আমাদের কথা খুঁজে নিন

   

ভাষার উৎপত্তি কীভাবে হলো

নানা পবিত্র ধর্মগ্রন্থে বলা হয়েছে, ভাষার সৃষ্টি করেছেন স্বয়ং বিধাতা। তবে ভাষার উদ্ভবের এই ঐশ্বরিক তত্ত্বের কোনো বৈজ্ঞানিক ভিত্তি নেই। ঊনবিংশ শতাব্দীতে ভাষার উৎপত্তি সম্পর্কে একের পর এক যতগুলো তত্ত্ব প্রবর্তিত হয়েছে, তাদের প্রত্যেকটিই ততটা স্বীকৃতি পায়নি। কেননা প্রত্যেকটির তত্ত্বের পেছনে যে শানে নুযুল দেখানো হয়েছে, তা কেমন যেন এলোমেলো। যেমন_ একটি তত্ত্ব ছিল যে, ধ্বনির অনুকরণ থেকেই ভাষার উৎপত্তি।

উদহারণস্বরূপ_ কুকুরের ডাক অনুকরণের মধ্য দিয়ে কুকুর বাচক শব্দের সৃষ্টি। এক্ষেত্রে বিরোধীরা কৌতুক করে এর নামকরণ করেছিলেন 'বৌ-ঔ, তত্ত্ব বা ভৌ-ভৌ তত্ত্ব। আরেক দল মনে করতেন, ভাষার আদিম রূপ হলো আবেগ বাচক ধ্বনি, ইংরেজিতে যাদের বলা হয় ওহঃবৎলবপঃরড়হধষ শব্দ, যেমন_ উঃ আঃ ইত্যাদি; যা হলো মানুষের প্রথম উচ্চারিত ধ্বনি এবং এরই বিকশিত রূপ ভাষা। আবার এক্ষেত্রে বিরোধী দল এটিকে ব্যঙ্গ করে নাম দিলেন পুঃ পুঃ তত্ত্ব। ঠিক এ ধরনের আরেকটি স্বভাব-তত্ত্বে উল্লেখ করা হয় যে, ধ্বনি আর অর্থের মধ্যে একটা গভীর সম্পর্ক আছে বিধায় বিভিন্ন ধ্বনির দ্বারাই আদিম যুগে বস্তুর নামকরণ করা হয়েছিল।

এক্ষেত্রে ধ্বনিগুলোর সঙ্গে বস্তুকে জুড়ে দিয়ে বিভিন্ন নাম দেওয়া হয়েছে। এর মধ্যে একটি হলো_ ডিং ডং (ঘণ্টা), তা ছাড়া এ ধরনের অনেক আছে। যাহোক, যে ঐতিহাসিক ভিত্তি ধরে ভাষার উদ্ভব হয়েছিল বলে উল্লেখ করা হয়, তার কোনো তথ্যাদি না থাকায় এ সংক্রান্ত অনুমানের বেশির ভাগই জল্পনা-কল্পনা জাতীয় এবং অনেক ক্ষেত্রে উদ্ভট। সৃষ্টির ক্ষেত্রে যারা দৈব উদ্ভবে বিশ্বাস করেন, তাদের অনুমানের যৌক্তিকতার ক্ষেত্রে বিশ্বাসযোগ্যতা নেই। তাই এটা নিয়ে দড়ি টানাটানি চলতে থাকে।

ভাষার উদ্ভব সম্বন্ধে এ ধরনের অনুমান বা কল্পনার সত্যতা ও মূল্যায়ন সম্বন্ধে গবেষকদের মনে সংশয় সৃষ্টি হয়েছিল বিধায় ১৮৭৮ সালে প্যারিসের ভাষাতত্ত্ব সমিতিতে (লা সোসিয়েতে লাঁগিস্তিক দ পারি) গণ্ডগোল বাঁধবে বলে কোনো এক অধিবেশেনে ভাষার উদ্ভব বিষয়ক কোনো প্রবন্ধ পাঠ না করার ব্যাপারে নির্দেশনামা জারি করা হয়। তবে ভাষার উদ্ভব সম্বন্ধে মানুষের প্রশ্নের উত্তরে কোনো সুনিশ্চিত তথ্য পাওয়া যাক বা না যাক, নিশ্চয় এক্ষেত্রে একটা সঙ্গত ও বিশ্বাস অনুমানের জায়গা আছে। এ রকমই একটি অনুমান করেছিলেন মি. হার্ডার। তিনি বলেন যে, ভাষার সৃষ্টি করেছে মানুষ, ঈশ্বর নয়। ব্যক্তি থেকে সমাজের সৃষ্টি এবং পরস্পরের সঙ্গে ভাবের বিনিময়ের জন্যই ভাষার উদ্ভব।

এদিকে মি. মার্কস একটি মজার কথা বলেছেন_ 'ব্যক্তিমানুষ একসঙ্গে বাস করছে না, পরস্পরের সঙ্গে কথা বলছে না, অথচ ভাষার জন্ম ও বিকাশ হচ্ছে। এটি অসম্ভব এবং যৌক্তিক নয়'। সেহেতু এ কথা বলতে দ্বিধা নেই যে সমাজ তৈরি না হলে মানুষের মধ্যে আদান-প্রদান বা ভাব বিনিময়ের সম্বন্ধ সৃষ্টি হতো না এবং সেহেতু ভাষার জন্ম সম্ভবপর ছিল না। প্রসঙ্গতক্রমে উল্লেখ্য, আজকের জগতে নিসর্গের এবং জীব-উদ্ভিদ-মানুষের সম্বন্ধের আবর্তে প্রতিদিন নতুন নতুন তত্ত্ব, তথ্য ও সত্যতা উদ্ঘাটিত হচ্ছে। আর মানুষের জীবন এখন বিজ্ঞান ও প্রযুক্তিনির্ভর।

তাই এ যন্ত্রনির্ভর জীবনে মানুষের মন-মনন-মনীষা প্রসূন বা পুষ্পসম্বলিত ভাষা, যা বিকশিত হচ্ছে বিভিন্নভাবে, চিকিৎসা ও পুষ্টিবিজ্ঞানসহ বিজ্ঞানের অন্যান্য শাখারও নব নব আবিষ্কার-উদ্ভাবন মানুষের মানসিক ও ব্যবহারিক জীবনের চিন্তা-চেতনা ও আচার-আচরণ একাধারে বিকাশ এবং যুগপৎ উৎকর্ষের, সৌকর্যের, বৈচিত্র্যের ও স্বাচ্ছন্দ্যের গুণে-মানে-মাপে-মাত্রায়-ঘন-ঘন রূপান্তর ঘটাচ্ছে এবং সবটাই পরিণামে নতুন নতুন শব্দে আশ্রিত হয়েই দাঁড়াচ্ছে অভিব্যক্তি স্বরূপ সাবলীল ভাষা। আদি সূত্রের সন্ধান না মিললেও প্রতিক্ষণে ভাষা নিঃশব্দে এ অবনীর ঘুম ভাঙায়, প্রকৃতিকে জাগায় এবং মানুষকে ভাবায়। তাই আজ সাড়ে সাতশত কোটি মানুষের ভাষায় মুখর হয়ে উঠেছে সারা বিশ্ব। কত না সুন্দর এবং কত না অনাবিল শান্তি, যা ভাষা বাহন হিসেবে এগিয়ে দিয়েছে, দিচ্ছে এবং আগামীতে দেবে।

সমুদ্রের তলদেশে অগণিত প্রবাল কীট তাদের আপন দেহের আবরণ মোচন করতে করতে কখনও এক সময়ে দ্বীপ বানিয়ে তোলে।

তেমনি, বহু সংখ্যক মন আপনার একান্ত অংশ দিয়ে গড়ে তুলেছে আপনার স্ব স্ব ভাষা দ্বীপ। এভাবে এক এক ভৌগোলিক ভূ-খণ্ডে বসবাসকারী জনগোষ্ঠীর ব্যবহৃত কথ্য বা উপভাষা থেকে সময়ের আবর্তে বিভিন্ন ভাষার উদ্ভব। উদাহরণস্বরূপ_ চীনের ভূ-খণ্ডে বসবাস করে যে জনগোষ্ঠী, তাদের ভাষা চাইনিজ। ফ্রান্সের অধিবাসীদের ভাষা ফরাসি। ঠিক তেমনই বাংলাদেশের অধিবাসীদের ভাষা 'বাংলা'।

এক্ষেত্রে একটা উদাহরণ দিলে স্পষ্ট হবে বলে প্রতীয়মান হয়। যেমন_ ১. কারও মুখ থেকে 'না' শুনলেই আমরা বুঝি যে লোকটা কথা বলছে বাংলায়, কেননা 'না' ধ্বনি বাংলা ভাষার শব্দ আর লোকটি যদি 'ঘড়' বলত তাহলে সঙ্গে সঙ্গেই ধরা যেত যে কথাটা ইংরেজি। কেননা বাংলায় 'ঘড়' বলে কোনো শব্দ নেই। আবার ফরাসি ভাষায় ওই কথাটা বুঝতে চাইলে বলতে হবে 'নঁ'। অথচ না, ঘড়, নঁ-এই তিনটি ধ্বনির মধ্যে পার্থক্য তো খুব বেশি নেই, আর অর্থ তো তিনটিরই এক।

তবু বাংলা ভাষীদের ঐ 'না' ধ্বনি বা শব্দটা বাংলা ভাষার শব্দ। আমরা বাঙালিরা যে ভাষায় কথা বলি, লিখি, স্বপ্ন দেখি, মনের ভাব প্রকাশ করি তার নাম বাংলা ভাষা। বাংলা ভাষা সম্পর্কে প্রদত্ত সংজ্ঞা যদি বিশ্লেষণ করি, তাহলে দেখি, বাঙালি সমাজে ব্যবহৃত 'মনের ভাব প্রকাশের জন্য বাগযন্ত্রের সাহায্যে উচ্চারিত ধ্বনির দ্বারা সম্পাদিত বা নিষ্পন্ন, যা স্বতন্ত্রভাবে অবস্থিত। আর এগুলো বাক্যে প্রযুক্ত শব্দসমষ্টির নাম বাংলা ভাষা। ' বাংলা ভাষা বাংলাদেশের বাইরে ভারতের পশ্চিমবঙ্গে, আসাম ও ত্রিপুরাসহ আরও কিছু কিছু জায়গায় প্রচলিত আছে।

পৃথিবীর প্রায় পঁচিশ কোটি লোক বাংলা ভাষায় কথা বলে। ভাষাভাষী জনসংখ্যার দিক থেকে বাংলাকে বিশ্বে চতুর্থ স্থানীয় ভাষা বলে মনে করা হয়। তাছাড়া প্রথম ভারতীয় রাজ্য হিসেবে বাংলাকে দ্বিতীয় রাষ্ট্রভাষা মর্যাদা দেওয়া হয়েছে ঝাড়খণ্ড এর দ্বিতীয় রাজ্য হিসেবে কর্নাটক। এদিকে পৃথিবীর স্বাধীন দেশ হিসেবে বাংলাকে সরকারি হিসেবে দ্বিতীয় রাষ্ট্রভাষা মর্যাদা দিয়েছে সিয়েরা লিয়ন। এর স্থান কেবল চাইনিজ, ইংরেজি, হিন্দি-উর্দু, স্প্যানিশ, আরবি ও পর্তুগিজের পরেই।

আর বাংলাই সম্ভবত পৃথিবীর একমাত্র ভাষা, যার জন্য বায়ান্নতে তরতাজা কতগুলো উঠতি বয়সী মানুষ (রফিক, শফিক, সালাম, জব্বার, বরকত, প্রমুখ) জীবন দিয়েছেন এবং এর প্রতি ভালোবাসা ও মর্যাদাবোধ থেকে একটি স্বাধীন রাষ্ট্রের জন্ম আমাদের এই লাল-সবুজের বাংলাদেশ। তাছাড়া ১৯৬১ সালের ১৯ মে ভারতের আওতাধীন আসামের শিলচরে ভাষার জন্য জীবন দানও প্রণিধানযোগ্য। _লেখক : প্রবন্ধকার।

 

অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।

প্রাসঙ্গিক আরো কথা
Related contents feature is in beta version.