আমাদের কথা খুঁজে নিন

   

"এই গল্প কিছু মহান মানবতাবাদী মানুষের গল্প , যাদের অবদান কখনও ভুলবার মত নয় "

স্বপ্নগুলো শুধু স্বপ্ন হিসেবে রেখে দিতে চাই না , বাস্তবতার আলোয় স্বপ্নগুলো আরো রঙ্গিন করতে চাই । যুদ্ধকালীন সময়ে সাধারণত বেসামরিক লোকজন, উপাসনালয়, হাসপাতাল, সাংবাদিক এবং জরুরী সেবায় নিয়োজিতদের আক্রমণের বাইরে রাখা হয়। কিন্তু আমাদের মুক্তিযুদ্ধে বর্বর পাকবাহিনীর প্রধান লক্ষ্যই ছিল নিরীহ লোকজন এবং এসব শান্তিকামী মানবতা সেবায় নিয়োজিত মানুষজন। পাকবাহিনীর নির্মম নির্যাতনে টিকতে না পেরে সাধারণ মানুষজন আশ্রয় নিতো উপাসনালয়ে। কিন্তু সেখানেও হতোনা শেষ রক্ষে।

কী মসজিদ,কী মন্দির,কী গির্জা; “না’পাকবাহিনী” সবখানেই রক্ত পিয়াসু হায়েনাদের মত খুঁজে খুঁজে হত্যা করতো নিরীহ গ্রামবাসীদের। দেশের গ্রামে,গঞ্জে প্রত্যন্ত অঞ্চলে ছড়িয়ে আছে খৃস্টান ধর্মাবলম্বীদের বহু গির্জা। আর সেসব গির্জায় থাকা ফাদাররা পুরো একাত্তরে জুড়ে সেবা করে গেছেন নিপীড়িত মানুষদের। আর এজন্য অনেক ভিনদেশী ফাদারকেই মাশুল দিতে হয়েছিলো নিজের জীবন দিয়ে। অনেকে বা বেঁচে গেছেন নেহাত কপাল জোরে।

আসুন আমাদের এই মহান বিজয়ের মাসে সেইসব ভীনদেশী বীরদেরকে আবার স্মরণ করি : - ফাদার ম্যারিনো রিগ্যানঃ আহত হয়ে চিকিৎসার জন্য এলেন একজন গেরিলা দলনেতা। রামশীলের যুদ্ধে হানাদার বাহিনীর গুলি তার মুখের বামপাশে ঢুকে ডানপাশ দিয়ে বেরিয়ে যায়। এতে তার মুখের বামপাশের ১১টি দাঁত ও জিহ্বার একটি অংশ পড়ে যায়। আহত এই গেরিলা যোদ্ধা যখন মৃতপ্রায়; ঠিক তখন তাকে মাতৃসম চিকিৎসাসেবা দিয়ে সুস্থ করে তোলেন একজন ভিনদেশি যাজক। তারপর সেই গেরিলা নেতা সুস্থ হয়ে আবারও ফিরে যান মুক্তিযুদ্ধে।

আহত এই বীরযোদ্ধা ছিলেন ৫ হাজার ৫৫৮ গেরিলা যোদ্ধার সমন্বয়ে গঠিত হেমায়েত বাহিনীর প্রধান হেমায়েত উদ্দীন। আর সেই ভিনদেশি মানুষটি ছিলেন ইতালিয়ান ধর্ম যাজক ফাদার মারিনো রিগন। হেমায়েত বাহিনীর প্রধান বীর বিক্রম হেমায়েত উদ্দীন বলেন,“যুদ্ধের সময় সৃষ্টিকর্তা ছিলেন স্বর্গে আর রিগন ছিলেন মর্ত্যে। ” এ দেশটাকে কতটা ভালোবাসতেন তিনি, তার কিছুটা প্রকাশ পাওয়া যায় এ দেশের মাটিতে সমাহিত হওয়ার ইচ্ছা পোষণের মধ্য দিয়ে। ২০০১ সালে তাঁর হৃদযন্ত্রে অসুস্থতা ধরা পড়ে।

উন্নত চিকিৎসার জন্য তাঁর আত্মীয়স্বজন তাঁকে ইতালিতে নিয়ে যেতে চাইলে তিনি প্রথমে কিছুতেই সম্মত হননি। স্বজনদের পীড়াপীড়িতে অবশেষে তিনি এই শর্তে রাজি হন, ইতালিতে যদি তাঁর মৃত্যু হয়, তাহলে মরদেহটি বাংলাদেশে পাঠাতে হবে। তিনি ইতালী চিকিৎসা নিতে যাবার সময় বলে যান,”আবার আসিব ফিরে এই বাংলায়, এই ধানসিঁড়ি নদীর তীরে”। তিনি কথা রেখেছিলেন, ফিরে এসেছিলেন আমাদের মাঝে। অথচ অদ্ভুত ব্যাপার কী জানেন? ফাদার মারিনো রিগন ২০০৮ সাল পর্যন্ত বারবার আবেদন করেছেন তাঁকে এ দেশের নাগরিকত্ব দেয়ার জন্য অথচ তাঁকে নাগরিকত্ব দেয়া হয়নি।

অবশেষে, ২০০৯ সালে তিনি এ দেশের নাগরিত্ব পান। এর জন্য উনাকে অপেক্ষা করতে হয় দীর্ঘ ৩৮ বছর ধরে। কিন্তু তারপরও মুক্তিযুদ্ধে অসামান্য অবদানের স্বীকৃতিস্বরূপ এ দেশের সন্মানসূচক নাগরিকত্ব প্রাপ্তিকে তিনি স্মরণ করেন পরম কৃতজ্ঞতার সাথে। মুক্তিযুদ্ধের সময় ফাদার রিগন ছিলেন ফরিদপুরের বানিয়ারচর মিশনে। তিনি এই মিশনের হাসপাতালে সহকর্মী ডাক্তার লক্ষ্মীবাবু ও সিস্টার ইমেলদাকে নিয়ে আহত মুক্তিযোদ্ধাদের চিকিৎসা সেবার জন্য একটি ক্যাম্প স্থাপন করেন।

ক্যাম্পে তিনি আহত মুক্তিযোদ্ধাদের গোপনে চিকিৎসাসেবা দিতেন। এছাড়া রিগন মুক্তিযোদ্ধাদের তার মিশনে ও ক্যাম্পে আশ্রয় দিতেন, স্থানীয় মুক্তিযোদ্ধাদের খাবার সরবরাহ করতেন এবং বিভিন্নভাবে তথ্য সরবরাহ করতেন। এসব সেবা রিগন করতেন অতি গোপনে। কারণ তিনি জানতেন পাকিস্তানি বাহিনী যদি জানে তার মিশনে মুক্তিযোদ্ধাদের চিকিৎসা দেওয়া হয়, তাহলে হয়তো হানাদার বাহিনী মিশনে হামলা চালাবে। এই মিশনে অনেক আহত মুক্তিযোদ্ধা চিকিৎসাসেবা পেয়ে সুস্থ হয়ে আবারও ফিরে গেছেন রণাঙ্গনে।

রিগন সে সময় বানিয়ারচর এলাকার কৃষক ও মৎস্যজীবীদের নিয়ে একটি সমিতি পরিচালনা করতেন। এই সমিতির আওতায় স্থানীয় অনেক জমিতে কৃষি কাজ হতো ও অনেকগুলো মাছ ধরার নৌকা ছিল। মুক্তিযুদ্ধকালীন ও স্বাধীনতা-পরবর্তী রিগন নতুন কয়েকটি মাছ ধরার নৌকা তৈরি করেছিলেন। যুদ্ধের শুরুর দিকে একটি নৌকাটি তৈরি করেন তার নাম দেন ‘সংগ্রামী বাংলা’, যুদ্ধের মাঝামাঝি আরও একটি নৌকা তৈরি করেন তার নাম দেন ‘রক্তাক্ত বাংলা’ এবং বাংলাদেশ সদ্য স্বাধীন হলে যে নৌকা তৈরি করেছিলেন তার নাম দেন ‘স্বাধীন বাংলা’ ও তার কিছুদিন পর আরও একটি নৌকা তৈরি করে তার নাম দেন ‘মুক্ত বাংলা’। মুক্তিযুদ্ধের সময় রিগন তার কৃষক ও জেলে সমিতির মাছ ধরার নৌকাগুলোতে এবং স্থানীয় জেলেদের নৌকাতে স্বাধীন বাংলাদেশের পতাকা উড়িয়ে দিয়েছিলেন।

মুক্তিযোদ্ধাদের প্রতি রিগনের এই সহযোগিতা, তাদের চিকিৎসাসেবা দেওয়া, খাদ্য সরবরাহ করা, আশ্রয় দেওয়া কিংবা বাংলার প্রতি এই দরদ পাকিস্তানি বাহিনী ও স্থানীয় রাজাকারদের কাছে ভালো লাগেনি। তাই বারবার রিগনের প্রতি বিপদ এসেছে। রিগনকে তারা মুক্তিযোদ্ধাদের প্রতি এসব সহযোগিতা না করার হুমকিও দিয়েছেন। কিন্তু রিগন তাতে থেমে থাকেননি। বরং তিনি আরও বেশি সহযোগিতা করেছেন মুক্তিযোদ্ধাদের।

জীবনের বেশীরভাগ সময় এই দেশে কাটানো এই মানুষটি আজও নিভৃতে তার আশ্রমে কাজ করে যাচ্ছেন মানবতার সেবায় আমাদের তরে। এই মানুষটিকে শ্রদ্ধা জানানোর মত ভাষা আমার নেই। মনটা আছন্ন হয়ে উঠে যখনই ভাবি তাদের আত্মত্যাগ আর আমাদের বর্তমানের কথা। কিছুতেই যেন আর হিসেব মেলে না। শুধু মনের ভেতর হু হু করে ওঠে এক চাপা কান্না।

শহীদ ফাদার লুকাস মারান্ডীঃ পাকিস্তানী বাহিনীর আক্রমণে সবাই পালাচ্ছে ভারত। পুরো চার্চের সব কিছু গুটিয়ে অন্যান্য সব ফাদাররা নিরাপদ আশ্রয়ের জন্য ছুটে যাচ্ছেন ভারতে। কিন্তু ব্যতিক্রম ফাদার লুকাস। ফিরে এলেন মানবতার ডাকে সাড়া দিয়ে। সেবা দিতে লাগলো সর্বস্ব হারানো মানুষদের।

২১ এপ্রিল ১৯৭১ সাল৷ বেলা বারোটা৷ ফাদার মিশনে বসেই দেখলেন সেনাবাহিনীর কয়েকটি গাড়ি সড়ক বেয়ে রুহিয়ার বাজারের দিকে ছুটে গেল৷ এর ঠিক কয়েক মিনিট পর একটি গাড়ি মিশনের সামনে থামলো৷ চারজন সৈন্য গাড়ি থেকে নেমে ফাদারের কাছে ছুটে এসে বলল, ‘তারা ফাদারের বাড়ি ঘর দেখতে চায়৷’ সৈন্যরা ধারণা করেছিল অথবা তাদেরকে ধারণা দেয়া হয়েছিল মিশনে মুক্তিযোদ্ধা থাকতে পারে৷ ফাদার লুকাস মারান্ডী সৈন্যদেরকে অফিস ঘর, শোবার ঘর এমনকি খাবার ঘরও দেখালেন৷ এরপর তিনি মিশনের বাবুর্চি সহিস দাসকে সবার জন্য চা তৈরি করতে বললেন৷ সহিস বাবুর্চি এসে জানতে চাইল ফাদার কতজনের চা? তখন একজন সৈন্য বাবুর্চিকে চড় মারলে বাবুর্চি প্রাণ ভয়ে পালিয়ে যায়৷ আর ঠিক তখনই সৈন্যদের একজন ফাদারের কানের নিচে গুলি চালায় এবং ফাদার মাটিতে লুটিয়ে পড়েন৷ তাঁর মৃত্যুর খবর ছড়িয়ে পড়ার সঙ্গে সঙ্গে লোকজন জড়ো হয় সেখানে৷ যাজক শহীদ ফাদার লুকাস মারান্ডীর মৃতদেহ ভারতের ইসলামপুর মিশনে নিয়ে যাওয়া হয় এবং সেখানে তাঁকে যথাযোগ্য মর্যাদায় সমাহিত করা হয়৷ শহীদ ফাদার মারিও ভেরোনেসিঃ অন্যান্য সব ফাদারদের মত এই ইটালিয়ান ধর্ম যাজকও একাত্তরে দিনরাত অক্লান্ত ব্যস্ত ছিলেন যুদ্ধাহত মানুষদের সেবায়। ১৯৭১ সালের ৪ এপ্রিল রেডক্রসের পতাকা, বুকে ঝোলানো রেডক্রসের ব্যাজ সব কিছু অবজ্ঞা করে হানাদার বাহিনী যশোর ক্যাথলিক চার্চে ঢুকে সাতজনকে গুলি করে হত্যা করে। শহীদদের রক্তভেজা ব্যাজ, রক্তে সিক্ত তুলা আলামত হিসেবে আন্তর্জাতিকভাবে সংরক্ষিত আছে। কিন্তু একজন ইটালিয়ান ফাদার, তিনজন মহিলাসহ খ্রিস্টধর্মের ওই সাতজনের হত্যাকাণ্ডের বিচার হয়নি। তাঁদের শহীদের মর্যাদাও দেওয়া হয়নি।

ঘটনার প্রত্যক্ষদর্শী পরেশ সরদার। তাঁর বাবা অনিল সরদারকেও সেদিন হানাদাররা গুলি করে হত্যা করেছিল। পরেশ সেদিনের নৃশংস ঘটনার বর্ণনা করতে গিয়ে বললেন, ‘ক্যাথলিক চার্চের ফাতিমা হাসপাতালে যুদ্ধাহতদের চিকিৎসার তদারকির দায়িত্ব পালন করতেন ফাদার মারিও। এখানে কয়েক হাজার মানুষ প্রাণভয়ে আশ্রয় নিয়েছিল। আমাদের পরিবারও সে সময় চার্চে আশ্রয় নেয়।

বিকেল ৪টার দিকে হানাদাররা গালি দিতে দিতে চার্চে প্রবেশ করে। জানালা দিয়ে আমি দেখি, ফাদার মারিও দুই হাত উঁচু করে এক সেনার সঙ্গে কথা বলার চেষ্টা করছেন। কিন্তু তাঁকে কথা বলার সুযোগ না দিয়ে গুলি করা হয়। শহীদ ফাদার উইলিয়াম ইভান্স: এই আমেরিকান ধর্ম যাজকও ১৯৭১ সালে সাড়া দিয়েছিলেন মানবতার ডাকে। সদা হাস্যময় এই ফাদার আশ্রয় দিয়েছিলেন হাজারো রিফুজিদের, গেরিলা এবং মুক্তিযোদ্ধাদের।

নভেম্বর ১৩,১৯৭১ সালে বক্সানগর গ্রামে যাবার পথে নওয়াবগঞ্জ পাকিস্তানী ক্যাম্পে নৌকা থামাতে বলে পাকিস্তানীরা। নৌকা থেকে নামার সাথে সাথে রাইফেলের বাঁট দিয়ে প্রচণ্ড আঘাত করে এই হাস্যময় মানুষটির মুখে। মৃত্যু নিশ্চিত করতে পর পর আরো দুটি গুলী করা হয় ফাদারের বুকে এবং চার্জ করা হয় বেয়োনেট। তারপর তার লাশ ছুঁড়ে ফেলা হয় নদীতে। পড়ে সাধারণ মানুষ লাশ খুঁজে পেয়ে এই ফাদারকে গোল্লা চার্চে সমাহিত করে।

এছাড়া ফাদার পিনোস,ফাদার হোমারিকসহ আরো অনেক জানা অজানা মানুষ আছে যারা একাত্তরে অবদান রেখেছেন এদেশের স্বাধীনতায়। শ্রদ্ধা রইলো এসব মানবতাবাদী মানুষদের প্রতি যারা দেশ,জাতি,বর্ণ-গোত্রের ঊর্ধ্বে উঠে ‘মানুষ’ পরিচয়টিকে করেছিলেন মহিমান্বিত। অপরিসীম শ্রদ্ধা রইলো এসব মহান মানুষদের প্রতি। উৎস ঃ *মুক্তিযুদ্ধের কিছু মহান মানূষের গল্প* বইটি থেকে এই মহান মানূষদের তথ্য নিয়েই এই লিখাটি লিখেছি । এইসব মহান মানুষদেরকে স্যালুট ।

সোর্স: http://www.somewhereinblog.net     দেখা হয়েছে ১৪ বার

অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।