আমাদের কথা খুঁজে নিন

   

ক্রিমিয়া নিয়ে যুদ্ধ কি অত্যাসন্ন?

১৬ মার্চের গণভোটে শতকরা ৯৭ ভাগ 'হ্যাঁ ভোট' পেয়ে ক্রিমিয়ার স্বাধীনতা ঘোষণা এবং ইউক্রেন থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে রাশিয়ার সঙ্গে সংযুক্তির সিদ্ধান্তকে কেন্দ্র করে পাশ্চাত্য ও রাশিয়ার অবরোধ এবং পাল্টা অবরোধ শুরু হয়েছে। এ ঘটনাকে কেন্দ্র করে বিশ্ব একটি অর্থনৈতিক যুদ্ধের দিকে অগ্রসর হচ্ছে বলে অনুমিত হচ্ছে। আশঙ্কা তীব্র থেকে তীব্রতর হচ্ছে এ কারণে যে, বিবদমান পক্ষদ্বয়ের সবাই পারমাণবিক শক্তিসম্পন্ন এবং অর্থনৈতিক ক্ষমতাধর। স্নায়ুযুদ্ধকালীন পরাশক্তিদ্বয় যুক্তরাষ্ট্র এবং সাবেক সোভিয়েত ইউনিয়নের প্রধান শরিক রাশিয়া ক্রিমিয়া সংকট ঘিরে স্নায়ুযুদ্ধকালীন রণদামামার সব শৌর্যবীর্য ছড়িয়ে মুখোমুখি হচ্ছে। যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে রয়েছে পশ্চিম ইউরোপীয় মিত্ররা।

আর রাশিয়ার সঙ্গে যারা আছে তারা এখনো মিডিয়ায় স্পষ্টভাবে প্রতিফলিত না হলেও ইঙ্গ-মার্কিন বিরোধীরা যে তার পাশে দাঁড়াবে, এমন ভবিষ্যদ্বাণী করা যায়। ইতোমধ্যে অনেক বিশ্লেষক বর্তমান ক্রিমীয় সংকটের অনিবার্য পরিণতি হিসেবে একটি বৃহৎ যুদ্ধের আশঙ্কার চিত্র তুলে ধরেছেন। আমার মনে হয় সেরকম চূড়ান্ত যুদ্ধ শুরু না হলেও বিবদমান বৃহৎ শক্তিগুলো নিশ্চিতভাবে অর্থনৈতিক দ্বন্দ্বে জড়িয়ে পড়বে এবং এদের অনুসারী অন্য রাষ্ট্রগুলোর সমর্থন যুক্ত হয়ে এক পর্যায়ে এর বৈশ্বিক অর্থনৈতিক দ্বন্দ্বের রূপ পরিগ্রহ করবে।

২৭ মার্চ ইইউ শীর্ষ বৈঠকে ক্রিমিয়া সংকটকে কেন্দ্র করে ইউরোপের সম্ভাব্য অর্থনৈতিক ক্ষতি সর্বনিম্ন পর্যায়ে রাখার কৌশল প্রাধান্য পেয়েছে। এ লক্ষ্যে ইউরোপীয় দেশগুলো ইতোমধ্যে বিতর্কে জড়িয়ে পড়েছে।

উদাহরণস্বরূপ স্লোভাকিয়ার প্রধানমন্ত্রী রবার্ট ফিকো বেশ উদ্বিগ্ন হয়ে বলেছেন, রাশিয়ার ওপর জ্বালানি সংক্রান্ত নিষেধাজ্ঞা স্লোভাকিয়ায় অর্থনীতির জন্য বিপর্যয়কর হবে। ইউরোপীয় রাষ্ট্রগুলো আস্তে আস্তে জ্বালানি ইস্যুকে কেন্দ্র করে বিব্রতকর দ্বন্দ্বে জড়িয়ে পড়বে বলে ইঙ্গিত পাওয়া যাচ্ছে।

রাশিয়া এবং যুক্তরাষ্ট্র পাল্টাপাল্টি অবরোধের হুঁশিয়ারি দিয়েই যাচ্ছে। ইইউ বেশ কড়াভাবে রাশিয়ার প্রতি অবরোধের মাত্রা ও পরিধি বাড়ানোর হুঙ্কার দিচ্ছে। যুক্তরাষ্ট্র ও তার মিত্রদের এ সব হুমকির বিরুদ্ধে রাশিয়াও পাল্টা হুমকি দিয়ে পরিস্থিতি উত্তপ্ত করে তুলছে।

এমন অবস্থায় একটি অর্থনৈতিক বাকবিতণ্ডা শুরু হয়ে তা আস্তে আস্তে বৈশ্বিক অর্থনৈতিক যুদ্ধের দিকে অগ্রসর হতে পারে বলে আশঙ্কা করা হচ্ছে। গত ১৩ মার্চ ইউক্রেন ও রাশিয়া জাতিসংঘ নিরাপত্তা পরিষদের সামনে কোনো যুদ্ধে না জড়ানোর অঙ্গীকার করলেও পরবর্তীতে সংকট সমাধানে তারা কোনো ভূমিকা নেয়নি। ফলে ক্রিমিয়ায় স্বাধীনতা ঘোষণা এবং রাশিয়ার সঙ্গে তার সংযুক্তি সম্ভব হয়েছে। অধিকন্তু এ ইস্যুকে কেন্দ্র করে যুক্তরাষ্ট্র ও ইইউ বার বার নিষেধাজ্ঞা আরোপ করছে রাশিয়ার ওপর।

মার্কিন প্রেসিডেন্ট বারাক ওবামা নতুন করে গত ২০ মার্চ রাশিয়ার আরও কয়েকজন সরকারি কর্মকর্তা ও একটি ব্যাংকের বিরুদ্ধে অবরোধের ঘোষণা করেছেন।

সাম্প্রতিকতম এ হুমকির আওতায় পড়বেন ক্রিমিয়ায় স্বার্থসংশ্লিষ্ট ২০ জন রুশ কর্মকর্তা। এ ছাড়া এ কর্মকর্তাদের সহায়তা করার অভিযোগে অবরোধের শিকার হবে ব্যাংক রোশিয়া। ইইউ ও যুক্তরাষ্ট্রের মতো রাশিয়ার বিরুদ্ধে নতুন করে নিষেধাজ্ঞা আরোপের ইঙ্গিত দিচ্ছে। গত ২০ মার্চ ব্রাসেলস বৈঠকে ইইউ নেতারা কঠোর নিষেধাজ্ঞার কথা উচ্চারণ করেন। বৈঠক শুরুর আগে জার্মান চ্যান্সেলর অ্যাঙ্গেলা মেরকেল হুঁশিয়ারি উচ্চারণ করে বলেন, সাম্প্রতিক পরিস্থিতিতে জি-৮ এর কার্যকারিতা হয়তো ধূলিসাৎ হয়ে যাবে।

এদিকে রাশিয়াও পাল্টা ব্যবস্থা হিসেবে যুক্তরাষ্ট্রের বিরুদ্ধে অবরোধ আরোপের তালিকা দীর্ঘ করছে। রুশ-অবরোধের মুখে পড়তে যাচ্ছেন যারা তাদের অন্যতম হলেন- জ্যেষ্ঠ কংগ্রেসম্যান হ্যারি রিড, জন বোয়েনার, জন ম্যাককেইন এবং বারাক ওবামার অন্যতম জাতীয় নিরাপত্তা উপদেষ্টা বেঞ্জামিন রোডস। জাতিসংঘে এ পর্যন্ত তৃতীয় দফা বৈঠক হলেও ক্রিমিয়ার সংকটে সমাধানকল্পে কোনো সুদূরপ্রসারী অগ্রগতি হয়নি। গত ১৮ মার্চে নিরাপত্তা পরিষদের তৃতীয় দফা জরুরি বৈঠকে জাতিসংঘে নিযুক্ত মার্কিন দূত সামান্থা পাওয়ার রাশিয়ার ক্রিমিয়া দখলকে 'চুরি' করার সঙ্গে তুলনা করেন। তিনি বলেন, একজন চোর কোনো সম্পদ চুরি করলে, সে ওই সম্পদের মালিক হয়ে যায় না।

জাতিসংঘে রুশ রাষ্ট্রদূত ভিতালি চুরকিন সামান্থার বক্তব্যে ক্ষুব্ধ প্রতিক্রিয়া ব্যক্ত করে বলেন, রাশিয়ার ব্যাপারে সামান্থার হাস্যকর বক্তব্য গ্রহণযোগ্য নয়।

সব আন্তর্জাতিক প্রক্রিয়া উপেক্ষা করে রাশিয়া ক্রিমিয়াকে রাশিয়ার অন্তর্ভুক্ত করার চূড়ান্ত পর্যায়ে উপনীত। রুশ পররাষ্ট্রমন্ত্রী ল্যাভরভকে উদ্ধৃত করে 'ইতারতাস জানায়, মার্চের মধ্যেই ক্রিমিয়াকে যুক্ত করার আইনি প্রক্রিয়া শেষ করা হবে। আগামী ১ জুন পর্যন্ত অন্তবর্র্তী সময়ের মধ্যে ক্রিমিয়া সম্পূর্ণরূপে রাশিয়ার অংশ হয়ে যাবে। স্পষ্টত রাশিয়া ও পাশ্চাত্য শক্তির মধ্যকার এ স্নায়ুযুদ্ধের চারিত্রিক বৈশিষ্ট্য হলো এর অর্থনৈতিক মোড়ক।

অর্থাৎ অর্থনীতিকে ঘিরেই উদ্ভূত স্নায়ুযুদ্ধ আবর্তিত হবে। প্রথমেই আমাদের বুঝতে হবে ইউক্রেনের অধীনে স্বায়ত্তশাসিত ক্রিমিয়ার ভূঅর্থনৈতিক গুরুত্ব কি এবং কেনইবা ইউক্রেন রাশিয়া ও পাশ্চাত্যের জন্য গুরুত্বপূর্ণ। ইইউভুক্ত দেশগুলোর প্রয়োজনীয় গ্যাসের এক-চতুর্থাংশ সরবরাহ করে থাকে রাশিয়া এবং এর এক-তৃতীয়াংশ ইউক্রেনের ভেতর দিয়ে ইউরোপে প্রেরিত হয়। অর্থাৎ ইউরোপের শিল্প-কারখানা এবং প্রাত্যহিক গৃহস্থালি কাজকর্ম রাশিয়ার ইচ্ছা ও ইউক্রেনের অবকাঠামোর সঙ্গে ওতপ্রোতভাবে জড়িত। পোল্যান্ড, ফিনল্যান্ড, হাঙ্গেরি, স্লোভাকিয়া, বুলগেরিয়াসহ বাল্টিক রাষ্ট্রগুলো রাশিয়ার রাষ্ট্রায়ত্ত প্রতিষ্ঠান গাজপ্রম থেকে চাহিদার সব গ্যাস আমদানি করে।

এ পরিসংখ্যান থেকে স্পষ্ট বোঝা যায়, রাশিয়ার ওপর ইউরোপের গ্যাসনির্ভরতার কারণে তাদের পাল্টাপাল্টি অবরোধ ইউরোপকে সমূহ বিপদে নিক্ষিপ্ত করবে। কিন্তু রাশিয়ার পক্ষে ভাবার কোনো কারণ নেই যে, ইউরোপীয়রা গ্যাসনির্ভরশীলতার কারণে রাশিয়ার বাড়াবাড়ি নীরবে সহ্য করবে। বস্তুত অবরোধ নিষেধাজ্ঞা ইউরোপের চেয়ে রাশিয়ার ক্ষতি করবে বেশি। ব্রাসেল্সভিত্তিক গবেষণা প্রতিষ্ঠান 'সেন্টার ফর ইউরোপিয়ান পলিসি' জানিয়েছে যে, রাশিয়ার ওপর ইউরোপের গ্যাসনির্ভরতার তুলনায় ইউরোপ থেকে গ্যাস রপ্তানি আয়ের ওপর রাশিয়ার নির্ভরতা তুলনামূলকভাবে বেশি। এএফপির পরিসংখ্যান থেকে জানা যায়, রাশিয়ার বার্ষিক গ্যাস-রপ্তানির ৫৩ ভাগ যায় ইউরোপে।

যার মূল্যমান প্রায় ২৪ বিলিয়ন ডলার। গবেষণাগুলো থেকে জ্ঞাত হওয়া যায় যে, রাশিয়ার জাতীয় বাজেট ও গাজপ্রমের সচলতার চাবি হলো ইউরোপের সঙ্গে রাশিয়ার অর্থনৈতিক সহযোগিতা। ইইউ রাশিয়া ছাড়া অন্যান্য উৎস থেকেও গ্যাস ক্রয় করতে পারে। উদাহরণস্বরূপ, ২০০৯ সালে রাশিয়া-ইউক্রেন দ্বন্দ্বের সময় ইউরোপ তার গ্যাস সরবরাহ সূত্র বহুমুখী করেছিল। ইউরোস্টাটের তথ্যানুযায়ী ২০০৩ সালে রাশিয়ার ওপর ইইউর ৪৫ ভাগ গ্যাসনির্ভরতা হ্রাস পেয়ে ২০১২ সালে ৩২ ভাগে নেমে আসে।

তবে ইউরোপের আশান্বিত হওয়ার এমন কোনো কারণ নেই যে, তারা রাশিয়া ছাড়া স্বচ্ছন্দে চলতে পারবে। ইউরোগ্যাসের হিসাব মতে, ২০১৩ সালে ইউরোপের গ্যাস আমদানি খাতে রাশিয়ার অংশগ্রহণ শতকরা ৪০ ভাগে উন্নীত হয়।

রাশিয়া এবং ইউরোপের পারস্পরিক নির্ভরশীলতার কারণে সরাসরি যুদ্ধে জড়িয়ে পড়া তাদের জন্য খুবই কঠিন হবে। ফলে তারা এ মুহূর্তে গভীর স্নায়ুযুদ্ধে লিপ্ত হয়ে নানামুখী বিকল্প অনুসন্ধানে তাদের শক্তি নিয়োজিত রাখবে। আন্তর্জাতিক সম্পর্কে স্নায়ুযুদ্ধ বলতে সেই নীরব প্রতিযোগিতাকে বুঝানো হয়, যেখানে সরাসরি অস্ত্রশস্ত্র ব্যবহার না করে বেশি বেশি বন্ধু ও সহযোগী রাষ্ট্রকে সঙ্গে নিয়ে প্রভাব বলয় বৃদ্ধির নিরন্তর চেষ্টা করে যায়।

তবে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ উত্তর স্নায়ুযুদ্ধ এবং ক্রিমীয় সংকটকে কেন্দ্র করে উদ্ভূত সম্ভাব্য স্নায়ুযুদ্ধের মাত্রা, বৈশিষ্ট্য ও অগ্রাধিকার সম্পূর্ণ ভিন্ন প্রকৃতির। প্রাক্তন স্নায়যুদ্ধের সামরিক, রাজনৈতিক প্রতিশ্রুতি ছিল প্রত্যক্ষ এবং অর্থনৈতিক সংশ্লিষ্ট। কিন্তু অধুনা-আবিভর্ূত স্নায়ুযুদ্ধের প্রত্যক্ষ প্রকাশ হলো অর্থনৈতিক প্রয়োজনে অর্থনৈতিক বন্ধু বলয় গঠনের সরাসরি উদ্যোগ। তবে সামরিক এবং রাজনৈতিক বিবেচনাগুলোও এর পাশাপাশি বৃহৎ শক্তিগুলোর নীতি প্রণয়নে সক্রিয়। আগেই উল্লেখ করেছি, প্রতিদ্বন্দ্বী বৃহৎ রাষ্ট্রগুলোর পারস্পরিক নির্ভরশীলতার কারণে তারা বৃহৎ কোনো যুদ্ধে জড়িয়ে পড়বে না।

ইতোমধ্যে রাশিয়ার পুঁজিবাজার এবং ইউরোপের পুঁজিবাজারে ধাক্কা লাগতে শুরু করেছে। এই ধাক্কা কাটাতে তারা শীঘ্রই সমঝোতায় আসতে উদ্যত ও উদগ্রীব হবে। তবে তার আগ পর্যন্ত অবশিষ্ট বিশ্ব বৃহৎ শক্তির রাষ্ট্রগুলোর স্নায়ুযুদ্ধের ছলচাতুরি অবলোকন করার সুযোগ পাবে।

লেখক : অধ্যাপক আন্তর্জাতিক সম্পর্ক বিভাগ, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়

ই-মেইল :mramin68@yayoo.co

 

সোর্স: http://www.bd-pratidin.com

অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।

প্রাসঙ্গিক আরো কথা
Related contents feature is in beta version.