আমাদের কথা খুঁজে নিন

   

প্রিয়দর্শনের গাঁজা এবং সেই কিশোর ...

তুমি আমি আমরা ......


ক)

তাহলে কি এই কুঁজো হয়ে হাটা ভদ্রলোকটিই ‘গাঞ্জুট্টি প্রিয় ‘ ?

রায়হান বেশ কিছুটা সময় ধরে ভদ্রলোকটিকে অনুসরণ করছে । নিজেকে কিশোর গোয়েন্দা মনে হচ্ছে তার । তবে সে একটা বিষয়ে সিদ্ধান্তে আসতে পারছে না । গাঞ্জুট্টি প্রিয়কে কি ভদ্রলোক ডাকা উচিৎ হচ্ছে ? ভদ্রলোক হবার যোগ্যতার মাঝে একজন গাঁজা বিক্রেতাকে জায়গা দেয়া যায় কিনা রায়হান বুঝতে পারছে না । কাউকে জিজ্ঞাস করলে ভালো হতো ।

কাকে জিজ্ঞাস করা যায় ? বাবাকে ?

-বাবা জানো , আমি না একজন গাঁজা বিক্রেতাকে ফলো করছি । এখন উনাকে আমি ‘ ভদ্রলোক নাকি শুধু লোক বলবো বুঝতে পারছি না ? আমি ডিস্ক্রাপশন দিচ্ছি তুমি বলে দাও তো উনাকে কি বলা উচিৎ !

এমনিতে বাবা রায়হানের সকল প্রশ্নের উত্তরদাতা হলেও গাঞ্জুট্টি প্রিয় সম্বন্ধে কোন প্রশ্ন করার অর্থ বাবার নির্বাক হয়ে রায়হানের কথা শোনা । একমাত্র ছেলের মুখে এমন অদ্ভুত প্রশ্ন শুনে নির্ঘাত তিনি পাগল হয়ে যাবেন ।
সুতরাং উত্তরদাতার লিস্ট থেকে বাবা বাদ । বাকি থাকলো মাত্র একজন ।

কবি হোসেন সম্রাট । রায়হানের ক্লাসম্যাট সম্রাট হোসেন একজন বড় কবি এবং তার কাছে তাবৎ দুনিয়ার কাব্যিক সব উত্তর জমা আছে । মজার বিষয় উত্তর ভুল বা সঠিক যাই হোক না কেন , সম্রাট হোসেন সকল প্রশ্নের উত্তর দেয় খুব কনফিডেন্সের সাথে । যেন সে যা বলেছে তাই সঠিক এবং ধ্রুব ।
তবে রায়হানের মতে সবচেয়ে ভালো হয় সরাসরি গাঞ্জুট্টি প্রিয়কে প্রশ্নটা করতে পারলে ।

কারণ সবচেয়ে সেরা উত্তর খুব সম্ভবত তিনিই দিতে পারবেন ।
রায়হান আপাতত ভদ্রলোক / লোক ইস্যু সাইডে রাখতে চাচ্ছে । সামনে তার কঠিন সময় । রায়হানকে গাঞ্জুট্টি প্রিয়’র সাথে কথা বলতে হবে এবং একটি বিষয়ে তাকে কনভিন্স করতে হবে ।

গাঞ্জুট্টি প্রিয় বেশ লম্বা ।

তাই যখন হাঁটেন কিছুটা কুঁজো হয়ে যান । মনে হয় একটা উঁচু বিল্ডিং মাটি দেখে দেখে হেঁটে যাচ্ছে । এমন করে রায়হানের মেজো মামা হাঁটতেন । ঐ যে রায়হানের সেই মেজো মামা যিনি ভাত খাবার সময় ঝাল করে টমেটো ভর্তা খেতে পছন্দ করেন । ঠিক তার মতো ।


গাঞ্জুট্টি প্রিয়’র চুল সাদা কালোয় মিশানো । লম্বা চুল পিছনে রাবার ব্যান্ড দিয়ে শক্ত করে বাঁধা । গাঁয়ের ফর্সা রঙ আর ঘন দাড়ি গোঁফে তার চেহারায় একটা সূফী ভাব চলে এসেছে ।

ল্যাবরোটরি স্কুলের পিছনের গলিতে ইকবালের চায়ের দোকানে গাঞ্জুট্টি প্রিয় দুপুরের পর এসে বসেন । দোকানের সাথে লাগোয়া বেঞ্চে বসে তিনি একের পর এক লাল চায়ের অর্ডার দেয় আর গাঁজার ছোট্ট ছোট্ট পুটলির হাত বিনিময় চলে ।

তার গাঁজা অনেক জনপ্রিয় হওয়ায় তাকে ডাকা হয় গাঞ্জুট্টি প্রিয় ।
গাঁজাখোরেরা প্রতিদিন এই সময়ের অপেক্ষায় থাকে । তাঁর গাঁজা আশেপাশের সকল এলাকা মধ্যে বিখ্যাত ! তবে উনার ব্যাবসার একটা ধরন আছে । দর্শনবিচার । তিনি যাকে তাঁকে গাঁজা দেন না ।

কেউ তার কাছে গাঁজা নিতে আসলে আগে তাকে দর্শনবিচার পরীক্ষার মুখোমুখি হতে হয় ! বিচারে সবুজ সিগন্যাল জ্বললেই কেবল পুটলি ডেলিভারি ! এই জন্য অনেকে তাকে প্রিয়দর্শনও ডেকে থাকেন । রায়হানের কাছে প্রিয়দর্শন নামটি পছন্দ । নামটায় আর্ট আছে ।

প্রিয়দর্শনের এই দর্শন বিচার কিসের আঙ্গিকে হয় তার কোন সঠিক হিসাব নেই । কখন কাকে পুটলি দেয়া হবে তা সম্পূর্ণ প্রিয়দর্শনের নিজস্ব ইচ্ছার উপর নির্ভর করে ।

হয়তো এই জন্যই পুলিস আর প্রিয়দর্শনের বরফ পানি খেলায় আজ পর্যন্ত তাঁকে বরফ বনে যেতে হয়নি ।

রায়হান প্রিয়দর্শনের সব গল্প শুনেছে তার একমাত্র বন্ধু কবি হোসেন সম্রাটের কাছ থেকে ! ইদানীং প্রিয়দর্শনের গাঁজার সুবাদে সম্রাট নিজেকে আর কবি দাবী করছে না । সে এখন নিজেকে গাঞ্জুট্টি সম্রাট হিসেবে বন্ধু মহলে প্রতিষ্ঠা করতে চাচ্ছে । তার ধারণা সে যখন গাঁজা খায় তখন সে সত্যিকারের সম্রাট হয়ে যায় । প্রিয়দর্শনের গাঁজা ছাড়া দাদীর দেয়া সম্রাট হোসেন নাম তার কাছে একটা বুজরুকি ছাড়া ভিন্ন কিছু নয় ।

প্রিয়দর্শনের গাঁজা টানা সাথে সাথে তার কাছ থেকে একের পর এক মাস্টারপিস সাহিত্য বের হয়ে আসে ! এই সাহিত্যের ধারে কাছে যাওয়া রবীন্দ্রনাথ থেকে শুরু করে হালের হেলাল হাফিজ কারও পক্ষে সম্ভব নয় ।

এই কথা রায়হান কিছুটা বিশ্বাস করে । যদিও রবীন্দ্রনাথ , হেলাল হাফিজ এই উদাহরণগুলো বেশি হয়ে যায় তারপরও রায়হান লক্ষ্য করেছে গাঁজা খাবার পর সম্রাট উঁচু পর্যায়ের ফিলসফি করতে পারে । যেটা সে সাধারণ অবস্থায় পারে না । আর তাই সম্রাটের বর্তমান ওস্তাদ একজন - প্রিয়দর্শন ।

সে প্রিয়দর্শনের অন্ধ ভক্ত । তবে দুর্ভাগ্য একবারও সে দর্শন বিচারে পাশ করতে পারেনি ! সে প্রিয়দর্শনের গাঁজা টেনেছে তাঁর এলাকার এক বড় ভাইয়ের মাধ্যমে ! সেই থেকে সম্রাটের মুখে প্রিয়দর্শনের গুণকীর্তন !সেই কীর্তন শুনতে শুনতে রায়হান সিদ্ধান্ত নিয়েছিল ক্লাস এইটের বার্ষিক পরীক্ষা যেদিন শেষ হবে ঠিকসেদিন সে গাঁজার স্বাদ নিবে এবং সেটা গাঁজাটা হতে হবে অতিঅবশ্যই প্রিয়দর্শনের বিখ্যাত গাঁজা !

খ )

প্রিয়দর্শনের বিখ্যাত গাঁজা টানলে সত্যিকারের সম্রাট হওয়া যায় এই জন্য রায়হান গাঁজা টানার প্ল্যান হাতে নেয়নি । রায়হান গাঁজা টানতে চায় কারন সে শুনেছে গাঁজা টানলে স্বপ্ন দেখা যায় ! তার মা তিন বছর আগে যখন আত্মহত্যা করে তারপর থেকে রায়হান আর স্বপ্ন দেখতে পারছে না । রাতে সে অনেক ভাবনা চিন্তা করে ঘুমায় । আজ স্বপ্ন দেখবেই দেখবে ।

কিন্তু কোথায় কি ! স্বপ্নের ‘ স ‘ ও বহুদিন রায়হানের চোখে ধরা দেয়নি ।
বন্ধুরা ক্লাসে রসিয়ে কষিয়ে গল্প করে । কেউ কেউ স্বপ্নে বান্দরবন হিল ট্রাকে চড়ে বসে কেউ বা হয়ে যায় বিশাল বড় বিমানের পাইলট । কেউ বা স্বপ্নে হয় দোষী । তারা বলে -
আরে বস ! আইজকা তো মনিকা বেলুচ্চিরে স্বপ্নে নামাইয়া দিলাম ! বেলুচ্চিরে পুরা খসাইয়া তব্ধা কইরা দিছি মামা ! সকাল বেলাত দেখি পুরা আউট ! প্যান্ট তো এক্কেবারে প্লাস্টার ! আরেকজন বলে – আরে দূর বিদেশী মালের টাইম আছে নাকি এখন ! আমি তো দোষ ঘটাই দেশী আইটেম লইয়া ! পরশু রাইতে নায়িকা মৌ...

রায়হান দোষ দূরের কথা সে এখন পর্যন্ত স্বপ্নের ত্রি সীমানাতেই ডুকতে পারছে না ! সে যে স্বপ্ন দেখাই ভুলে গেছে ।



রায়হান তীব্রভাবে চায় স্বপ্ন দেখতে । সে স্বপ্নে অনেক উচু ছাদের একদম কিনারায় পা দুলিয়ে বসতে চায় । যে সন্ধার আড়ালে হয়ে যাবে পাখি ।
মাঝে মাঝে স্বপ্নে সে ফেলুদা তপসে লালমোহন বাবুর সঙ্গী হতে চায় । কখনো সে চায় মেজর জেনারেল রাহাত খানের তত্ত্বাবধানে mr9 এর সাথে দুর্দান্ত এসপিওনাজ হতে অথবা হ্যারি পোর্টার সিরিজের ড্যানিয়েল জ্যাকব রেডক্লিফের মতো কোন মুভি স্টার !
অনেক কিছু হতে চায় রায়হান ।

বাস্তবে যা সম্ভব না সেটা স্বপ্নে সম্ভব ।

মূলত বাস্তবে রায়হান কি ? বাস্তবে সে খুব সাধারণ এক নিয়মে চাপাপড়া কিশোর । যার প্রতিদিন সকাল ৬ টায় ঘুম থেকে উঠতে হয় । ঢুলুঢুলু চোখে দাঁত ব্রাশ করে দু ‘ পিস পাউরুটি ফ্রিজের তরকারিতে মিশিয়ে গিলে সে দৌড়ায় স্কুলের উদ্দেশ্যে । তারপর ক্লাসরুমের পিছনের বেঞ্চে বসে ফাঁকা চোখে ব্ল্যাকবোর্ড দেখা ।

দুপুরে বাসায় এসে রওশনা বুয়ার হাতের পাবদা মাছের ঝোল কিম্বা মুরগীর ঝাল মাংশ গলায় ঠেলে চলে যায় বিছানায় । হাতের কাছে সেই সেবা প্রকাশনীর তিন গোয়েন্দা সিরিজ কিংবা কাজি আনোয়ার হোসেনের মাসুদ রানা । বইয়ের নায়কদের নতুন মিশনের উত্তাপ আর গায়ে তাপ দেয় না রায়হানের । শেষে বিকেলে পিসি মনিটরের সামনে বসে ফিফা খেলা , সন্ধ্যার পর বিরস মুখে হোম ওয়ার্ক শেষ করে আবার পাবদা মাছের ঝোল কিম্বা মুরগী খাওয়া । রাতে খাবার টেবিলে ব্যাংকার বাবা কখনো সুশিক্ষার গৎবাঁধা ছবক দেন পুত্রকে ।

বিশাল টেবিলে দুজন মানুষের একপক্ষ ভাষণ কেবল বিরক্তি ছড়ায় । রায়হান মাথা নিচু করে শুনে । উপদেশ শ্রবন শেষে রুমে এসে অন্ধকার ঘরে ঝিম মেরে বসে থাকে । ঘুমাবার আগে হয়তো স্পোর্টস চ্যানেল ঘুরানো , রেস্লিং দেখা অথবা বুকমার্ক করে রাখা পর্ণ সাইট ভিজিট ! একঘেয়ে ছন্দহীন একলা জীবন রায়হানের আর সহ্য হয় না । বিরক্তির চরম মুহূর্তে যখন সব কিছু অসহ্য লাগে তখন সামনের দেয়ালে মায়ের ছবির সাথে গল্প জমানোর চেষ্টা করে ! মায়ের ঠোঁট নড়া সে দেখতে পায় ।

কিন্তু শব্দের কোন মানে বুঝতে পারে না ।

এই তো রায়হান । একটা মানুষকে কতো সহজেই বর্ণনা করা হয়ে যায় ! কিন্তু তাই বলে এতো সহজে !
স্বপ্ন । রায়হানকে স্বপ্ন দেখতে হবে । অনেক গুলো স্বপ্ন দেখতে হবে ।

হরেক রকমের হরেক প্রকারের । স্বপ্নে রয়েছে রায়হানের মুক্তি ।


গ )

--আদাব দাদা ! আমি রায়হান । প্রিয় দর্শনের সামনে দাড়িয়ে রায়হানের বুক দুরুদুরু করছে ।
প্রিয়দর্শন চায়ের কাপে পরপর চুমুক লাগাচ্ছিল ।

বক্তার দিকে ফিরেও তাকালো না । রায়হান আবারো বলল – দাদা , আদাব !
এবারও প্রতিক্রিয়া নেই ! রায়হান ধড়ফড়ানি আরও বেড়ে যায় । এমনেই সে প্রচণ্ড ভয়ে এই জায়গায় এসেছে ! একদম অপরিচিত মানুষ তারপরও আবার গাঁজার সাপ্লায়ার । সম্রাটের কাছে প্রিয়দর্শনের ঠিকানা পাবার পর থেকেই সে একধরনের আতঙ্ক , উত্তেজনা , ভয় সব মিশিলে একটা খিচুড়ির ভিতরে অবস্থান করছে । একবার ভেবেছিল আসবে না ।

শেষ পর্যন্ত এই জায়গায় দাঁড়ানোর মূল প্রভাবক হিসেবে কাজ করেছে তাঁর স্বপ্ন দেখার দূর্বার আকাঙ্ক্ষা । কিন্তু এখন সেই স্বপ্নের তরণ দ্বারে এসে যদি তার স্বপ্নদাতা ’ মুক ও বধির’ হয়ে যায় তাহলে কিভাবে হবে !
রায়হান এবার একটু জোর দিয়ে উচ্চারন করলো – ভাইয়া , আসালামুয়ালাইকুম

যেই বোবা কালা সেই মুক ও বধির ! প্রিয়দর্শন আরেক কাপ চা হাতে তুলে নিয়েছেন । তাঁর সামনে যে একটি ভীত সন্তস্ত্র কিশোর দাড়িয়ে সে দিকে তাঁর বিন্দু মাত্র ভ্রূক্ষেপ নেই !
এইভাবে রায়হানের স্বপ্নমালিক তাঁকে অস্বীকার করছে ! রায়হানের মনে হল তাঁর নিঃশ্বাস নেবার সম্বলখানা ধীরে ধীরে তাঁকে ভেংচি কেটে হাতছাড়া হয়ে যাচ্ছে ,খুব নিষ্ঠুরভাবে ।

--স্যার , দয়া করে আমাকে স্বপ্ন দেখতে সাহায্য করুন । আমি আবার স্বপ্ন দেখতে চাই ।



এর নামই কি ব্যাকুলতা ? হাত জোড়রত রায়হানের দিকে খুব আস্তে আস্তে প্রিয়দর্শন তাকালেন । স্থির চোখে রায়হানকে দেখছেন তিনি । কয়েক সেকেন্ড পর প্রিয়দর্শন খুব নিচু স্বরে বলল – বসো !

ঘ )

সামনের বেঞ্চে বসা জড়সড় কিশোরের দিকে প্রিয়দর্শন মনোযোগ দিল ! বয়স কতো ছেলেটার । তের নাকি চোদ্দ ? কচি মুখটায় হালকা গোঁফের একটা রেখা আসবো আসবো করছে । ঝাঁকড়া চুলের অধিকারী বালকটির স্বাস্থ্য খুব নাজুক ! তাতে অবহেলার ছাপ স্পষ্ট ।

বাবা-মা ছাড়াছাড়ি নাকি মা মৃত ? দারিদ্র্যতার ছাপ না থাকলেও মমতার অপূর্ণ অসহায়ত্বের প্রকটতা ছেলেটিকে অনেকটাই নিঃস্ব করে দিয়েছে ! তবে ছেলেটির সবচেয়ে আকর্ষণীয় অংশ হচ্ছে তার হাত ! সে যখন কথা বলে তাঁর হাতও যেন সঙ্গে সঙ্গে বুঝাতে চায় সে কি বলতে চাচ্ছে !

--আমি স্বপ্ন বেচাকেনা করি এই তথ্য তোমাকে কে দিয়েছে ? ছেলেটির চোখে চোখ রেখে প্রিয়দর্শনের শান্ত প্রশ্ন ।
--আপনার কাছে ভিন্নধরণের গাঁজা পাওয়া যায় , আমি শুনেছি গাঁজা খেলে মানুষ স্বপ্নবাজ হয়ে যায় !
--ও তাই নাকি ! তা স্বপ্নবাজ হলে কি হয় ?
--নিজের ভিতরের অপূর্ণতা স্বপ্ন দিয়ে পূরণ করা যায় ।
প্রিয়দর্শন চায়ের কাপ নামিয়ে রাখলো । বাহ ছেলেটা তো খুব মায়া করে কথা বলে । দু হাত উপরে তুলে আড়মোড়া ভেঙ্গে প্রিয়দর্শন জিজ্ঞাস করলো -
--তুমি কি চা খাবে ?
রায়হান উপর নীচ মাথা নেড়ে হ্যাঁ বলল ।

চায়ের কাপ হাতে নিয়ে সে প্রিয়দর্শনের দিকে তাকাল –
--সন্ধ্যা হয়ে আসচ্ছে । আমাকে ফিরতে হবে । আমাকে একটু গাঁজা দিবেন স্যার ?
--তাড়া কিসের ! আমাদের হাতে অফুরন্ত সময় বিধাতা বিনা কারনে দিয়ে রেখেছেন । আরাম করে বসো । আর আরেকটা কথা আমাকে স্যার বলবে না ।

আমি তোমাকে রাজা চন্দ্রগুপ্তের সভাকবি কে এই বিষয়ে কিছু শিখাইনি যে গদগদ করে স্যার বলতে হবে ।
--ঠিক আছে বলবো না । কিন্তু আমাকে তাড়াতাড়ি ফিরতে হবে ।
--কেন ?
--বাবা বাসায় আসবেন আর কিছু সময় পর । আমার কাছে বাসার চাবি ।

বাবা বাসার গেটে ডুকার আগেই আমাকে বাসায় উপস্থিত থাকতে হবে । আমাকে না পেলে উনি অস্থির হয়ে যাবেন । আমি ঝামেলা চাচ্ছি না ।
--তুমি না স্বপ্নবাজ হতে চাও ! স্বপ্নবাজদের ঝামেলা পাশ কাটিয়ে গেলে কি চলে ? স্বপ্নে কতো কিছুর পরিবর্তন হবে ! কতো কি ভাঙবে , গড়বে । নতুন পুরোতন , চাওয়া , না পাওয়া , প্রাপ্তি ব্যর্থতা একাসাথে গিট্টু বেঁধে যাবে ! তখন এইসব ঝামেলা কিভাবে পাশ কাটাবে ?
--আমি আমার স্বপ্ন নিয়ন্ত্রন করবো ! আমি যা চাইবো আমার স্বপ্নগুলো তাই করবে !
--পারবে ?
--জানি না তো ।

আমি তো স্বপ্ন ই দেখতে পারি না ! আমি আপনার গাঁজার ভরসায় আছি । প্লীজ আমাকে স্বপ্ন দেখতে সাহায্য করুন । প্লীজ
হটাৎ গাম্ভীর্য খসে পড়লো প্রিয়দর্শনের ! হো হো করে হাসছে একেবারে ঠাণ্ডা স্বভাবের প্রিয়দর্শন ! চোখে পানি চলে এসেছে তার ! রায়হান থতমত । সে এমন কি বলেছে যে এতো ভয়ঙ্কর ভাবে হাসতে হবে ! গাঁজাখোররা কি এমন ই হয় নাকি ! সম্রাটও মাঝে মাঝে এমন অদ্ভুত আচরন করে ।
--এই ভরসা শব্দখানা বড় ই আজব , বুঝলে ভাই ! “ অনেকদিন পর আমার উপর ভরসা শব্দখানার ধনাত্মক ব্যবহার শুনলাম ! আমার গাঁজাতে তোমার ভরসা ! স্বপ্ন দেখতে পাবার ভরসা ! আমার গাঁজাতে ! হো হো হো ... প্রিয়দর্শন এখনো হাসছে ।


--কেন আপনি নিজে কি স্বপ্ন দেখেন না ? রায়হানের বুঝতে না পারা সরল প্রশ্ন ।
চোখের পানি মুছে প্রিয়দর্শন রায়হানের হাত থেকে চায়ের খালি কাপ নিয়ে আরেক কাপ ধরিয়ে দিল ।
--হুম দেখি তো । আমি স্বপ্ন দেখি ! আমি প্রতিনিয়ত প্রতিক্ষন স্বপ্ন দেখি ! মুলত আমি ভয়ংকর এক স্বপ্ন চক্রে আটকে গেছি ।
-- মানে ? স্বপ্ন-চক্র কি ? রায়হান এমন শব্দ আজ প্রথম শুনলো ।

স্বপ্ন-চক্র !

মাথার ঝুঁটি করা ব্যান্ড খুলে হাতের কব্জিতে জড়িয়ে নিল প্রিয়দর্শন । সাদা কালোয় মেশান ঘন চুল ছড়িয়ে তিনি মাথা নিচু করলেন । বেশকিছুক্ষণ ঝিম ধরে বসে থাকার পর মিহি সূরে বললেন --
-- আমি স্বপ্ন দেখি এক আবছায়া গলিতে আমাকে সবুজ খাটিয়ায় চড়িয়ে নিয়ে যাওয়া হচ্ছে ! আমি তাতে সটান হয়ে শুয়ে আছি ! শবযাত্রীরা উচ্চস্বরে বলছে “ বল হরি , হরি বল ; বল হরি , হরি বল - আমার মাথার কাছে জ্বলছে আগরবাতি ! কিন্তু আগরবাতির গন্ধটা অন্যরকম । এই গন্ধ আমার পরিচিত ! আগরবাতিতে ভর করেছে আমার গাঁজার গন্ধ ! শবযাত্রীরা আমার লাশ নিয়ে সেই আবছায়া গলি থেকে আরেক অন্ধকার গলিতে ডুকছে । সে অলি থেকে আবার আগের গলিতে ফিরে আসচ্ছে ।

চলতেই থাকে , চলতেই থাকে আমার সবুজ খাটিয়া !
--তারপর ?
-- তার আর পর কোথায় ? সবুজ খাটিয়া , আমি আর একদল শব যাত্রী । যেন লুপে ঘুরতে থাকে অহর্নিশ । জানো রায়হান , আমি খুব করে চাই আমার স্বপ্ন চক্র থেমে যাক । আমি আর স্বপ্ন দেখতে চাই না । সেই “ বল হরি , হরি বল ! বল হরি , হরি বল !’ শুনতে শুনতে আমি ক্লান্ত ।

গাঁজা মেশানো আগরবাতি আমার কাছে অসহ্য লাগে । কিন্তু আমার চক্র থামে না । তারা যে কেবল চলতেই শিখেছে ।
রায়হান অবাক হয়ে প্রিয়দর্শনের চোখে তাকিয়ে আছে । মানুষটার চোখ জুড়ে পানি ।

একজন মানুষের কান্নার ফোঁটা এতো বড় হতে পারে রায়হান প্রিয়দর্শনের কান্না দেখার আগ পর্যন্ত জানতো না !

বহুক্ষণ কেউ কোন কথা বলল না । এখন অন্ধকার হয়ে গেছে । বাবা এতক্ষনে বাসায় এসে গেছেন । রায়হানকে না পেয়ে নিশ্চয়ই তিনি দৌড়াদৌড়ি শুরু করে দিয়েছেন । রায়হান উঠে দাঁড়ালো ।

বাসার পথে সে এগিয়ে যায় । পিছনে একাকী বসে রয় স্বপ্ন-চক্রে জর্জরিত এক অচেনা প্রিয়দর্শন । তাকে পিছন ফেলে অনেক দূর চলে আসার পর রায়হানের মনে পড়ে উনাকে জিজ্ঞাস করা হয়নি তিনি কি ভদ্রলোক নাকি কেবল মাত্র একজন লোক ?

প্রশ্নটি অজানাই রয়ে গেল । থাক । কিছু প্রশ্ন হয়তো অজানাতেই মুক্তি ।




 

অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।

প্রাসঙ্গিক আরো কথা
Related contents feature is in beta version.