এমন অনেক কিছুই আছে যা কখনই বুদ্ধির কাছে ধরা পড়ে না।

তারা রহস্য হয়েই থেকে যায়।

মিস্টিসিজম, রহস্যবাদ, সংশয়বাদ বা কোন প্রকার মরমি ভাবনার দ্বারা আমরা এখানে তাড়িত নই। আমরা যে দর্শন বা ভাবুকতা নিয়ে আলোচনা করছি, তার চরিত্র ভিন্ন। আমরা আলোচনার ফাঁকফোকরে ‘নদিয়ার ভাব’ নিয়ে দুই একটি কথাও বলছি ও বলব। নদিয়ার ভাবের মধ্যে কোন ধরণের মিস্টিসিজম, সংশয় বা মরমিবাদ নাই।

অবশ্য থাকবার কথাও নয়। কারণ নদিয়ার ভাব – যার শিরোমণি লালন – তিনি কান্টের মতো বুদ্ধির বিচার দিয়ে সত্য নির্ণয় জরুরী গণ্য করেন না। শুরুও করেন না। কারণ বুদ্ধিকে ইহলোকে হাজির থাকতে হলে আগে ‘দেহ’ হয়ে বর্তমান থাকতে হয়। এটাই ‘মহাজনের পুঁজি’, সত্য নির্ণয়ের আগেই সত্য অন্বেষণের উপায় হিসাবে দেহ প্রদত্ত।

মুশকিল হচ্ছে বাংলাদেশের শিক্ষিত শ্রেণি যেহেতু দেহকে যৌনতার যন্ত্র ছাড়া আর কিছু এখনও ভাবতে অক্ষম, ফলে নদিয়ার ভাববিজ্ঞান তাদের কাছে এখনও অস্পষ্ট। তারা বাংলার সাধনা বা জ্ঞানচর্চার ধারাকে এখনও উদাসী থাকা, বাউলিয়ানা, ফকিরী ও নানান গুহ্যবিদ্যার ক্ষেত্র বলে মনে করে। বাংলা ভাষায় দর্শন বা ভাবচর্চার ধারা অবিকশিত থাকার পেছনে চিন্তার এই বিকৃতি বিরাট অন্তরায় হয়ে আছে। ফলে এখানে যে ‘অধরা’র কথা বললাম তাকে মিস্টেরিয়াস কিছু ভাবার দরকার নাই। তবে জ্ঞানকর্তার বাইরে যে জগৎ অধরা হয়ে থেকে যায় তার সঙ্গে বাংলার ভাবচর্চার যোগসূত্র কোথায় তা সামনের কোন কিস্তিতে আমরা ব্যাখ্যা করবার চেষ্টা করব।



প্রসঙ্গক্রমে উল্লেখ করা রাখা দরকার কাণ্ট দ্বারা প্ররোচিত মিস্টিসিজম, রহস্যবাদ, সংশয়বাদ বা যে কোন প্রকার মরমি ভাবনাকে ভ্লাদিমির ইলিচ লেনিন যখন বিপ্লবী রাজনীতির দিক থেকে প্রতিক্রিয়াশীল দর্শন বলে আখ্যায়িত করেছিলেন তখন সেটা দর্শনের ওপর তাঁর তীক্ষ্ণ নজরদারির প্রমাণ হয়ে ইতিহাসে থেকে গিয়েছে। এই নজরদারি ছাড়া কোন প্রকার বৈপ্লবিক সাফল্য অসম্ভবও বটে। লেনিন বৈপ্লবিক কর্তব্য নির্ধারণের দিক থেকে জ্ঞানের বাইরে অধরা বা অজানা হয়ে অপর একটি জগতের থেকে যাওয়ার ধারণার মধ্যে সমূহ বিপদ শনাক্ত করেছিলেন। তর্কের বিষয় হিসাবে পুরানা হয়ে যাওয়া সত্ত্বেও নব্য কাণ্টবাদীদের বিরুদ্ধে তাঁর অসামান্য গ্রন্থ Materialism and Empirico-Criticism: Critical Comment on Reactionery Philosophy এখনও চিন্তাশীলদের জন্য সোনার খনি হয়ে আছে।

কাণ্ট যে সমস্যা তৈরী করেছিলেন তার একদিকে রয়েছে ফরাসী দার্শনিক রেনে দেকার্তের চিন্তার জের।

একদিকে আছে চিন্তাশীল মানুষ (Subject) বা বিষয়ী আর অন্যদিকে জগত বা জ্ঞানের বিষয় (Object)। আর, দর্শনের ভিত্তিদাতা প্রশ্ন হচ্ছে বিষয়ী যে-বিষয়কে নিশ্চিত ভাবে জানতে চাইছে সেই নিশ্চিত জ্ঞানের গ্যারান্টি কি? আর এখান থেকেই উৎপত্তি ঘটছে কোন কিছু ‘আছে’ নাকি ‘নাই’ এই প্রশ্ন মীমাংসার তাগিদ।

এই দেকার্তীয় জের ছাড়াও অন্যদিকে রয়েছে কান্টের নিজের তৈরী সমস্যা। আসলে জগত কি এই ভাবে ধরা আর অধরা হয়েই মানুষের কাছে বিরাজ করে, নাকি জগত এক ও অখণ্ড আর মানুষ তার অন্তর্গত অংশ, বাইরের নয়। যাকে আমরা মানুষের চিন্তা বলি সে নিজেই হয়তো এই অখণ্ড জগতেরই শক্তি – সেই পরমার্থ (Idea) যে নিজেই এই মুহূর্তে জগত আর পরের মুহূর্তে চিন্তা হয়ে পরস্পর পরস্পরকে অর্থ প্রদান করতে করতে এক পর্যায়ে পরমার্থ (Absolute) হয়ে উঠছে।

এভাবেই কান্টের তৈয়ার করা পাটাতনের ওপর জর্মন দেশে এক শক্তিশালী ভাববাদী দার্শনিক ধারা (speculative Philosophy) তৈয়ার হয়।

বিজ্ঞান ও কৃৎকৌশলের প্রবল বিকাশের ফলে ১৯ শতকের শেষ পর্যায় থেকে ভাববাদিতার প্রাধান্য কমতে থাকে। অনেক ক্ষেত্রে দর্শনের কাছে তার গুরুত্ব গৌণ কিম্বা অর্থহীন হয়ে পড়ে। এই পরিস্থিতিতে ১৯ শতকের শেষ পর্যায় থেকে বিষয়বিজ্ঞানের গবেষণা জোরদার হয়ে ওঠে। প্রকৃতি বিজ্ঞানের পদ্ধতি ও প্রকরণের ক্ষেত্রেও পরিবর্তন ঘটতে শুইরু করে।

সামগ্রিক ভাবে বিজ্ঞানের পদ্ধতি ও প্রকরণের ক্ষেত্রে পরিবর্তনের কারণে বিষয়বিদ্যার অন্বেষণের ক্ষেত্র চিহ্নিত করবার শর্ত তৈরী হয় । বিজ্ঞানের পদ্ধতি ও প্রকরণে পরিবর্তন শুধু বিজ্ঞানকেই বদলে দেয় না, একই সঙ্গে দর্শনেরও বদল ঘটায়।

বিজ্ঞান চর্চার ক্ষেত্রে একটি ধারা শুরু হয়। সেটা হোল, প্রতিটি বিজ্ঞান যে বিষয় নিয়ে গবেষণা করছে সেই বিষয়কে সুস্পষ্ট ও আলাদা করা। একে অনেক সময় বলা হয় চিন্তার বিভক্তি ও বিভাজন।

পদার্থ বিজ্ঞানের বিষয় আর উদ্ভিদ বিজ্ঞানের বিষয় এক নয়, তাদের গবেষণার ক্ষেত্র পরস্পরের কাছে স্পষ্ট থাকা দরকার। একই ভাবে গণিত ও জ্যামিতি, রসায়ন শাস্ত্র, চিকিৎসা শাস্ত্র ইত্যাদি তাদের নিজ নিজ জ্ঞানের ক্ষেত্র বা বিষয়কে সুনির্দিষ্ট করতে শুরু করে। ধর্মতত্ত্বও নিজের জায়গা সুরক্ষিত করবার চেষ্টা করে। নিজের ক্ষেত্র নিজেকে সুনির্দিষ্ট ভাবে চিহ্নিত করবার দায় ও তাগিদ দর্শনের ঘাড়েও এসে পড়ে। শুধু ভাবুকতা বা চিন্তাশীলতার দ্বারা দর্শন নিজের ন্যাযতা প্রতিষ্ঠা করতে পারে না।

কারণ প্রতিটি বিজ্ঞানের মধ্যেই চিন্তা সক্রিয় এবং তারা চিন্তা নিয়েই কারবার করে। তাহলে ‘দর্শন’ ডাকনামে চিন্তা আলাদা ভাবে যে বিষয়গুলো চিন্তা করে তাকে সুনির্দিষ্ট করা প্রয়োজন। দর্শনের বিষয় আসলে কী, সেটা একটি গুরুতর দার্শনিক প্রশ্ন হয়ে ওঠে।

জ্ঞানের জন্য ভালবাসা থেকে পাশ্চাত্যে দর্শনের উৎপত্তি। গ্রিক ‘ফিলসফিয়া’র অর্থ তো সেটাই।

আধুনিক কালে সেটাই পরিণত হয়েছে নিশ্চিত জ্ঞানের তাগিদে, সেই তাগিদ থেকে বিভিন্ন বিজ্ঞানের জন্ম। এই নতুন পরিস্থিতিতে দর্শনকেও বিজ্ঞানের নিশ্চিত জ্ঞান অন্বেষণের পদ্ধতি ও প্রকরণ মেনে নিয়ে নিজেকে চিন্তাচর্চার আরেকটি ন্যায্য ক্ষেত্র হিসাবে প্রতিষ্ঠিত হতে হবে। তাকেও হতে হবে বিজ্ঞান। এই দাবি ও তাগিদের মুখে দর্শন নিজের জন্য যে ক্ষেত্র বেছে নিলো সেটা হচ্ছে বিজ্ঞানের তাত্ত্বিক ভিত্তিকে স্পষ্ট করবার কাজ বা বিজ্ঞানের অন্তর্গত চিন্তার প্রক্রিয়া বা তার অন্তর্নিহিত লজিক স্পষ্ট করে তোলার কর্তব্য।

এই কাজটি করতে গিয়ে দর্শনের প্রধান ধারা ভাববাদিতায় ফিরে গেল না।

বা ভাববাদ/বস্তুবাদের নিস্ফল বিতর্কে সময় নষ্ট করলো না। বরং ফিরে গেলো কান্টের কাছেই। কাণ্টের দর্শন নিশ্চয়ই দর্শনের শেষ কথা নয়, কিন্তু দর্শনের ক্ষেত্র আসলে কী হতে পারে সেটা কান্টই প্রথম সবচেয়ে স্পষ্ট হাজির করতে পেরেছেন। অন্যদিকে তার মধ্যে পাশ্চাত্য দর্শনের ঐতিহ্যের একটা ধারাবাহিকতাও দার্শনিকরা সহজে ধরতে পারেন। দর্শনের প্রশ্ন কি হওয়া উচিত সে জটিল ক্ষেত্রগুলোর সীমানা যেমন কাণ্টে স্পষ্ট তেমনি দর্শনের প্রশ্ন তুলবার ধরণ ও প্রকরণও তাঁর হাতে অনেক পরিচ্ছন্ন।

কাণ্টকে আশ্রয় করে দর্শন বিজ্ঞানের অন্যান্য শাখার বিপরীতে নিজের গবেষণা ও চর্চার জায়গা নির্দিষ্ট করতে চেষ্টা করেছে। সেটা ১৯ শতকের শেষ দিকে।

সে সময়ে বিজ্ঞানের সামগ্রিক পরিস্থিতি কেমন ছিল তার একটা ধারনা থাকা দরকার। তবে এখানে বিজ্ঞানের বিবর্তন বা ইতিহাস ব্যাখ্যা করার সুযোগ হবে না। আমাদের আলোচনার জন্য সেই পরস্থিতিকে এক কথায় বুঝাতে হলে বলা যায় বিজ্ঞানের কাছে কোন কিছু প্রত্যক্ষ পরীক্ষা নিরীক্ষার মাধ্যমে যাচাইবাছাই না হলে ‘সত্য’ বলে বিবেচিত নয়, এই ধারণা এই সময়েই সবচেয়ে শক্ত ভাবে দানা বাঁধে।

মনে রাখা দরকা্র, ‘সত্য’ দর্শনেরও অন্বিষ্ট, এবং ধর্মেরও বটে। ধর্মচিন্তা আবার চিন্তারই একটি ধরণ, ফলে আমাদের আলোচনার জন্য এ পর্যায়ে কোন বিশেষ ধরণের চিন্তাকে বিশেষ রূপে আলাদা করার দরকার নাই। ধর্মের চিন্তা, দর্শনের চিন্তা বা বিজ্ঞানের চিন্তার মর্ম কিম্বা রূপের মধ্যে ভিন্নতা থাকলেও তাদের আলাদা আলাদা না করে তাদের চিন্তার ইতিহাসের মধ্যেই অন্তর্ভুক্ত বলে ধরে নেওয়াই সঙ্গত।

বিজ্ঞান ‘সত্য’ বলতে কী বোঝাতে চায়? সত্য বলতে বোঝানো হয় কোন কিছুর সঠিকতা নিরূপন (empirical facts)। প্রত্যক্ষ পরীক্ষানিরীক্ষার মধ্য দিয়ে যা নির্ণয় করা হয়।

তুলনায় দর্শনের কাছে সত্যের ধারণা এতো সাদা বা সিধা নয়। যা প্রমাণ করা যায় না, বা যার প্রমাণ প্রত্যক্ষ পরীক্ষানিরীক্ষা দ্বারা নিশ্চিত করবার বিষয় নয়, তার সত্যতা নির্ণয়ের পদ্ধতি কি হবে? কিন্তু ভাবাদর্শিতার নানান পথ ও প্রকরণের ক্ষয়ের ফলে পাশ্চাত্য চিন্তাকে এই বিজ্ঞানচিন্তার পথেই আসতে হয়েছে। অনুসরণ করতে হয়েছে প্রকৃতি বিজ্ঞানের পদ্ধতি ও প্রকরণের। দর্শনের কাছে তার নিজের বিষয়কে শনাক্ত করা ও নিজের পদ্ধতি ও প্রকরণ সুনির্দিষ্ট করাও কঠিন হয়ে উঠল।

আসলে মুশকিল বাঁধল অন্যত্র।

মানুষের জগত তো শুধু বস্তু পদার্থ দিয়ে গঠিত নয়। তার বাইরে আরও অনেক ‘বিষয়’ আছে। তার বিচার কিভাবে হবে? এই মুশকিল আসানের জন্য ‘প্রকৃতি’ বিজ্ঞানের বিপরীতে ‘ইতিহাস’ বিজ্ঞান হিসাবে বিজ্ঞানের বাইরের বিষয়গুলোর অন্বেষণ চলতে থাকল। ফলে মোটা দাগের একটি বিভাজন ঘটল। একদিকে ‘প্রকৃতি’ অন্য দিকে মানুষের ‘ইতিহাস’।

‘প্রকৃতি’ আর ‘ইতিহাস’ উভয়ের পথ চলা শুরু হোল পরস্পরের মধ্যে দূরত্ব বজায় রেখে এবং ভিন্ন পথে। পদ্ধতি ও প্রকরণের পার্থক্য দেখা দিল। কিন্তু বিজ্ঞানের প্রবল প্রতাপের ফলে সামগ্রিক ভাবে যে দৃষ্টিভঙ্গী গড়ে উঠল তাকে বলা যায় প্রকৃতি বিজ্ঞানের বিশ্ব দৃষ্টিভঙ্গী। ইতিহাস বিচারের ক্ষেত্রেও এই দৃষ্টিভঙ্গীর আধিপত্য বাড়তে লাগল। মার্কসবাদ নামে দর্শনের যে ধারার সঙ্গে আমরা পরিচিত তার ‘দৃষ্টিভঙ্গী’ বা দর্শনের গোড়ায় রয়েছে উনিশ শতকে গড়ে ওঠা প্রকৃতি বিজ্ঞানের দৃষ্টিভঙ্গী।

প্রকৃতি বিজ্ঞানের পদ্ধতি ও প্রকরণ অনুকরণ করে কিম্বা তাদের আবিষ্কারের সফলতা থেকে শিক্ষা গ্রহণ করে মানুষের ইতিহাসের মধ্যেও প্রকৃতির নিয়মের মতো ইতিহাসের ‘নিয়ম’ আবিষ্কার দর্শনের একটি ধারা হয়ে উঠল। অন্যদিকে মানুষের চিত্তবৃত্তির ইতিহাস সীমিত হয়ে পড়ল গ্যয়েটে বা লেসিং-এর মতো চিন্তাশীলদের পরিমণ্ডলে। এইসব নজরে রেখেও চিন্তা বা দর্শনের জন্য যে দিকটা গুরুত্বপূর্ণ হয়ে উঠল সেটা হচ্ছে, সঠিকতার প্রতি ঝোঁক। ঠিকবেঠিক যাচাইয়ের তাগিদ। এই সারমর্মটা সহজে করা যায়।



বিজ্ঞান নাহয় ঠিকবেঠিক তার পরীক্ষানিরীক্ষা দ্বারা ঠিক করলো, কিন্তু যাঁরা ইতিহাস লিখছিলেন তারা তাদের ‘সত্য’ প্রমাণ করবেন কিভাবে? কিভাবে তারা তাদের দাবির ঠিকবেঠিক প্রমান করবেন? প্রকৃতি বিজ্ঞানের দৃষ্টিভঙ্গির আধিপত্যে সেটা তাঁদের করতে হয়েছে তথ্যের সূত্র ও সেই সূত্রের নিশ্চয়তা উল্লেখ করে। সে সূত্র করায়ত্ব করা বা সেইসব সূত্র উদ্ঘাটনের মধ্য দিয়ে তারা দেখাতে চাইলেন তারাও বিজ্ঞানের মতোই সত্যচর্চা করছেন। অর্থাৎ সূত্র নিশ্চিত করা ও তা প্রদর্শন করা ইতিহাসের পদ্ধতি ও প্রকরণের গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হয়ে উঠল। অন্যদিকে আবার, উদ্ঘাটিত সূত্র সত্য কিনা সেই প্রশ্ন আরেক মুশকিল তৈরী করল। তাঁরা যে ‘ইতিহাস’ লিখছেন তাকে তারা ‘সত্য ঘটনা বা ফ্যাক্টস বলে দাবি করছেন; কিন্তু সেটা যে ঘটনার একটি বয়ান মাত্র, ভিন্ন বয়ানও সম্ভব, সেটা সব সময় স্পষ্ট থাকে না।

ঐতিহাসিকদের ঘটনা প্রমাণ প্রদর্শণ বা তথ্যের সূত্র আবিষ্কার বৈজ্ঞানিক আবিষ্কারের সমতুল্য হয়ে উঠল, কিন্তু তাঁরা যা লিখছিলেন তা ছিল তাদের নিজ নিজ ইচ্ছা ও পছন্দ অনুযায়ী ঘটনার বিচার বিশ্লেষণ। অনেক সময় সেটা ছিল তাদের রাজনৈতিক দৃষ্টিভঙ্গীর অভিপ্রকাশ। ইতিহাসও হয়ে উঠেছিল রাজনীতির ইতিহাস। তার পাশাপাশি দেখা যায় ইতিহাস ব্যখ্যা হয়ে উঠেছে সংস্কৃতির ব্যাখ্যা। এক সময় এমন তর্কও উঠলো ইতিহাস কি আসলে সামগ্রিক অর্থে সংস্কৃতির ইতিহাস হবে, নাকি সীমিত থাকবে শুধু রাজনীতির ইতিহাসে? এখন অবশ্য সমাজ, অর্থনীতি, সংস্কৃতি সব কিছুই ইতিহাসের অন্তর্গত।

এবং তার সত্যাসত্য নির্ণয়ের মানদণ্ড হচ্ছে ঐতিহাসিক সত্যের উৎসের নিশ্চয়তা।

সে যাই হোক, সারকথা হচ্ছে, বৈজ্ঞানিক দৃষ্টিভঙ্গির ভিত্তিতে ইতিহাস ‘ফ্যাক্টস’-এর কারবারী বা কখন কি ঘটেছিল সেই সত্যসত্য যাচাইয়ের বিজ্ঞান হয়ে উঠতে চাইল। ইতিহাসের এভাবে বৈজ্ঞানিক হয়ে ওঠার আকুতি এখনও কোন অংশে কম নাই।

উনিশ শতকের শেষের দিকে প্রকৃতি বিজ্ঞান গ্যালিলিও ও নিউটনের পদ্ধতি ও প্রকরণের দ্বারা বিপুল ভাবে প্রভাবিত ছিল। একই পদ্ধতি ও প্রকরণ প্রাণবিজ্ঞান, কিম্বা শরীর বিজ্ঞানেও প্রয়োগ হতে থাকল।

জীব ও মানুষের শরীর নিয়ে সেই সময়ের বৈজ্ঞানিক ধ্যানধারণা নিয়ে পরীক্ষা নিরীক্ষার পথ ধরে একই বৈজ্ঞানিক দৃষ্টিভঙ্গী নিয়ে মানুষের মনোজগতকেও প্রকৃতি বিজ্ঞান তার গবেষণার অন্তর্ভূক্ত করল। ঠিক যেভাবে বিজ্ঞান বস্তুপদার্থকে নিয়ে পরীক্ষানিরীক্ষা করে, মানুষের মন ও চিন্তা প্রক্রিয়াও সেই ভাবে গবেষণার বিষয় হয়ে উঠল । প্রকৃতি বিজ্ঞানের দৃষ্টিভঙ্গীর বলয়ের মধ্যে এভাবেই আধুনিক মনোবিজ্ঞানের উৎপত্তি ঘটেছে। শুরুতে মনোবিজ্ঞানের বিষয় ছিল মানুষের ইন্দ্রিয়ানুভূ্তি কিভাবে ঘটে, মানুষের ইন্দ্রিয়োপলব্ধির প্রক্রিয়া কেমন, ইত্যাদি। মানুষের ইন্দ্রিয়ানুভূতি, ইন্দ্রিয়োপলব্ধি, ইন্দ্রিয়পরায়নতা ইত্যদি গবেষণার বিষয় হয়ে ওঠার অর্থ হছে এইসবকে প্রধানত শারীরীক জৈব প্রক্রিয়া হিসাবে বিচার করা।

মনোবিজ্ঞান মুলত ছিল শারিরীক প্রক্রিয়ার মধ্য দিয়ে মানুষের মন বা চিন্তার প্রক্রিয়া নির্ণয় করার চেষ্টা।

এখানে মনে রাখা দরকার ফরাসি দার্শনিক রেনে দেকার্তের চিন্তার জের ধরে ব্রিটিশ প্রত্যক্ষবাদের প্রভাবে মনোবিজ্ঞান হয়ে ওঠে চেতনার বিজ্ঞান। মানুষকে তার মন বা চেতনা থেকে বিচ্ছিন্ন বা আলাদা করে চিন্তা করার ধারণাটাই ছিল অস্বাভাবিক একটি ধারণা। শরীর আর মনের সম্পর্ক নিয়ে দার্শনিক তর্ক অনেক পুরানা। গ্রিক দর্শনেও দেখা যায় মানুষকে সমগ্র ভাবে গণ্য করা হয়েছে বা অখণ্ড সত্তা হিসাবেই প্রধানত বিবেচনা করা হয়েছে।

যাকে আমরা এখন মনোবৃত্তি বলি, কিম্বা অতি সহজে ‘মন’ বলে চিহ্নিত করতে পারি, তাকে এভাবে শরীর থেকে আলাদা ভাবে শনাক্ত করবার অভ্যাস খুবই সম্প্রতিকালের। রেনে দেকার্তের সময় থেকে শুরু। মানুষের চেতনা বা বুদ্ধিবৃত্তি এই শরীরেরই সামগ্রিক প্রতিভা। মানুষের চিন্তা চেতনাকেও সেই ভাবেই গ্রিক দর্শনে বিবেচনা করে হোত। মনোবিজ্ঞান বললে সেটাই বোঝাতো।

শরীরের ভেতরে কোথাও ঘুপটি মেরে থাকা ব্যাপার অথচ মানুষের শরীর থেকে আলাদা কোন মনের বা কোন বুদ্ধির কায়কারবার মনে করত না। ‘আমি ভাবছি, তাই আমি আছি’ এই কথার ওপর দাঁড়িয়ে দেকার্তে জ্ঞানকর্তা হিসাবে চিন্তাকে ‘আমি’ হিসাবে শনাক্ত করলেন। এই ‘আমি’ শরীর থেকে আলাদা এবং তার অস্তিত্বের নিশ্চয়তার ওপর শরীরের অস্তিত্বের নিশ্চয়তাকে দেকার্তে শর্তসাপেক্ষ করলেন। এই আমির অস্তিত্বেরও মধ্য দিয়ে বিশ্ব জগতের অস্তিত্বের সম্বন্ধ ঘটালেন। এই ভাবে মানুষের মনোজগতকেও যেভাবে শরীর থেকে আলাদা করলেন সেটা পাশ্চাত্য চিন্তার জগতে বিশাল একটি ঘটনা।

ফলে দর্শনেরও।

এই বিভাজনের ধারা থেকে বেরিয়ে আসবার প্রচেষ্টা হিশাবে কিভাবে পাশ্চাত্য দর্শন নিজেকে বিষয়বিজ্ঞান বা বিষয়বিদ্যা হিশাবে গড়ে তুলল ও উপস্থিত করল তার পেছনের ইতিহাস সম্পর্কে কিছুটা ধারণা না নিলে আমরা যে ‘তিন’ নিয়ে কথা শুরু করতে চাইছি তা অর্থপূর্ণ হবে না। অন্যদিকে চিন্তাকে খামাখা ভাববাদ/বস্তুবাদ নামক দুই খাপের মধ্যে ফেলে দিলে সেটাও সময়ের অপচয় হবে। অন্যদিকে দর্শন বিষয়বিদ্যা হিসাবে কেন এবং কিভাবে গঠিত হয়ে উঠেছে সেটাও আমরা বুঝবোনা। আমাদের সামনের কিস্তির আলোচনার জন্য এতোটুকু বুঝলেই যথেষ্ট যে শরীর থেকে আলাদা সত্তা বা জগৎ হিসাবে মনের আবির্ভাব ঘটার ঘটনা সাম্প্রতিক।

প্রকৃতি বিজ্ঞানের দৃষ্টিভঙ্গী নিয়ে এই মনকে বুঝতে গিয়েই মনোবিজ্ঞান গড়ে উঠেছে। শুরুতে এই বিজ্ঞানের পক্ষে শরীরবৃত্তীয় মনস্তত্ত্ব (Physiological Psychology) ছাড়া অন্য কোন কিছু হওয়া অসম্ভব ছিল। এতোটুকু বুঝতে পারলে আমরা বুঝতে পারব কিভাবে মনোবিজ্ঞান চেতনা বা চিন্তাকে বস্তুপদার্থ হিসাবে জানতে ও বুঝতে চেষ্টা করেছে। সেই চেষ্টার সীমাবদ্ধতা ও ব্যর্থতার হাত ধরেই চেতনা বা চিন্তার বিজ্ঞান হিসাবে বিষয়বিদ্যা একালে নিজেকে প্রতিষ্ঠিত করেছে।

আসলে প্রকৃতি বিজ্ঞানের পদ্ধতি ও প্রকরণ নিয়ে চিন্তা বা চেতনাকে বুঝতে পারবার চেষ্টার মধ্য দিয়ে প্রকৃতিবিজ্ঞান আসলে দর্শনের ক্ষেত্রেই প্রবেশ করা শুরু করেছিল উনিশ শতকে।

এরপর আমরা দেখব কিভাবে মনোবিজ্ঞান থেকে ‘বিষয়বিদ্যা’-কে একালে দর্শনের মূল ধারা হিসাবে ফ্রানৎস ব্রেনতানো ও এডমুণ্ড হুসার্ল গড়ে তুলেছেন। তাদের চাষ করা জমিতেই মার্টিন হেইডেগারের জন্ম ও বিকাশ। যে তিনের কথা আমরা আগে উল্লেখ করেছি সেই তিন হচ্ছে দর্শনের ধারণা ও চর্চার মৌলিক রূপান্তর বোঝার চাবিকাঠি। যা কিছু ‘বিষয়’ আমাদের চেতনা ও চিন্তায় উদিত হয় – হোক তারা বস্তুপদার্থ, ভাবপদার্থ, রসপদার্থ বা অন্য কিছু – যা কিছুই তারা হোক তাদের জানা ও বোঝার বিজ্ঞান হিসাবে দর্শনের যে বিকাশ সেই ধারাটিকেই আমরা যথাসম্ভব পরিচ্ছন্ন ভাবে বুঝতে চাই বলেই এর পরের কিস্তিতেও আরও কিছু পেছনের কথা আমরা পেশ করব।
ফরহাদ মজহার।


অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।