আমাদের কথা খুঁজে নিন

   

পাহাড়কন্যা বান্দরবান



অপার সৌন্দর্য আর সবুজ পাহাড়ে ঘেরা বান্দরবান পার্বত্য জেলা। সর্বোচ্চ সংখ্যক ক্ষুদ্র নৃ-গোষ্ঠী,সর্বোচ্চ শৃঙ্গ,পাহাড়ী নদী আর অসংখ্য প্রাকৃতিক নয়নাভিরাম দৃশ্যপট বুকে নিয়ে এ পার্বত্য জেলা আপন মহিমায় সমুজ্জল। এখানকার জীবন-জীবিকা,সামাজিক আচার অুনষ্ঠান ও ধর্ম নানা বৈচিত্রে পরিপূর্ণ। পাহাড়ী কন্যা বান্দরবানে বেড়ানোর মত অসংখ্য জায়গা রয়েছে। এসব জায়গা দিনে দিনে দেশ বিদেশের পর্যটকদের নিকট অতি জনপ্রিয় হয়ে উঠছে।

আর এসব নৈসর্গিক দৃশ্যের মোহমায়ায় গাজীপুর শুভসংঘের ক’জন শুভার্থী গিয়েছিল বান্দরবানে। নিসর্গপ্রেমী দলের ভ্রমণসঙ্গীরা হলেন গাজীপুর শুভসংঘের সভাপতি মো. মনির হোসেন, শুভসংঘ সদস্য মু. নাজমূল ইসলাম, মো. হুমায়ূন কবির, মো. মাঈনুল ইসলাম, মো. মনোয়ার হোসেন রনি ও ডা. বোরহান উদ্দিন অরণ্য। ১৮ জানুয়ারী ভ্রমণ শুরু আর ফিরতি যাত্রা ২৩ জানুয়ারী। এ ভ্রমণের অন্যতম উদ্দেশ্য ছিল বন নদী পাহাড় প্রকৃতি ও জীববৈচিত্র্য রক্ষায় স্থানীয় জনগোষ্ঠী ও আগত পর্যটকদের মধ্যে সচেতনতা বৃদ্ধি করা।



বান্দরবান-রুমা সড়কে শহর থেকে মাত্র ৮ কি.মি. যেতেই দেখা মিলল প্রাকৃতিকভাবে সৃষ্ট শৈলপ্রপাত ঝর্ণাটির।

এ ঝর্ণাটিতে প্রায় সবসময়ই পানি বহমান থাকে। এখানে স্থানীয় অধিবাসীদের হাতে তৈরী বিভিন্ন ধরনের দ্রব্যসামগ্রী পাওয়া যায়। এবার লক্ষ্য নীলগিড়ি। উচুঁ-নিচু আর আকাঁবাঁকা পাহাড়ী রাস্তা দিয়ে গাড়ি চলছে। চলছে অধ্যক্ষ হুমায়ূন কবিরের গান আর আমাদের গানের কসরত।

‘এই পথ যেন না শেষ হয়.... হুমায়ূন কবিরের সুরেলা কণ্ঠে গাওয়া এই গানটির সাথে আমরাও হারিয়ে গেলাম পাহাড়ী সৌন্দর্যের স্বপ্নলোকে। কিছু দূর এগিয়ে দেখতে পেলাম চিম্বুক পাহাড়। তারপর কিছুক্ষণ বিরামহীনভাবে গাড়ি চলার পর পৌছলাম কাক্সিক্ষত নীলগিরিতে। এটি বান্দরবান জেলা সদর হতে ৫২ কি.মি. দূরে থানছি সড়কে এবং সমুদ্র পৃষ্ঠ থেকে ২৪০০ফুট উচ্চতায় অবস্থিত। এটি পাহাড় আর আকাশের মিতালীর অপূর্ব নিদর্শন।

এখানে আগত পর্যটকরা প্রায়শই মেঘের ছোঁয়া পান।


নীলগিরিতে কিছুক্ষণ অবস্থান করে এবং প্রিয় কিছু মুহূর্তগুলো ক্যামেরাবন্দি করে ফিরে আসলাম বান্দরবান শহরে। দুপুরের খাবারের পর চল্লাম স্বর্ণ মন্দিরের খোঁেজ। এটি শহর থেকে ৪ কি.মি. দূরে সুউচ্চ পাহাড়ের চূড়ায় অবস্থিত। স্বর্ণ মন্দিরটি থাইল্যান্ড ও মিয়ানমারের স্থাপত্য নকশায় তৈরী আধুনিক স্থাপত্য শিল্পের এক অনন্য সৃষ্টি।

পরের গন্তব্য মেঘলা পর্যটন কেন্দ্র। এটিও জেলা শহর থেকে ৪ কি.মি. দূরে ও জেলা পরিষদের বিপরীতে অবস্থিত একটি মনোরম পর্যটন স্পট। ঝুলন্ত ব্রিজ, কেবল কার, পেডেল বোট ও মিনি চিড়িয়াখানা এখানকার প্রধান আকর্ষণ। শেষ বিকেলে গেলাম নীলাচল পাহাড়ে। এটি বান্দরবান শহর থেকে প্রায় ৫ কি.মি. দূরে সুউচ্চ পাহাড়।

সুভ্রনীলা নামেও এটি পরিচিত। সমুদ্র পৃষ্ঠ থেকে এর উচ্চতা প্রায় ২০০০ ফুট। নীলাচল থেকে সমগ্র বান্দরবান শহরটি এক নজরে দেখা যায়। সময়ে সময়ে এখানে আগত পর্যটকদের মেঘ ছুঁেয় যায়।


এবারের গন্তব্য বগালেক।

বান্দরবান শহর থেকে বাসযোগে রুমা তারপর রমা বাজারে সেনা ক্যাম্পে নাম নিবন্ধন করে গাইড নুরুল ইসলামকে নিয়ে সফর শুরু বকালেকেরে উদ্দেশ্যে। পাহাড়ী অধ্যুষিত থানা পাড়া,মোল্লাই পাড়া,সইরাটং পাড়া ও কমলা বাজার হয়ে অবশেষে দলটি বগালেকে পৌছল। রুমা উপজেলা সদর থেকে ১৫ কি.মি. দূরে সমুদ্র সমতল থেকে প্রায় ২৭০০ ফুট উঁচু পাহাড়ের উপর প্রাকৃতিক ভাবে সৃষ্ট বগালেক। এ লেকটি নিয়ে অনেক পৌরাণিক কাহিনী প্রচলিত আছে। তারপর হারমন পাড়া,লুনতুন পাড়া,চিংড়ি ঝর্ণা ও দার্জিরিং পাড়া হয়ে অবশেষে শুভসংঘের নিসর্গপ্রেমী দলটি কেউক্রাডংয়ে উঠতে সক্ষম হল।

এটি রুমা উপজেলা সদর হতে ৩০ কি.মি. দূরে অবস্থিত। সমুদ্র পৃষ্ঠ থেকে এর উচ্চতা প্রায় ৩১৭২ ফুট। এখানে রয়েছে একটি সেনা ক্যাম্প ও মেঘমালা নামে একটি গেষ্ট হাউজ। এখানকার সেনা সদস্যদের আতিথেয়তা মুগ্ধ হওয়ার মতো।



এখানে জানিয়ে রাখা ভালো বাংলার আমাজানখ্যাত সাঙ্গু বা শঙ্খ নদী পুরো বান্দরবানকে মায়ের মমতায় জড়িয়ে রেখেছে।

নদীটির নাম বাংলায় ‘শঙ্খ’ কেন, তার কোন ঐতিহাসিক তথ্যসূত্র পাওয়া যায়নি। ধারণা করা যায়, ব্রিটিশ আমলে বাঙালি আমলারা গেজেটিয়ার করার সময় এটিকে ‘শঙ্খ নদী’ হিসেবে নথিভূক্ত করেন। যদিও ‘শঙ্খ’ বলতে যে ধরণের সামূদ্রিক শামুকের কথা বোঝায়, নদীর দুপাড়ে যুগ যুগ ধরে বসবাসকারী আদিবাসী পাহাড়িরা জানিয়েছেন, এ নদীতে আদৌ সে ধরণের শঙ্খের অস্তিত্ব কখনোই ছিল না। সম্ভবত ১৮৬০ সালে চট্টগ্রাম ও পার্বত্য চট্টগ্রামের গেজেটিয়ার প্রকাশকালে ব্রিটিশ শাসকেরা ইংরেজীতে একে ‘সাঙ্গু’ নদী হিসেবে চিহ্নিত করেন। তবে মারমা আদিবাসীরা তাদের ভাষায় শঙ্খ নদীটিকে ‘রিগ্রাই খিয়াং’ অর্থাৎ ‘স্বচ্ছ নদী’ নামে আদিকাল থেকে ডেকে আসছেন।

নদীটির দৈর্ঘ্য প্রায় ২৭০ কি.মি. এবং এটি চট্রগ্রাম বিভাগের দ্বিতীয় বৃহত্তম নদী। ছোটবড় র্ঝণা থেেক সৃষ্টি হওয়া ছোট ছোট ছড়া এসে মিশেছে শঙ্খ নদীতে। এ নদীর দু’পাড়ে বাসন্দিাদরে অধকিাংশই মারমা বা অন্য কোনো নৃ-গােষ্ঠীর মানুষ। তাদের অধকিাংশরেই পেশা আবার জুম চাষ। কয়কে দশক আগেও এ নদীর দু’তীরে ছিল ঘন বন।

সে বনে বিচরণ করতো হাতি, বাঘ, ভালুক, হরিণ, বানর, বনবেড়াল, ময়ূর, হনুমান, উল্লুকসহ আরো অনকে বিরল প্রজাতির প্রাণি। ছিলো অনেক প্রজাতির অজগর। নদীর জলে অবাধে সাঁতরাতো রুই-কাতলা, গলদা চংিড়ি, শোল, মাগুর, সিং, মৃগলেসহ আরো কতো নাম না জানা মাছ। নদী অববাহিকায় প্রচুর পলি জমতো পাহাড়ি ঢলে। সার ছাড়াই হতো ধান, ডাল, শাক-সবজি, বাদামের বাম্পার ফলন।

বান্দরবানরে প্রধান যোগাযোগরে মাধ্যমও ছিলো এ নদী।


সব মিলিয়ে বান্দরবানবাসীর জীবন ও জীবকিার প্রধান উৎস ছিলো সাঙ্গু। কিন্তিু নির্বিচারে নদী তীরবর্তী বৃক্ষ নিধনে প্রাণী বৈচিত্র্যের স্বভাবটাই যেন পাল্টে গেছে সাঙ্গুর। একই পাহাড়ে বারবার জুম চাষে ভূমিক্ষয় বেড়েছে আশঙ্কাজনকভাবে। তাই শুভসংঘ নিসর্গপ্রেমী দলটির চাওয়া সীমাহীন অযতœ,অবহেলা,অনাদর ও অসচেতনতার কারণে বান্দরবানের মায়াময় প্রকৃতি ও প্রতিবেশ ব্যবস্থা যেন ধ্বংস হয়ে না যায়।




লেখক: বাংলাদেশ নদী বাঁচাও আন্দোলনের কেন্দ্রীয় সাধারন সম্পাদক। ।

সোর্স: http://prothom-aloblog.com

অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।

প্রাসঙ্গিক আরো কথা
Related contents feature is in beta version.