আমাদের কথা খুঁজে নিন

   

স্টোরি রিটেন ইন অ্যান আননেমড সিজন



খুব ভোরে, বল ভালো ঊষালগ্নে— হালকা কুয়াশার মত ঊষালগ্নের আধো আধো অন্ধকার, আর আধো আধো আলোর লগ্নে— বাড়ি থেকে বেরিয়ে একটু দূরেই মরা নদীর রেখা বরাবর চলে যাওয়া পথ ধরে হাঁটতে হাঁটতে অনেক দূর হেঁটে যাবার পর তার সঙ্গে দেখা।

রবীন্দ্রনাথের ওই হঠাত দেখা কবিতার মতনই— দেখা। কালো রঙের একটা দূরত্ব যেনো ঘিরে নিয়েছিল আমাদের।

যেনো হাজার বছরের দূরত্ব পেরিয়ে দেখা হলো। হাজার বছর পর নদীর পাড়ে হাঁটতে গিয়ে যখন দেখা তখন মনে হয়: আরে! এই তো সেদিন, এই গোরস্থানে লুকিয়ে-চুরিয়ে এসে কত ফুল তুলে নিয়ে গেছি!

হাজার বছর পর একজনের মাথার চুল উঠে মাঝখানটা গড়ের মাঠ প্রায়; কপালে অনেকগুলো রেখা; চোখের তারায় সাবধানতার ভার।

অথচ আরেকজনের বয়সই বাড়ে নি যেনো; যেনো সে একটু পরেই ফুল তুলতে যাবে গোরস্থানে; ফুল তুলে এনে খেলাঘরের চারপাশে সাজাবে কল্পরাজ্য এক। সেইখানে ফুলপরী এসে নামবে; লালপরী নীলপরী এসে নামবে; কত কথা বলবে; একত্রে তারা কত দেশ ঘুরবে; সাত সাগর তেরো নদী পাড় হয়ে যাবে গল্পের দেশে।

হাজার বছর পর, হাটতে গিয়ে, নদীর পাড়ে দেখা হয় দু’জনের। তাদের একজন যেনো এই এলো গল্পের দেশ থেকে। আরেকজন যেনো এইখানে দাঁড়িয়ে আছে দ্বিধান্বিত হাজার বছর।



নদীর ধার ধওে হাঁটতে হাঁটতে কথা হয়। দলকলস ফুলের গোড়ায় কত মধু ছিল, মরিচ ফুলের গোড়ায় কত মধু ছিল; তেজপাতা দিয়ে বিড়ি বানিয়ে চুরি কওর খাওয়ায় কত মধু ছিল; চুরি কওে নদীতে গোসল করতে যাওয়ায়, শাপলা ও শালুক তুলতে যাওয়ায় কত মধু ছিল সেই সব কথা হয়।

কথা হতে হতে দু’জন অনেক দূর যায়। ওরা যেতে যেথে ভোরের রোদ আকাশ আলো কওে নিজেকে বিছিয়ে দেয় ধানের সবুজ ক্ষেতে; প্যাক প্যাক প্যাক প্যাক প্যাক কল-কাকলী করতে করতে ধানক্ষেতের আল ধরে নদীর দিকে পুকুরের দিকে নামতে থাকা হাঁসের ডানায়, মোরগের সদ্য উঠা ঝুঁটিতে সোনার গুঁড়োর মতন হয়ে মাখামাখি হয়ে থাকে সকালের কোমল রোদ।

এই কোমল রোদে ওদের গল্প বহুদূর যায়।

যেতে যেতে একজন গিয়ে ঠেকে এক শীতের দেশে; বরফে ঢাকা ভয়ানক এক লোনলি রাস্তায়।

'লোনলি ক্রাউডে'র ভেতর কী করে বেঁচে বর্তে থাকা— সেই গল্প হয়; কী কওে রাতের পর রাত, দিনের পর দিন কেবল এক জোড়া ঘুঘু, একটা ওক গাছ, আর পাতাঝরা একটা ম্যাপল ট্রি তাকে সঙ্গ দিয়ে যায়— সেই সব গল্প হয়।

তারপর গ্রীস্ম এলে কী কওে চেরি ফুলের রঙ, রাস্তার অপরিচিত পথচারীর হাতে ধওে রাখা উজ্জ্বল টিউলিপ ফুলের তোড়া, পার্কে নাম না জানা বহু রঙের গাছে পাতা ও ফুল ফুটে উঠলে তাদেও সঙ্গ পেয়ে কী করে যে জীবনের বরফ গলে কিছুদূর; কী ভাবে মাইলের পর মাইল একা অকারণ হেঁটে গিয়ে অকারণ ফিওে এসে পার্কেও বেঞ্চিতে রাত দশটা অব্দি বসে রাতের বেলায় বন্ধ হয়ে আসার শহরের দোকানপাটের অলি-গলি ঘুরে শেষ ট্রামের আগের ট্রাম ধরে রেড ওয়াইনের বোতলে একা চুমুক দিতে দিতে বাড়ি ফিরে এসে কেন অকারণে ডায়রি লিখতে বসতে হয় সেই সব গল্প হয় দুজনের।

গল্প করতে করতে একজন যেনো কোথায় মিলিয়ে যায়; আরেক জন একা অপেক্ষা করতে করতে দেখে সে যার জন্য অপেক্ষা করছে সে তো যায় নি কোথাও; সে এখানে আছে; আর হারানো মানুষের নাম ধরে ডাকতে ডাকতে যে খঁজতে গেছিল দূরে সেই এখন হারিয়ে গেছে কোথায়!

ফলে, খুঁজতে গিয়ে হারিয়ে যাওয়া মানুষের জন্য অপেক্ষা দীর্ঘায়িত হয়।

কিন্তু নদী পাড়ের এই অপেক্ষা ভালো লাগে।

হঠাত একটা বউ কথা কউ পাখি উড়তে উড়তে ডাকতে ডাকতে চলে যায়; হঠাত অসময়ে অজায়গায় গোরস্থানের কোনো একটা গাছের ডাল থেকে ডেকে উঠে একটা কোকিল; তার ডাকে সাড়া দিয়ে নদীর পাড়ের একটা বদ্দিরাজ গাছের ডাল থেকে সাড়া দিয়ে উঠে আরেকটি কোকিল; হলুদ রঙের একটা ইষ্টিকুটুম পাখি চোখের পলকে এক গাছ থেকে উড়ে আরেক গাছের আড়ালে লুকায়; একটা চড়ুই আরেকটা চড়ুইকে দেখে লেজ নাড়ায়, টুঁই টুঁই করে। রাস্তার দুই দিক থেকে আসা দুটো মানুষ মুখোমুখি হবার পর একজন আরেকজনকে কুশল জানতে চায়; বাচ্চা কোলে নিয়ে রাস্তার পাড়ে দাঁড়িয়ে সকালে ঠান্ডা হাওয়া গায়ে লাগাচ্ছিল যে সব নারী বা যুবতী বউ তাদের মধ্যে একজন আরেকজনকে জিজ্ঞেস করে: কাল রাতে কী হৈছিল? ছোটো ছেলেটা এতো কান্তেছিল কেন?

অপেক্ষার মধ্যে অনেক গল্প ঘটে যায়। সকালের রোদ চড়চড়িয়ে উঠে; কিন্তু অপেক্ষার শেষ হয় না। যেনো পূব আর পশ্চিমের দূরত্বেও মত। একদিকে ভোর হলো তো একদিকে রাত।

দু’জনের সময় আর যেনো কিছুতেই এসে মেলে না ঘড়ির একটি বিন্দুতে।

দুজনেই দৌড়াচ্ছে; আর দু’জনকে সঙ্গে নিয়ে দৌড়াচ্ছে সময় । ফলে, ত্রিমুখী দৌড়ের মধ্যে কারোর মুখ দেখার সুযোগ হয় না কারো। দেখা হবার বাসনায় পরস্পর দৌড়ায় কিন্ত একজনও থামে না। অন্তত কোন একজন একদিকে থেমে গেলে আরেক দিক থেকে দৗড়টা শেষ হতে পারে, একটা আপাত সীমান্তে এসে পৌঁছাতে পারে।



কিন্ত তা হয় না। না থামে সময়, না তারা দুই জন। ফলে, অপেক্ষা দীর্ঘায়তি হয়।

কিন্ত তারা কেউ কোথাও পৌঁছাতে পারে না। বরং বার্গম্যানের ওয়াইল্ড স্ট্রবেরি থেকে বেরিয়ে এসে কাঁটাহীন একটা ঘড়ি হঠাত মানুষের মত দু'টো হাত বাড়িয়ে নদীর পাড়ে অপেক্ষআরত মানুষটির দিকে হাত বাড়ায়।

মানুষটিও বাড়ায় হাত। এমন সময় ঘড়িটার ভেতর হঠাত একটা কাঁটা কোত্থেকে উদিত হয়ে গীর্জার ঘন্টার মতন বাজতে থাকে ঢং ঢং।

ফলে, হাতে হাতে মিলন ঘটে না। এবং এমন সময় আচানক ভাবে পাশের মরা নদীটা জলে ও জোয়ারে ভরে যায়। সেই ভরা নদীতে নৌকো বাইতে বাইতে একজন মাঝি সকাল বেলায় ''চিরদিন পুষলাম এক অচিন পাখি'' গাইতে গাইতে যায়।



এই গানের পর হঠাত করে কেন যেনো রাইন নদীর কথাটা মনে আসে। মনে প্রশ্ন আসে এতো খরস্রোতেও ভরা রাইন নদী, তার পাশে গুণে গুণে এতোগুলো মাস, এতোগুলো বছর পার হয়ে গেলো। কিন্তু কই, রাইন নদীতে নৌকো বাইতে বাইতে কেউ এইরকম গান গায় নি কেন? চির হরিৎ বনের মতন চির লোনলি মানুষের কি গলা খোলে না?

গান না গাওয়ার কথা ভাবতে ভাবতে হঠাত এই নদীর পাড়ের এই রাস্তাটা আরেকটা নদী হয়ে গেলো; নদীটা খরস্রোতা হয়ে গেলো; নদীটার দুই ধারে কেমন ছোটো ছোটো পাহাড়ের মতন, টিলার মতন হলো। দেখা গেলো, দুইটা নদী— যেটা সমতল দিয়ে বইছলি, বইতে বইতে মরে গিয়েছিল এবং আজ সকালেই যেটা সহসা আবার জলে ও গানে ভওে গেলো সেটি সমতল দিয়ে বইতে থাকলো আর তারই পাশ দিয়ে বইতে থাকলো আঁকাবাঁকা পাহাড়ী পথের এক নদী।

সমতলের নদী দিয়ে যে নৌকো বেয়ে যায় সে গান গায়, তার গানের সুর এই পাহাড়ী নদীতে আসে।

সেই সুর শুনতে শুনতে হঠাত মনে হয়, আরে! যার অপেক্ষায় নদী পাড়ে দাঁড়িয়ে থাকা সেই তো ওই নদীর মধ্যে নৌকা বাইতে বাইতে এই গান গাইছে!

কিন্তু আবারও সেই একই গড়মিল। একজন সমতলে গান গায়। আরজন পাহাড়ী জলপথে গানহীন বাইছে তরী।

দুই নদী চলছে। মোহনায়।

মোহনার পরে জল বাড়তে বাড়তে তা সমুদ্র হয়ে যায়, সেই সমুদ্রের নাম হতে পাওে বঙ্গোপসাগর অথবা হতে পারে তৃষ্ণসাগর।

অনেক তৃষ্ণা নিয়ে এইখানে দুইজন আসে, দুই নৌকায়, একীভূত হবার বাসনায়। কিন্তু এখানেই প্রকৃতির প্যারাডক্স।

যতক্ষণ দুইজন থাকে দুই নৌকোয় ততক্ষণ তারা থাকে মূলত একে একাকার। কিন্তু যখন আসে মাহেন্দ্রক্ষণ সেইটাই ছদ্মাবরণ; বিধিলিপিতে লেখা আছে মিলনক্ষণই হবে একজনের চিরপ্রস্থান।



ফলে, এক হতে গিয়ে তারা বিভক্ত হয়ে যায়।

কিন্তু বিভক্তির মধ্য দিয়েই ওরা হাজার বছর ধওর একজন আরেক জনকে লালন করে; হাজার বছর অন্য এক নদীর ধারে অন্য এক জনপদে অন্য এক শীতের দেশে অন্য এক ষড়ঋতুর দেশে ওদের দেখা হবার পর ওরা ডেকে ওঠে নিজেদের নাম ধরে। এবং দুজনইে চমকিত হয়।

দু'জনই একই নাম ধরে ডাকছে! একই দেখতে দুইয়ের নাক-চোখ-মুখের গড়ন। একই দেখতে তাদের চিবুকের তিল।

একই গুয়ামুরি হাসি তারা হাসে।

একই হাসি হাসতে হাসতেই দুইজন এক হয়ে যায়; একই দেহে একই শরীওে একই পোশাকের ভেতর একটি বেদনা বা সুখ হয়ে একটি ডাক নামেই ওরা করে বসবাস। কিন্ত সময়ে সময়ে যখন একটা চোখ যায় দলকলস ফুলের দিকে এবং আরেকটা চোখ যেতে চায় কাঁটা ভরা মান্দার গাছের লাল লাল ফুলের দিকে, একটা মন যখন বসে থাকতে চায় নদীর পাড়ে উদ্দেশ্য হীন আরেকটা মন যখন তেপান্তরের মাঠে ধুলো উড়িয়ে ঘোড়া ছুটিয়ে চলে যায় তখনি মনে হয় একটা মানুষ দুইটা মানুষ হয়ে যায়।

মনে হয়, দুইটা মানুষের একজন চলে যায় হাজার মাইল দূরের ঠিকানাহীন এক শীতের দেশে। আরেকটা মানুষ থেকে যায় মান্দার গাছের ফুলে ও বদ্দিরাজের বিচির ভেতর নতুন গাছের চারার সম্ভাবনা হয়ে।



তারপর, হাজার বছর পর আবার তাদের দেখা হয় এক ভোরে গ্রামের বাড়িতে মরা নদীর পাশে ঊষালগ্নে হাঁটতে বেরিয়ে একা।

২১.০৩.১৪


এর পর.....

অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।

প্রাসঙ্গিক আরো কথা
Related contents feature is in beta version.