আমাদের কথা খুঁজে নিন

   

ওয়াকা ওয়াকা –ট্যুর আফ্রিকা; দানানে, লগুয়াতু হয়ে ইয়েকেপা আয়রন হিল ভ্রমণ এবং দারুণ অভিজ্ঞতা সঞ্চয় (২য় পর্ব )

সুখি হওয়ার সবচেয়ে সহজ উপায় বিবেক হীন হওয়া। ঘড়িতে সময় বেলা আড়াইটা। আমাদের গাড়ি দানানে ছাড়িয়ে ধীরে ধীরে এগিয়ে চলছে লগুয়াতু বর্ডারের উদ্দেশ্যে। মূল সড়ক ছেড়ে আমরা এখন ঢুকে পড়েছি উঁচু নিচু, এবড়ো থেবড়ো রাস্তায়। অনিবার্য কারণে গাড়ির গতি নামিয়ে আনতে হল ১৫ কিলোমিটারের নিচে।

দানানের রাস্তাকে বলেছিলাম ইউরোপীয় স্ট্যান্ডার্ডের। কিন্তু এটাকে পৃথিবীর কোন রাস্তার সাথে তুলনা করবো ভেবে পাচ্ছিলাম না। দুই একজন শুভাকাঙ্ক্ষী অবশ্য বলেছিল রাস্তাটা খুব একটা ভাল না। কিন্তু এতোটা খারাপ কখনো কল্পনায় আসেনি আমাদের। উঁচু নিচু খানা খন্দক পেরিয়ে অতি সাবধানে চলছে আমদের গাড়ি।

একটু পান থেকে চুন খসলেই গাড়ি উল্টে গিয়ে সমূহ বিপদের সম্ভাবনা রয়েছে। ভেতরে বসে মাঝে মধ্যে এমন ঝাঁকুনি খাচ্ছি যে মনে হল মঙ্গল কিংবা চন্দ্র পৃষ্ঠে ভ্রমণ করছি। নিজের ব্যালেন্স ধরে রাখতে বেশি ব্যস্ত থাকায় চন্দ্র পৃষ্ঠের ছবি তোলা সম্ভব হয়নি। ভালই হল। নইলে এ পোস্ট দেখে যাদের যাওয়ার আগ্রহ আছে তারা নিরুৎসাহিত হতে পারেন।

তথাকথিত সড়কটির দু ধারে রয়েছে যথারীতি ঘন ঝোপ ঝাড়ের আধিপত্য। দেখে মনে হবে দুই পাশ থেকে রাস্তাটাকে জাপটে ধরে আস্তে আস্তে পুরো রাস্তাটাই গ্রাস করার পাঁয়তারা চলছে। মনে পড়ল, ‘পথিকই পথের সৃষ্টি করে’ কিন্তু এ রাস্তায় যে পথিকের বড্ড বেশি অভাব! তাই চলছে বন জঙ্গলের অতি আগ্রাসন। অদূরে কিছু কফি বাগানও চোখে পড়ল। হঠাৎ বাতাসে ভর করে নাকে এসে ঠেকল অজানা ফুলের কড়া সৌরভ।

কিছুটা হাস্নাহেনা ফুলের মত মনে হল গন্ধটা। কিন্তু পরক্ষনে বুঝলাম, এটা কফি ফুলের সুবাস। কফি ফুল সাদা রঙয়ের হয়ে থাকে, সে কারনে গন্ধটাও অতি মাত্রায় কড়া। জন মানব শুন্য রাস্তা ধরে চলতে চলতে বেশ কিছু দূর যাওয়ার পর প্রানের দেখা মিলল! – এক পাল গরু আমাদের পাশ কাটিয়ে পাশের এক অজানা মেঠো পথ মাড়িয়ে হারিয়ে গেল নিকটবর্তী কোন জঙ্গলে। এরা এভাবে বনে বাদাড়ে ২৪ ঘণ্টা চরে বেড়ায়।

শুনেছি আশে পাশের দেশ মালি, বুরকিনাফাসো থেকে রাখালেরা গরুর পাল চরাতে চরাতে সীমান্ত ক্রস করে তাড়িয়ে নিয়ে আসে আইভরিকোষ্ট। ছোট বেলায় ওয়েস্টার্ন গল্পের কাহিনীতে এ রকম ঘটনা পড়েছি বহুবার। গাড়ির ভেতর শুনশান নিরবতা, কারো মুখে কোন কথা নেই। সবাইকে গাড়ির ছন্দময় ঝাঁকুনি সামলাতেই বেশি ব্যতিব্যস্ত মনে হল। কিন্তু জানা ছিলোনা সামনে আমাদের জন্য অপেক্ষা করছে আরও বড় বিশ্বয়! কিছুদূর যাওয়ার পর হঠাৎ দেখি রাস্তা শেষ! আর সামনে মাথা উঁচু করে দাঁড়িয়ে আমাদের দিকে বিদ্রুপের হাসি হাসছে একটা প্রবাহমান খাল।

এখন উপায় ? ভাগ্যক্রমে দুই তিন জন স্থানীয় লোকের দেখা পেলাম ওখানে। তারা আশ্বস্ত করল, পানির গভীরতা বেশি নয়। গাড়ি চালিয়ে পার হওয়া যাবে। অগত্যা বিসমিল্লাহ্‌ বলে গাড়ি নিয়ে নেমে পড়লাম খালে। গাড়ির ভেতর পানি ঢুকে যায় যায় অবস্থা।

যা হোক, খালটা পাড়ি দিয়ে ফেললাম আমরা কোন প্রকার অঘটন ছাড়াই। লগুয়াতু পৌঁছাতে প্রায় বিকেল হয়ে গেল। একটা লোহার ব্রিজ পার হয়ে আমরা ঢুঁকে পড়লাম লাইবেরিয়ায়। ব্রিজটা সব সময় মোটা শেকল দিয়ে লক করা থাকে। আমাদের পাসপোর্ট দেখে গার্ড শেকল অবমুক্ত করল।

লগুয়াতুতে আমরা আধা ঘণ্টার যাত্রা বিরতি করলাম। এখানে জাতিসংঘের একটি বাংলাদেশী ক্যাম্প আছে। তারা আমাদের সাদরে আপ্যায়ন করল। ওদের আপ্যায়নে আমরা যারপরনাই মুগ্ধ হলাম। ভ্রমনের ক্লান্তিও লাঘব হল অনেকটা।

আমাদের পরবর্তী গন্তব্য ‘ সানিকুলি’; এটি লাইবেরিয়ার ‘ নিম্বা’ কাউন্টির রাজধানী। সানিকুলিতে আমাদের যাওয়ার উদ্দেশ্য আয়রন হিল দেখা। লগুয়াতু থেকে সানিকুলি গমনের রাস্তা ইতোপূর্বে পেরিয়ে আসা রাস্তাটির তুলনায় কোন অংশে কম ভয়াবহ ছিলোনা। সানিকুলি পৌঁছুতে প্রায় সন্ধ্যা সাড়ে সাতটা বেজে গেল। শরীরের উপর প্রচণ্ড ধকল গেছে আজ, তাই বিদ্রোহ করে জানান দিচ্ছে বিশ্রাম চাই তার।

দ্রুত ডিনার সেরে নিদ্রা দেবীর কোলে ঢলে পড়ার যাবতীয় আয়োজন সম্পন্ন করে ফেললাম। আজ বোধ হয় পূর্ণিমা। পুরো এলাকা জুড়ে চলছে জ্যোৎস্না বর্ষণ। কিন্তু ভরা পূর্ণিমার জ্যোৎস্নায় অবগাহনের মত পরিস্থিতি আমার এখন নেই। কবি সুকান্তের মত করে বলতে হয় – ঘুমের রাজ্যে পৃথিবী স্বপ্নময় পূর্ণিমার চাঁদ যেন শিমুল তুলোর কোল বালিশ!! রাতের জম্পেশ ঘুম শেষে সকাল বেলায় ফুরফুরে মেজাজে আমরা রওনা দিলাম ‘ ইয়েকেপা আয়রন হিল’ এর উদ্দেশ্যে।

যেতে সময় লাগল ঘণ্টা দেড়েকের মত। ইয়েকেপা যাওয়ার রাস্তা ঘাট দেখে একটু আশ্বস্ত হওয়া গেল। পাকা না হলেও এটলিস্ট মহাজাগতিক রাস্তার মত নয়, একেবারে সমতল আর মসৃণ। অবশ্য বৃষ্টি হলেই এ রাস্তাই নাকি আবার বর্ষা কালের গরুর হাঁটের রুপ নেয়। কপাল ভাল আমাদের এখন বৃষ্টি বাদল নেই।

বৃষ্টিতে রাস্তার অবস্থা কেমন দাঁড়ায় তার একটা নমুনা দেখুন। ইয়েকেপা শহরটি লাইবেরিয়ার উত্তরাঞ্চলে গিনি বর্ডারের সন্নিকটে অবস্থিত। এখানকার আয়রন হিল গুলো থেকে লোহা আহরণ করছে ইন্ডিয়ান ষ্টীল জায়ান্ট ‘ মিত্তাল গ্রুপ’ তাদের এ বাণিজ্য সমগ্র বিশ্বব্যাপী বিস্তৃত। লাইবেরিয়ায় ২০০৭ সাল থেকে মিত্তাল গ্রুপ তার কার্যক্রম শুরু করে। সারা বিশ্বে লোহা উৎপাদনে মিত্তালের অবস্থান এখন শীর্ষে।

২০১১ সালের পরিসংখ্যান অনুযায়ী কোম্পানিটির বার্ষিক ক্রুড ষ্টীল উৎপাদনের পরিমাণ ৯৭.২ মিলিয়ন টন। Arcelor Mittal কোম্পানিটির সদর দপ্তর অবস্থিত লুক্সেমবার্গে। তাদের মোট কর্মচারীর সংখ্যা ২,৬০,০০০; এর মধ্যে ই ইউ ভুক্ত দেশ গুলিতে ৩৭%, নন ই ইউ ভুক্ত দেশে ১৬%, এশিয়ায় ১৬%, উত্তর আমেরিকায় ১৪% এবং বাকি জনবল দক্ষিণ আমেরিকা, মিডল ইস্ট ও আফ্রিকায় নিয়োজিত। Yekepa Iron ore এর ৩০% অংশীদার লাইবেরিয়ার সরকার( সূত্রঃ বি বি সি নিউজ) মিত্তাল সম্পর্কে জানতে ক্লিক করুন এখানে বাকীটা মিত্তাল গ্রুপের। উৎপাদিত লোহা, ক্রুড ষ্টীল ইত্যাদি পরিবহনের জন্য কারখানা থেকে Bruchanan পোর্ট পর্যন্ত রেল লাইন স্থাপন করেছে মিত্তাল কোম্পানি।

মিত্তাল গ্রুপ অবশ্য লাইবেরিয়ার আর্থসামাজিক অবকাঠামো উন্নয়নে বেশ কিছু উদ্যোগ গ্রহণ করেছে। যেমন হাসপাতাল ও স্কুল নির্মাণ, রেল লাইন স্থাপন ইত্যাদি। দীর্ঘমেয়াদী গৃহ যুদ্ধের কারনে লাইবেরিয়ায় বিদ্যমান সোনা, হীরা ও লোহার খনি গুলিতে কার্যত স্থবিরতা নেমে আসে গত কয়েক বছরে। স্বাভাবিক কারনে দেশটির অর্থনীতিও হয়ে পড়ে ভঙ্গুর। বর্তমানে দেশটি নির্জীব অবস্থা কাটিয়ে আস্তে আস্তে আবার জেগে উঠছে।

এখন পার্শ্ববর্তী দেশ গিনির সরকার ও আগ্রহ প্রকাশ করেছে সে দেশের খনিজ লৌহ রপ্তানির সুবিধার্থে দুই দেশের মধ্যে রেল যোগাযোগ স্থাপনের। আমরা যতই সামনে অগ্রসর হচ্ছি ততই নজরে পড়ছে ছোট বড় বিভিন্ন ধরনের পাহাড়। ধীরে ধীরে আমরা মূল সড়ককে পাশ কাটিয়ে প্রবেশ করলাম জঙ্গলে ঘেরা এক সরু পথে। মূলত এখান থেকেই পাহাড়ের ঢালের শুরু । আরও ৫/৬ কিলোমিটার সামনে গেলে দেখা মিলবে আমাদের কাঙ্ক্ষিত আয়রন হিলের।

ভাল করে লক্ষ্য করে দেখলাম, রাস্তাটাকে যতোটা সরু মনে হয়েছিল ঠিক ততোটা নয়। দুই পাশের ঘন জঙ্গল পীচ ঢালা রাস্তাটাকে সংকীর্ণ করে ফেলেছে অনেকাংশে। আমরা যে আয়রন হিল দেখতে যাচ্ছি ওখান থেকে মিত্তাল গ্রুপ লোহা আহরণ শেষ করে তাদের কার্যক্রম স্থানান্তর করেছেঅন্য এক লোকেশনে। দীর্ঘদিনের অব্যবহারের কারনেই রাস্তার এ বেহাল অবস্থা। পাহাড়ের আঁকাবাঁকা পথ বেয়ে দশ মিনিটের মধ্যে আমরা পৌঁছে গেলাম আয়রন হিলের পাদদেশে।

আহ, কি চমৎকার! লোহা আহরণ করতে গিয়ে পাহাড় কেটে তৈরি করা হয়েছে দৃষ্টিনন্দন সব কারুকাজ- ঠিক যেন মিশরের পিরামিড। ইয়েকেপা আয়রন হিলের দারুন কিছু ছবি দেখুন। লোহা খুঁজতে পাহাড়ের পাদদেশে খোঁড়াখুঁড়ি করাতে তৈরি হয়ে গেছে কৃত্রিম লেক। লেকের পানি কাকের চক্ষুর ন্যায় টলটলে। পানিতে নামার আগ্রহ থাকা সত্বেও লেকের গভীরতা আর বিশুদ্বতা নিয়ে সন্দেহের উদ্রেক হওয়ায় আর নামার সাহস করিনি।

এখনো অনেক লোহা আহরণের বাকি এসব হিল থেকে। পাহাড়ের কাটা অংশে দেখা যাচ্ছে লোহার টুকরো । পরিত্যক্ত অবস্থায় মিত্তাল গ্রুপের কিছু যন্ত্রপাতি। মিত্তালের পরিত্যক্ত কারখানার ধ্বংসাবশেষের একাংশ। আমাদের উপস্থিতি টের পেয়েই কিনা আয়রন হিলের উপর চক্কর দিচ্ছে একটা টহল হেলিকপ্টার ফেরার পথে আমরা গিনি সীমান্তে গেলাম।

ওদের পতাকার ছবি তুলতেই এক সীমান্ত রক্ষী বেশ হম্বিতম্বি শুরু করল। পরে অবশ্য আমাদের সাথে পোজ দিয়ে ছবি ও তুলল তারা কয়েকজন। বলল- তোমরা ইচ্ছে করলে গিনির ভেতরে গিয়ে ঘুরে দেখে আসতে পারো। আমরা আগ্রহ দেখালাম না। হাতে সময় ও নেই তেমন একটা।

তাছাড়া ওদের মনে কি মতলব আছে কে জানে? অবৈধ অনুপ্রবেশের দায়ে এরেস্ট করে মুক্তিপণ দাবি করা এদের কাছে অস্বাভাবিক কিছু নয়। ওদের বিশ্বাস করার কোন কারণ নেই। তাই গুডবাই জানিয়ে ফিরে এলাম। আমাদের আগামীকালের গন্তব্য ‘ গান্তা’ হয়ে লাইবেরিয়ার রাজধানী ‘ মনরোভিয়া’।  ।

অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।

প্রাসঙ্গিক আরো কথা
Related contents feature is in beta version.