আমাদের কথা খুঁজে নিন

   

ওরা যেন মৃত্যুর পর সংবাদ শিরোনাম না হয়ে জীবন থাকতেই তাদের ন্যুনতম অধিকারটুকু নিয়ে বাচতে পারে, সেই সুদিন কি কখনো আসবে?

হতাশা আর দু;খ ব্যাথা যাদের দেখে থমকে দাঁড়ায় আজকে তাদের খুব প্রয়োজন, বিশ্ব এসে দু হাত বাড়ায়। কাদম্বিনী মরিয়া প্রমাণ করিল যে সে মরে নাই” রবি গুরুর সেই বিখ্যাত বাক্যের মতই আমাদের গার্মেন্টস শ্রমিকরা “মরে প্রমাণ করল যে ওরা একদিন বেচে ছিল”। ওরা গরীব-অসহায়, লিখাপড়া জানে না, শ্রম আইন জানে না, নিজের অধিকার বুঝে না। শুধু জানে পেটের ক্ষুধা, আর স্বপ্ন দেখে একদিন ছেলে-মেয়েকে মানুষ করবেন। এরা তালি দেয়া সেন্ডেল পড়ে, একটা টিফিন বাটিতে দুপুরের খাবার বেধে নিয়ে দল বেধে কাজে যায়।

সে খাবার বেচে থাকবার জন্য ন্যুনতম ক্যালোরি দেয় কিনা তা খোজ আমরা রাখি না। বরং ওদের ভীড়ে রাস্তায় গাড়ি চালাতে অসুবিধা হয় দেখে আমরা বিরক্ত হই। মাঝে মাঝে এর বেতন-বোনাসের দাবীতে মিছিল-মিটিং ভাংচুর করে, তখনও আমরা বিরক্ত হই। এদের চেহারার মলিনতা আমাদের চোখে পড়ে না, এরা রাতে ফিরে যেখানে ঘুমায় সেটাকে ঘর বলা যায় কিনা তা নিয়েও আমরা ভাবি না। এই গরীব মানুষ গুলো যেন অস্তিত্বহীন, তাই ওরা মাঝে মাঝে মারা গিয়ে খবরের শিরোনাম হয় আর প্রমান করেন যে তারা বেচে ছিলেন।

মালিকরা বিজনেস ক্লাসে ফ্লাই করে কাস্টমার ধরবার জন্য ঘুরে বেড়ান। পাওয়ার পয়েন্ট প্রেজেন্টেশন বানিয়ে ক্রেতাদের দেখান যে তার ফ্যাক্টরী কত উন্নত, আধুনিক। দেশের মধ্যে তারা দামী পাজেরো চড়ে ঘুরেন। জালাধার দখল বিজিএমই এর হেড কোয়ার্টার বানান। রাজনৈতিক অস্থিরতায় তারা অস্তির হয়ে বিবৃতি দেন যেন দেশের জন্য তাদের দরদ উথলে পড়ছে।

দেশের রাজনীতির কর্তাব্যাক্তিরা তাদের পকেটে থাকেন। বছর গেলে পুরাতন ফ্যাক্টরী বাচ্চা দিয়ে মত নতুন ফ্যাক্টরীর জন্ম দেয়। শ্রমিক এখানে সস্তা, পানির মুল্য। আজ ১০০ জন মরে গেলে কি হবে, চাইলেই বিজ্ঞাপন দিয়ে কালকেই আরো ২০০ জন নিয়োগ দিবেন তারা। আইন আরো সস্তা।

এরকম অবহেলাজনিত দুর্ঘটনায় শত শ্রমিক মারা গেলেও শাস্তি মাত্র ৪ বছর জেল, তাও বাংলাদেশের ইতিহাসে কোন মালিকের এই শাস্তিটুকুও হয়নি (সুত্রঃ প্রথম আলো)। তাজরীন ফ্যাশনে যে শ্রমিকরা জীবন্ত দগ্ধ হলো তারা যেন মরে প্রমান করলেন তারা এতদিন বেচে ছিলেন। কিম্বা যারা চট্টগ্রামের নির্মানাধীন ফ্লাইওভারের গার্ডার ধ্বসে মারা গেলেন তারাও তো এ রকমই। মারা গেল বলেই আমরা জানতে পারলাম তারা ছিলেন, না মরলে কি জানতাম? একটু বড় ঘটনা ঘটে এরা মারা গেলেন বলেই তারা আলোচিত হলেন। সড়ক দুর্ঘটনায় প্রতিদিন মারা যাচ্ছে মানুষ, যা যোগ করলে একটা মহামারি বললেও হয়ত ভুল হবে না, তারা এখন শুধু নিয়ম রক্ষার খবরে সংবাদপত্রে জায়গা পায় কিন্তু ক’জন তা পড়ে দেখবার ধৈর্য্য রাখে? শুধু নিজের কেউ মারা গেলে আমরা উদ্বিগ্ন হই আর বড় কেউ মারা গেলে সরকার কিছু চোটবাট করে।

কিন্তু সড়ক দুর্ঘটনা রোধে কার্যকর কোন ভুমিকা নিতে কাউকে দেখা যায় না। একটা বড়সড় দুর্ঘটনার পর মেইনস্ট্রীম মিডিয়া-সোস্যাল মিডিয়া গরম হয়। তদন্ত কমিটি হয়, সরকারের উচ্চমহল থেকে ঘটনাস্থল পরিদর্শনে যান দ্বায়িত্বপ্রাপ্ত কর্মকর্তা কিম্বা মন্ত্রী। হতভাগ্য পরিবার গুলোকে ঘটা করে চেক তুলে দিয়ে নেতাদের রাজনৈতিক ব্রান্ডিং হয়। মালিক হয়ত এই ধাক্কা সামলিয়ে ওঠেন ইন্সুরেন্স এর টাকায় কিম্বা তার নতুন করে ঋণ নিয়ে।

কিন্তু যে শ্রমিক মারা গেলেন তার রেখে যাওয়া শিশু সন্তানটির কথা আমরা মনে রাখি না। দুর্ভাগ্যজনকভাবে রহস্যজনক হত্যাকান্ডের স্বীকার সাগর-রুনি দম্পতির একমাত্র সন্তান এর ঘটা করে দ্বায়িত্ব নেন প্রধানমন্ত্রী, কিন্তু তাজরীন এর নিহত শ্রমিকদের সন্তানেদের দ্বায়িত্ব কোন ব্যাবস্থা রাষ্ট্রের নাই। এরা যে জীবিত আছে, তার নিকট কিছু আত্মীয় ছাড়া হয়ত কেউ আর কোন দিন মনেও রাখবে না। বাবা-মা গার্মেন্টস-এ উদায়স্ত পরিশ্রম করে যে মেয়েটিকে তিল তিল করে পড়াচ্ছিলেন, মেয়েটি একদিন বড় অফিসার হবে বলে স্বপ্নের জাল বুনাচ্ছিলেন, তার ইতি ঘটলো। পেটের তাগিদে এই মেয়েটি এখন হয়ত শিশু-শ্রমিক হবে, কোন গার্মেন্টসে কাজ শুরু করবে।

না হয় কোন বাসায় “কাজের মেয়ে” হিসাবে যোগ দিয়ে কত্রীর গরম খুন্তির ছ্যাকা খাবে কিম্বা কত্রীর ছেলে কিম্বা সাহেবের কাছ থেকে যৌন হয়রানীর শিকার হবেন। তারা কিভাবে বেচে আছে বা এই দুঃসময় পার করছে তার খোজ হয়ত কেউ রাখবে না, তার চলাচলের রাস্তায় বখাটেরা উতপাত করলে সে কোন সাহায্য পাবেনা, কর্মস্থলে যৌন হয়রানির শিকার হলে তার বলবার জায়গা থাকবে না, সে নায্য মজুরী না পেলেও তা দেখার লোক থাকবেনা। এদের নিয়ে কথা বলবার জন্য কোন আমিনুল তৈরী হলে সে হবে গুপ্ত হত্যার শিকার! অসুস্থ হলে চিকিতসার জন্য টাকা থাকবে না। সরকারের শ্রম আইন থাকবে কিন্তু আইনের রক্ষকেরা থাকবে মালিক পক্ষের পকেটে। গার্মেন্টস বিল্ডিং-এর সিড়ি থাকবে কিন্তু দরজা গুলো থাকবে তালা দেয়া।

যাদের বেচে থাকবার গল্প আমরা ভুলে থাকব। আবার কোন ঘটনায় তারা মারা গিয়ে প্রমান করবে যে তারা বেচে ছিল! পত্রিকান্তরে দেখলাম ক্রেতারা কর্মস্থলে নিরাপদ পরিবেশ তৈরীর জন্য চাপ দিয়েছে। ভাল লাগল, আমরা আবার বিদেশীদের কথা ছাড়া কিছু করতে চাইনা। নিজেদের সমস্যা নিজেরা সমাধান না করে আমেরিকার পায়ে পড়ি, একজন যেয়ে আরেকজনের বিরুদ্ধে অভিযোগ করি। ক্রেতাদের চাপে নয়, আমাদের নিজেদের বিবেক জাগ্রত হোক এটাই কামনা করি।

আমাদের শ্রমিকরা তাদের অধিকার বুঝে নিতে শিখুক। আমরা আশা করি মালিকরা গুড বিজনেস প্রাক্টিস হিসাবেই শ্রমিকদের নিরাপত্তার জন্য প্রয়োজনীয় ব্যাবস্থা নিবেন। সাথে রাষ্ট্র যেন কঠোর হস্তক্ষেপের মাধ্যমের শ্রমিকদের অধিকার প্রতিষ্ঠা করতে পারে। ওরা যেন মৃত্যুর পর সংবাদ শিরোনাম না হয়ে জীবন থাকতেই তাদের ন্যুনতম অধিকারটুকু নিয়ে বাচতে পারে, সেই সুদিন কি কখনো আসবে? ।

অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।