আমাদের কথা খুঁজে নিন

   

শিল্পায়ন বন্ধ ছিল দিলীপ বড়ুয়ার পাঁচ বছরে

বিগত মহাজোট সরকারের অংশীদার বাংলাদেশের সাম্যবাদী দলের (এমএল) সাধারণ সম্পাদক দিলীপ বড়ুয়া শিল্পমন্ত্রী থাকাকালে দেশে কোনো শিল্পের বিকাশ হয়নি, বরং দামি ব্র্যান্ডের স্যুট-টাই পরে প্লট ও গাড়ি কেলেঙ্কারিসহ নানা বিতর্কে জড়িয়ে পড়েছিলেন এই বাম নেতা। বিদেশ সফর এবং নিজেকে গোছানো নিয়েও তিনি অধিক সময় কাটিয়েছেন। এ সময় দেশের শিল্প খাতে স্থবিরতা নেমে আসে। এমনকি সরকারি শিল্পেরও বিকাশ হয়নি। তার পরও মহাজোটের প্রভাবশালী মন্ত্রী হিসেবে টানা পাঁচ বছর দায়িত্ব পালন করেছেন।

জানা গেছে, দ্বিতীয় মেয়াদে ক্ষমতায় আসা মহাজোট সরকারের মন্ত্রিসভায় নানামুখী বিতর্কের কারণেই ঠাঁই পাননি দিলীপ বড়ুয়া। তার ধারণা ছিল তাকে আবারও রাখা হবে। কিন্তু শেষ পর্যন্ত মন্ত্রিত্ব না পেয়ে হতাশ সাম্যবাদী দল নেতা। দলীয় কার্যালয়েও এখন তেমন যান না। তার দলের আলাদা কোনো কর্মসূচিও নেই জাতীয় দিবস ও বিভিন্ন ইস্যুতে।

তবে মাঝেমধ্যে ১৪ দলের কর্মসূচিতে যান। সর্বশেষ তাকে গতকাল ১৪ দলের বৈঠক-পরবর্তী সংবাদ সম্মেলনে আওয়ামী লীগের প্রেসিডিয়াম সদস্য, স্বাস্থ্যমন্ত্রী মোহাম্মদ নাসিমের পাশে বসা দেখা গেছে। বুধবার রাতে মোবাইল ফোনে যোগাযোগ করে তার কাছে 'কেমন আছেন, কী করছেন' জানতে চাইলে নিজের ব্যস্ততার কথাই জানান। ব্যস্ততার অজুহাতে বাংলাদেশ প্রতিদিনকেও সময় দিতে অপারগতা ব্যক্ত করেন। বর্তমান দিনকাল নিয়ে মুখোমুখি কথা বলার জন্য সময় চাইলে তিনি বলেছিলেন, 'কাল (বৃহস্পতিবার) সকালে ঢাকার বাইরে যাচ্ছি'।

অথচ গতকালই ঢাকায় ১৪ দলের সংবাদ সম্মেলনে দেখা গেছে তাকে।

জানা গেছে, শিল্পমন্ত্রী হওয়ার আগে দিলীপ বড়ুয়াকে সবাই চিনতেন সাম্যবাদী দলের নেতা হিসেবে। অনেকটা নাটকীয়ভাবে মহাজোট মন্ত্রিসভার সদস্য হন। তিনি মন্ত্রী হবেন তা নিজেই বিশ্বাস করতে পারেননি। কারণ ২০০২ সালের ২৩ ডিসেম্বর তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী বেগম খালেদা জিয়ার সঙ্গী হয়ে চীন সফর করেছিলেন।

সেই সঙ্গে আওয়ামী লীগের কঠোর সমালোচক ছিলেন। স্বাধীনতার পর তার অনেক বক্তব্য-বিবৃতি ছিল কঠোরভাবে বঙ্গবন্ধুকে আক্রমণ করে। সেই দিলীপ বড়ুয়া মন্ত্রী হলেন আওয়ামী লীগের। বাম নেতারা ভেবেছিলেন মন্ত্রী হিসেবে এই রাজনীতিক সফল হবেন। কিন্তু শুরুতেই ব্যবসায়ীরা তার ওপর আস্থা আনতে পারেননি।

তাদের মনে প্রশ্ন ছিল, পুঁজিবাদী অর্থনীতিতে দেশের শিল্প-বাণিজ্যের সঙ্গে কমিউনিজমের সম্পর্ক কোথায়? দিলীপ বড়ুয়া মন্ত্রিত্বের পাঁচ বছর ব্যবসায়ী-শিল্পপতিদের আশঙ্কা বাস্তব রূপ দিলেন। মন্ত্রী থাকাকালে দেশের শিল্পোন্নয়নে তার কোনো পদক্ষেপই ছিল না, বরং প্রতিবন্ধকতা সৃষ্টি করেছিলেন পদে পদে। শুধু শিল্পপতি-ব্যবসায়ীই নয়, খোদ সরকারের নীতিনির্ধারকরাও তাকে নিয়ে হতাশায় ছিলেন।

দিলীপ বড়ুয়াকে একজন ব্যর্থ মন্ত্রী হিসেবে আখ্যায়িত করে শিল্পপতিদের সংগঠন বাংলাদেশ চেম্বার অব ইন্ডাস্ট্রিজের সহ-সভাপতি মোস্তফা আজাদ চৌধুরী বাবু বাংলাদেশ প্রতিদিনকে বলেন, শিল্প মন্ত্রণালয়ের কাজ কী, মন্ত্রী হিসেবে তিনি জানতেন না। তিনি মনে করতেন সরকারি শিল্প দেখভাল করাই তার দায়িত্ব।

আসলে তিনি সে কাজটিও ঠিকমতো করতে পারেননি। আর বেসরকারি শিল্প খাতের ওপর তার কোনো নজরই ছিল না। বাস্তবতা হলো হতাশার সাগরে দিলীপ বড়ুয়া দেশের শিল্প-ব্যবসা-বাণিজ্যকে ভাসিয়ে দিয়েছেন।

ক্ষোভ প্রকাশ করে বাংলাদেশ প্রকৌশল শিল্প মালিক সমিতির সভাপতি, এফবিসিসিআইর পরিচালক আবদুর রাজ্জাক বলেন, তিনি (দিলীপ বড়ুয়া) শিল্পোন্নয়নে কিছুই করেত পারেননি। তার আমলে শিল্প মন্ত্রণালয় ছিল অচল।

এদিকে মন্ত্রিত্বলাভের আগে দিলীপ বড়ুয়া ঢাকায় সাধারণ মানুষের মতোই সাদামাটা জীবনযাপন করতেন। পোশাক-আশাক, চালচলনে ছিলেন আপদমস্তকে একজন বামপন্থী। ঢাকায় তার কোনো বাড়ি-গাড়ি ছিল না। ছিল না কোনো ব্যাংক ব্যালান্স। রিকশা আর বাসে চলাচল করতেন।

কিন্তু মন্ত্রিত্ব পেয়ে একেবারে বদলে যান। যদিও তখন সাংবাদিকদের বলেছিলেন, মন্ত্রিত্ব পেয়ে বড়লোক হতে চাই না। জবাবদিহি রাখতে চাই। সৎ জীবনযাপন করেছি সবসময়। এটা মন্ত্রী হওয়ার পরও থাকবে।

তবে বাস্তবে তার এ কথার সঙ্গে কাজের কোনো মিল ছিল না পুরো পাঁচ বছর।

সাবেক শিল্পমন্ত্রী দিলীপ বড়ুয়া প্রথম বিতর্কে জড়ান ২০১০ সালের মে-তে জামালপুরের যমুনা সার কারখানা থেকে দামি গাড়ি ও এসি উপঢৌকন নিয়ে। পরে সমালোচনার মুখে এসব পণ্য তিনি ফেরত দিতে বাধ্য হন। এরপর আলোচনায় আসেন রাজউকের প্লট নিয়ে। তিনি তার স্ত্রী, সন্তান ও পরিবারের অন্য সদস্যদের নামে ছয়টি প্লট বরাদ্দ নেন।

২০১১ সালের ২৯ ডিসেম্বর অনুষ্ঠিত রাজউকের ১২তম বোর্ড সভার সিদ্ধান্তের আলোকে এবং মন্ত্রণালয়ের নির্দেশে ১৩ এ(সি) ধারার সুপারিশ অনুযায়ী সংরক্ষিত কোটায় মোট ২২ জনকে পূর্বাচলে প্লট বরাদ্দ দেওয়া হয়। এ ২২ জনের মধ্যে তিনজনই শিল্পমন্ত্রীর পরিবারের সদস্য। এর মধ্যে তার স্ত্রী অধ্যাপিকা তৃপ্তি রানীর নামে পূর্বাচলে বরাদ্দ দেওয়া হয় পাঁচ কাঠার প্লট, মন্ত্রীর মেয়ে ডা. উপমা বড়ুয়ার নামে বরাদ্দ দেওয়া হয় তিন কাঠার প্লট এবং দিলীপ বড়ুয়ার ভাই ডা. অলক বড়ুয়ার নামে তিন কাঠার প্লট। দিলীপ বড়ুয়ার পরিবারের সদস্যরা মিলে মোট তিনটি প্লট বরাদ্দ পান পূর্বাচল থেকে। এ ছাড়া দিলীপ বড়ুয়ার তৎকালীন এপিএস পুলক বড়ুয়ার নামেও তিন কাঠার একটি প্লট বরাদ্দ দেওয়া হয়।

আর এপিএস পুলক বড়ুয়া দিলীপ বড়ুয়ার দূরসম্পর্কের আত্দীয়। সব নিয়মনীতি ভঙ্গ করে দিলীপ বড়ুয়া কেরানীগঞ্জে অবস্থিত রাজউকের অন্য আরেকটি প্রকল্প ঝিলমিল থেকে তিন কাঠার আরেকটি প্লট বরাদ্দ নেন। নিজ ও পরিবারের সদস্যদের নামে প্লট পাওয়া সম্পর্কে তখন বলেছিলেন, আমি মন্ত্রী হিসেবে একটি প্লট পেয়েছি। আমার মেয়ে এবং ভাই বৈদেশিক কোটায় আবেদনের পরিপ্রেক্ষিতে আরও দুটি প্লট বরাদ্দ পায়। তারা আমেরিকায় থাকেন বলে তিনি জানিয়েছিলেন।

নিজ দলে বিদ্রোহ

মন্ত্রী থাকাকালে দিলীপ বড়ুয়ার নিজের দলেই বিদ্রোহ হয়। ক্ষুদ্র এই দলের নেতাদের বড় অংশ তার বিপক্ষে অবস্থান নেন। বাংলাদেশের সাম্যবাদী দলের কেন্দ্রীয় নেতা মরহুম ডা. এখলাসুর রহমান ও নেতা-কর্মীদের মূল্যায়ন না করাসহ নানা অভিযোগ এনে ২০১২ সালের ডিসেম্বরে দিলীপ বড়ুয়ার সাধারণ সম্পাদকের পদ থেকে পদত্যাগ দাবি করেছিলেন রাজশাহীর নেতারা। ওই বছর ১৯ ডিসেম্বর রাজশাহী প্রেসক্লাবে আয়োজিত সংবাদ সম্মেলনে সাম্যবাদী দলের নেতারা বলেছিলেন, ১৯৭৩ সালের ১১ ডিসেম্বর রাজশাহীর তানোরে দলের ৪৪ জন কমরেডকে হত্যা করা হয়। কিন্তু ক্ষমতায় আসার পর সাধারণ সম্পাদক দিলীপ বড়ুয়া এই শহীদদের মর্যাদা দেননি, এমনকি কখনো তানোরেও আসেননি।

এদিনটিকে বিপ্লবী শহীদ দিবস হিসেবে পালনের ব্যাপারেও কোনো উদ্যোগ নেননি তিনি। তা ছাড়া শহীদ পরিবারগুলো চরম দুরবস্থার মধ্যে দিন পার করছে। কিন্তু তাদের কোনো খোঁজখবর রাখেন না দিলীপ বড়ুয়া।

সাম্যবাদী দলের রাজশাহী জেলা শাখার সদস্য এরশাদ আলী, কাবিল উদ্দিন, মনিরুজ্জামান, ওসমান গনি, বাসন্তী রানী, সাজ্জাদ আলী, নওশাদ আলী ও গোলাম মর্তুজা মুরাদের উপস্থিতিতে ওই সংবাদ সম্মেলনে দিলীপ বড়ুয়াকে 'চরম সুবিধাভোগী' আখ্যা দিয়ে নেতারা বলেছিলেন, দলের গঠনতন্ত্রের কোনো নিয়ম-নীতির তোয়াক্কা করেন না দিলীপ বড়ুয়া। তিনি দলের সাধারণ সম্পাদকের পদ দখল করে আছেন এমন অভিযোগ এনে তীব্র ক্ষোভ প্রকাশ করে আরও বলা হয়েছিল- শত শহীদের রক্তে রঞ্জিত এ দলটি এখন তার 'পকেট পার্টি' হিসেবেই রয়েছে।

এ সময়ে বলা হয়, দিলীপ বড়ুয়ার সমালোচনা করায় কেন্দ্রীয় কমিটির সদস্য নুরুল ইসলামকে পলিটব্যুরো থেকে অপসারণ করেন। দিলীপ বড়ুয়া নিজেকে সৎ ব্যক্তি হিসেবে জাহির করলেও চাকরি দেওয়ার কথা বলে এখলাসের কাছ থেকে প্রায় ৫০ হাজার টাকা ঘুষ নিয়েছিলেন। তবে চাকরি তাকে দেননি। পরে এখলাস এ টাকার শোক সহ্য করতে না পেরে মারা যান। নানা অভিযোগে তখন অবিলম্বে দলের সাধারণ সম্পাদক ও মন্ত্রিসভা থেকে দিলীপ বড়ুয়ার পদত্যাগ দাবি করা হয়েছিল ওই সংবাদ সম্মেলনে।

বাংলাদেশের সাম্যবাদী দলের (মার্কসবাদী-লেনিনবাদী) সুপ্রিম সেলের মুখপাত্র সাইদ আহম্মেদ, আরিফুল হক সুমন ও কেন্দ্রীয় সংগঠক শাহানা বেগম চিনু, কাজী মোস্তফা কামাল, আবদুল হক ভূইয়া, এরশাদ আলী গত বছর এক যুক্ত বিবৃতিতে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার কাছে আবেদন জানিয়ে বলেছিলেন, আপনার শিল্পমন্ত্রী দিলীপ বড়ুয়া সুবিধাবাদী। তিনি এখন গোপন পথের আশায় চুপ করে আছেন। যারা দলের শহীদ কমরেডদের রক্তের সঙ্গে বেইমানি করতে পারেন তারা দেশের সঙ্গেও বেইমানি করবেন। এসব নষ্ট বামপন্থীর কারণেই আপনার সরকারের আজ দুরবস্থা। মন্ত্রী থাকাকালে দিলীপ বড়ুয়া তার দলের এই বিদ্রোহের প্রতি গুরুত্ব দেননি।

তবে মন্ত্রিত্ব হারানোর পর নতুন করে দল গোছানোর জন্য তিনি পর্যাপ্ত নেতা-কর্মীর সংকটে রয়েছেন। নতুন করে কাজ করার ক্ষেত্রে তাকে সমস্যায় পড়তে হচ্ছে। দিলীপ বড়ুয়ার দলের ক্ষুব্ধ কর্মীদের অভিযোগ, তিনি ক্ষমতায় থাকতে দলের জন্য কিছুই করেননি। যিনি পাঁচ বছর মন্ত্রী থেকে নিজের দল গোছাতে পারেননি, তিনি জোটের জন্য কী করতে পারবেন!

 

সোর্স: http://www.bd-pratidin.com

অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।