আমাদের কথা খুঁজে নিন

   

কঠিন সময়ে তিন বাল্যবন্ধু তরিকুল টিটো রাজু

তরিকুল ইসলাম, খালেদুর রহমান টিটো ও আলী রেজা রাজু। তিন বাল্যবন্ধু। ষাটের দশকে অবিভক্ত ছাত্র ইউনিয়ন করার মধ্য দিয়ে রাজনীতিতে তাদের হাতেখড়ি। এরপর দীর্ঘ পথচলায় কখনো তারা ছিলেন একই ছাতার নিচে। কখনো পথ হয়ে গেছে আলাদা।

প্রতিপক্ষ হয়ে একে-অন্যের বিরুদ্ধে লড়েছেন নির্বাচনে। যশোর-৩ সদর আসন থেকে এমপি হয়েছেন তিনজনই। অথচ এ তিন নেতাই রাজনীতিতে এখন কঠিন সময় পার করছেন। আজীবন আদর্শভিত্তিক রাজনীতি করে আসা তিন বন্ধু বর্তমান সময়ের পেশিশক্তি আর কালো টাকার রাজনীতির কাছে অসহায় হয়ে পড়ছেন বলে মনে করছেন অনেকেই। রাজনীতিতে তিন বন্ধুর মধ্যে সবচেয়ে সফল তরিকুল ইসলাম।

বিএনপির প্রতিটি শাসনামলেই মন্ত্রী হয়েছেন তিনি। দলটির জন্মলগ্ন থেকেই একটানা রয়েছেন বিএনপির সঙ্গে। জেল খেটেছেন, নির্যাতিত হয়েছেন। দলের দুঃসময়ে সফলতার সঙ্গে পালন করেছেন মহাসচিবের দায়িত্বও। এখন তিনি বিএনপির জাতীয় স্থায়ী কমিটির সদস্য।

খালেদুর রহমান টিটো জাতীয় পার্টির মন্ত্রী হয়েছিলেন। দলটির মহাসচিবও ছিলেন। একসময় জাতীয় পার্টি ছেড়ে বিএনপিতে যোগ দেন। কিন্তু ২০০১ সালের নির্বাচনে মনোনয়ন না পেয়ে রাজনীতিই ছেড়ে দেওয়ার ঘোষণা দেন। ২০০৬ সালে তিনি আওয়ামী লীগে যোগ দেন।

দলটির মনোনয়ন নিয়ে ২০০৮ সালের নির্বাচনে বন্ধু তরিকুল ইসলামকে পরাজিত করে সংসদ সদস্য হন। তবে গেল সংসদ নির্বাচনে তিনি দলীয় মনোনয়ন পাননি। আলী রেজা রাজু একসময় বিএনপির যশোর জেলা সভাপতি ছিলেন। এখন আওয়ামী লীগের জেলা সভাপতি। মনোনয়ন পাওয়া-না পাওয়ার দ্বন্দ্বে তিনিও বিএনপি ছেড়ে আওয়ামী লীগে যোগ দিয়েছিলেন।

প্রার্থী হয়ে পরাজিত করেছিলেন বন্ধু তরিকুল ইসলামকে। যশোরের যে সুদীর্ঘ রাজনৈতিক সংস্কৃতির ইতিহাস, তা লিখতে গেলে সিংহভাগ জুড়েই থাকবে এ তিন বন্ধুর কথা। যশোরের উন্নয়ন কর্মকাণ্ডের প্রায় সবটাতেই রয়েছে এ তিন বন্ধুর কমবেশি অবদান। বর্ষীয়ান এ তিন নেতা যে কঠিন সময় অতিক্রম করছেন, এ নিয়ে যশোরের রাজনৈতিক মহলে চলছে জোর আলোচনা। উপজেলা নির্বাচনে যশোরের আটটির মধ্যে পাঁচটিতেই পরাজিত হয়েছেন বিএনপি সমর্থিত প্রার্থীরা।

২৩ মার্চ সদর ও কেশবপুর উপজেলায় ভোট গ্রহণ অনুষ্ঠিত হয়। দুটিতেই আওয়ামী লীগ সমর্থিত প্রার্থীরা বিপুল ভোটে বিজয়ী হন। সদর উপজেলায় বিএনপি সমর্থিত প্রার্থীর চেয়ে আওয়ামী লীগ সমর্থিত প্রার্থী প্রায় ৯০ হাজার ভোট বেশি পান। যদিও বিএনপির অভিযোগ, নজিরবিহীনভাবে কেন্দ্র দখল ও জাল ভোট প্রদানের মাধ্যমে আওয়ামী লীগ সমর্থিত প্রার্থী জয় ছিনিয়ে নিয়েছেন। কিন্তু ভোটের আগে জেলা বিএনপি এবং তরিকুল ইসলাম কয়েক দফা সংবাদ সম্মেলন করে বাঁশ হাতে ভোট ডাকাতি প্রতিরোধের আহ্বান জানালেও কার্যত কেন্দ্রে নেতা-কর্মীদের উপস্থিতি চোখে পড়েনি।

'ভোট ডাকাতি'র প্রতিবাদে ২৫ মার্চ বিএনপি জেলাব্যাপী সকাল-সন্ধ্যা হরতাল আহ্বান করলেও রাজপথে নেতা-কর্মীদের অবস্থান ছিল নগণ্য। পিকেটিং হয়নি। হরতাল চলাকালে শহরের কেন্দ্রস্থল দড়াটানা মোড়ে বিএনপির দু-তিনজন নেতা অসহায়ের মতো বসে ছিলেন। নেতা-কর্মীর অভাবে তারা মিছিলও বের করতে পারেননি। বিএনপি নেতারা মনে করছেন, সরকারি দলের সশস্ত্র গুন্ডাদের দৌরাত্দ্য এবং পুলিশকে দলীয় কর্মীর মতো ব্যবহার করায় জীবনের ভয়ে নেতা-কর্মীরা রাজপথে জোরদার আন্দোলন গড়ে তুলতে পারছেন না।

রাজনীতি ছাড়ার ঘোষণা দেওয়ার পর আবার আওয়ামী লীগে যোগ দিয়ে সংসদ সদস্য নির্বাচিত হন খালেদুর রহমান টিটো। কিন্তু পাঁচ বছর সংসদ সদস্য থাকাকালে জেলা আওয়ামী লীগের একাংশের সঙ্গে তার ছিল দা-কুড়াল সম্পর্ক। ৫ জানুয়ারির নির্বাচনে তিনি দলীয় মনোনয়ন পাননি। উপজেলা নির্বাচনে ছেলে মাশুক হাসান জয় প্রার্থী হয়েছিলেন। পাস করাতে পারেননি তাকেও।

শারীরিকভাবে অসুস্থ আলী রেজা রাজু জেলা আওয়ামী লীগের সভাপতি আছেন বটে তবে দলের অনেক নেতার সঙ্গে তিনি নিজেকে ঠিক মানিয়ে নিতে পারছেন না বলেই অনেকে মনে করেন। যশোরের রাজনীতিতে বরাবরই তিনি সন্ত্রাসের বিপক্ষে। কিন্তু তার দলের অনেক নেতার বিরুদ্ধেই রয়েছে সন্ত্রাসের অভিযোগ, যা তিনি কখনোই মেনে নেননি। প্রকাশ্যে এসব ব্যাপারে মন্তব্যও করেছেন তিনি। চিকিৎসার জন্য বর্তমানে ভারতে অবস্থান করায় এসব ব্যাপারে তার বক্তব্য জানা সম্ভব হয়নি।

বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য তরিকুল ইসলাম বলেন, 'ষাটের দশকে যখন আমরা রাজনীতি শুরু করেছি, তখন তা ছিল আদর্শভিত্তিক। কালো টাকা ছিল না। এখন রাজনীতি হচ্ছে উল্টো ধারার। কালো টাকা আর পেশিশক্তিনির্ভর। আগে গুন্ডাপান্ডারা রাজনীতিবিদদের ভয় পেত, রাজনীতিবিদদের নিয়ন্ত্রণে থাকত।

এখন গুন্ডাপান্ডারাই নেতা হয়ে গেছে। স্বাধীনতার পর বিভিন্ন সরকারের আমলে রাজনীতির বাইরে থাকা একশ্রেণীর মানুষ ব্যাপকভাবে লাভবান হয়েছে। একসময় তারা নিজেদের স্বার্থে বিভিন্ন রাজনৈতিক দলকে সাহায্য-সহযোগিতা করত। এখন তারা নিজেরাই রাজনীতির সঙ্গে যুক্ত হয়ে গেছে। ' তরিকুল ইসলাম বলেন, 'আমাদের তিন বন্ধুর চিন্তা-চেতনার মধ্যে তেমন কোনো পার্থক্য নেই।

তিনজনই পেশিশক্তির বিরুদ্ধে কথা বলছি। ' তরিকুল ইসলাম জোর দিয়ে বলেন, যশোরের বেশির ভাগ মানুষ তাদের তিন বন্ধুর চিন্তা-চেতনার সঙ্গে এখনো একমত আছেন। কিন্তু অস্ত্র আর পেশিশক্তির ভয়ে সাধারণ মানুষ কিছু করতে পারছে না। মত-পথের পার্থক্য থাকলেও অন্য রাজনৈতিক দলের বিবেকবান নেতারাও বর্তমান পরিস্থিতি থেকে উত্তরণ চান। তিনি বলেন, মানুষ অত্যাচারিত হতে হতে একসময় ফুঁসে উঠবে।

তখন এ অবস্থার পরিবর্তন হবেই। তিনি আশা প্রকাশ করেন, নতুন প্রজন্ম তাদের পথ ঠিকই খুঁজে নেবে।

যশোরের দীর্ঘ রাজনৈতিক সংস্কৃতি ধ্বংস হওয়ার পেছনে তিন বন্ধুরই দায় রয়েছে বলে মনে করেন খালেদুর রহমান টিটো। তিনি বলেন, 'আমাদের ব্যর্থতার কারণেই আজকের এ অবস্থার সৃষ্টি হয়েছে। ' টিটো বলেন, রাজনীতি এখন সন্ত্রাস আর কালো টাকার নিয়ন্ত্রণে।

স্থানীয়ভাবে এ অবস্থার পরিবর্তন সম্ভব নয়। কেন্দ্রীয় পর্যায় থেকে সুস্থ রাজনীতির বিকাশ না ঘটা পর্যন্ত কোনো দলের পক্ষেই এ পরিবর্তন আনা সম্ভব নয়। তিনি বলেন, 'সমস্ত শিল্পের বড় শিল্প হচ্ছে রাজনীতি। এই একটিমাত্র ক্যানভাসে আপামর জনসাধারণের ভালো-মন্দ সৃষ্টি করা যায়। এই বিশ্বাস থেকেই রাজনীতি শুরু করেছিলাম।

কিন্তু সময়ের সঙ্গে সঙ্গে রাজনীতি এখন কালো টাকা আর ব্যবসায়ীদের নিয়ন্ত্রণে চলে গেছে। রাজনীতি এখন আর শিল্প নেই। সব দলেরই কমবেশি চেহারা এক। আমাদের চিন্তা-চেতনার সঙ্গে সমকালীন রাজনীতি মেলানো কোনো অবস্থাতেই সম্ভব নয়। ' টিটো বলেন, 'আগেও রাজনীতিবিদদের সঙ্গে গুন্ডাপান্ডারা থাকত।

কিন্তু তারা থাকত রাস্তায়। পরে আস্তে আস্তে আমরা তাদের বারান্দায় তুলেছি, ঘরে তুলেছি। এখন সেই গুন্ডাপান্ডারাই ঘর থেকে বের করে দিচ্ছে আমাদের। রাজনীতি-সচেতন মানুষের ব্যর্থতার কারণেই এ পরিস্থিতির সৃষ্টি হয়েছে। কালো টাকা আর সন্ত্রাসের বিরুদ্ধে মানুষকে সংগঠিত করতে আমরা ব্যর্থ হয়েছি।

কিন্তু এ অবস্থা চলতে পারে না। একসময় সাধারণ মানুষই বিদ্রোহ ঘটাবে। তারপর মুক্তি আসবে। তত দিন হয়তো বেঁচে থাকব না। '

 



সোর্স: http://www.bd-pratidin.com

অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।

প্রাসঙ্গিক আরো কথা
Related contents feature is in beta version.