আমাদের কথা খুঁজে নিন

   

অমর একুশ ও জাতির মননের প্রতীক

অমর একুশে ছিল ন্যায়ের পক্ষে, সুতরাং সত্যেরও পক্ষে। কিন্তু আমাদের নির্মোহ, তথ্যভিত্তিক সঠিক এবং সত্য ইতিহাস কি এখনো লেখা হয়েছে? না, হয়নি। সত্য কথা বললে কেউ যদি আহত হন, সেই ভয়ে বার বার বিকৃত বা খণ্ডিত বা অধসত্য বিবরণ রচিত হয়েছে। কোনো মানুষই ভুলের ওপর নয়। ভুলভ্রান্তি থাকলেই যেকোনো মানুষের কৃতিত্ব ও গৌরভ ম্লান হয়ে যাবে, এমনও নয়।

তাহলে একজন মানুষকে আমরা পূর্ণাঙ্গভাবে দেখব না কেন? আমাদের ভয় কিসের? একুশের চেতনাকে যদি আমরা সত্যিকারভাবে উপলব্ধি করতে পারতাম এবং নিজেদের মধ্যে লালন করতে পারতাম, তাহলে এমনটি ঘটত না, খণ্ডিত বা পক্ষপাতদুষ্ট ইতিহাস রচিত হতো না। আমরা কি সত্য বলব, না কেবল ক্ষমতাসীনদের মুখ চেয়ে আমাদের লেখা লিখে যাব, কাউকে অবজ্ঞা করব, কাউকে ঢাকঢোল পিটিয়ে বড় করে তুলব, এটি আর যাই হোক একুশের চেতনা নয়। এসব ব্যর্থতা সত্ত্বেও আমি গৌরবের সঙ্গে বলতে চাই, একুশের চেতনা একটি খাঁটি চেতনা। এই চেতনা বেঁচে আছে এ দেশের জনসাধারণের মধ্যে, ক্ষমতাসীন কিংবা ক্ষমতা আকাঙ্ক্ষী মানুষের মধ্যে নয়। একুশের চেতনার এই শক্তির প্রমাণ প্রতি বছর সেই অমর দিনে আমরা দেখতে পাই।

কয়েক বছর আগে সংস্কৃতি মন্ত্রণালয়ের এক সভায় প্রস্তাব করা হয়েছিল, সে বছর 'আমার ভাইয়ের রক্তে রাঙানো' গানটি অমর একুশের দিনে গাইতে দেওয়া হবে না, এ গানের লেখক সরকারবিরোধী, এমনই বিরোধী যে, তাকে দেশের বাইরে থাকতে হয় এবং তিনি দেশে ফিরে আসতে পারেন না। সে বছরও প্রতি বছরের মতো কোটি কণ্ঠে অমর একুশের দিনে এই গান গীত হয়েছিল।

প্রতিহিংসার প্রবৃত্তি চরিতার্থ করার প্রবণতা কি আমাদের স্বভাবের মধ্যে নিহিত আছে? ১৯৫২-এর এত বছর পরও যখন আমাদের রাজনীতির দিকে চোখ ফেরাই, দুঃখের সঙ্গে দেখি, প্রতিহিংসার প্রবৃত্তি চরিতার্থ করার বাসনা এখনো এই রাজনীতিতে দাউ দাউ করে জ্বলছে। এর ফলে সংঘাত, সংঘর্ষ ও সহিংসতা দেখা দিচ্ছে, সমঝোতার পথ রুদ্ধ হয়ে যাচ্ছে, নিম্নরুচির উচ্চারণে পরিবেশ কলুষিত হচ্ছে। একুশের সংগ্রাম তো ছিল একটি আদর্শের জন্য; বাংলা ভাষাকে রাষ্ট্রীয় মর্যাদায় অধিষ্ঠিত করার আদর্শ।

এখন রাজনীতিতে দলগুলোর কোনো আদর্শ বিশেষভাবে দৃষ্টিগোচর হয় না।

মাতৃভূমি ও মাতৃভাষাকে ভালো কে না বাসে! এই ভালোবাসা মানুষের স্বভাবের মধ্যে এমনভাবে মিশে আছে, সংকটে পতিত না হওয়া পর্যন্ত মানুষ এই ভালোবাসার কথা ভুলেই যায়। যখন মানুষ তা ভুলে যায়, তখন মানুষ এমন কোনো কাজে লিপ্ত হয়ে পড়তে পারে, যাতে সেই ভালোবাসা ক্ষুণ্ন হওয়ার আশঙ্কা থাকে। মানুষ হয়তো এই আশঙ্কার কথা বুঝতেই পারে না। মাতৃভূমি ও মাতৃভাষার প্রতি ভালোবাসার কথা মানুষকে তাই মনে করিয়ে দেওয়া প্রয়োজন।

মনে করিয়ে দেওয়া প্রয়োজন যে, মাতৃভূমি ও মাতৃভাষার জন্য হৃদয়ের ফল্গুধারার মতো ভালোবাসা থাকাই যথেষ্ট নয়, সে ভালোবাসার প্রকাশ প্রয়োজন। সে ভালোবাসাকে লালন করা প্রয়োজন এবং সে মাতৃভূমি ও মাতৃভাষার মর্যাদাকে সমুন্নত রাখার জন্য সচেতন প্রচেষ্টা প্রয়োজন। অমর একুশে আমাদের সেই প্রচেষ্টা প্রয়োজনীয়তার কথাই স্মরণ করিয়ে দেয়।

বায়ান্নোর ভাষা আন্দোলন ছিল বাঙালির রাজনৈতিক-অর্থনৈতিক অধিকার আদায়ের লক্ষ্যে সাংস্কৃতিক সংগ্রাম। আন্দোলনের মিছিলে গুলিবর্ষণ এবং জীবনদান ইতিহাসের প্রেক্ষাপটে একটি বিশাল ঘটনা।

মাতৃভাষার জন্য লড়াই করা জাতি হিসেবে পৃথিবীতে আমাদের পরিচয়। বিশ্বব্যাপী আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস পালিত হয়। কিন্তু এ দিবসটির তাৎপর্য আমরা যথাযত তুলে ধরতে পারিনি। এজন্য সক্রিয়ভাবে আমাদের চেষ্টা করতে হবে। ভাষা আন্দোলন, মুক্তিযুক্ত এবং বাংলা ভাষায় রচিত গুরুত্বপূর্ণ রচনাসমূহ অনুবাদ করে বিশ্বব্যাপী প্রচার করতে হবে।

তা না হলে ভিন্ন ভাষী জনগোষ্ঠী আমাদের তা না হলে ভিন্ন ভাষী জনগোষ্ঠী আমাদের আন্দোলন, সংগ্রাম, ভাষা, সংস্কৃতি সম্পর্কে জানতে পারবে না। অন্যরা যদি বিষয়টি না জানে তাহলে কিভাবে তাদের চর্চার মধ্যে আনবে। এ বিষয়ে সরকারি ও বেসরকারি উদ্যোগে যোগ্য ব্যক্তি নির্বাচন করে গবেষণা, গ্রন্থ প্রণয়ন করা প্রয়োজন। জাতিসংঘ বাংলাদেশের প্রস্তাবে আন্তজার্তিক মাতৃভাষা দিবস ঘোষণা করেছে। এজন্য এ দিবসের তাৎপর্য সম্পর্কে জানানোর দায়িত্ব আমাদের।

বিভিন্ন পোষ্টার, লিফলেট, বুকলেট, বই, পত্র-পত্রিকাসহ তথ্যচিত্র নির্মাণ করা যেতে পারে। এগুলো বহি:বিশ্বে আমাদের দূতাবাসগুলোর মাধ্যমে প্রচার করতে হবে। বিভিন্ন দেশের বিশ্ববিদ্যালয়, ভাষা ইন্সটিটিউগুলোতে সেগুলো পাঠাতে হবে। কিন্তু আজও আমাদের মানসিকতার কোনো পরিবর্তন হয়নি। বাংলা ভাষার দৈনতা নেই।

দৈনতা আমাদের। দেশ স্বাধীনের পর বঙ্গবন্ধু বলেছিলেন, সর্বস্তরে বাংলা ভাষা ব্যবহার করতে হবে। পরবর্তী সময়ে সেটা হয়নি। কেউ আমাদের সংগঠিত করেনি। আজও সর্বস্তরে বাংলা ভাষার প্রচলন সম্ভব হয়নি।

আদালতে ইংরেজিতে রায় দেওয়া হচ্ছে। আমার প্রশ্ন একজন কৃষক, দিনমজুর কেন ইংরেজি ভাষায় রায় পাবে?

বাংলা একাডেমি শহীদের রক্তের বিনিময়ে প্রতিষ্ঠিত একমাত্র প্রতিষ্ঠান। সে সময়ে গণমানুষের দাবি ছিল যে ভবন থেকে তৎকালীন সরকার গুলিবর্ষণের নির্দেশ দিয়েছিল, সেই ভবনকে বাংলা ভাষার গবেষণাগারে পরিণত করার। ১৯৫৩ সালের ৪ ডিসেম্বর বিভিন্ন রাজনৈতিক দলের সমন্বয়ে গঠিত হয় যুক্তফ্রন্ট। এই ফ্রন্ট ১৯৫৪ সালের মার্চ মাসে পূর্ব বাংলা সরকার কর্তৃক ঘোষিত সাধারণ নির্বাচনে অংশগ্রহণ করে জয়লাভ করে।

যুক্তফ্রন্টের নির্বাচনী ইশতেহারে ২১ দফার উল্লেখ করে রাজনৈতিকভাবে ২১ ফেব্রুয়ারিকে সামনে নিয়ে এসেছিলেন সে সময়ের রাজনীতিবিদেরা। ২১ দফার প্রথম দফাতে ছিল: 'বাংলাকে পাকিস্তানের অন্যতম রাষ্ট্রভাষা করা হইবে। ' ষোলোতম দফায় ছিল, 'যুক্তফ্রন্টের প্রধানমন্ত্রী বর্ধমান হাউসের বদলে অপেক্ষাকৃত কম-বিলাসের বাড়িতে বাসস্থান নির্দিষ্ট করিবেন এবং বর্ধমান হাউসকে আপাতত ছাত্রাবাস ও পরে বাংলা ভাষার গবেষণাগারে পরিণত করা হইবে। ' ১৯৫৫ সালের ৩ ডিসেম্বর বর্ধমান হাউসে বাংলা একাডেমির উদ্বোধন করেন মুখ্যমন্ত্রী আবু হোসেন সরকার। বর্ধমান হাউসের সামনের প্রাঙ্গণে প্যান্ডেল টানিয়ে বাংলা একাডেমির উদ্বোধন অনুষ্ঠান আয়োজিত হয়েছিল।

ভাষণে মুখ্যমন্ত্রী বলেছিলেন, 'আমি আশা করি, দেশের সকল সাহিত্যিক কর্মী এবং জনসাধারণের সহযোগিতার ফলে এই একাডেমি দুনিয়ার মধ্যে একটি শ্রেষ্ঠ একাডেমি বলিয়া স্বীকৃতি লাভ করিবে। ' বাংলা একাডেমির স্পেশাল অফিসার হিসেবে মুহম্মদ বরকতউল্লাহ ডিসেম্বর মাসে যোগদান করেছিলেন। ১৯৫৬ সালের ১ ডিসেম্বর ড. মুহম্মদ এনামুল হক বাংলা একাডেমির প্রথম পরিচালক হিসেবে যোগদান করেন। শুরু হয় বাংলা একাডেমির গবেষণা ও প্রকাশনা কার্যক্রম। ১৯৫৭ সালের জুন মাসে প্রকাশিত হয়েছিল দৌলত উজির বাহরাম খান রচিত 'লাইলী-মজনু' গ্রন্থ।

সম্পাদনা করেছিলেন ড. আহমদ শরীফ। মধ্যযুগের সাহিত্যচর্চার এই সূচনা ছিল বাংলা ভাষার ঐতিহ্যের সঙ্গে যোগসূত্র স্থাপন। জাতির সাংস্কৃতিক ঐতিহ্যের লালন। আর এ জায়গাটিকে বাংলা একাডেমি সূচনালগ্ন থেকেই নির্ধারণ করেছিল।

জ্ঞানতাপস ড. মুহম্মদ শহীদুল্লাহ বাংলা ভাষার চর্চাকে সমৃদ্ধ করেছিলেন বাংলা একাডেমিতে বসে 'আঞ্চলিক ভাষার অভিধান' সম্পাদনা করে।

ড. মুহম্মদ এনামুল হক বাংলা একাডেমি 'ব্যবহারিক বাংলা অভিধান' সম্পাদনার কাজ শুরু করেছিলেন ষাটের দশকে। গবেষণা-প্রকাশনার মননশীল চর্চার পাশাপাশি বাংলা একাডেমি একুশের চেতনাকে প্রবাহিত রেখেছে। বাংলা একাডেমির আলোচনা অনুষ্ঠানের মঞ্চ ছিল মুক্তবৃদ্ধির চর্চায় স্নাত প্রতিবাদী চেতনার মঞ্চ। ১৯৬৯ সালের গণ-অভ্যুত্থানের সময় এই মঞ্চ থেকে বিতাড়িত হয়েছিল তৎকালীন পরিচালক এবং আলোচক। তাদের পাকিস্তানপন্থী তাবেদারি মনোভাবে ক্ষুব্ধ হয়ে উঠেছিল উপস্থিত শ্রোতা।

১৯৭১ সালে বাংলা একাডেমি আয়োজিত সপ্তাহব্যাপী অমর একুশে অনুষ্ঠান উদ্বোধন করেছিলেন বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান। পরিচালক ছিলেন প্রয়াত অধ্যাপক কবীর চৌধুরী। জাতীয় চেতনার বিকাশে বাংলা একাডেমির ভূমিকাকে অস্বীকার করতে পারেনি তৎকালীন পাকিস্তান সরকার। সে জন্যই মুক্তিযুদ্ধের সূচনায়, ২৫ মার্চের রাতেই, কামান দিয়ে বর্ধমান ভবনের দেয়াল ভেঙেছিল পাকিস্তানি সেনাবাহিনী। স্বাধীনতা-পরবর্তী সময় থেকে জাতির সাংস্কৃতিক চেতনাকে সমুন্নত রেখেছে বাংলা একাডেমি।

লেখক : কথাশিল্পী

 

অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।