আমাদের কথা খুঁজে নিন

   

সাগরপথে মানব পাচার

সীমান্ত জেলা  কক্সবাজারের উখিয়া-টেকনাফের উপকূলীয় এলাকার সাগরপথ দিয়ে দীর্ঘদিন ধরে মানব পাচারে জড়িত রয়েছে রোহিঙ্গাসহ স্থানীয় দুই শতাধিক দালাল। উপকূলীয় এলাকায় আইনশৃঙ্খলা রক্ষায় নিয়োজিত স্থানীয় প্রশাসনের কতিপয় ব্যক্তির প্রত্যক্ষ-পরোক্ষ সহযোগিতায় সক্রিয় দালালরা দেশের বিভিন্ন এলাকা থেকে কম টাকায় মালয়েশিয়া পৌঁছে দেওয়ার কথা বলে অব্যাহত রেখেছে মানব পাচার।

জেলা সদরের খুরুশকুল, নাজিরার টেক, টেকনাফ, শাহপরীর দ্বীপ, হারিয়াখালী, কচুবনিয়া, সি-বিচ, বাহারছড়া শামলাপুর, সোনারপাড়া এলাকায় মালয়েশিয়াগামী যাত্রীদের জড়ো করে একাধিক সিন্ডিকেট মানব পাচারে সক্রিয় রয়েছে বলে অভিযোগ উঠেছে। প্রশাসন মাঝেমধ্যে লোক-দেখানো অভিযান চালিয়ে গুটিকয় মালয়েশিয়াগামীকে আটক করলেও মূল হোতারা থেকে যাচ্ছে ধরাছোঁয়ার বাইরে। মালয়েশিয়াগামী যাত্রী আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর হাতে আটক হলেও তাদের বিরুদ্ধে মানব পাচার আইনে মামলা না করে স্বজনদের হাতে বুঝিয়ে দেওয়া হচ্ছে।

গেল এক বছরে পাচারকারী চক্র অবৈধ পথে প্রায় ৫০ হাজারের বেশি লোক মালয়েশিয়ায় পাচার করেছে বলে বিভিন্ন সূত্রে জানা গেছে। ১১ ফেব্রুয়ারি ভোরে সেন্ট মার্টিনের অদূরে বঙ্গোপসাগরে অভিযান চালিয়ে ২১১ জন মালয়েশিয়াগামী যাত্রী আটক করেছে কোস্টগার্ড। সর্বশেষ ১ মার্চ সেন্ট মার্টিনের কাছে কোস্টগার্ড আরও ৭২ জনকে আটক করে টেকনাফ থানায় সোপর্দ করে। এ ব্যাপারে কোস্টগার্ডের সেন্ট মার্টিন স্টেশনের লে. কমান্ডার মোহাম্মদ আরিফ বলেন, এ ঘটনায় পৃথকভাবে ৯১ দালালের বিরুদ্ধে থানায় মামলা করা হয়েছে। মালয়েশিয়ায় আদম পাচার রোধ করতে অভিযান অব্যাহত থাকবে বলে তিনি জানান।

বিভিন্ন সূত্রে জানা গেছে, উপকূলের সাগরপথ দিয়ে মালয়েশিয়া মানব পাচার উদ্বেগজনক হারে বেড়ে চলেছে। রোহিঙ্গাসহ স্থানীয় লোকজনের বিরুদ্ধে জড়িত থাকার অভিযোগ থাকলেও তারা ধরাছোঁয়ার বাইরে। কিছু দালাল পুলিশের হাতে আটক হলেও তারা আইনের ফাঁক গলে জামিনে ছাড়া পেয়ে পুরোদমে ব্যবসা চালিয়ে যাচ্ছে। কোস্টগার্ড, বিজিবি ও পুলিশ বিভিন্ন সময় সমুদ্র উপকূল ও বিভিন্ন এলাকায় অভিযান চালিয়ে এক বছরে সহস্রাধিক মালয়েশিয়াগামী যাত্রীকে আটক করেছে। মানব পাচারের ঘটনায় এক বছরে মামলা হয়েছে ৪০টির বেশি।

অনুসন্ধানে জানা যায়, এক বছরে দালাল চক্রের সদস্যরা টেকনাফ শাহপরীর দ্বীপ পশ্চিমপাড়া, ঘোলাপাড়া, সাবরাং বাহারছড়া, হারিয়াখালী, কচুবনিয়া, সি-বিচ, বাহারছড়া শামলাপুর, উখিয়ার জালিয়াপালং, রত্নাপালং, হলদিয়াপালং, রাজাপালং ও পালংখালী দিয়ে হাজার হাজার মানুষ মালয়েশিয়া পাচার করেছে। এর মধ্যে কয়েক শ মানুষ নিখোঁজ রয়েছে বলে অভিযোগ উঠেছে। স্বজনহারাদের আহাজারিতে গ্রামগঞ্জের পরিবেশ ভারী হয়ে উঠলেও দেখার কেউ নেই। অবৈধ পথে অল্প টাকায় মালয়েশিয়ায় যাওয়ার কথা বলা হলেও যাত্রীরা সে দেশে পেঁৗছলে বন্দীশালায় আটকে রেখে মারধর, নির্যাতন করে স্বজনদের কাছ থেকে দালালরা আদায় করছে বিপুল পরিমাণ টাকা। এদিকে বিশেষ করে উখিয়ার কুতুপালং ও টকনাফের নয়াপাড়া শরণার্থী ক্যাম্পভিত্তিক একাধিক দালাল চক্র মানব পাচারের সঙ্গে সরাসরি জড়িত বলে নির্ভরযোগ্য সূত্রে জানা গেছে।

সরকার মানব পাচার প্রতিরোধ ও দমন আইন, ২০১২ প্রজ্ঞাপন আকারে জারি করলেও এ অঞ্চলে এ আইনের কার্যকারিতা নেই বললে চলে। সচেতন মহলের মতে, মানব পাচার প্রতিরোধ ও দমন আইনের যথাযথ প্রয়োগ এবং জড়িতদের গ্রেফতার করে আইনের আওতায় আনা হলে পাচার প্রতিরোধ সম্ভব। নির্ভরযোগ্য ও দায়িত্বশীল সূত্রে জানা গেছে, মালেয়েশিয়া মানব পাচারে জড়িতরা হচ্ছেন- টেকনাফের শাহপরীর দ্বীপের শরীফ হোছেন, নুর হোছন, ধলু হোছন, নুরুল আলম, আবদুস সালাম, মো. আমিন, মো. ইউনুছ, মো. ফিরোজ, লম্বা সেলিম, দেলোয়ার, আবু তাহের, হেলাল উদ্দিন, আবুল কালাম, ছৈয়দ উল্লাহ, মুজিবুল্লাহ, মো. শফি বাইন্যা, লম্বা জলিল, মো. ইসমাইল, নুর হাকিম মাঝি, আবুল হাশিম ওরফে পুয়া মাঝি, হাবিব উল্লাহ বতইঙ্গা, আবু বক্কর, মো. ইলিয়াছ, সোনা মিয়া, আবুল হোছন মাঝি, সাবরাং কচুবনিয়ার আবদুল হামিদ, নজির ডাকাত, আবদুল গফুর, রকিম মাঝি, ফরিদ মাঝি, রশিদ আহমদ ডাইল্লা, ইমান শরীফ, মুজিবুল্লাহ, শওকত আলম, জাহাঙ্গীর আলম, জিমা কাছিম, ছিদ্দিক আহমদ, নয়াপাড়ার নুরুল আলম, লাল মিয়া ওরফে দুয়াইন্না, মোয়াজ্জেম ওরফে ধানু, কোয়াইনছড়ী পাড়ার এজাহার মিয়া, কুইল্যা মিয়া, মোহাম্মদ, আলীডেইল এলাকার সাইদ কামাল, আক্তার কামাল, হাদুছড়ার আবদুল গফুর, মুন্ডার ডেইলের রব্বানী, শাকের আহমদ, মনু মিয়া, মোহাম্মদ হোছেন কালু, রশিদ মিয়া, শাহাব মিয়া, চকবাজার এলাকার হেফজ রহমান মাঝি ওরফে বার্মাইয়া ও তার বড় ভাই মুবিবুল্লাহ মাঝি (থাইল্যান্ড কারাগারে), লেদা ক্যাম্পের নুর হোছন, মো. নাগু, নাজির পাড়া গ্রামের কামাল, কুতুপালং শরণার্থী ক্যাম্পের দিল মোহাম্মদ, মো. ফারুক, জোবাইর হোসেন, চট্টগ্রাম কর্ণফুলী চিরার টেক গ্রামের রোহিঙ্গা মো. আজিম, উখিয়ার রূপপতি গ্রামের জমির মিয়া ও গফুর মিয়া, কুতুপালং শরণার্থী ক্যাম্পের আবু ছৈয়দ, আবু ছিদ্দিক, চোয়াংখালী গ্রামের ছলিম উল্লাহ, মাদারবনিয়া গ্রামের আবদুল জলিল, জালিয়া পালং ডেইল পাড়ার মো. আবু তাহের, জসিম উদ্দিন, রফিক উল্লাহ, রহমত উল্লাহ, কুতুপালং শরণার্থী ক্যাম্পের রোহিঙ্গা রবিউল আলম, পশ্চিম সোনারপাড়ার জালাল উদ্দিন, কুতুপালং শরণার্থী ক্যাম্পের ছৈয়দ আমিন, হামিদ হোসেন, আরিফ উল্লাহ, ছৈয়দ কাশেম, রশিদ উল্লাহ, মো. কালু, সোনারপাড়ার মো. শফিউল আলম, জয়নাল আবেদিন, জালাল উদ্দিন (২৮), টেকনাফের শাপলাপুর পুরান পাড়ার আশিক উল্লাহ, শহীদুল্লাহ, শফিউল্লাহ, বাহারছড়ার মৌলভি আজিজ উল্লাহ, সোনার পাড়ার নুরুল কবির, নুরুল আবছার, নজরুল ইসলাম, সাগের আলী ওরফে সাগর, মো. আলম, সোনাইছড়ি গ্রামের জিয়াউল হক, শফি আলম, মনখালী গ্রামের মোহাম্মদ হোছন, আবদুর রাজ্জাক, মো. ফয়সাল ও মোহাম্মদ হোছন, টেকনাফ উপজেলার কাটাবনিয়া গ্রামের জাহাঙ্গীর আলম, মো. রফিক, জাহাঙ্গীর আলম, মোজাহের মিয়া, যশোরের ঝিকরগাছার আজিজুল, নরসিংদীর চর আড়ালিয়া গ্রামের এমরান, মোমেন, মাদারবুনিয়ার আবদুল জলিল, লম্বরীপাড়ার বেলাল ওরফে লাল বেলাল, পশ্চিম সোনার পাড়ার জালাল উদ্দিন, চেপটাখালীর ফয়েজ ওরফে ফয়েজুর রহমান, আবুল কালাম, মাগুরার শালিকা গ্রামের মো. হাকিম,  কক্সবাজারের ইসলামপুর গ্রামের নাসির ওরফে নাসিজ্যা, রামুর খুনিয়াপালং গ্রামের মাহমুদুল হক, নুরুল কবির বাদশা, পশ্চিম সোনাইছড়ি গ্রামের মুজিবুল হক, দারিয়ারদীঘি গ্রামের মফিজুর রহমান, উত্তর বড়বিল গ্রামের মো. এরশাদ, মনখালী গ্রামের তোফায়েল আহম্মদ, আবদুল্লাহ, চোয়াংখালী গ্রামের মো. সাইফুল্লাহ ভুলু, ইমামের ডেইল গ্রামের বেলাল, মো. শফির বিল গ্রামের মো. মোস্তাক, আবদুস ছালাম, জমির আহম্মদ, পশ্চিম সোনারপাড়া গ্রামের নুর কবির, ডেইল পাড়া গ্রামের মো. শফিক, রামুর মোস্তাক আহম্মদ, চোয়াংখালীর জাহেদ মেম্বার, মনখালীর নুরুল আবছার ওরফে ধইল্যা, রূপপতির আবদুস ছালাম, চেপটখালীর আবদুল জলিল, নবী হোছন, সোনারপাড়ার সাদেক আলী, শাপলাপু গ্রামের শামশু ওরফে বাঘা শামশু, চোয়াংখালী গ্রামের মোজাম্মেল হক, জাহেদ মেম্বার, সোনারপাড়া গ্রামের কালা জমির, এমপি বদির ভাই মৌলভি মুজিব, ডা. হানিফের ছেলে ট্যাবলেট সাইফুল, রামুর চাকমারকুলের মৌলভি আমিন উল্লাহ, কঙ্বাজার শহরতলির খুরুশকুলের সেলিম উদ্দিন ওরফে পিন সেলিম, সোহেল, বেলাল, হেলাল উদ্দিন নুনু, ছৈয়দ হোছন, সমিতিপাড়ার বার্মাইয়া শুক্কুর, কুতুবদিয়া পাড়ার রশিদ মাঝি। কঙ্বাজার সদর মডেল থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) মো. জসিম উদ্দিন জানান, চিহ্নিত এসব মানব পাচারকারীকে আটকে পুলিশের অভিযান অব্যাহত রয়েছে। তারা বিভিন্ন সময় মানব পাচারের রুট পরিবর্তন করায় সহজে আটক করা যাচ্ছে না।

টেকনাফ থানার অফিসার ইনচার্জ মো. ফরহাদ জানান, মানব পাচার প্রতিরোধে পুলিশ তৎপর রয়েছে। জড়িত দালালদের বিরুদ্ধে অভিযান চলছে। টেকনাফ ৪২ ব্যাটালিয়ন বিজিবির অধিনায়ক লে. কর্নেল আবু জার আল জাহিদ বলেন, সীমান্ত চোরাচালান, মাদক পাচার রোধের পাশাপাশি আদম পাচার রোধে বিজিবি সব সময় গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে আসছে। প্রায় সময় বিজিবির অভিযানে মালয়েশিয়াগামী যাত্রী ধরা পড়ছে। অভিযান অব্যাহত থাকবে।

 

অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।

প্রাসঙ্গিক আরো কথা
Related contents feature is in beta version.