আমাদের কথা খুঁজে নিন

   

বিশ্বজিতের, আমার ভাইয়ের, রক্তে লাল হয়ে যাওয়া শাদা শার্ট...

"জল যে পথে যায় রক্ত সে পথে যায় না, কেননা রক্ত জলের চাইতে গাঢ় এবং ঘন। " [আহমদ ছফা] আমরা ইতিমধ্যেই জেনে গেছি, গত রবিবার, বিএনপির ডাকা অবরোধের দিন, পুরান ঢাকায় বিশ্বজিৎ দাস নামক একজন দর্জিকে খুন করা হয়েছে। গোপনে নয়, প্রকাশ্যে দিবালোকে রড ও ধারালো অস্ত্র দিয়ে পিটিয়ে ও কুপিয়ে উল্লাস করতে করতে খুন করা হয়েছে। প্রায় পত্রপত্রিকার ছবি ও টেলিভিশন ফুটেজে দ্যাখা যাচ্ছে খুনের কাজটি অত্যন্ত ঠাণ্ডা মাথায় করেছে দশ বারো জন যুবক। তারা কারা? ১১ই ডিসেম্বর ২০১২-র কালের কণ্ঠ পত্রিকার লিড নিউজ রিপোর্ট “বিশ্বজিতের রক্তে হাত রাঙিয়ে আনন্দ করছে ছাত্রলীগ” থেকে হত্যাকারীদের পরিচয় আমরা যতটুকু জানতে পেরেছি সেটা অনেকটা এরকমঃ ১/ মাহফুজুর রহমান নাহিদ, বাংলা বিভাগের ছাত্র (২০০৪-০৫ শিক্ষাবর্ষ). এর আগেও নৃশংসতার ঘটনা ঘটিয়েছে নাহিদ।

গত ১৬ জুলাই জবি ছাত্রলীগের সাবেক যুগ্ন আহবায়ক খন্দকার আরিফুল ইসলাম আরিফের কর্মী রুবেল ও রাজকে কুপিয়ে সে ব্যাপক জখম করে। এরও আগে, গত ১৪ই ফেব্রুয়ারি বিশ্ব ভালোবাসা দিবস উপলক্ষ্যে (১৪ই ফেব্রুয়ারি যে স্বৈরাচার প্রতিরোধ দিবস, সেটা সম্ভবত নাহিদের জানা নাই। স্বাভাবিক। ) সে গণপরিবহনে ব্যাপক চাঁদাবাজি করে এবং টাকা না দেওয়ায় অনেক সুপারভাইজারকে মারধর করে। এছাড়াও তার বিরুদ্ধে রয়েছে ইয়াবা ব্যবসা, হোটেলে ফাও খাওয়া ও চাঁদাবাজি করার অভিযোগ।

২/ ইমদাদুল হক (ওরফে, কাইল্যা ইমদাদ), দর্শন বিভাগের ছাত্র (২০০৪ শিক্ষাবর্ষ)। ২০১০ সালে সে মুক্তি নামের একটি মেয়ের মোবাইল ছিনতাই করে এবং গত রমজান মাসে একজন রিকশাচালককে মারধর করে গণধোলাইয়ের শিকার হয়। ৩/ নূরে আলম লিমন, রাষ্ট্রবিজ্ঞান বিভাগের ছাত্র (২০০৫-০৬ শিক্ষাবর্ষ) ৪/ আব্দুল কাদের তাহসীন, মনোবিজ্ঞান বিভাগের ছাত্র (২০০৬-০৭ শিক্ষাবর্ষ) ৫/ রফিকুল ইসলাম শাকিল, ইসলামের ইতিহাস বিভাগের ছাত্র। ৬/ শাওন, মনোবিজ্ঞান বিভাগের ছাত্র (তৃতীয় ব্যাচ অষ্টম সেমিস্টার)। আপাতত এই ছয় জনের পরিচয়ই জানা গেছে।

কালের কণ্ঠের রিপোর্ট অনুসারে এরা সবাই জবি ছাত্রলীগের কর্মী। তো, যেহেতু খুনীরা চিহ্নিত, নিশ্চয়ই তাদের গ্রেপ্তার করা হয়ে গেছে। হয় নাই? না, হয় নাই। পুলিশ অজ্ঞাতপরিচয় ২০-২৫ জনকে আটক করেছে। কালের কণ্ঠের রিপোর্ট আমাদের জানাচ্ছে যে, সূত্রাপুর থানার ওসি বলেছেন ঘটনাটা বেশ দুঃখজনক, এবং “ঘটনায় জড়িতদের ভিডিও ফুটেজ ও পত্রিকায় ছবি দেখে হত্যাকারীদের চিহ্নিত করা হয়েছে।

তারা সবাই ছাত্রলীগের রাজনীতির সাথে জড়িত বলে প্রাথমিক তদন্তে ধারণা পাওয়া গেছে (বাঁকা অক্ষর আমার)। " অর্থাৎ ওসি সাহেব নিশ্চিত নন যে তারা ছাত্রলীগের রাজনীতির সাথে জড়িত, তদন্ত এখনো প্রাথমিক পর্যায়ে আছে এবং তিনি কেবল ধারণা করছেন। ভালো, ভালো। কালের কণ্ঠের একই নিউজ থেকে আরো জানা যাচ্ছে, “বিশ্বজিতকে হত্যার পর নাহিদ, লিমনসহ অন্যরা গত রবিবার দুপুর সোয়া বারোটার দিকে জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়ের ভাস্কর্য চত্বরে ছাত্রলীগের সভাপতি শরিফুল ইসলাম শরিফের জন্মদিন পালন করেছে। এ সময় তারা নেচে গেয়ে আনন্দ ফুর্তিও করে।

তখন আশেপাশে অনেক পুলিশ ও গোয়েন্দা সংস্থার লোকজন থাকলেও তাদেরকে আটক করা হয় নি। ” হুম...তদন্ত, প্রাথমিক পর্যায়, ধারণা... এদিকে। এই রিপোর্ট থেকে জানা যাচ্ছে আরেকটি বিচিত্র তথ্য। কালের কণ্ঠ আমাদের জানাচ্ছে যে জবি ছাত্রলীগের সাধারণ সম্পাদক সিরাজুল ইসলাম সিরাজ বলেছেন বিশ্বজিতকে ছাত্রদল ও ছাত্রশিবিরের ক্যাডাররা পরিকল্পিতভাবে হত্যা করেছে এবং এই ঘটনার সাথে ছাত্রলীগের কেউ জড়িত নয়। পত্রিকায় যাদের ছবি ছাপা হয়েছে তারা নাকি কেউ ছাত্রলীগের নয়।

তাহলে পত্রিকার ছবি ও টেলিভিশনের ফুটেজগুলো যে বলছে এরা ছাত্রলীগের কর্মী, সেটা কি মিথ্যাচার? “বিশেষ মহলের” ষড়যন্ত্র? ছাত্রলীগের “ভাবমূর্তি” নষ্ট করার জন্য বাংলাদেশের সব পত্রিকা ও টেলিভিশন চ্যানেল কি ছাত্রদল ও ছাত্রশিবিরের টাকা খেয়েছে; এরকম কিছু? নাকি... আমাদের হয়তো সূত্রাপুর থানার ওসি ও জবি ছাত্রলীগের সাধারণ সম্পাদকের কথায় বিশ্বাস স্থাপন করা উচিত, ইলেকট্রনিক ও প্রিন্ট মিডিয়ার “দুষ্ট” সাংবাদিকগুলোর কথায় কান দেওয়া উচিত না। কিন্তু, কোথায় যেন, একটা "কিন্তু" থেকে যাচ্ছে... কিংবা আমাদের হয়তো, আওয়ামী লীগের যুগ্ন সাধারণ সম্পাদক ও প্রধানমন্ত্রীর বিশেষ সহকারী মাহাবুব-উল-আলম হানিফের কথায় কর্ণপাত করা উচিত। ১১ই ডিসেম্বর ২০১২ তারিখেই, কালের কণ্ঠ পত্রিকার পৃষ্ঠা এগারোর খবরে বলা হচ্ছে, বিরোধী দলের অবরোধ কর্মসূচি চলাকালে পুরান ঢাকায় বিশ্বজিত হত্যার দায় আওয়ামী লীগ নেবে না বলে জানিয়ে দিয়েছেন মাহাবুব-উল-আলম হানিফ। কেন? তাঁর ভাষায়ঃ “পুরো বিষয়টা বুঝতে হবে। ওয়েস্ট ইণ্ডিজের বিরুদ্ধে সিরিজ জেতায় আমরা আনন্দ মিছিলের কর্মসূচি দিয়েছিলাম।

অনেক জায়গায় বিরোধী দল আনন্দ মিছিলে হামলা করেছে। আনন্দ মিছিলে বোমাবাজি হয়েছে। এরপর সংঘর্ষ হয়েছে। এর দায় আওয়ামী লীগের ওপর আসতে পারে না। ” সব কেমন যেন এলোমেলো হয়ে যাচ্ছে।

বিশ্বজিতের মৃত্যু কি আনন্দ মিছিলে বোমাবাজির পর সংঘর্ষের কারণে হয়েছে? এর দায় যদি আওয়ামী লীগ না নেয় তো কে নেবে? ওয়েস্ট ইণ্ডিজ ক্রিকেট টিম? তারা যদি বাংলাদেশ ক্রিকেট টিমের বিরুদ্ধে না হারতো, তাহলে আনন্দ মিছিল হত না। আনন্দ মিছিল না হলে বিরোধী দল আনন্দ মিছিলে হামলা করত না। হামলা না করলে কোনো সংঘর্ষও হত না। আর সংঘর্ষ না হলে, বিশ্বজিত মৃত্যুর হাত থেকে বেঁচে যেতেন। সুতরাং, আমাদের কি উচিত না ওয়েস্ট ইণ্ডিজ ক্রিকেট টিমকে বিশ্বজিতের মৃত্যুর জন্য দায়ী করা? না, আমাদের উচিত না।

২ আমাদের উচিত এই হত্যাকাণ্ডের জন্য আওয়ামী লীগকে দায়ী করা, বিএনপিকে দায়ী করা, জামায়াতে ইসলামীকে দায়ী করা এবং এই সকল লুটপাটকেন্দ্রিক- দুর্নীতিবাজ-মুখে জাতীয়তাবাদী ও কাজে সাম্রাজ্যবাদের দালাল-ধর্মব্যবসায়ী সকল দলকে দায়ী করা। তারা সবাই মিলে এই দেশটাকে করে তুলেছে এক নৃশংস নরক, ছাপান্ন হাজার বর্গমাইলের এক বন্দিশিবিরঃ আউসউইৎজ। বিশ্বজিতের শাদা শার্ট রক্তে লাল হয়ে যাওয়া যেনো বাংলাদেশের রক্তাক্ত হওয়ার প্রতীক, যে রক্ত প্রতিদিন খুব গভীরে ঝরছে এদেশের নিপীড়িত কৃষক-শ্রমিক-মেহনতি মানুষ-সাধারণ মধ্যবিত্তের হৃদয়ে, জীবনযাপনের গ্লানির ভেতর দিয়ে প্রবাহিত হচ্ছে, বিশ্বজিতের রক্ত যেন তারই এক নির্মম প্রকাশ। কবে আমরা জাগবো? কবে আমরা জনগণের নিজস্ব রাজনৈতিক শক্তি গড়ে তুলে এইসব হায়েনাদের হাত থেকে মুক্ত করতে পারবো আমাদের প্রিয় মাতৃভূমি, গড়ে তুলতে পারবো একটি আত্মনির্ভরশীল সার্বভৌম জনগণতান্ত্রিক বাংলাদেশ? কবে আমরা সংগঠিত হব? কবে শুধু পত্রিকায় আর টেলিভিশনে ছবি/ফুটেজ দেখে একটু কষ্ট পাওয়া, একটু ভাত খেতে খারাপ লাগা, একটু মুখে বেদনার ছায়া পড়া; তারপর আস্তে আস্তে সব ভুলে যাওয়ার এই অমানবিক বৃত্ত থেকে আমরা বেরোতে পারবো? আর কত ভাইবোন খুন/ধর্ষিত হলে পাহাড়ে ও সমতলে? আর কত রামুর বৌদ্ধমন্দির ভাঙা হলে? আর কত তাজরিনে শ্রমিক ভাইবোনেরা জ্যান্ত আগুনে পুড়ে কয়লা হলে? আর কত ফেলানি খুন হলে সীমান্ত এলাকায়? আর কত বিশ্বজিতের মৃত্যু হলে? ৩ হয়তো একদিন এই দেশটা আলো হবে। ভোর হবে।

সব অন্ধকার কাটবে। মুক্তিযুদ্ধের আকাঙ্কার বাংলাদেশ হবে আক্ষরিক অর্থে। কিন্তু "১২৩ শাঁখারীবাজারের আমন্ত্রণ টেইলার্সে" একটি ছেলেকে আর কোনোদিন দ্যাখা যাবে না। যে ছেলেটা খুব ভালবাসত একটু অবসর পেলে এলাকার অল্পবয়সী ছেলেদের সাথে ক্রিকেট খেলতে। সে আর অবসর পাবে না, সে চিরকালের জন্য অবসর পেয়ে গেছে।

শরীয়তপুরের নড়িয়া উপজেলার ভোজেশ্বর ইউনিয়নের মশুরা গ্রামের একজন নারীর সেদিনও খুব খালি খালি লাগবে। তিনি উঠোনে বসে অশ্রুসজল চোখে অনেকদিন আগের কথা ভাববেন; যখন তিনি তাঁর সন্তানের বিয়ের জন্য মেয়ে দেখছিলেন, আর পিশাচরা প্রকাশ্য দিবালোকে তার সন্তানকে পিটিয়ে ও কুপিয়ে খুন করছিল। তাঁর চোখে তখনও কি পানি থাকবে? হ্যাঁ, থাকবে। সন্তানের জন্য মায়ের কান্না কখনো শেষ হয় না...  ।

অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।