আমাদের কথা খুঁজে নিন

   

হিস্ট্রিওনিক পার্সোনালিটি ডিসঅর্ডার -প্রেমের ফাঁদ



হিস্ট্রিওনিক পার্সোনালিটি ডিসঅর্ডার(HPD=Histrionic Personality Disorder)-এর ব্যক্তিরা তাদের ব্যক্তিজীবন,সংসার ও সমাজকে কি মারাত্মকভাবে প্রভাবিত করতে পারে তা নীচের বর্ণনাতেই বুঝতে পারবেন। এদের প্রেমের খেলার খপ্পরে পড়ে কতজনের জীবন যে তছনছ হয়ে গেছে এবং যাচ্ছে তা কল্পনাকেও হার মানায়। অথচ আমরা অনেকেই জানি না যে এটা একটা মানসিক রোগ। মেয়েদের মধ্যে এর প্রাদূর্ভাব বেশী হওয়ায় নিম্নে এরকম একটি মেয়ের বৈশিষ্ট্যগুলো তুলে ধরা হলো সহজে বোধগম্য হওয়ার জন্যঃ-

১)অপরিপক্কতাঃ-এটা এদের অন্যতম প্রধান বৈশিষ্ট্য। জীবনের গুরুত্বপূর্ণ সিদ্ধান্ত গ্রহণে প্রায়ই এরা অপরিপক্কতার পরিচয় দেয়।

বিবেচনা না করেই বার বার প্রেমে পড়া,পরিবারের অমতে বিয়ে করা,তুচ্ছ কারণেই সম্পর্ক ভেঙ্গে ফেলা,ঘন ঘন সিদ্ধান্ত পরিবর্তন,বয়স আনুপাতিক আচরণের অভাব ইত্যাদি তাদের মানসিক অপরিপক্কতার চিহ্ন বহন করে।

২)আকর্ষণের কেন্দ্রবিন্দুতে থাকাঃ-এরা সবসময় সবার মাঝে মনোযোগ ও আকর্ষণের কেন্দ্রবিন্দুতে থাকতে চায়। এটা হাসিল করার জন্য এরা নানারকম উপায় অবলম্বন করে। এদের হাসি,গল্প,কথা বলার স্ট্যাইল,আধুনিকতা সবকিছুই চিত্তাকর্ষক।

৩)পরনির্ভরশীলতাঃ-এরা প্রায়ই কারো না কারোর উপর নির্ভরশীল থাকে এবং নিজ কার্য সিদ্ধির জন্য অন্যকে খুব সহজেই ব্যবহার করতে পারে।

কোন কোন ক্ষেত্রে এরা অন্যের কথায় এতটাই নির্ভরশীল হয়ে পড়ে যে জীবনের মূল্যবান অনেক কিছুই হারিয়ে ফেলতে পারে বা সমূহ বিপদে পড়তে পারে। এক অর্থে এরা বেশ বোকা। প্রতারকরা প্রায়শঃই এদেরকে মিথ্যা প্রলোভনে ফেলে নানা সর্বনাশ করে থাকে।

৪)আবেগের বৈপরীত্যঃ-এরা অত্যন্ত আবেগপ্রবণ। বিশেষতঃ নিজ ইচ্ছা পূরণের জন্য এরা আবেগকে চমৎকারভাবে ব্যবহার করে।

এদের কাঁদতেও বেশী সময় লাগেনা আবার কাঁদাতেও বেশী সময় লাগেনা। এদের আবেগ পেন্ডুলামের মত দোদুল্যমান। ফলে এদের নিকটজনেরা অনেকসময় বুঝতে পারেনা কী করলে তার মন রক্ষা করা সম্ভব হবে।

৫)বিপরীতলিঙ্গের প্রতি তীব্র আকর্ষণঃ-এ ব্যক্তিত্বের মেয়েরা মেয়েদের তুলনায় ছেলেদের সাথে মেলামেশা করতে বেশী আগ্রহী থাকে ফলে এদের অনেক ছেলে বন্ধু থাকে। ছেলে-বুড়ো সকল পছন্দের পুরুষকে এরা নিজেদের দিকে আকৃষ্ট করে।

মুখে অনাত্মীয় পুরুষদের বন্ধু,বড় ভাই,ছোট ভাই,মামা,আঙ্কেল ডাকলেও অনেকক্ষেত্রেই সে তাদের সাথে প্রেমিকার মত আচরণ করে। অনেকসময় এরা একইসাথে একাধিক জনের সাথে প্রেম/পরকীয়ায় জড়িয়ে পড়ে। এমনকি বিয়ের পরেও তাদের পরপুরুষের প্রতি সর্বদা আকৃষ্ট হতে দেখা যায়। ফলে এরা প্রায়শঃই পরিবার বা সমাজে দুষ্ট বা খারাপ চরিত্রের মেয়ে বলে বিবেচিত হয়।

৬)আন্তঃব্যক্তিক সম্পর্কঃ-এরা মানুষের সাথে এত দ্রুত ঘনিষ্টভাবে মিশতে পারে যে দেখলে মনে হবে তাকে ছাড়া সে বাঁচবে না।

কিন্তু বাস্তবতা হলো এরা অধিকাংশ ক্ষেত্রে কারোর সাথেই গভীরভাবে সম্পর্কে জড়াতে পারে না। ফলে কারো সাথে সম্পর্কের বিচ্ছেদ হলে যার সাথে বিচ্ছেদ হলো তার জীবন তছনছ হয়ে গেলেও এদের খুব বেশী বিচলিত হতে দেখা যায় না। তবে এদের জীবনে কখনও কখনও তার স্বপ্নের মানুষ এসে হাজির হতে পারে যার সাথে এরা লাভ অবসেশনে জড়িয়ে যায়। মনোবিজ্ঞানের দৃষ্টিতে এটাকে সম্পর্কের গভীরতা বলা যায় না;বরং এটি আরেকটি মানসিক রোগ।

৭)কামোদ্দীপক পোষাকঃ-যে ধরনের পোষাক পরিধান করলে বা সাজগোজ করলে নিজের দেহকে যৌনাকর্ষণের উপলক্ষ্য বানানো যায় সেদিকে এদের মনোযোগ খুব বেশী থাকে।

আধুনিক পোষাক বিশেষতঃ যেসব পোষাক পরলে দেহের সৌন্দর্য্য ফুটে উঠে তার দিকে এদের বিশেষ ঝোঁক দেখা যায়। কেউ কেউ টম বয় হিসাবেও পরিচিতি লাভ করে।

৮)চাহনিঃ-পুরুষ আকর্ষণের এটা তাদের গুরুত্বপূর্ণ মারণাস্ত্র। কোন ছেলে ভিন্ন দৃষ্টিতে তাকালে অন্য মেয়েরা যেখানে বিব্রত বা বিরক্তি বোধ করে সেখানে এরা তার দিকে সরাসরি বা আড়চোখে বার বার কৌতুহলী দৃষ্টিপাত করে যা পুরুষদের কাছে প্রশ্রয় হিসাবে বিবেচিত হয়।

৯)কথাবার্তাঃ-এদের গলার স্বর ও কথা বলার স্টাইল অত্যন্ত আকর্ষণীয় হয়।

সেটাকে আরও আকর্ষণীয় করতে ইংরেজী শেখা ও তার ব্যবহারের প্রতি এদের বিশেষ ঝোঁক দেখা যায়।

১০)ডাহা মিথ্যুকঃ-মিথ্যা বলায় এদের গুণ শৈল্পিক পর্যায়ের। এদের মিথ্যাকে অনেকসময় সত্যের চেয়েও বেশী সত্য মনে হয়। এক পলকে এরা একজনকে ফেরেশতা থেকে শয়তান বা শয়তান থেকে ফেরেশতা বানাতে সিদ্ধহস্ত। অনেক সময় এরা তার পছন্দের পুরুষকে পেতে নিজ জীবনের সীমাহীন কষ্টের মিথ্যা কাহিনী রচনা করে যা ঐ ব্যক্তিকে তার প্রতি সহানুভূতিশীল হতে বাধ্য করে।



১১)উচ্চভিলাস ও লোভঃ-এরা সাধারণতঃ উচ্চভিলাসী ,লোভী ও স্বার্থপর হয়। অর্থ ও উচ্চ সামাজিক মর্যাদা লাভের জন্য নৈতিকতা,সম্পর্ক,পরিবার,সমাজ কিংবা ধর্ম সবকিছু এরা ত্যাগ করতে পারে। অনেকসময় দেখা যায় এরা তাদের মোবাইলের খরচ,দামী গিফ্ট,ভালো রেস্তোরায় খাওয়া বা ঘুরে বেড়ানোর খরচ তার ছেলে বন্ধুদের কাছ থেকেই আদায় করে থাকে। একটু বেশী ভালবাসা,অর্থ বা উচ্চ সামাজিক মর্যাদার কাউকে পেলে সে সহজেই বর্তমান সম্পর্ক ভেঙ্গে তার কাছে চলে যেতে কুন্ঠাবোধ করে না।

১২)অভিনয় দক্ষতাঃ-এরা অভিনয় করতে দারুন পটু।

অবাক হলেও সত্যি মিডিয়া জগতে রোমান্টিক অভিনেত্রী হিসাবে যারা চরম খ্যাতি পেয়েছেন তাদের একটা গুরুত্বপূর্ণ অংশ এ ব্যক্তিত্বের শিকার।

১৩)প্রেমের তীব্রতাঃ-এদের প্রেম এত তীব্র ও আকর্ষণীয় যে একবার এদের সাথে প্রেমে জড়ালে সারাজীবন তাকে প্রেমভিখারী হয়ে ঘুরে বেড়াতে হয়। এদের প্রেমিকদের অনেকেই লাভ অবসেশনে চলে যায়;কেউ কেউ প্রতিশোধমূলক নানা কর্মকান্ড ঘটিয়ে থাকে।

১৪)যৌনশীতলতাঃ-পুরুষ আকর্ষণের এদের প্রধান অস্ত্র যৌনাচরণ হলেও এরা যৌনজীবন খুব বেশী উপভোগ করেনা। যৌনশীতলতার জন্য অনেকসময় এরা নিয়মিত শারীরিক সম্পর্কও এড়িয়ে চলে।



১৫)আত্মহত্যার প্রবণতাঃ-এদের অনেকেরই জীবনবৃত্তান্তে আত্মহত্যার হুমকি দেওয়া,আত্মহত্যার চিন্তা বা চেষ্টা করার ইতিহাস থাকে। বেশীরভাগ ক্ষেত্রে অবশ্য অন্যকে জব্দ করতেই আত্মহত্যার হুমকি দিয়ে থাকে। তবে কখনও কখনও তীব্র আবেগ তাড়িত হয়ে এরা আত্মহত্যা করে ফেলতে পারে।

১৬)এরা সাধারণতঃ বাবার প্রশ্রয় বেশী পেয়ে থাকে এবং মায়ের সাথে সম্পর্ক বেশ খানিকটা তিক্ত থাকে। সম্ভবতঃ ফ্রয়েডের লিঙ্গিক ত্বত্ত্ব এদের ক্ষেত্রে প্রকটভাবে কাজ করে।

তবে আমার মনে হয় মায়েরা এদের অনৈতিক আচরণের ব্যাপারে বেশী খেয়াল করে ও তা প্রতিহত করার চেষ্টা করে বলেই মায়েদের সাথে এদের সম্পর্ক প্রায়শঃই তিক্ত থাকে।

উপরে যে উপসর্গগুলো আলোচিত হলো তা সবার ক্ষেত্রে সমভাবে প্রযোজ্য নাও হতে পারে;কারণ রোগের তীব্রতা ও উপসর্গের সামগ্রিক উপস্থিতি ব্যক্তি বিশেষে পার্থক্য হয়।

এতক্ষণ কেবল নেগেটিভ কথাই বলা হলো। আমার পর্যবেক্ষণে এদের সবচেয়ে পজিটিভ দিক হলো এদের মেধা। অধিকাংশ হিস্ট্রিওনিকরা যথেষ্ট মেধাবী হয়ে থাকে।

এদের মেধার সঠিক পরিচর্যা হলে এরা জীবনে অনেকদূর পর্যন্ত এগিয়ে যেতে পারে। কিন্তু দুঃখের বিষয় উঠতি বয়সেই বিপরীত লিঙ্গের প্রতি আকর্ষণজনিত জটিলতায় প্রায়শঃই এদের মেধাবিকাশের অকাল মৃত্যু ঘটে।

উল্লেখ থাকে যে সমাজের নিম্নবিত্ত ও নিম্ন মধ্যবিত্ত অংশে এ রোগের প্রাদূর্ভাব বেশী। তবে তা সমাজের সকল স্তরের মাঝেই কমবেশী পাওয়া যায়। আমি আবারও উল্লেখ করতে চাই এ রোগে মেয়েরা বেশী ভূগলেও পুরুষদের সংখ্যাও নিতান্ত কম নয়।



চিকিৎসাঃ-এদের চিকিৎসা করা অত্যন্ত কঠিন;কারণ এদের বেশীরভাগই নিজেদের ব্যক্তিত্বকে সমস্যা হিসাবে মানতে নারাজ। এরা সাধারণতঃ বিষন্নতা নিয়ে চিকিৎসকের কাছে আসে। হিস্ট্রিওনিক পার্সোনালিটি ডিসঅর্ডার-এই সমস্যার কোন ঔষধী চিকিৎসা নেই। সাইকোথেরাপীই একমাত্র ভরসা। তাই এ রোগে আক্রান্তদের ক্লিনিক্যাল সাইকোলজিষ্টের শরনাপন্ন হতে হবে।



কােথায় চিকিৎসা পাবেন?-জাতীয় মানসিক স্বাস্থ্য ইনস্টিটিউট,শ্যামলী,ঢাকা;বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিকেল ইউ. হাসপাতাল(পিজি হাসপাতাল)-এর মানসিক রোগ বহির্বিভাগে ও সকল মেডিকেল কলেজের মানসিক রোগ বিভাগে। এছাড়াও মনোরোগ বিশেষজ্ঞদের ব্যক্তিগত চেম্বারে আপনি এ চিকিৎসা পাবেন।

এই আর্টিকেলটি যথাসম্ভব সাধারণ ভাষায় লেখার চেষ্টা করেছি এবং তা কেবল গণসচেতনতা তৈরী করার জন্য। রোগ নির্ণয় ও চিকিৎসার জন্য সাইকোলজিস্টের শরণাপন্ন হতে হবে। ধন্যবাদ।

সোর্স: http://prothom-aloblog.com     দেখা হয়েছে বার

অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।

প্রাসঙ্গিক আরো কথা
Related contents feature is in beta version.