আমাদের কথা খুঁজে নিন

   

জ্বিনে ধরা একটি মেয়ের গল্প এবং....

রুমা নরসিংদী ডিগ্রী কলেজের অনার্স প্রথম বর্ষের ছাত্রী। দেখতে যেমন রূপবতী তেমননি গুণবতীও। রক্ষণশীল ধার্মিক পরিবারের মেয়ে;বড় লাজুক,অসম্ভব ভদ্র ও খুব শান্ত প্রকৃতির মেয়ে। এরকম একটা মেয়েকে ঘরের বউ বানানোর জন্য অনেকেরই প্রস্তাব আসে। শেষ-মেষ বাবা-মা লন্ডন প্রবাসী এক পাত্রের সাথে রুমার বিয়ে ঠিক করে ফেলল রুমার সম্মতিতেই।

বিয়ে বাড়ীতে চলছে ধূমধাম। বিপত্তিটা বাঁধল গায়ে হলুদের দিন। শীতের দিন তারপর মফস্বল এলাকা তাই সন্ধ্যের ঠিক আগেই রুমার গায়ে হলুদের অনুষ্ঠান শেষ হলো। হলুদ শাড়ী,হলুদ মাখা দেহ আর খোলা দীঘল চুলে রুমাকে পরীর মত দেখাচ্ছিল। তখন ভরা সন্ধ্যা।

রুমা দৌড় দিয়ে গেল ছাদে কি একটা কাপড় আনতে। কিন্তু ছাদ থেকে নেমে আসল অন্য রুমা হয়ে। লাল বড়বড় চোখে অস্বাভাবিক দৃষ্টিতে সবাইকে দেখতে লাগল। রুমার মা মেয়েকে জড়িয়ে ধরে কাঁদতে কাঁদতে জিজ্ঞাসা করল “মা তোর কী হয়েছে?”। রুমা অট্টহাসিতে ফেটে পড়ল।

গান গাইতে গাইতে বায়না ধরল “আমাকে এখনি লাল শাড়ী,লাল পেটিকোট,লাল ব্লাউজ,লাল সেন্ডেল ও লাল টিপ এনে দে,আমি সাজব”। মেয়ের গায়ে অসুরের শক্তি,ধরে রাখা মুশকিল। মৌলভী সাহেবকে খবর দেওয়া হলো। নামাজ শেষে তিনি এসে রুমাকে দেখে সবার আশংকাকে সত্যিতে পরিণত করে জানালেন রুমাকে জ্বিনে ধরেছে। উনার দোয়া ও পানি পড়ায় কোন ফল হলো না।

আবদার মোতাবেক বাজার থেকে সবকিছু কিনে আনা হলো। রুমা সুর করে গান গাইতে গাইতে সুন্দর করে সাজলো। তারপর খেতে চাইলো। তার গোগ্রাসে খাওয়া দেখে সবাই ভয় পেয়ে গেল। কিছুক্ষণের জন্য ঘুমালো ঠিকই কিন্তু শেষ রাতে উঠে সবাইকে আদেশ-নিষেধ ও নসিহত করতে লাগল।

এমনকি আত্মীয়দের বিভিন্ন গোপন কথাও বলে দিতে লাগল। সূর্য উঠার আগেই গোটা পাড়ায় রটে গেল রুমাকে জ্বিনে ধরেছে। সকাল থেকেই বিভিন্ন পীর-ফকিরের আনাগোনা শুরু হলো কিন্তু কোন লাভ হলোনা। দুপুর নাগাদ হাজির হলেন জ্বিনের বাদশা পকেটে নিয়ে ঘোরা ফকির চাঁন মিঞা। নাকে শুকনা মরিচ পোঁড়া,ঝাড়ু–পেটা,নিমের ডাল দিয়ে পেটানো,কনিষ্ঠা আঙ্গুলি ধরে প্রচন্ড ব্যথা দেওয়া,অশ্লীল ভাষায় জ্বিনকে গালিগালাজ,জ্বিনকে হুমকি-ধুমকি দেওয়া-ফকির চাঁন মিঞার সব চেষ্টা ব্যর্থ হওয়ার পর জানালেন এ খুব শক্তিশালী জ্বিন;একে শায়েস্তা করতে হলে ভর সন্ধ্যায় দুই নদীর মোহনার পানিতে জ্বিন ছেড়ে না যাওয়া পর্যন্ত গোসল করাতে হবে।

“জ্বিন আগুনের তৈরী আর পানি আগুন নেভাতে পারে”-এ তত্বে বিশ্বাসী হয়ে গেল সবাই। ইতোমধ্যে বরের বাড়ীতে জ্বিনে ধরার খবর পৌঁছে গেছে। তারা সাফ জানিয়ে দিল এ মেয়েকে কোন অবস্থায় ঘরের বউ করবে না। বিয়ে ভেঙ্গে যাওয়ায় রুমার বাপ-মার যত না কষ্ট তার চেয়ে বেশী কষ্ট মেয়ের জ্বিনে ধরা নিয়ে। বিধান মোতাবেক রুমাকে নদীর পাড়ে নিয়ে ঘন্টা দু এক গোসল করানো হলো।

এটা ঠিক রুমা বেশ নিস্তেজ হয়ে গেল এবং তার অস্বাভাবিক আচরণও কিছুটা কমে গেল। কিন্তু পরের দিন থেকে শুরু হলো প্রবল জ্বর,শ্বাস কষ্ট ও ভুল বকা। স্থানীয় ডাক্তারকে কল দেওয়া হলো। নিউমোনিয়া হয়েছে ও খুব খারাপ পর্যায়ে চলে গেছে এরকম ভেবে তিনি রুমাকে ঢাকায় রেফার করলেন। ঢাকা মেডিক্যালে রুমাকে ভর্তি করা হলো।

কয়েকদিনের চিকিৎসায় বেশ সুস্থও হয়ে উঠলো রুমা। এরপর চিকিৎসক তাকে সাইকিয়াট্রিস্টের কাছে রেফার করলেন। সবকিছু শুনে সাইকিয়াট্রিস্ট রুমাকে DISSOCIATIVE IDENTITY DISORDER(POSSESSION DISORDER)এর কেস বলে ডায়াগোনোসিস করলেন এবং সে মোতাবেক চিকিৎসা দিলেন। সফল চিকিৎসা শেষে রুমা পরিপূর্ণ সুস্থ হয়ে বাড়ী ফিরল। মজার বিষয় হলো জ্বিনে ধরা সম্পর্কে রুমার কিছুই মনে নেই।

সবার কাছ থেকে গল্প শুনে সে খুব লজ্জা পেতে লাগল।


POSSESSION DISORDER কী?-এক সময় এ রোগকে হিষ্টিরিয়া বলা হতো। সুনির্দিষ্টভাবে এর কারণ জানা না গেলেও রোগীদের রোগের ইতিহাস থেকে ধারণা পাওয়া যায় যখন কেউ বার বার প্রচন্ড মানসিক আঘাত পায় বা মনে যখন কোন কারণে প্রচন্ড CONFLICT বা দ্বন্ধ তৈরী হয় এবং তা সমাধান করা সম্ভব হয় না তখন কিছু ঝুঁকিপূর্ণ মানুষের ব্রেন তার দেহ ও মনে জিন-ভুত বা কোন অশরীরী আত্মার উপস্থিতির উপসর্গ তৈরী করে(মনের মধ্যে তৈরী হওয়া প্রচন্ড মানসিক চাপ থেকে বাঁচতে) কোন পরীক্ষা-নিরীক্ষায় যার কোন প্যাথলজিক্যাল কারণ খুঁজে পাওয়া যায় না। মোটামুটিভাবে এটাই হলো POSSESSION DISORDER।


ব্রেন এই কাজ কেনো করে?-কিছু ঝুঁকিপূর্ণ ব্যক্তিত্বের মানুষ আছে যাদের মনে প্রচন্ড কোন কষ্ট বা দ্বন্ধ তৈরী হলে তা নিরসনের যৌক্তিক পথ অবলম্বন করতে পারে না।

তখন তার ব্রেনে মাত্রাতিরিক্ত মানসিক চাপ তৈরী হয় । এই মানসিক চাপ থেকে বাঁচতেই রোগীর দেহ থেকে মন বা চেতনা বিচ্ছিন্ন বা DISSOCIATE হয়ে যায় এবং সে অশরীরী আত্মার উপস্থিতি অনুভব করে। আলোচ্য রুমার ক্ষেত্রে হিষ্ট্রি নিয়ে জানা গেছিলো তার এ বিয়েতে অমত ছিলনা কিন্তু বাবা-মাকে ছেড়ে লন্ডন যেতে তার ঘোর আপত্তি ছিল। কিন্তু রুমা তার ব্যক্তিত্বের ত্রুটির কারণে তা প্রকাশ করতে পারেনি। ফলে তার ব্রেনে দ্বন্ধ থেকে প্রচন্ড মানসিক চাপ তৈরী হয়।

এ থেকেই তার জ্বিনে ধরার উপসর্গ প্রকাশ পায়। এ থেকে দু টো লাভ হলোঃ-

১। তার বিয়ে ভেঙ্গে গেল যা তার দ্বন্ধের প্রধান কারণ ছিল। একে primary gain বা প্রাথমিক লাভ বলে।

২।

বিয়ে ভাঙ্গার জন্য তাকে কেউ দায়ী করতে পারল না। উল্টো সবাই তার রোগ নিয়ে ব্যস্ত হয়ে পড়ল এবং আদর-যত্ন বেড়ে গেল। একে secondary gain বা দ্বিতীয় লাভ বলে।

উল্লেখ্য ব্রেনের অবচেতন মনে এ ঘটনা ঘটে বিধায় রোগী যখন পরিপূর্ণ চেতনা ফিরে পায় তখন এসবের কিছুই মনে করতে পারে না। মজার বিষয় হলো রোগের উপসর্গে রোগীর পরিবার পরিজন যতটা ভীত সন্ত্রস্ত থাকে রোগীর মধ্যে ততটা দেখা যায় না।




চিকিৎসা কী?-POSSESSION DISORDER এর চিকিৎসায় ঔষধ ও সাইকোথেরাপী দুইই লাগতে পারে। সাইকোটিক উপসর্গ,উত্তেজনা কমানো ও ঘুমের জন্য ঔষধ দিতে হয়। কাউন্সেলিংটা মূলতঃ রোগীর পরিবার-পরিজনদের জন্য বেশী জরুরী। রোগীর বিবরণটা ভালভাবে জানতে হবে কেন তার কষ্ট বা দ্বন্ধ তৈরী হয়েছে-এটা সমাধান করতে হবে ভবিষ্যতে এরূপ উপসর্গ যেন আবার দেখা না দেয় তার জন্য। একটা মজার কথা উল্লেখ না করে পারছি না যারা প্রথাগত চিকিৎসা করে থাকেন(অর্থাৎ যারা ঝাড়-ফুঁক করেন) তারা অনেকসময় জ্বিন-ভূতের চাহিদা পূরণ করে রোগী ভাল করে থাকেন।

আপাততঃ বিষয়টা হাস্যকর মনে হলেও কোন কোন মনোবিজ্ঞানী এটাকে এক ধরণের সাইকোথেরাপী মনে করছেন। হয়তো এ কারণেই এদের কাছে গেলে কখনও কখনও রোগী ভাল হয়ে যায়!


কোথায় চিকিৎসা পাবেন?-জাতীয় মানসিক স্বাস্থ্য ইনস্টিটিউট,শ্যামলী,ঢাকা;বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিকেল ইউ. হাসপাতাল(পিজি হাসপাতাল)-এর মানসিক রোগ বিভাগে;সকল মেডিকেল কলেজের মানসিক রোগ বিভাগে। এছাড়াও মনোরোগ বিশেষজ্ঞদের ব্যক্তিগত চেম্বারে আপনি এ চিকিৎসা পাবেন।


সুতরাং যারা এই আর্টিকেলটা পড়ছেন তারা অন্যদেরকে সচেতন করে তুলুন এবং জ্বিনে ধরা রোগীদের চিকিৎসার জন্য একজন মনোচিকিৎসকের শরণাপন্ন হউন। পুরো আর্টিকেলটা আমার সংকলিত এবং রুমা একটা কাল্পনিক চরিত্র।

আর্টিকেলটি কেবলমাত্র সাধারণের সচেতনতা তৈরীর জন্য লেখা হয়েছে;রোগ নির্ণয় বা চিকিৎসার জন্য নয়। আপনি যদি এ বিষয়ে আরও জানতে চান তাহলে নীচের রেফারেন্স বইগুলো পড়তে পারেন। ধন্যবাদ আর্টিকেলটি পড়ার জন্য।

REF.-1.Clinical Psychology by A.K.Agarwal 2.Review of General Psychiarty by Howard H. Goldman 3.Current Medical Diagnosis & Treatment.।

সোর্স: http://prothom-aloblog.com

অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।