আমাদের কথা খুঁজে নিন

   

আফসোস নয়, নদী হোক গর্বের উপলক্ষ

আমি হৃদয়ের কথা বলিতে ব্যকুল ...

নদীর জল ছিল না, কূল ছিল না/ ছিল শুধু ঢেউ। সন্দেহ নেই, গানের এ কথাগুলো ব্যবহার করা হয়েছে রূপক অর্থে। তবে আক্ষরিক অর্থ বিশ্লেষণ করলে ব্যাকরণবিদরা এ বাক্যের ‘যোগ্যতা’ নিয়ে প্রশ্ন তুলতেই পারেন। কেননা জল ও কূল না থাকলে তাকে কি নদী বলা যাবে? আর তাতে ঢেউইবা থাকবে কী করে? গীতিকার গানটি লেখার সময় এসব বিষয় ভেবেছেন কিনা, জানি না। তবে বাস্তবতা হলো, এর প্রথম লাইনের আক্ষরিক অর্থের সঙ্গে আমাদের দেশের অনেক নদ-নদীর কিছুটা মিল রয়েছে।

সেসবে জল নেই, নির্বিচারে দখল হওয়ায় কূলেরও ঠিক-ঠিকানা নেই। কোনো কোনো ক্ষেত্রে অবস্থা এতটাই খারাপ হয়েছে, একদা যে সেটা নদী ছিল, তাও বুঝতে কষ্ট হয়

বস্তুত বাংলাদেশকে অভিহিত করা হয় নদীমাতৃক দেশ হিসেবে। নদী যেমন অপার দানে এ দেশের মানুষের জীবন সমৃদ্ধ করেছে, তা বিবেচনায় রেখেই একে গণ্য করা হয় ‘মাতা’। নদী আমাদের কী দেয়নি? এক কথায় বললে, নদীই জীবন ও জীবিকা সঞ্চার করেছে এই বঙ্গেয় ব-দ্বীপের মানুষের। নদীবাহিত পলি দিয়ে গঠন হয়েছে এ দেশের ভূমি।

এর পানি সেচকে করেছে সহজ, মাছ জোগান দিয়েছে প্রাণিজ আমিষ; আর তীরের গাছপালা শুধু এ দেশের প্রকৃতিকেই সুন্দর করেনি, দ্বিজেন্দ্রলাল রায়ের ভাষায়— বাংলাদেশকে গড়েছে ‘সকল দেশের রাণী’ হিসেবে। নৌপথে যাতায়াত কিংবা পণ্য পরিবহন যতটা সুলভ, বাংলাদেশের বর্তমান পরিস্থিতিতে এর কি কোনো উত্তম বিকল্প রয়েছে? নদীর মতো সুপেয় পানির বিকল্প উত্স পাওয়া কি আমাদের পক্ষে সম্ভব?
বাস্তবতা হলো, যে নদী তার অপরিসীম দানে আমাদের জীবনযাত্রাকে করেছে অনাবিল, অর্থনীতিকে করেছে সমৃদ্ধ; তার ওপর আমরা অত্যাচার করেই ক্ষান্ত হইনি, কখনো কখনো হয়েছি খড়্গ হস্ত। এর তীর দখল করে নির্মাণ করেছি স্থাপনা, পানি দূষিত করে তা পান এবং জীববৈচিত্র্য টিকে থাকার অযোগ্য করে তুলেছি। ক্রসবাঁধ নির্মাণ করে মেতে উঠেছি নদী হত্যাযজ্ঞে।

বলা বাহুল্য, আমাদের দেশে নদীর দুর্দশার এগুলোই প্রধান কারণ।

এ কারণে আমাদের জীবনেও যে নেতিবাচক প্রভাব পড়েনি, তা কিন্তু নয়। নদীতে পানিপ্রবাহ না থাকায় আমাদের জীবন হয়ে উঠেছে দুর্বিষহ। শুধু পান করার জন্যই নয়, সেচের জন্য নির্ভরতা বাড়াতে হচ্ছে ভূগর্ভস্থ পানির ওপর। এ কারণে আর্সেনিক সংক্রমণের হার বেড়েছে, বেড়েছে কৃষকের সেচ ব্যয়। খুব সরলভাবে হিসাব করলেও জনজীবন ও অর্থনীতিতে কি এর প্রভাব পড়ছে না? উত্তরের জন্য বড় ধরনের গবেষণার প্রয়োজন পড়ে না।

কাণ্ডজ্ঞানই যথেষ্ট। দুঃখের বিষয় হলো, সে কাণ্ডজ্ঞানও আমরা যেন হারিয়ে ফেলেছি। শিক্ষিত-নিরক্ষর নির্বিশেষে প্রায় সব শ্রেণীর মানুষ নদী ধ্বংসে মেতে উঠেছে।

কেন হলো এ অবস্থা? এর উত্তরটাও সহজ। মাতৃভক্তির যে নিদর্শন বাংলার চিরায়ত সংস্কৃতিতে বিদ্যমান, নদীমাতার প্রতি মানুষের ভক্তি এখানে সেভাবে গড়ে ওঠেনি।

বরং দখল ও দূষণে তার ‘জীবন’ করে তোলা হয়েছে অতিষ্ঠ। ব্যক্তিগতভাবে তো বটেই, নদী কখনো হয়েছে দলীয় ও রাজনৈতিক কারণে দখলের শিকার। দুর্ভাগ্যের বিষয়, সরকারি প্রতিষ্ঠান কর্তৃক নদী দখলের উদাহরণও রয়েছে আমাদের দেশে। নদী দখল করে গড়ে তোলা হয়েছে শিল্প-কারখানা। কোথাও রোপণ করা হয়েছে ধান।

কিছুদিন আগে প্রকাশিত এক জরিপে দেখা গেছে, বুড়িগঙ্গার দখল হয়ে যাওয়া অংশের ৬০ শতাংশের ওপরই নির্মাণ করা হয়েছে শিল্প-কারখানা। কারো কারো যুক্তি, শিল্পায়নের মাধ্যমে আমাদের অর্থনীতি সমৃদ্ধ হচ্ছে। অন্যদিকে এতে যে ফসল উৎপাদিত হচ্ছে, তারও ইতিবাচক প্রভাব পড়ছে আমাদের খাদ্যনিরাপত্তা ও অর্থনীতিতে। এক্ষেত্রেও প্রশ্ন থেকেই যায়। পরিবেশ ও জীববৈচিত্র্য ধ্বংস হওয়ার কারণেও কি আমাদের ক্ষতি হচ্ছে না? নদী দখল করে শিল্পায়নের মাধ্যমে যে পরিমাণ অর্থনৈতিক সুফল আমরা লাভ করছি এবং এর বিপরীতে নদীবর্তী মানুষের জীবনযাত্রায় দুর্ভোগ ও ব্যয় যেভাবে বেড়ে উঠেছে, তার হিসাব কষলে লোকসানের পাল্লাই কি ভারী হবে না?

নদীই হলো এ দেশের মানুষের প্রাণসঞ্চারিণী।

নদীহীন জীবনের কথা ভাবলে দুর্বিষহ এক জীবনচিত্র আমাদের সামনে ফুটে উঠবে। ঢাকার চারপাশের নদীগুলোর অবস্থা যেমন করুণ, এগুলোর পানি পানের অযোগ্য হয়ে পড়লে এ নগরী কি আর বাসযোগ্য থাকবে? ভূগর্ভস্থ পানির স্তর নেমে যাওয়ার ফলে এর অববাহিকার মানুষের জীবনে যে দুর্ভোগ নেমে আসবে, অর্থনৈতিক উন্নয়ন কি হবে তার পরিপূরক? শুধু ঢাকার পাশের চার নদীই নয়, দেশের অন্যান্য নদীর ক্ষেত্রেও একই কথা প্রযোজ্য। নদী বিপন্ন হলে মানুষের জীবনও হবে বিপন্ন। অর্থনৈতিক উন্নয়ন দিয়ে সে ক্ষতি পুষিয়ে নেয়া যাবে না। এ অবস্থায় একটি বিষয় আমাদের স্বীকার করতেই হবে, নদীর ক্ষতি করে উন্নয়ন টেকসই করা যাবে না।

আর যে উন্নয়ন টেকসই নয়, তা থেকে বিরত থাকাই হবে সুবুদ্ধির পরিচায়ক।

আশার কথা হলো, গত কয়েক বছরে আমাদের এখানে নদী রক্ষা আন্দোলন ক্রমে দানা বাঁধছে। রাজধানী ও জেলা শহরে সভা-সেমিনার, মানববন্ধন প্রভৃতি কর্মসূচির পাশাপাশি শুরু হয়েছে মাঠপর্যায়ের কাজ। এ ধরনের কর্মসূচি পালনের মধ্য দিয়ে সচেতনতা সৃষ্টি হচ্ছে বটে। তবে নদী রক্ষায় এসব কর্মসূচি যথেষ্ট নয়।

অস্বীকার করা যাবে না, এসব কর্মসূচিতে যেসব মানুষ অংশগ্রহণ করেন, তারা সংখ্যায় খুবই নগণ্য। নদী রক্ষায় দরকার আরো বেশি মানুষের সক্রিয় অংশগ্রহণ। উল্লেখ্য, দেশে নদী রক্ষা আন্দোলনে যুক্তদের বড় অংশ তরুণ। তরুণদের নিয়ে অনেকেই আশাবাদী। তাদের সক্রিয় অংশগ্রহণে এ দেশের অনেক আন্দোলন সফলতা লাভ করেছে।

নদী রক্ষা আন্দোলনেও তার ব্যত্যয় হবে কেন? সেজন্যই এ প্রক্রিয়ায় আরো বেশি তরুণের অংশগ্রহণ দরকার। প্রয়োজন নদী সুরক্ষায় তাদের ভাবনার পাশাপাশি মাঠপর্যায়ের কর্মসূচিতে অংশগ্রহণ। এটা সম্ভব হলেই বাংলাদেশে নদী রক্ষা আন্দোলন সফলতার মুখ দেখবে।

কারো অজানা নয়, বাংলাদেশ ও ভারতের মধ্যে ৫৭টি আন্তর্জাতিক নদী প্রবাহিত হলেও পানি বণ্টন চুক্তি এখন পর্যন্ত সম্পাদন হয়েছে মাত্র একটির। তিস্তার পানি বণ্টন নিয়ে দীর্ঘ আলোচনার পর চূড়ান্ত পর্যায়ে এসে তা ভেস্তে গেছে।

উভয় দেশের রাজনৈতিক বাস্তবতায় নিকট ভবিষ্যতে এ চুক্তি সম্পাদন হওয়ার সম্ভাবনা ক্ষীণ। বাকি নদীগুলোর পানি বণ্টন নিয়ে আলোচনা শুরু হয়নি বললেই চলে। বহুল আলোচিত ‘তিস্তা’র পানির ন্যায্য হিস্যা পাচ্ছে না বাংলাদেশ। বলা বাহুল্য, ভারত উজানে পানি প্রত্যাহার করায় সাম্প্রতিক কালে উত্তরাঞ্চলের তিস্তা সেচ প্রকল্প এলাকায় পানির জন্য হাহাকার শুরু হয়েছে। পানি বণ্টন চুক্তি না হলে অন্য নদীগুলোর ক্ষেত্রেও যে আমাদের একই পরিস্থিতির মুখোমুখি হতে হবে, তা কে না জানে।



দীর্ঘ আলোচনার পর তিস্তা চুক্তি কেন সম্পাদন করা গেল না, সেটা বড় এক প্রশ্ন। এরই মধ্যে অনেক বিশ্লেষক একে অভিহিত করেছেন মহাজোট সরকারের গত আমলের সবচেয়ে বড় কূটনৈতিক ব্যর্থতা হিসেবে। বাস্তবতা হলো, কূটনৈতিক ক্ষেত্রে উন্নতি করতে না পারলে বাংলাদেশের নদ-নদীতে পানি পাওয়া হবে দূর অস্ত। নদীকৃত্য দিবসে তাই কূটনৈতিক দক্ষতা বৃদ্ধির প্রতিও আমরা গুরুত্বারোপ করতে চাই। উইন-উইন সিচুয়েশনে পৌঁছানো না গেলে দ্বিপক্ষীয় চুক্তি সম্পাদন কঠিন।

এক্ষেত্রে পানিপ্রবাহ-সংক্রান্ত আন্তর্জাতিক আইন অনুযায়ী বাংলাদেশ যেন উজান থেকে আসা নদ-নদীর পানির ন্যায্য হিস্যা পায়, সেটি নিশ্চিত করতেও দরকার কূটনৈতিক প্রচেষ্টা।
এক্ষেত্রে আরেকটি বিষয় ভুলে গেলে চলবে না। বাংলাদেশের প্রবাহিত নদ-নদীর পানির ৯৬ শতাংশই আসে ভারত থেকে। এ দেশের মানুষ নদী ব্যবহারে যত সচেতন এবং সতর্কই হোক, উজানে পানি প্রত্যাহার করা হলে এ ধরনের সচেতনতা কাজে আসবে না। বস্তুত নদীতে স্বাভাবিক প্রবাহ বজায় রাখতে হলে পানি আসতে হবে উজান অর্থাৎ ভারত থেকেই।

এজন্য কূটনৈতিকভাবে সফল হওয়ার বিকল্প নেই। সরকার কি সে ধারায় অগ্রসর হচ্ছে? এত আলোচনার পর তিস্তা চুক্তি সম্পাদনে ব্যর্থতায় সরকার কি আত্মসমালোচনা করছে? অভ্যন্তরীণ পর্যায়ে সচেতনতা সৃষ্টির কাজ চলছে। এখন কূটনৈতিক পর্যায়ে সফল না হলে নদী রক্ষা আন্দোলন কাঙ্ক্ষিত মাত্রায় সফলতা পাবে না।

আন্তর্জাতিক নদীকৃত্য দিবস উদযাপনের উদ্দেশ্য মূলত নদীর জন্য করণীয়গুলো মানুষকে জানানো, সচেতন করার পাশাপাশি তাদের মধ্যে নদীভক্তি জাগ্রত করা। এ দিবস উপলক্ষে আজ দেশব্যাপী বিভিন্ন আয়োজন হবে।

মাতৃভক্তির ক্ষেত্রে আমরা যেমন লিঙ্গ, বয়স প্রভৃতিকে রাখি বিবেচনার ঊর্ধ্বে, নদীর ক্ষেত্রেও সে ধরনের মানসিকতাই আমাদের প্রয়োজন। সতর্ক হওয়ার পাশাপাশি দরকার এ ধরনের বোধ অন্যদের মধ্যে জাগ্রত করা। এজন্য প্রচারণার পাশাপাশি তৃণমূল থেকেও উদ্যোগ নেয়া দরকার। এ ধরনের উদ্যোগ এবং মানুষের কার্যকর অংশগ্রহণ যত বাড়বে, নদী সুরক্ষার ক্ষেত্রে ইতিবাচক অর্জনে আমরা ততই এগিয়ে যাব।

শুরুতেই যে গানটি উদ্ধৃত করেছি, তার পরের লাইনেই আফসোসের সুরে গীতিকার লিখেছেন, ‘আমার একটা নদী আছে জানলো না তো কেউ!’ অস্বীকার করা যাবে না, যে নদী বিপন্নপ্রায়, তাকে নিয়ে গর্ব করে মানুষকে জানানোর কিছু নেই।

তবে এটা ঠিক, জনসাধারণের সচেতনতার পাশাপাশি সরকারের আন্তরিকতা যুক্ত হলে বিপন্নপ্রায় নদী রক্ষা এবং দখল হওয়া নদী উদ্ধার সম্ভব। এমন আশাবাদ নিয়েই বাংলাদেশের বিভিন্ন প্রান্তে গড়ে উঠেছে নদী রক্ষা আন্দোলন। এ আন্দোলন সফল হিসেবে বিবেচিত হবে যদি নদী দখল ও দূষণমুক্তসহ তাতে স্বাভাবিক প্রবাহ ফিরিয়ে আনা যায়। তাহলে নদী নিয়ে আফসোস নয়, বরং গর্ব প্রকাশ পায়— এমন গান রচনা করতে ও গাইতে পারব আমরা।

লেখক: সাংবাদিক

Click This Link


অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।