আমাদের কথা খুঁজে নিন

   

জুবা দি সিটি অভ গোল্ডেন অপরচুনিটি

কিছু দেশ দেখার সুযোগ হয়েছে এই জীবনে। ভ্রমণ আমার ভাল লাগে্‌ তাই সবার মাঝে তা জানাতে চাই। সবার উপরে ভালোবাসি বাংলাদেশ । ধন্যবাদ

জুবা শহরে ৮৮ পয়েন্ট ৪ এফ এম রেডিও চ্যানেল বেশ জনপ্রিয়। আর জে সবসময় বলে, ‘জুবা দি সিটি অভ গোল্ডেন অপরচুনিটি’।

এই চ্যানেল সুন্দর গান প্রচার করে। মাঝে মাঝে শুনি এদের গান। জুবার অধিবাসী চার্লসের সাথে কথা বলছিলাম, তাঁর বাড়ি সেন্ট্রাল ইকুইয়েটরিয়ার প্রদেশের জুবাতে। সে বারি গোত্রের মানুষ, এরাই জুবার আসল মানুষ, তারা এখানে সংখ্যাগরিষ্ঠ। চার্লস বলল, আমাদের গোত্র সাউথ সুদানের মধ্যে চার নম্বরে, আমাদের আগে আছে ডিঙ্কা, নুয়ের আর আজান্দে গোত্র।

আজান্দে ও বারি গোত্র ছাড়াও আরও অনেক গোত্র আছে এই প্রদেশে, এদের সবাইকে ইকুয়েটরিয়ান বলা হয়। এই গোত্রগুলোর সাধারণ বৈশিষ্ট হল এরা মূলত কৃষিজীবী, যাযাবর প্রকৃতির না। তারা এক জায়গাতে স্থায়ী ভাবে বসবাস করে। ‘আমরা আমাদের পূর্বপুরুষের জমি চাষ করি এবং না ধরনের ফল ও ফসল ফলাই’। ইকুয়েটরিয়ানদের কেউ কেউ যেমন বারি গোত্রের কিছু কিছু মানুষ চাষাবাদের পাশাপাশি পশুপালন ও করে।

বারি এথনিক গোত্রের অন্তর্গত মুন্দেরি সম্প্রদায়ের মানুষেরা পশুপালন করে থাকে।
ডিঙ্কা ও নুয়েররা নাইলটিক গোত্রভুক্ত এরা ইকুয়েটরিয়ানদের থেকে আলাদা। ইকুয়েটরিয়াতে ও নাইলটিক গোত্রভুক্ত আচলি সম্প্রদায়ের মানুষেরা বসবাস করে। নাইলটিক গোত্রগুলোর বিশেষত্ব হল এরা যাযাবর এবং পশুপালনের মাধ্যমে জীবিকা নির্বাহ করে। এদের মধ্যে ও কেউ কেউ চাষাবাদ করে ও ফসল ফলায়।

ডিঙ্কা ও নুয়েররা তাদের পশুদের জন্য পশুচারণ ভূমি এবং পানির সন্ধানে বৎসরের বিভিন্ন সময়ে বিশাল এলাকা জুড়ে ঘুরে বেড়ায়। পশুপালন ডিঙ্কা ও নুয়েরদের জীবন, জীবিকা ও সংস্কৃতির সাথে ওতপ্রোত ভাবে জড়িয়ে আছে। তারা পশুপালন এবং এগুলো লাভজনকভাবে লালনপালনের জন্য বিখ্যাত।
চার্লস বলছিল, ‘গৃহযুদ্ধের সময় আমার কিছু আত্মীয়ের গরুর খামার কয়েকজন ডিঙ্কা দেখা শোনা করত। তারা গৃহযুদ্ধের কারনে নিজ এলাকা থেকে পালিয়ে জুবাতে চলে আসে।

আমাদের দেশে একটা কথা প্রচলিত আছে, যে সব খামার যদি ডিঙ্কা ও নুয়েররা চালায় সেসব খামারে পশুরপাল দ্রুত বংশ বৃদ্ধি করে। এটা কিভাবে সম্ভব তা আমি জানি না কেউ কখন ও তা আমাকে বলেনি। তবে এই গুনের জন্য ডিঙ্কা কিংবা নুয়েররা অন্য গোত্রগুলোর সাথে সুন্দর ভাবে মিলে মিশে থাকতে পারে। এভাবেই পারস্পরিক নির্ভরতা থেকে গোত্র সম্প্রীতি গড়ে উঠে’।
খামারের কাজে নিয়োজিত ডিঙ্কা কিংবা নুয়ের খামারে উৎপাদিত দুধের অংশ পেত এবং এর সাথে বেতন হিসেবে জমিতে উৎপাদিত বাদাম, ভুট্টা কিংবা মাইলোর ভাগ পেত।

এটা দুই গোত্রের জন্যই লাভজনক। এত সুন্দরভাবে সবকিছু হলে এখন ডিঙ্কা ও নুয়েরদের মধ্যে সমস্যা হচ্ছে কেন? এর উত্তরে সে জানাল, এটা বহু দিন ধরে দুই দলের নেতাদের মধ্যে তুষের আগুনের মত ধিকি ধিকি করে জ্বলতে থাকা ক্ষমতার লড়াইয়ের একটা অশুভ ফসল। গোত্রের সংঘাত এর একটা কারণ হতেও পারে, তবে এটাই আসল কারণ না। ডিঙ্কা ও নুয়েররা যুগ যুগ ধরে নিজেদের মধ্যে যুদ্ধ করেছে তাঁর কারণ তাদের উভয়ের স্বার্থ ছিল এক ও অভিন্ন। ভৌগলিক এলাকা দখলের প্রয়োজনে এই প্রধান দুটো দলের সংঘাত হত, এখানে রাজনৈতিক কোন প্রভাব ছিল না।

তাদের বাঁচার প্রয়োজনে চারন ভূমি দরকার হত এবং তাঁর দখল নিয়েই যুদ্ধ বেঁধে যেত। প্রাকৃতিক বিপর্যয়ের কারনে কিংবা খরার সময় পানির উৎসের দখল নিতেও এসব মারামারির ঘটনা হতো। এই দ্বন্দ্ব কেবলমাত্র ডিঙ্কা ও নুয়েরদের মধ্যে সীমাবদ্ধ না থেকে অন্য গোত্রের মাঝেও এটা ঘটত। এক পরিবারে ভিতর ও এধরনের মারামারি হয়ে থাকে, তাই ডিঙ্কা ও নুয়েরদের এই গোত্রের সংঘাত তেমনি একটা স্বাভাবিক ঘটনা। এই দুটো গোত্রের মানুষেরা যুদ্ধবাজ, কিন্তু তাদের এই সংঘাত গণহত্যার কারণ কখনো হতে পারে না।


যুগ যুগ ধরে পশুপালনকে কেন্দ্র করে সাউথ সুদানে নিজেদের মধ্যে এই ধরনের সমস্যা লেগেই থাকত। পশুপালন এদের সংস্কৃতির একটা অংশ। এই সমস্যাকে যখন রাজনীতির সাথে মেলানো হয় তখনই তা ভয়ংকর রূপ লাভ করে। সাউথ সুদান বহু বছর ধরে সুদানের সাথে যুদ্ধ করেছে, কাজেই সবার কাছে এখন অস্ত্র আছে। এই অস্ত্র গুলোই এখন যে কোন ধরনের দাঙ্গা কিংবা গোত্র সংঘাতের সময় ব্যাবহার হয়।

প্রাচীন কালে আধুনিক মারণাস্ত্রের বদলে লাঠি ও বল্লম ব্যবহার হত। তখন হতাহত ও অনেক কম হত এখনকার তুলনায়।
ক্যাটাল রেইডে অংশগ্রহণকারীরা যুদ্ধের নিয়ম নীতি বেশ কঠোরভাবে মেনে চলে। এখানে মানবাধিকার ও অন্যান্য মানবিক নিয়ম কানুন কঠোরভাবে মেনে চলা হয়। ক্যাটাল রেইডের অলিখিত নিয়মে কেবলমাত্র অস্ত্রধারীদের সাথে যুদ্ধ করা হয়।

মহিলা শিশু বৃদ্ধদের আক্রমনের বাহিরে রাখা হয়। কেউ পালিয়ে গেলে তাকেও আর আক্রমন করা হয় না। এসব এখন মানুষ মেনে চলছে না, রাজনীতি, লোভ লালসার কাছে প্রাচীন মূল্যবোধ হার মেনে যাচ্ছে। এখন নিরীহ মানুষজনই যুদ্ধের ফলে বেশী ক্ষতির সম্মুখীন হচ্ছে। সাউথ সুদানে খাবার জোগাড় করার চেয়ে অস্ত্র জোগাড় করা অনেক সোজা।



মার্চ মাসের ০৫ তারিখে সকাল আনুমানিক ৯ টার সময় জুবা শহরে গোলাগুলি শুরু হয়, গোলাগুলি এখানে নিত্য দিনের সমস্যা হলেও এবার এর পরিধি একটু বেশী ছিল। সারাদিনই থেমে থেমে কালাশনিকভ ও মেশিনগানের গুলি চলে। মাঝে মাঝে মেশিনগানের গুলির পাশাপাশি রকেট এবং আর্টিলারির গোলার শব্দ ও পাওয়া যায়। জুবা শহরের এস পি এল এর সৈনিকদের গেইদা এলাকার ব্যারাকে এই গোলাগুলি হয়। বেতন নিয়ে মতানৈক্যের কারনে এই ঘটনা ঘটেছে বলে জানা যায়।

এই ঘটনায় তিরিশ জন সেনা নিহত এবং শতাধিক আহত হয় বলে জানা যায়। এই ঘটনায় চারজন কর্মকর্তাকে গ্রেফতার করা হয়। সকাল থেকে শুরু হয়ে গোলাগুলি রাত প্রায় ১১ টা পর্যন্ত চলে। পরদিন রাস্তায় রাস্তায় ব্যারিকেড দিয়ে সেনা টহল চলতে থাকে।

জানা যায় যে কিছু সৈনিক তাদের বেতন নেয়ার পর অন্য সদস্যদের নামে বেতন নেয়ার চেষ্টা করছিল যাদের নাম পে রোলে ছিল না, দুর্নীতি ও ভূতুড়ে সদস্যদের কমানোর জন্য নতুন নিয়ম আনুসারে সবাইকে স্বশরীরে এসে বেতন নেয়ার আদের দেয়া হয়।

এতে অনেকে অসন্তুষ্ট হয় ও বাকবিতণ্ডার ও বিশৃঙ্খলার সৃষ্টি হয়। গেইদা ব্যারাকের এক সৈনিকের বরাত দিয়ে জানানো হয়েছে যে, সৈনিক ও অফিসাররা যখন বেতন নিচ্ছিল তখন কমান্ডার গাতুইচ গাইয়ের অধিনস্থ কমান্ডো ইউনিটের সৈনিকরা তাদের উপর গুলি করে। এরপরই ঘটনা সংঘর্ষের দিকে মোড় নেয় ও গোলাগুলি চলতে থাকে, এতে অনেকে নিহত হয়। কমান্ডো ইউনিটের কমান্ডার গাতুইচ গাইয়ের বার জন নিরাপত্তারক্ষীকে পাওয়া যাচ্ছে না, ধারনা করা হচ্ছে তারা নিহত হয়েছে। গাই সেনাপ্রধান জেনারেল জেমস হোত মাইয়ের কাছে নিরাপত্তা চেয়েছে এবং পালিয়ে আছে।

সরকারী আদেশ অনুসারে যে সব সামরিক ও বেসামরিক কর্মচারী ইউ এন কম্পাউন্ডে আশ্রয় নিয়েছে তারা বেতন পাবে না, তাদের পক্ষে কাউকে বেতন নিতেও দেয়া হবে না।
সাউথ সুদান সরকার দুর্নীতি বন্ধ করার জন্য একটা নতুন বেতন প্রদানের নিয়ম চালু করেছে। এই নিয়মে এখন সরকারী কর্ম কর্তা ও কর্ম চারী এবং সেনাবাহিনীর সদস্যদের বেতন নিতে হলে সশরীরে আসতে হবে। এই নিয়মে ভূতুড়ে কর্মচারী দেরকে সনাক্ত করা যাবে । এর আগে ভুয়া নাম ঠিকানা দিয়ে টাকা তুলে নেয়া হত।

দাতা দের চাপে পড়ে সরকার এই ব্যবস্থা নিতে বাধ্য হয়েছে। নতুন স্বাধীন হওয়া এই দেশে গত ডিসেম্বরের সংঘাতের পর আজ পর্যন্ত প্রায় ৮ লক্ষ ষাট হাজার মানুষ তাদের বাড়িঘর ছেড়ে পালিয়ে গেছে। এর মধ্যে এক লাখের বেশী মানুষ প্রতিবেশী দেশগুলোতে আশ্রয় নিয়েছে।


ডিসেম্বর ২০১৩ থেকে মার্চ ২০১৪ পর্যন্ত প্রায় ৮৬০,০০০ মানুষ তাদের ঘরবাড়ী ছেড়ে পালিয়ে গেছে


এয়ারপোর্ট ও টম্পিং এলাকা সংলগ্ন মুনুকি এলাকার বাসিন্দারা গোলাগুলির প্রত্যক্ষ সাক্ষী। তাদের ভাষ্য অনুযায়ী পার্লামেন্ট ভবনের পেছনের জংশনে প্রায় কুড়ি মিনিট গোলাগুলি হয় তারপর তারা বেশ বড় বিস্ফোরনের শব্দ শোনে তারপর গোলাগুলি থেমে যায়।

পরবরতি সময়ে থেকে থকে গোলাগুলি চলতে থাকে, মাঝে মাঝে আর পি জির শব্দ ও পাওয়া যায়। সারা জুবা শহরের বিভিন্ন পয়েন্টে সরকারী সেনারা টহল জোরদার করে এবং চেকপোস্টে অবস্থান নেয়।

সাউথ সুদানে সামনের দিনগুলোতে আরও সমস্যা হওয়ার সম্ভবনা আছে। বড় দুই দলের মধ্যে শেষ পর্যন্ত ভালই সমস্যা হবে বলে মনে হচ্ছে। তাহলে কি এই সমস্যার কোন সমাধান নেই? অবশ্যই আছে, স্বাধীনতার বহু আগে সেই কলোনিয়াল সময় কিংবা তারও আগে থেকে সাউথ সুদানিরা নিজেদের মধ্যে শান্তিপূর্ণভাবে বসবাস করে আসছে।

মাঝে মাঝে তাদের মাঝে কিছু মারামারি সংঘর্ষ হত এবং তা মিটেও যেত। কলোনিয়াল শাসকরা দলগত কোন্দল উস্কে দিয়ে ডিভাইড এন্ড রুল পলিসির মাধমে তাদের স্বার্থ রক্ষা করত। এই স্বাধীন দেশে এখন এসব দরকার নেই। নেতাদেরকে দল মত ভুলে নিজ স্বার্থ ছেড়ে নতুনভাবে দেশ গড়ার জন্য নিবেদিত হতে হবে। আর্থ সামাজিক উন্নয়নের মাধ্যমে মানুষের ন্যূন তম চাহিদা মিটিয়ে আস্তে আস্তে দেশটাকে এগিয়ে নিয়ে যেতে হবে।


আইন শৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীকে উপযুক্ত প্রশিক্ষণ দিয়ে সামাজিক নিরাপত্তা নিশ্চিত করার কাজে নিয়জিত করতে পারলে কিছুটা স্বস্তি আসবে বলে আশা করা যায়। মানুষ তখনই স্বস্তি পাবে যখন ন্যায় বিচার নিশ্চিত হবে এবং রাষ্ট্র তাদের নিরাপত্তা বিধানে সমর্থ হবে। সাউথ সুদান জুড়ে স্কুল হাসপাতাল বানানো প্রয়োজন, প্রতিটা ঘরে এবং টুকুলে যেন সবাই পানি পায়। কাজের ব্যবস্থা করা অতীব জরুরি তাহলে যুবকদেরকে পশুপালন এবং এর সাথে সম্পকিত সমস্যা থেকে দূরে রাখা সম্ভব হবে। বিবাহের জন্য উপযুক্ত হতে হলে আর্থিক সংগতির দরকার , করমসন্সথান হলেই একমাত্র তা সম্ভব হবে।


বিদেশী বিনিয়োগকারীদেরকে সাউথ সুদানে বিনিয়োগের পরিবেশ করে দিলে তারা উৎসাহিত হবে এবং উন্নয়নে ভুমিকা রাখতে পারবে। সবাই মিলে একত্রে দুর্নীতিকে না বলতে হবেই তা না হলে উন্নয়ন আলোর মুখ দেখবে না। দল মত গোত্র স্বার্থ ভুলে, সাউথ সুদানের তেল সম্পদকে যথাযথ ভাবে কাজে লাগিয়ে শিক্ষা, চিকিৎসা, নাগরিক সুবিধার উন্নয়ন, চাকুরী সৃষ্টি, নিরাপত্তার পরিবেশ নিশ্চিত করার পাশাপাশি দুর্নীতি দমন ও আইনের শাসন প্রতিষ্ঠা করতে পারলে এই দেশ একদিন সোনার দেশ হবে। তখন সত্যিই বলা যাবে ‘জুবা দি সিটি অভ গোল্ডেন অপরচুনিটি’।
- কিছু ছবি ও তথ্য নেট থেকে

 



এর পর.....

অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।