আমাদের কথা খুঁজে নিন

   

কোন্দলেই আওয়ামী লীগের সর্বনাশ

দলীয় কোন্দল, জনবিচ্ছিন্নতা, প্রভাবশালী মন্ত্রী-নেতাদের দাম্ভিকতা-অহমিকায় দ্বিতীয় দফা উপজেলা নির্বাচনেও ভরাডুবি হয়েছে ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগ সমর্থিত প্রার্থীদের। একইভাবে পাঁচ বছরে কার্যকর সংগঠন গড়ে তুলতে না পারা, তৃণমূল নেতা-কর্মীদের অবমূল্যায়নও পরাজয়ের অন্যতম কারণ বলে মনে করছেন সংশ্লিষ্টরা। তা ছাড়া প্রায় অধিকাংশ স্থানেই বিদ্রোহী প্রার্থীর ছড়াছড়ি ছিল। অনেক উপজেলায় তৃণমূলের মতামতকে গুরুত্ব না দিয়ে ভুল প্রার্থী বাছাই করা হয়েছে বলেও অভিযোগ রয়েছে। বিএনপি ও জামায়াতের নেতা-কর্মীদের হয়রানির ফলে অনেক উপজেলায় সাধারণ নিরীহ জনগণও ছিল অতিষ্ঠ।

প্রথম ও দ্বিতীয় দফা উপজেলা নির্বাচনে পরাজয়ের এসবই প্রধান কারণ বলে মনে করেন তৃণমূলের নেতা-কর্মীরা। ভবিষ্যতে এসব ব্যাপারে সতর্ক না হলে আওয়ামী লীগের একই ধরনের বিপর্যয়ে পড়ার আশঙ্কা করেন তারা। দ্বিতীয় দফা নির্বাচনে পরাজয়ের মূল্যায়ন প্রসঙ্গে আওয়ামী লীগের প্রেসিডিয়াম সদস্য মোহাম্মদ নাসিম বলেন, আমরা প্রত্যাশা অনুযায়ী বিজয়ী হতে পারিনি। সাংগঠনিক দুর্বলতা, স্থানীয় নেতা ও এমপিদের নেতিবাচক মনোভাবের কারণে অনেক উপজেলায় দল সমর্থিত প্রার্থীদের পরাজয় হয়েছে। শীঘ্রই আমরা এসবের কারণ খুঁজে বের করে সংশ্লিষ্টদের বিরুদ্ধে সাংগঠনিক ব্যবস্থা নেব।

শেরপুরের নালিতাবাড়ী উপজেলার সাবেক চেয়ারম্যান বদিউজ্জামান বাদশা মনে করেন, প্রার্থী নির্বাচনে স্থানীয় এমপিদের মতামতকে প্রাধান্য দিতে গিয়ে দল সমর্থিত প্রার্থীদের পরাজয় হয়েছে। ক্ষমতায় থাকলে সরকারের সঙ্গে তৃণমূল সংগঠনের দূরত্ব সৃষ্টি হয়। দুই দফা উপজেলা নির্বাচনে তারই প্রতিফলন ঘটেছে। সরকারের সঙ্গে তৃণমূল সংগঠনের দূরত্ব নিরসনের পদক্ষেপ শীঘ্রই নেওয়া উচিত বলে মনে করেন তিনি। দ্বিতীয় দফা উপজেলা নির্বাচন পর্যালোচনা করে দেখা গেছে, প্রথম দফার মতো এবারও আওয়ামী লীগের প্রভাবশালী মন্ত্রী-নেতাদের এলাকায় বিএনপি ও জামায়াতের প্রার্থীদের কাছে ধরাশায়ী হয়েছেন দল সমর্থিত প্রার্থীরা।

অনেক মন্ত্রী-এমপির বিরুদ্ধে অভিযোগ ছিল, তারাই চাননি নিজ সংসদীয় এলাকায় দল সমর্থিত প্রার্থী জয়লাভ করুক। তাদের জনবিচ্ছিন্ন নেতৃত্ব, দাম্ভিকতা-অহমিকায় সাধারণ মানুষ তো নয়ই তৃণমূলের নেতা-কর্মীরাও কাছে ভিড়তে সাহস পেতেন না। স্থানীয় প্রশাসনকে ব্যবহার করে বিএনপি ও জামায়াতকে ঘায়েল করতে গিয়ে নিরীহ মানুষকেও হয়রানির অভিযোগ রয়েছে অনেক মন্ত্রী-এমপি ও নেতার বিরুদ্ধে। প্রথমবারের মতো দ্বিতীয় দফায়ও পররাষ্ট্রমন্ত্রী আবুল হাসান মাহমুদ আলী ও প্রতিমন্ত্রী শাহরিয়ার আলমের নিজ এলাকায় জামায়াতের প্রার্থীর কাছে পরাজিত হয়েছেন আওয়ামী লীগ সমর্থিত প্রার্থী। কৃষিমন্ত্রী মতিয়া চৌধুরীর নিজ জেলা শেরপুরেও আওয়ামী লীগের প্রার্থীর পরাজয় হয়েছে।

ধর্মমন্ত্রী অধ্যক্ষ মতিউর রহমানের ময়মনসিংহের সদর, যুব ও ক্রীড়া প্রতিমন্ত্রী বীরেন শিকদারের মাগুরার মহম্মদপুর, শালিখা, মৎস্য ও প্রাণী সম্পদ প্রতিমন্ত্রী নারায়ণ চন্দ্র চন্দের খুলনার ডুমুরিয়া, স্বাস্থ্য প্রতিমন্ত্রী জাহিদ মালেক স্বপনের মানিকগঞ্জ সদর, পার্বত্য চট্টগ্রামবিষয়ক প্রতিমন্ত্রী বীর বাহাদুরের বান্দরবানের থানছি, রুমা ও লামায় আওয়ামী লীগ প্রার্থীরা শোচনীয়ভাবে বিএনপি ও জামায়াতের প্রার্থীর কাছে পরাজিত হয়েছেন। সাবেক তথ্যমন্ত্রী আবুল কালাম আজাদের বকশিগঞ্জেও পরাজয় ঘটেছে আওয়ামী লীগ সমর্থিত প্রার্থীর।

কৃষিমন্ত্রীর নিজ জেলা শেরপুরের ঝিনাইগাতী উপজেলায় বিএনপি সমর্থিত প্রার্থী আমিনুল ইসলাম বাদশাহ কারাগারে থেকেও বিজয়ী হয়েছেন। মতিয়া চৌধুরীর এলাকায় পরাজয়ের মূল কারণ হিসেবে স্থানীয় নেতা-কর্মীরা বলছেন, ঝিনাইগাতীতে সাংগঠনিক দুর্বলতা ছিল দীর্ঘ দিন থেকেই। নির্বাচনের আগমুহূর্তে বিএনপি নেতা-কর্মীদের বাড়িতে বাড়িতে পুলিশি হয়রানিতে সাধারণ মানুষের মধ্যে একধরনের নেতিবাচক প্রভাব পড়ে।

বিএনপি নেতা-কর্মীদের নামে অনেক সাধারণ নিরীহ জনগণও হয়রানির শিকার হন। প্রশাসনকে ব্যবহার করায় বিজয় অনেকাংশে বুমেরাং হয়েছে বলে জানান তারা। বান্দরবানের লামায় পার্বত্য চট্টগ্রামবিষয়ক প্রতিমন্ত্রীর আস্থাভাজন সাবেক উপজেলা চেয়ারম্যান আওয়ামী লীগ প্রার্থী মোহাম্মদ ইসমাইলের ছোট ভাই বাদশাহ এলাকার সব টেন্ডার, ব্যবসা-বাণিজ্য, হোটেল, পর্যটন, তামাকসহ সব কিছু একাই নিয়ন্ত্রণ করতেন। এ ছাড়া তার চাঁদাবাজি, সন্ত্রাস ও ভূমি দখলে অতিষ্ঠ ছিল সর্বস্তরের মানুষ। এসব কারণেই বিএনপি প্রার্থীর বিজয় হয় বলে মনে করেন স্থানীয় আওয়ামী লীগের নেতা-কর্মীরা।

পররাষ্ট্রমন্ত্রী আবুল হাসান মাহমুদ আলীর দিনাজপুর-৪ আসনের চিরিরবন্দর উপজেলায় জয়ী হয়েছেন জামায়াতের প্রার্থী আফতাব উদ্দিন মোল্লা। দ্বিতীয় অবস্থানে ছিলেন আওয়ামী লীগের প্রার্থী তরিকুল ইসলাম তারিক। সেখানে আওয়ামী লীগ উপদলে বিভক্ত ছিল। এ ছাড়া কিছু নেতার দাম্ভিকতায় সাধারণ কর্মী-সমর্থকরা নিজ দলের প্রার্থীর বিরুদ্ধে অবস্থান নেন। ফলে সুবিধাজনক অবস্থানে চলে যায় জামায়াত।

পররাষ্ট্র প্রতিমন্ত্রী শাহরিয়ার আলমের নির্বাচনী এলাকা রাজশাহী-৬ আসনের বাঘা উপজেলায়ও আওয়ামী লীগ প্রার্থীর ভরাডুবি ঘটেছে। জামায়াতের প্রার্থী জিন্নাত আলী জয়ী হয়েছেন। তার নিকটতম প্রতিদ্বন্দ্বী ছিলেন আওয়ামী লীগের প্রার্থী। এমপি শাহরিয়ার আলমের এ উপজেলায়ই এবার উত্থান ঘটেছে জামায়াতের। বাঘা উপজেলা পরিষদ নির্বাচনে ৭ হাজার ৯৭৭ ভোটের বিশাল ব্যবধানে জামায়াত প্রার্থীর কাছে পরাজিত হয়েছেন আওয়ামী লীগ সমর্থিত চেয়ারম্যান প্রার্থী আজিজুল আলম।

স্থানীয়রা বলতে শুরু করেছেন, পররাষ্ট্র প্রতিমন্ত্রীর ঘরেই এবার ঘটেছে জামায়াতের উত্থান। ধর্মমন্ত্রীর নিজ এলাকা ময়মনসিংহ সদর। এ উপজেলায় আওয়ামী লীগ সমর্থিত প্রার্থী আশরাফ হোসাইনের পরাজয় হয়েছে বিএনপির কামরুল ইসলাম মোহাম্মদ ওয়ালিদের কাছে। এখানে আওয়ামী লীগের দুজন বিদ্রোহী প্রার্থী ছিলেন। স্থানীয় কিছু আওয়ামী লীগ নেতার ইন্ধনের কারণেই বিদ্রোহী প্রার্থীকে বসানো যায়নি বলেও অভিযোগ রয়েছে।

প্রার্থী নির্বাচনে ভুল ও বিদ্রোহী প্রার্থী থাকায় নীলফামারীর কিশোরগঞ্জ উপজেলা পরিষদের নির্বাচনে চেয়ারম্যান পদে আওয়ামী লীগ সমর্থিত প্রার্থীর ভরাডুবি হয়েছে। আওয়ামী লীগের প্রার্থী এছরারুল হক ভোট পেয়েছেন মাত্র ১ হাজার ১০৯টি। এছরারুল হক উপজেলা আওয়ামী লীগের ভারপ্রাপ্ত সভাপতি এবং বিদ্রোহী প্রার্থী মশিয়ার রহমান নিতাই ইউনিয়ন আওয়ামী লীগের এক নম্বর ওয়ার্ডের সদস্য। জাতীয় পার্টির রশিদুল ইসলাম সরকার এখানে জয়লাভ করেছেন। এ ব্যাপারে এছরারুল হক বলেন, দলীয় নেতা-কর্মীরা আমার সঙ্গে বিট্রয় (অসহযোগিতা) করেছেন।

আওয়ামী লীগের 'ঘাঁটি' বলে খ্যাত ফরিদপুরের নগরকান্দা ও সালথা উপজেলায় আওয়ামী লীগ প্রার্থীর শোচনীয় পরাজয় হয়েছে। এ দুটি উপজেলায় আওয়ামী লীগের কিছু নেতার কাছে জিম্মি ছিল সর্বস্তরের মানুষ। তাদের সীমাহীন দুর্নীতি, চাঁদাবাজিসহ বিভিন্ন ক্ষেত্রে মাত্রাতিরিক্ত বাড়াবাড়ির কারণে জনগণ বিএনপি প্রার্থীর পক্ষে অবস্থান নিয়েছে। মৎস্য ও প্রাণী সম্পদ প্রতিমন্ত্রী নারায়ণ চন্দ্র চন্দের নিজ বাড়ি খুলনার ডুমুরিয়া উপজেলায় জামায়াত সমর্থিত প্রার্থীর জয় হয়েছে। স্থানীয় নেতারা জানান, সেখানে দলীয় প্রার্থী নির্বাচনে ভুল ছিল।

কারণ গাজী আবদুল হাদি গত পাঁচ বছর চেয়ারম্যান থাকাকালে নেতা-কর্মীদের চরম অবমূল্যায়ন করেছেন। নেতা-কর্মীদের দুঃখে পাশে দাঁড়াননি। নানা কারণে জনপ্রিয়তা হ্রাস পেলেও তাকেই দলীয় মনোনয়ন দেওয়া হয়। যুব ও ক্রীড়া প্রতিমন্ত্রী বীরেন শিকদারের মাগুরা-২ আসনের মহম্মদপুর ও শালিখা উপজেলায় বিএনপির প্রার্থীর কাছেই পরাজয় হয়েছে আওয়ামী লীগ প্রার্থীর। দলের অভ্যন্তরীণ কোন্দল ও সাংগঠনিক ব্যর্থতা এবং কতিপয় নেতার দাপটের কারণেই পরাজয় হয়েছে।

নাটোরের গুরুদাসপুর উপজেলা আওয়ামী লীগের দ্বন্দ্ব দীর্ঘ দিনের। দলীয় কোন্দলের কারণেই পরাজয় হয়েছে দলীয় প্রার্থীর। উপজেলায় আওয়ামী লীগের তৃণমূলের সমর্থন পান বর্তমান চেয়ারম্যান সরকার এমদাদুল হক মোহাম্মদ আলী। তার সঙ্গে দীর্ঘ দিনের দ্বন্দ্ব ছিল স্থানীয় সংসদ সদস্য আবদুল কুদ্দুসের। এ উপজেলায় আওয়ামী লীগের বিদ্রোহী প্রার্থী হিসেবে নির্বাচনে দাঁড়ান এমপির আস্থাভাজন মিজানুর রহমান সাজু।

কেন্দ্র ও জেলা থেকে বারবার একক প্রার্থী করার তাগাদা থাকলেও স্থানীয় এমপির কারণেই তা সম্ভব হয়নি বলে জানান নেতা-কর্মীরা। ফলে দলের কোন্দলের সুযোগ নেয় বিএনপি। বিএনপি প্রার্থী আবদুল আজিজ জয়লাভ করেন। দ্বিতীয় দফা উপজেলা নির্বাচন অনুষ্ঠানের এক দিন পর গতকাল আওয়ামী লীগের সিনিয়র নেতা, বাণিজ্যমন্ত্রী তোফায়েল আহমেদ পরাজয়ের ব্যাপারে সাংবাদিকদের কাছে প্রতিক্রিয়ায় বলেন, আওয়ামী লীগের একাধিক বিদ্রোহী প্রার্থী থাকায় উপজেলা নির্বাচনে পরাজয় হয়েছে। গতকাল জাতীয় প্রেসক্লাবে অনুষ্ঠিত আলোচনা সভা শেষে বেরিয়ে যাওয়ার সময় সাংবাদিকদের এসব কথা বলেন তিনি।

এর আগে ওই অনুষ্ঠানে বাণিজ্যমন্ত্রী দাবি করেন, উপজেলা নির্বাচনের ফলাফল দিয়ে সরকারের জনপ্রিয়তা নিরূপণের চেষ্টা করা ঠিক হবে না। তার মতে, উপজেলা নির্বাচনে কে বিজয়ী হলো তা বড় বিষয় নয়। বিষয় হলো, প্রধানমন্ত্রীর অধীনে সুষ্ঠু নির্বাচন হয়েছে।

 

অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।