আমাদের কথা খুঁজে নিন

   

অতিপ্রাকৃত গল্প: শিরিন

বাংলার মাটি বাংলার জল, বাংলার বায়ু, বাংলার ফল, পুন্য হউক, পুন্য হউক, পুন্য হউক, হে ভগবান। বাংলার ঘর, বাংলার হাট, বাংলার বন, বাংলার মাঠ, পুর্ন হউক, পূর্ন হউক, পূর্ন হ্‌উক, হে ভগবান। রবীন্দ্রনাথ আমার বড় ভাইয়ের সঙ্গে যে মেয়েটির বিয়ে হতে চলেছে সেই মেয়েটি একটি পরী। যদিও ব্যাপারটা আমারই বিশ্বাস করতে ভীষণ কষ্ট হচ্ছে। আমার বড় ভাইয়ের অনেক কিছুই খুব স্বাভাবিক না।

আমার মায়ের মুখে শুনেছি, আমার বড় ভাই নাকি ছেলেবেলায় মাঝে-মাঝে হারিয়ে যেত। কখনও তিনদিনের জন্য, কখনও সাত দিনের জন্য। পুলিশে খবর দিয়ে কিংবা সংবাদপত্রে বিজ্ঞাপন ছাপিয়েও নাকি কোনও লাভ হত না। অনেক পরে আমার বাবা-মা বুঝতে পেরেছিলেন আমার ভাইকে কারা যেন নিয়ে যেত, আবার দিয়েও যেত। ওই ভৌতিক ঘটনায় আমার মা ভীষন ঘাবড়ে গেলেও আমার বাবা কেন যেন নিশ্চিন্ত থাকত।

ছেলে নিখোঁজ, অথচ বাবা টেনশন করছে না-এই ব্যাপারটিও ভারী রহস্যময়। এসবই আমি আমার মায়ের মুখে শুনেছি। আমার বড় ভাইয়ের নাম রোকন। দেখতে একেবারেই আমাদের মত না। আমার মা-বাবার গায়ের রং শ্যামলা।

আমারও। মেয়ে বলেই এই নিয়ে আমার মনে যে কত কষ্ঠ! অথচ রোকন ভাইয়া ফরসা, লম্বা। কেবল ফরসা আর লম্বাই না- রোকন ভাইয়া ভীষণ হ্যান্ডসাম। প্রথম দর্শনেই সবাই মুগ্ধ হয়ে যায়। আমার বান্ধবী ফরিদা তো রোকন ভাইয়াকে দেখে... কী বলব ... সত্যিই রোকন ভাইয়া আমাদের পরিবারে একেবারেই বেমানান।

রোকন ভাইয়ার জন্ম ঠাকুরগাঁও শহরে। বাবা তখন ওই শহরেই প্রাকটিস করতেন। ডাক্তার হিসেবে বাবার নাকি খুব নামডাক হয়েছিল। আমি তখনও হইনি। এসবই আমি আমার মায়ের মুখে শুনেছি।

রোকন ভাইয়াকে একটা স্কুলে ভর্তি করিয়ে দেওয়া হয়েছিল। ক্লাস ফাইভে ওঠার পর প্রথম হারিয়ে গেল ভাইয়া ... রোকন ভাইয়া এসএসসি পরীক্ষা দেওয়ার পর আব্বা ঢাকা চলে এলেন। ভাইয়াকে নিযে বেশ ঝামেলা হচ্ছিল। ঘন ঘন হারিয়ে যাচ্ছিল। ঘরে ফল, মিষ্টি, গোলাপ ফুল- এসব পাওয়া যাচ্ছিল।

ভাইয়া নাকি খেতে চাইত না। খেতে বললে বলত খেয়েছি। কি খেয়েছো-জিজ্ঞেস করলেবলত, আপেল, রসগোল্লা আর দুধ ... আব্বা ঢাকার কলাবাগানে বাড়ি কিনলেন। একতলায় চেম্বার। আমি নতুন স্কুলে ভর্তি হলাম।

পুরনো স্কুল ছেড়ে আসতে আমার রীতিমতো কষ্টই হচ্ছিল। রুমা, সালমা, দীপ্তি এদের মুখগুলি সারাক্ষণ মনে পড়ত। সে যাক। রোকন ভাইয়া পড়াশোনায় খুব ভালো ছিল। এসএসসি পরীক্ষায় খুব ভালো রেজাল্ট করে ঢাকা কলেজে ভর্তি হল ভাইয়া।

হটাৎ করেই আব্বা মারা গেলেন। রোকন ভাইয়া তখন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হয়েছে। আমাদের ছোট্ট সংসারে শোকের ছায়া ঘনালো। মা স্তব্দ হয়ে গেলেন। বাবার জন্য আমারও খুব খারাপ লাগত।

বাবা যে আমার সঙ্গে খুব গল্প করত তা নয়। আমি বরং বাবাকে ভয়ই পেতাম। তবে বাবা যে আমায় খুব ভালোবাসত তা বুঝতে পারতাম ...বাবাকে আমার ভারি গম্ভীর মনে হত। ঘরে থাকলে বাবা সারাক্ষণ বই পড়ত। বাবার লাইব্রেরিতে যে কত বই! মনে হয় বই পড়ার অভ্যেস আমি আমার বাবার কাছ থেকেই পেয়েছি।

ধীরে ধীরে আমরা শোক সামলে নিলাম। দোতলায় থাকি। একতলার চেম্বারটা উঠিয়ে ভাড়া দিয়েছি। পরিবারটি চমৎকার । আতিক আঙ্কেল ব্যাঙ্কার।

তার মেয়ে ফরিদা, আমারই সমবয়েসি, ক্লাস টেনে পড়ে, আমার বান্ধবী। বেশ বুঝতে পারলাম- ফরিদা ভাইয়াকে মনে মনে পছন্দ করে। ফরিদা আমাকে একদিন জড়িয়ে ধরে বলল, উফঃ তোর ভাইয়াটা যা সুন্দর না আফরিন! এই কথা শুনে আমার ফরিদার জন্য খারাপই লাগল। রোকন ভাইয়া ওর দিকে মুখ তুলে তাকালে তো। ভাইয়া যা গম্ভীর প্রকৃতির মানুষ।

কথা এত কম বলে। আর ভীষণ নামাজী। ফজরের নামাজ পড়ে কী সুন্দর সুর করে কোরান তেলায়াৎ করে। ভাইয়া বাসায় যতক্ষণ থাকে নিজের ঘরেই থাকে। মাঝেমাঝে ছাদে পায়চারী করে।

খাওয়ার সময় অবশ্য খাওয়ার টেবিলে আমরা তিনজনই খাই। আমি টিভির সাউন্ড কমিয়ে দেখি। অবশ্য ভাইয়া আমাকে কখনও বকে-টকে না। ভাইয়া কলেজে থাকলে আমি ভাইয়ার ঘর গুছিয়ে দিই। ভাইয়া রাগ করে না।

( মা ভাইয়ার ঘরে ঢুকলে কী কারণে ভাইয়া রাগ করে। ) ভাইয়ার ঘরে ঢুকলেই কেমন একটা মিষ্টি গন্ধ পাই। মিষ্টি গন্ধটা অনেকটা আতরের গন্ধের মতন। একদিন ভাইয়া বাসায় ছিল না। ঘর গোছাতে ভাইয়ার ঘরে ঢুকেছি ... দেখি টেবিলের ওপর একটা রূপার থালায় আঙুর, (থালাটা আমাদের না ...আমি সিওর ) অন্য একটি চিনেমাটির প্লেটে (এই প্লেটটা আমাদের না) দুটি বড় বড় সাইজের রসগোল্লা আর চিনেমাটির প্লেটের ঠিক পাশে গোলাপের ছোট একটি ডাল; ডালে লাল টকটকে ফুল।

কে যেন রিনরিনে মিষ্টি গলায় বলল: কেমন আছ আফরিন? আমি চমকে উঠলাম। মাথা কেমন টলে উঠল। হিম- হিম ঠান্ডা অসার শরীর নিয়ে কোনওমতে পায়ে পায়ে ঘর ছেড়ে চলে আসি। কথাটা মাকে আর বললাম না ... এর পর থেকে ভাইয়ার ঘরে আর ঢুকি না। রান্না আর টিভি দেখার ফাঁকে মায়ের সঙ্গে গল্প করে সময় কাটে।

মা কত যে গল্প জানে। ছেলেবেলার গল্প। মার ছোটবেলা কেটেছিল ঠাকুরগাঁওয়ের বালিয়াডাঙ্গির তলমাল নদীর পাড়ে। নানার সঙ্গে শীতকালে তলমাল নদীর চরে পাখি শিকারের গল্প শুনতে আমার সবচে ভালো লাগে । একবার ভোরবেলা কুয়াশা ফুঁড়ে এক দুধওয়ালা এল।

দুধওয়ালা সবাইকে নাকি গরম দুধ খাইয়েছিল। টাকাপয়সা কিছু নেয়নি। দুধওয়ালা চলে যেতেই নানা বলেছিল, দুধওয়ালাটা ছিল জিন। তোর নানা ছোট থাকতে শীতকালে তলমাল নদীর চরে একবার দুধওয়ালাকে দেখেছিল। দুধওয়ালা তখনও গরম দুধ খাইয়েছিল।

আমি অবাক হয়ে মাকে বলি মা জিনরাও কি মানুষের মতই মানুষের মধ্যেই থাকে ? মা বলে, থাকে তো। একবার শোন কী হল। ঠাকুরগাঁও থাকতে তোর বাবা রাতবিরাতে রোগী দেখতে ছুটতেন। একবার ঠাকুরগাঁওয়ের উলির বিলের পাশে রহিমনপুর জিনবাড়িতে তোর আব্বা রোগী দেখতে গিয়েছিল। জিনবাড়িতে মানে! আমি অবাক।

তোর বাবা চেম্বার থেকে বাসায় ফিরছিল। কনকনে শীতের রাত। হঠাৎ কুয়াশা ফুঁড়ে লম্বাচওড়া এক তরুণ এসে উপস্থিত। তরুণটি তার নাম বলল, জিলানী। তার বউ নাকি প্রসব যন্ত্রণায় ছটফট করছে।

বাড়ি নাকি কাছেই এখনই একবার যেতে হবে। তো, তোর বাবা রাজি হল যেতে । হঠাৎ দেখে একটা ঘোড়াগাড়ি। জিলানী ঘোড়াগাড়িতে তোর বাবাকে উঠতে বলল। ঘোড়াগাড়ি চলছে তো চলছে।

কুয়াশায় ভালো দেখা যায় না। কোথায় যাচ্ছি জিজ্ঞেস করতেই জিলানী বলল, উলির বিলের পাশে রহিমনপুর উলির বিলের পাশে রহিমনপুর। সে তো অনেক দূর। জিলানী কিছু বলল না। বরং বলল, তার বউয়ের নাম আঞ্জুমান।

শরীর নাকি ভালো না। সে যাই হোক। আরও কিছুক্ষণ চলার পরে থামল ঘোড়াগাড়ি। তোর বাবা চেয়ে দেখে পুরাতন দূর্গের মতন দালান। বড় একটা চাতাল পেরিয়ে সিঁড়ি দিয়ে উঠে জিলানী তোর বাবাকে একটি ঘরে নিয়ে এল ।

মশালের আলোয় দেখল একটা পালঙ্কে একটি রূপসী মেয়ে শুয়ে। অবস্থা সত্যিই ক্রিটিকাল। যাক। শেষমেশ তোর বাবার কল্যাণে রক্ষা পেল। ফুটফুটে এক ছেলে হল।

তোর বাবার ওপর জিলানী অনেক খুশি হয়েছিল। তোর বাবাকে অনেক রূপার টাকা দিয়েছিল। রূপার টাকা? হ্যাঁ রে আফরিন। রূপার টাকা। রূপার টাকা ওরা কেন দিল মা? ওরা ছিল জিন।

জিন! হ্যাঁ। জিন। আশ্চর্য! সেই রূপার টাকা কই মা? জিনের টাকা নাকি ঘরে রাখতে নেই। সে টাকা তোর বাবা আউলিয়াপুর জামে মসজিদে দান করেছেন। ওহ্ ।

পরে ওই জিনদের আর দেখেনি বাবা? হ্যাঁ, দেখেছে। পরে একবার নাকি জিলানী মিষ্টি-টিষ্টি নিয়ে তোর বাবার চেম্বারে এসেছিল। ছেলের নাম রেখেছে আদনান। আদনান! হ্যাঁ। আদনান ।

আশ্চর্য! একদিন দুপুরে একটা ভারী অদ্ভূত ঘটনা ঘটল...তাতে আমি রোকন ভাইয়া সম্বন্ধে সত্য ঘটনা জানতে পারলাম। ভাইয়া তখন ঢাকা ইউনিভারসিটিতে পড়ে। অর্থনীতি বিভাগে। এইচএসসিতে ভাইয়া দারুণ রেজাল্ট করেছিল। ততদিনে আমি এসএসসি দিয়েছি।

রেজাল্ট তখনও বের হয়নি। রান্না করে, টিভি দেখে আর বই পড়ে সময় কাটছিল। এক দুপুরবেলা। মা ঘুমিয়ে ছিল। মায়ের শরীর ভালো ছিল না।

কিছুদিন হল মায়ের হার্টের সমস্যা ধরা পড়েছে। গতমাসে বাথরুমে মা মাথা ঘুরে পড়েও গিয়েছিল একবার। আমি পড়ার জন্য কিছু খুঁজছিলাম। আব্বার লাইব্রেরিতে গেলাম। খুঁজতে খুঁজতে ওপরের তাকে বইয়ের ভাঁজে কালো রঙের রেক্সিনের জ্যাকেটের একটা ডায়েরি পেয়ে গেলাম।

দেখেই চিনলাম ... বাবার হাতের লেখা, ঝরঝরে বাংলায়- সাধু ভাষায় । পড়ব কিনা তা নিয়ে দ্বিধায় ছিলাম। হঠাৎই পাতা ওল্টাতে ‘উলির বিলের পাশে রহিমনপুর’ লেখাটায় চোখ আটকে গেল। চোখ বুলিয়ে দেখলাম: বাবা যা লিখেছে সেসব আমি আমার মায়ের মুখে শুনেছি। আমি পড়তে শুরু করলাম।

... অনেক রাত্রে জিলানী আমাকে ঘোড়াগাড়ি করিয়া উলির বিলের পাশে রহিমনপুরের সেই পরিত্যক্ত দূর্গবাড়ি হইতে আমার ঠাকুরগাঁও শহরের বাসায় পৌঁছাইয়া দিল। রেহনুমা (আমার মায়ের নাম) গর্ভবতী হইয়া ছিল। তাহার প্রসব বেদনা আরম্ভ হইলে পড়ে পরের দিনই তাহাকে আমি ঠাকুরগাঁও সদর হাসপাতালে ভর্তি করাইয়া দিলাম। আমার দুর্ভাগ্যই বলিতে হয়, প্রসবকালীন জটিলতা দেখা দিল। হাসপাতালের গাইনি বিভাগের আমার একজন সিনিয়র কলিগ ডা. সুমিতা দস্তিদার আমাকে এই ইঙ্গিতে বলিলেন যে, রেহনুমা বাঁচিলেও তাহার অনাগত সন্তান বাঁচিবে নাও পারে।

আমি উৎকন্ঠিত হইয়া নির্জন করিডোরে পায়চারী করিতেছিলাম। গভীর শীতের রাত্র। ঠিক তখনই জিলানী আর আঞ্জুমান কে দেখিতে পাইয়া আমি বিস্মিত হইলাম। আমি জানিতাম যে তাহারা জিন প্রজাতির এবং ইহারা যে কোনও সময়ে যে কোনও স্থানে উপস্থিত হইতে পারে। আমি বিপদের সময়ে অতিপ্রাকৃত শক্তির অধিকারী জীবদের দেখিয়া এক প্রকারের স্বস্তিও পাইলাম।

আমি জিলানী আর আঞ্জুমান কে রেহনুমার সর্বশেষ অবস্থার কথা খুলিয়া বলিলাম। আঞ্জুমান আমাকে শান্ত্বনা দিয়া বলিল যে, ভাই, আপনি চিন্তা করিবেন না। আল্লাহই সমস্ত ব্যবস্থা করিয়া রাখিয়াছেন। সন্তান বাঁচিয়া নাই শুনিলে আপনার স্ত্রী মানসিক আঘাত পাইবেন। সেইরকম কিছু হইলে আমি আমার পুত্র আদনানকে আপনার স্ত্রীর কোলে রাখিয়া যাইব।

(বুঝিলাম আঞ্জুমান তাহার ছেলের নাম রাখিয়াছে আদনান। ) আপনি আমাকে বাঁচাইয়াছেন। আল্লাহর ইচ্ছায় আপনার ঘরে আমার ছেলে বাঁচিয়া থাকিবে। ... আমি আর কী বলিব। আমার তখন তরুণ বয়স।

যথাযথ সিদ্ধান্ত লইতে কার্পণ্য করিতাম। রেহনুমার মুখের দিকে চাহিয়া আমি নীরব থাকিলাম। যথাসময়ে রেহনুমা মৃত এক কন্যাসন্তান প্রসব করিল। অবশ্য সে ফুটফুটে এক পুত্রসন্তান লইয়াই আনন্দিত মনে হাসপাতাল হইতে ঘরে ফিরিল। আমিই কেবল শিশুটির প্রকৃত পরিচয় জানিলাম।

আর কেহ জানিল না, এমন কী হাসপাতালের নার্সও না। আমি জানি রোকন আমাদের সন্তান নয়, সে আঞ্জুমান- এর সন্তান। বিস্ময়কর হইলেও সত্য যে সে উলির বিলের জিন পরিবারের একজন। ... পড়তে পড়তে আমার শরীর হিম হয়ে এল। আশ্চর্য! রোকন ভাইয়া জিন।

আর বাবা সেটা জানত। কথাটা বাবা মাকেও কখনও বলেনি। এখন সব মিলে যাচ্ছে। ভাইয়া ছেলেবেলায় মাঝে-মাঝে হারিয়ে যেত। পুলিশে খবর দিয়ে কিংবা সংবাদপত্রে বিজ্ঞাপন ছাপিয়েও নাকি কোনও লাভ হত না।

আমি এখন জানি কেন লাভ হত না। আঞ্জুমান মনে হয় ওর ছেলেকে নিয়ে যেত? কোথায়? উলির বিলে? ওই ভৌতিক ঘটনায় মা ভীষন ভয় পেলেও বাবা কেন যেন নিশ্চিন্ত ছিল। আমি এখন জানি বাবা কেন নিশ্চিন্ত ছিলেন। বাবা আরও লিখেছে ... জিলানী ইহার পরেও আবার একদিন আমার কাছে আসিয়াছিল। সে মিষ্টি লইয়া আসিয়াছিল।

আদনান- এর আকিকার মিষ্টি। সে আরও একটি আনন্দের সংবাদ দিয়া সে বলিল, ফাহমিদা নামে আঞ্জুমান -এর এক বোন আছে। আজই ফাহমিদার একটি কন্যা সন্তান হইয়াছে। ফাহমিদা তাহার কন্যা সন্তানের নাম রাখিয়াছে শিরিন। এই পর্যন্ত লেখার পর অনেক গুলি পৃষ্ঠা ফাঁকা।

অন্য বিষয়ে লেখা। ব্যাঙ্কে ফিক্সড ডিপোজিট এর হিসাব আর ডাক্তার বন্ধুদের নিয়ে একটা নাসিংহোম দেওয়ার বর্ণনা। ব্যাঙ্ক লোন আর বিনিয়োগের টাকার জন্য ঠাকুরগাঁওয়ের জমি বিক্রির কথা। হঠাৎ একটি পৃষ্ঠায় আমার চোখ আটকে গেল। তারিখ মিলিয়ে দেখলাম বাবার সাত দিন আগে।

বাবা লিখেছে: গতকাল চেম্বারে বসিয়াছিলাম। জিলানী আর তার স্ত্রী আঞ্জুমান আসিল। আঞ্জুমান কে অনেক বৎসর পরে দেখিলাম। এতকাল পরেও মেয়েটি অনিন্দ্য সুন্দরীই রহিয়া গিয়াছে দেখিলাম। আঞ্জুমান সালাম দিয়া আমাকে বলিল ... তাহার বোন ফাহমিদার ইচ্ছা সে তাহার কন্যা শিরিনের সঙ্গে তাহার ছেলে আদনান- এর বিবাহ দিবে।

এই কথা শুনিয়া আমি হতভম্ভ হইয়া গেলাম। আমি বিস্ফারিত নয়ানে আঞ্জুমানের দিকে চাহিয়া রহিলাম। আমি বিড়বিড় করিয়া বলিলাম: ইহা কী করিয়া হয়? আঞ্জুমান আমাকে বলিল, আপনি ভাবিবেন না। ফাহমিদারা এখন ঢাকায় থাকে। উয়ারি।

আর আল্লাহর ইচ্ছায় শিরিন এই বৎসর ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে গণিত বিভাগে ভর্তি হইয়াছে। এই বলিয়া আমাকে কিছু বলিবার অবকাশ না- দিয়াই জিলানী আর আঞ্জুমান অদৃশ্য হইয়া গেল। আমার স্মরণ হইল বহু বৎসর পূর্র্বে ঠাকুরগাঁও সদর হাসপাতালে আঞ্জুমান আমাকে শান্ত্বনা দিয়া বলিয়াছিল যে, ভাই, আপনি চিন্তা করিবেন না। আল্লাহই সমস্ত ব্যবস্থা করিয়া রাখিয়াছেন। আল্লাহই যখন সমস্ত ব্যবস্থা করিয়া রাখিয়াছেন তখন আমি জানি যে এই বিবাহ হইবেই।

জানিনা সমস্ত শুনিলে এত বৎসর পরে রেহনুমার মানসিক অবস্থা কিরূপ হইবে। যাহা হউক, আল্লাহ আমাকে বিবাহ পর্যন্ত বাঁচিয়া থাকিবার তৌফিক দিন ... না, আল্লাহ, বাবার দোয়া কবুল করেন নি। আমি দীর্ঘশ্বাস ফেললাম। আমি কি ডায়েরির কথা মাকে জানব? নাহ্, ঠিক হবে না। মার শরীরের যা অবস্থা।

মাকে জানাবো না বলে ঠিক করলাম। আমার ঘরে ডায়েরিটা লুকিয়ে রাখব ঠিক করলাম। একরাতে খেতে বসে রোকন ভাইয়া বলল, মা, কাল তুমি দুপুরে কাচ্চি বিরানি রেঁধ। কেন রে? বলে মা ভাইয়ার প্লেটে রুটি তুলে দিল। ভাইয়া রাতে ভাত খায় না।

রুটি আর দুধ খায়। কখনও এক টুকরো ফল। দুধের বাটিটা টেনে ভাইয়া বলল, কাল ইউনিভার্সিটি থেকে আমার এক ক্লাসমেটকে নিয়ে আসব। ও দুপুরে খাবে। বেশ তো।

বলে চিনির কৌটা খুলতে লাগল মা। আমার বুক ধক করে উঠল। ভাইয়া ‘ক্লাসমেট’ বলল। ইস্ কতদিন পর আমার স্বপ্ন পূরণ হতে যাচ্ছে! আমি কতদিন স্বপ্ন দেখেটি ভাইয়া একদিন ওর এক বন্ধুকে বাসায় নিয়ে আসবে। খুব সুন্দর।

লম্বা আর ফরসা। (এত সুন্দর যে ফরিদা দেখে জ্বলে পুড়ে মরবে) তার সঙ্গে আমার পরিচয় হবে। ভাইয়ার ক্লাসমেট ছেলেটা কি খুব সুন্দর? কাল তাহলে আমি শাড়ি পড়ব। আর বোরহানি আর ফিরনিটাও আমিই রাঁধব। মা আপেল কাটতে কাটতে বলল, তা তোর বন্ধুর নাম কি রে রোকন? শিরিন।

ওহ্ । মা আমার দিকে তাকালো। মাকে কেমন হতভম্ব দেখাচ্ছে। মুখচোরা ছেলের যে মেয়েবন্ধু থাকতে পারে তা সম্ভবত মায়ের বিশ্বাস হচ্ছিল না। মা জিজ্ঞেস করল, তা মেয়েটা কই থাকে রে? ঢাকায়? না হোস্টেলে থেকে পড়ে? না মা, শিরিনরা ঢাকায় থাকে।

ঢাকায় কোথায়? উয়ারি। ।

সোর্স: http://www.somewhereinblog.net     দেখা হয়েছে বার

অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।

প্রাসঙ্গিক আরো কথা
Related contents feature is in beta version.