আমাদের কথা খুঁজে নিন

   

তিন-তিনটে নষ্ট জীবন

অভি , আমার বেস্ট্‌ ফ্রেন্ড
ক্লাসের ফাস্ট্‌ বয়।
সেবার ঈদের ছুটিতে ও যখন বাড়িতে বেড়াতে গিয়েছিল
আমি তখন ওকে ফোন করেছিলাম ;
ফোনটা অনুরাধা তুলেছিল।
অনুরাধা অভি-র সামগ্রিক আদরের একমাত্র বোন।
অনুরাধার সাথে সেটাই আমার প্রথম পরিচয়।

বেশ মনে আছে :
ছুটি কাটিয়ে হারামজাদা যখন হস্টেলে ফিরে এসেছিল ;
আমি তখন তার সাথে টানা-দীর্ঘ একমাস কোনো কথা বলিনি।


আর কেনই-বা বলব ?
শালা এত কথা বলত !
আর ওর যে একখানা বোন আছে—
সেটা কিনা , আমাকেও বলেনি।

চোরা-কাঙ্ক্ষিত কারণটা অবশ্য পরে জেনেছিলাম ;
যেদিন অনুরাধা নিজে আমাকে ফোন করেছিল।
বুঝেছিলাম , আমাদের দুই বন্ধুর যাবতীয় অনর্গল কথা
এই মেয়েটি জানত।
অনুরাধা বলেছিল ‘একটা অনুরোধ করব , রাখবেন ?’
তারপর আমার পূর্ণ-সম্মতি পেয়ে পরিচ্ছন্নভাবে সে আমাকে বলল
‘শুনেছি বেশ কিছুদিন হল ইদানিং আপনি নাকি আর
দাদার সাথে কোনো কথাই বলছেন না !
শুনুন , আমাকে নিয়ে আপনাদের মধ্যে যে তুমুল ভুল বোঝাবুঝি হয়েছে
তার জন্য দাদার হয়ে আমি আপনার কাছে ক্ষমা চাইছি ;
আপনি দাদার সাথে কথা বলবেন।
ও আপনাকে খুব মিশ করে।


আর কষ্ট দেবেন না প্লিজ !’
আমি এই অত্যন্ত-নির্দোষ মেয়েটির মুখ থেকে ক্ষমার কথা শুনে
রীতিমতো লজ্জা পেয়ে গেলাম। তারপর আমিও বললাম:
‘যদি না কিছু মনে কর ,
তাহলে আমিও তোমাকে একটা কথা জিজ্ঞাসা করব ?’
সে বলল ‘বলুন না’।
আমি বললাম ‘তোমার কথা অভি কেন আমার কাছে গোপন করেছিল ?’
সে বলল ‘আর বলবেন না ,
পৃথিবীতে যেন আর কারো দাদা নেই !
আর আমিও বুঝি একমাত্র বোন !
জানেন , সবসময় দাদা আমাকে সবায়ের থেকে লুকিয়ে রাখে ;
পাছে , কেউ আমাকে সস্তায় কষ্ট দিয়ে থাকে ! তাই।
আসলে দাদা আমাকে খুব ভালোবাসে কিনা !’

তারপরই অভি-র সাথে আমার আবার কথা বলা শুরু হল।
আর সাথে সাথে শুরু হতে লাগল নতুন নতুন সব সমস্যা
এবং আরো অন্যান্য সংখ্যাতীত উটকো ঝামেলা।


দিনে চব্বিশ ঘণ্টার মধ্যে কম করে অন্তত পঁচিশবার শুনব
তার মুখ থেকে তার বোনের কথা।
খাবারের দোকানে উঠলে—
শুধু ঐ খাবারটাই আমাদেরকে অসহ্য-অসহায়ভাবে খেতে হবে
যেটা কিনা ওর একমাত্র বোনের পছন্দের।
বোনের জন্য পোষাক কিনবে
সেটাকেও হতে হবে আমার সার্বিক-ভালোলাগার আন্তর্জাতিক-পরাগমাখা।
যেন এতদিন গোপন করে রাখার জন্য সর্বাঙ্গ-সহবাসে
সুদে-আসলে , এক এক করে ফিরিয়ে দিচ্ছে সেসব।

আর এদিকে দিন দিন—
অনুরাধার মনে আমি , আর আমার মনে অনুরাধা
ধীরে ধীরে ক্রমশ দানা বেঁধে উঠতে লাগলাম।


সেটা বুঝতে পেরেই—
অনুরাধার অভিজ্ঞ-গম্ভীর ডাক্তার বাবা অনুরাধার বিয়ের জন্য
একটা দুর্লভ হীরের টুকরো ডাক্তার-পাত্র ঠিক করল।
অভি জীবনে সেই প্রথম বাবা-মার অবাধ্য হয়েছিল।
রায় বাড়িতে প্রথম ঝড় উঠেছিল ;
আর তাও কিনা শুধু আমার জন্য !
কিন্তু তবুও অভি তার বাবার সাথে লড়াইয়ে হেরে গেল।

সেটা ছিল অনুরাধার বিয়ের দিন।
তার বিয়েতে আমাকে কেউ নেমন্ত্রন করে নি।


তার বদলে অভি আমাকে পাঠিয়েছিল ছোটো একটা চিরকুট
তাতে খরস্রোতে লেখা ছিল—
‘বেশি কথা লেখার মতো সময় নেই
আগামি ২০-শে ফাল্গুন অনুর বিয়ে ঠিক হয়েছে
ঐদিন বিকালে হাওড়া স্টেশনের ৮ নম্বর প্লাটফর্মে দাঁড়িয়ে থাকিস
খুব বেশি দরকার আছে। ’

কেন জানি না , কি এক অতিরিক্ত অমোঘ টানে—
সেদিন সকাল থেকেই , সারাটাক্ষণ চিঠির প্রত্যেক কথাকটাকে
অক্ষরে-অক্ষরে বেঘোরে অনুসরণ করছিলাম ?
ঘোর কাটল স্টেশনের মধ্যে ঘর থেকে পালিয়ে আসা
বিয়ের সাজে অপ্রতিভ অনুকে যখন দেখলাম।
অভি বলল— ‘এছাড়া আর কোনো উপায় ছিল না-রে !
এই নে এতে দু’খানা টিকিট আছে , তোরা তাড়াতাড়ি গাড়িতে উঠে পড়’।
সেদিন আমি পারিনি অভির কথা রাখতে !
ডাক্তারের মেয়ের সাথে—
একটা সাধারণ বাড়ির ন্যাড়া-খ্যাপা ছেলের বিয়ে হতে পারে না বলে ;
তাদের দুই ভাই-বোনকে কুকুরের মতো তাড়িয়ে দিয়েছি।
অনু শক্ত পাথর হয়ে দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে সব শুনছিল।


আর অভি আমাকে তার জীবনের প্রথম
‘হারামি’ বলে গালাগাল দিয়ে , অভিশাপ দিল :
‘মনে রাখিস , আজকে আমাদের দু’জনকে যতটা কাঁদালি
তার অনেকবেশি এরপর কিন্তু আমরা তোকে কাঁদাব। ’

সেদিনই অনুর বিয়ে হয়েছিল।
আর তার কিছুদিন পর অভি সুই্‌সাইট করল।
আমিও ঘর ছাড়লাম।

আজ মুখ ভরতি ধার্য দাড়ি ;
আর মাথা ভরতি বরাদ্দ উসকো-খুসকো চুল নিয়ে ;
স্টেশনে এসে বসে আছি , ট্রেনের জন্য।


হঠাৎ চোখে পড়ল , কিছুটা তফাতে সেইখানে বসে আছে অনুও ;
স্টেশনে একদিন— যে সম্পর্ক ভেঙে গিয়েছিল
অনেকদিন পর , হঠাৎ করে তাতে যেন কে আবার
অবিকৃতভাবে-সজোরে টান মারল।
ভাগিস ভাগ্য ভালো যে এ সাজে অনু আমাকে চিনতে পারে নি ;
তানাহলে কে জানে কি কান্ডই না ঘটত !
স্টেশনে ট্রেন আসতেই—
অনু তার ছেলের হাত ধরে , বরের পিছন পিছন চলতে থাকল
নির্দিষ্ট সমীপেষু এসি-বগিকে লক্ষ্য করে।
গাড়িতে চড়ায় একেবারে শেষ-নিঝুম মুহুর্তে তাকালো আমার দিকে।
দূর থেকেই দেখতে পেলাম তার নথিভুক্ত চোখের কোনে পাঠযোগ্য জল ।
তাড়াতাড়ি করে চোরা হাতে চোখ মুছে নিয়ে
সে ট্রেনে চড়ল।


ট্রেন চলে গেল।
জীবনে প্রথমবার থার্ডক্লাসের তাৎপর্যপূর্ন টিকিতে পালিয়ে বেড়ানো
ট্রেন আমার মিশ হয়ে গেল।

অনু আর অভি ;
তারা দুই ভাই-বোন।
একজন মরে গিয়ে
আর একজন বেঁচে থেকে
এভাবেই—
প্রতিদিন আমাকে অবিরত-অনবরত কাঁদায়। ।

সোর্স: http://prothom-aloblog.com

অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।