আমাদের কথা খুঁজে নিন

   

কোন পথে মিসরের গণতন্ত্র!!

সময়ের কাজ সময়ে করতে পছন্দ করি আরব বসন্তের মধ্য দিয়ে দীর্ঘদিন ক্ষমতায় থাকা স্বৈরশাসকদের পতনের পর গণতন্ত্রের জয়যাত্রা শুরু হয়েছিল তিউনিসিয়া, লিবিয়া এবং মিসরে। এরই ধারাবাহিকতায় ক্ষমতাচ্যূত হয় মিসরের প্রেসিডেন্ট হোসনি মোবারক। ২০১১ সালের ফেব্রুয়ারীতে মিসরের জনগন তার বিরুদ্ধে তীব্র আন্দোলন শুরু করলে তিনি পদত্যাগ করতে বাধ্য হন। এরপর ক্ষমতায় আসেন মুসলিম ব্রাদারহুদের নেতৃত্বদানকারী মোহাম্মদ মুরসি। হোসনি মোবারকের সময় এ দলটি দীর্ঘ দিন মিসরে নিষিদ্ধ ছিল।

নির্বাচনের আগে মুরসি প্রতিশ্রুতি দিয়েছিলেন যে, তিনি গণতান্ত্রিক নির্বাচনে জয়ী হলে গণতান্ত্রিক উপায়েই দেশ চালাবেন। গত ৩০ জুন তিনি প্রেসিডেন্ট হিসেবে দায়িত্ব গ্রহন করেন। অথচ আজ আমরা কি দেখছি, কোথায় গেল তার সেই প্রতিশ্রুতি? মিসরকে নিয়ে তিনি আজ কোন খেলায় মেতে উঠতে চাইছেন তা বলা দায়! ক্ষমতা বৃদ্ধির জন্য তিনি নতুন করে ডিক্রি জারি করে নিজের হাতে প্রচুর ক্ষমতা গ্রহন করেছেন এবং নিজেকে সর্বময় ক্ষমতার অধিকারী হিসেবে তৈরি করেছেন। নতুন সংবিধান প্রনয়ন না হওয়া পর্যন্ত তার এ ক্ষমতা থাকবে বলেও তিনি ঘোষনা দিয়েছেন। গত বৃহস্পতিবার সেখানে একটি খসড়া সংবিধানও তৈরি করা হয়েছে।

জনগনের আশার কান্ডারী, গণতন্ত্র এবং উদারপন্থি নেতা মুরসির এরূপ অগণতান্ত্রিক সিদ্ধান্তের ফলে আবারো উত্তপ্ত হয়ে উঠেছে মিসর। দেশেটির জনগন রাজধানী কায়রোসহ বেশ কয়েকটি শহরে প্রচ- বিক্ষোভের ডাক দিয়েছে। ইসলামিক ‘মুসলিম ব্রাদারহুডের’ প্রার্থী মোহাম্মদ মুরসির বিরুদ্ধে উদারপন্থী, ধর্মনিরপেক্ষ রাজনীতিবিদরা এবং আরো অনেকে প্রতিবাদমুখর হয়ে উঠেছেন। মুরসির বিরুদ্ধে বিক্ষোভে ২২টি ভিন্ন ধারার রাজনৈতিক দলের সাথে সেখানে সাবেক স্বৈরশাসক হোসনি মোবারকের সমর্থকরাও যোগ দিয়েছে। অন্যদিকে প্রেসিডেন্টের সমর্থকরাও পাল্টা বিক্ষোভের ডাক দিলে সেখানে এক সাংঘর্ষিক পরিস্থিতির সৃষ্টি হয়।

এরই মধ্যে সেখানে ১জন নিহত এবং কমপক্ষ্যে ৫’শ জন আহত হয়েছে। কিন্তু প্রশ্ন হলো মুরসি কেন এমন অগণতান্ত্রিক সিদ্ধান্ত গ্রহন করলেন? যে লোকটি সবার কাছে একজন উদারপন্থি এবং গণতন্ত্রী বলে পরিচিত তিনি কি করে নিজের ক্ষমতার জন্য ডিক্রি জারি করতে পারেন তা অবশ্যই অবাক হওয়ার মতো বিষয়! একজন চোর যখন চুরি করে তখন সেটা সবার কাছে স্বাভাবিক বলেই মনে হয়, কিন্তু একজন সাধু যখন চুরি করে সেটা নিয়ে অবশ্যই মানুষের মাঝে বিভিন্ন রকম কৌতুহলের তৈরি হয়। মুরসির ক্ষেত্রে সেই চিরায়ত সত্য আবারো প্রমানিত হলোÑ ক্ষমতার লোভ মানুষকে যে কোন হিং¯্রপথে চালিত করতে পারে। আর সেটাই হয়ত মুরসিকে জনগনের সকল মতামতকে উপেক্ষা করে নিজ সিদ্ধান্তে অটল থাকতে বাধ্য করছে। ফলশ্রুতিতে মিসরবাসী আজ তার মাঝে আর এক হোসনি মোবারকের প্রতিচ্ছবি দেখে আবারো তারা আন্দোলনের ডাক দিয়েছে।

যদিও তিনি বিভিন্ন নীতিবাক্য শুনিয়ে জনগনকে আশ্বস্ত করতে চাইছেন, বোঝাতে চাইছেন এই ডিক্রি একটি নির্দিষ্ট সময়ের জন্য কিন্তু তাতে কি আর কাজ হয়! যারা দীর্ঘ সংগ্রাম করে গণতন্ত্র ছিনিয়ে এনেছে তার আর কোন ঝুকি গ্রহন করতে চাবে না এটাই স্বাভাবিক। মুরসির এই সিদ্ধান্তকে অনেক বিশ্লেষকই ভালভাবে দেখবেন না, কারণ তার কাছে কেউ এটা প্রত্যাশা করেনি। সাবেক আনবিক সংস্থার প্রধান মোহাম্মদ আল বারাদি একে মোবারকের সময় থেকেও নিকৃষ্ট সিদ্ধান্ত বলে উল্লেখ করেছেন। কিন্তু ৩০ জুন যখন মুরসি শপথ গ্রহন করেন তখন গণতন্ত্রের নতুন যাত্রায় ভাল কিছু প্রত্যাশা করেছিল জনগন। আমরা দেখেছি এরই মধ্যে মুরসি অনেক ভাল সিদ্ধান্তও গ্রহন করেছেন।

হোসনি মোবারকের সময় কার্যত প্রশাসনের অনেক ক্ষেত্রে সেনাবাহিনীর ব্যাপক প্রভাব তৈরি হয়েছিল এবং তারা বহাল তবিয়তে সেই পদে তাদের প্রভাব খাটিয়ে আসছিলেন। গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠিত হলেও সেটা অনেকাংশেই বিরাজমান ছিল। কিন্তু মুসরি সেই ক্ষমতা খর্ব করেছেন। মুরসির বেসামরিক মন্ত্রিসভায়ও পূর্বের ক্ষমতাধর প্রতিরক্ষামন্ত্রী ফিল্ড মার্শাল হোসেন টানতায়াও একই পদে আসীন ছিলেন। কার্যত এটা সামরিক বাহিনীর চাপ এবং প্রভাবের কারণেই সম্ভব হয়েছিল।

তবে কিছুদিন পূর্বে মোহাম্মদ মুরসি সেই পদ থেকে হোসেন টানতায়াওকে অপসারণ করেন এবং শাসন কার্যে সামরিক বাহিনীর কর্তৃত্ব হ্রাস করেন। জনগন তার এই সিদ্ধান্তকে তখন স্বাগত জানিয়েছিল। আমরা জানি মুরসির রাজনৈতিক দল মুসলিম ব্রাদারহুড। তার মধ্যে ধর্মীয় আদর্শ খুব স্পষ্টভাবেই লক্ষ্য করা যায়। তিনি শুরু থেকেই যে সকল সিদ্ধান্ত গ্রহন করেছেন তার প্রায় সবই ছিল পাশ্চাত্য বিরোধী।

যদিও কিছু কিছু ক্ষেত্রে তিনি নিজের বা দেশের স্বার্থের কারণে নমনীয় হয়েছে। এরই মধ্যে মুরসি তুরস্ক এবং চীনে রাষ্ট্রীয় সফরে গিয়েছেন। সূতরাং, বোঝাই যাচ্ছে তিনি মুসলিম বিশ্বের সাথে সম্পর্ক উন্নয়নে যেমন গুরুত্বারোপ করেছেন তেমনি অর্থনৈতিক স্বার্থে শুধু পশ্চিমাদের উপর নির্ভরশীল না থেকে পূর্ব মুখী নীতির দিকেও আগ্রহ প্রকাশ করেছেন। গত ১৩ নভেম্বর গাজায় যে ইসরাইলী বর্বরোচিত হামলা হয় তাতে মুরসি গাজার পক্ষে তার শক্ত অবস্থান তুলে ধরেন। তার এই ভূমিকা বিশ্ববাসী তথা সারা মুসলিম বিশ্বের কাছে প্রশংসিত হয়েছে।

মুলত মুরসির মধ্যস্থতায় ইসরাইল-ফিলিস্তিনের মধ্যে অস্ত্রবিরতী চুক্তি স্বাক্ষরিত হয়েছে। এই অস্ত্র বিরতী চুক্তি ফিলিস্তিনকে একটা সংকটের হাত থেকে রক্ষা করেছে। এমনকি গত ২৯ নভেম্বর জাতিসংঘের সাধারন পরিষদে ফিলিস্তিন অসদস্য পর্যবেক্ষক রাষ্ট্রের মর্যাদা প্রদানের ক্ষেত্রেও মুরসির এই অবদান অনেক গুরুত্বপূর্ন ভূমিকা পালন করেছে বলে মনে হয়। অন্যান্য মুসলিম দেশগুলোর পাশাপাশি মিসরও এখানে ফিলিস্তিনীদের পক্ষে ভোট দেয়। আরব বসন্তের দীর্ঘ আন্দোলনে মিসরের অর্থনীতির অনেক অবনতি ঘটেছিল।

কিন্তু মুরসি ক্ষমতায় এসে এই ভঙ্গুর অর্থনীতি পুনরুদ্ধারের দিকে নজর না দিয়ে তিনি দেশের রাজনৈতিক দিকটাকেই বেশি প্রাধান্য দিয়েছেন। অথচ রাজনীতিকে প্রাধান্য দিয়েও তিনি আজ সঠিক সিদ্ধান্ত গ্রহন করতে পেরেছেন কি? তিনি আজ যে পথে হাটছেন তাকে অনেকে মোবারকের এঁকে যাওয়া বিকল্প পথ বলে মনে করছেন। কিন্তু এমনটা হওয়ার কথা ছিল না মুরসির ক্ষেত্রে। আরব বসন্তের পর মধ্যপ্রাচ্যের অনেক দেশেই আজ ইসলাম পন্থীরা ক্ষমতায়। সেখানে রাজনৈতিক কাঠামোতে এক বিরাট পরিবর্তন এসেছিল।

সকলের সমন্নয়ে নতুন করে আরব ঐক্য (অৎধন টহরভরপধঃরড়হ) প্রতিষ্ঠার সম্ভাবনা তৈরি হয়েছিল। যদিও তাদের মাঝে অনেক ভিন্ন মতাবল্বী ছিল কিন্তু তারপরও তারা বিভিন্ন আন্তর্জাতিক সিদ্ধান্তে ঐক্যবদ্ধ হয়ে নিজেদের স্বার্থ আদায় করতে পারত। যেমন আজ ফিলিস্তিন জাতিসংঘে তার জায়গা করে নিয়েছে। কিন্তু এক আন্দোলনের ঘোর কাটতে না কাটতেই মিসরে আজ শুরু হয়েছে আর এক আন্দোলন। ফলে তাদের ঐক্যবদ্ধ শক্ত অবস্থানটা অদূর ভবিষ্যতে নড়বড়ে হয়ে যাবে এটাই স্বাভাবিক।

মুরসি সংবিধান সংশোধন করলেও তিনি তাতে রাষ্ট্র ধর্ম হিসেবে ইসলাম এবং শরীয়াহ আইনকে রাষ্ট্রীয় আইনের অন্যতম উৎস হিসেবে মেনে নিয়েছেন যেমনটা ছিল হোসনি মোবারকের সময়। ফলে সেখানে উদারপন্থি রাজনীতিবীদগণ এবং অমুসলিমদের মধ্যে তীব্র ক্ষোভ দানা বেধেছে। কারণ তারা মনে করছে এর মাধ্যমে কট্টরপন্থি ইসলামী আদর্শ রাষ্ট্রের মধ্যে জায়গা করে নেবে এবং তাতে সুষ্ঠু গণতন্ত্র চর্চা ব্যহত হবে। অন্য দিকে এর মাধ্যমে মিসরে বসবাসরত বিধর্মীদের ধর্মীয় ও অন্যান্য অধিকার ক্ষুন্ন হওয়ার পথ তৈরি হয়েছে বলেও তারা মনে করেন। যা মিসরে আজ বড় সংকটের জন্ম দিয়েছে।

এখন মুরসি যদি নমনীয় না হয় তাহলে মিসরে নতুন করে বড় ধরনের সহিংসতা সৃষ্টি হবে তাতে কোন সন্দেহ নেই। সিরিয়ায় যেমন আজ সরকার সমর্থক এবং বিরোধীদের মধ্যে সংঘর্ষ চলছে ঠিক তেমন এক পরিস্থিতি এখানেও তৈরি হতে পারে। কারণ প্রতিদিনই কায়রোতে মুরসির সমর্থক এবং বিরোধী পক্ষ পাল্টাপাল্টি বিক্ষোভ করছে। আর সিরিয়ার মতো গৃহযুদ্ধের পরিস্থিতি তৈরি হলে সেটা মুরসির জন্য ভাল হবে বলে মনে হয় না। তিনি যে স্বপ্ন নিয়ে ডিক্রি জারি করে একচ্ছত্র ক্ষমতা গ্রহন করেছেন, তার সে স্বপ্ন তখন হয়ত স্বপ্নই থেকে যাবে।

তাই মুরসির উচিত হবে জনগনের মতামতকে প্রাধান্য দিয়ে সংবিধান প্রনয়ন এবং প্রকৃত গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠা করা। আর তিনি যদি তা না করেন তবে সেটা মিসরকে নতুন এক অরাজক পরিস্থিতির দিকে ঠেলে দিবে এবং দেশটির গণতন্ত্রের ভবিষ্যত হবে অনিশ্চিত। কিন্তু মিসরের জনগন, বিশ্বের শান্তিকামী মানুষ এবং মুসলিম বিশ্ব কেউই হয়ত বা সেটা চায় না। তাই মিসরের শান্তি ও প্রকৃত গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠিত হউক এবং মুসলিম বিশ্ব আবারও ঐক্যবদ্ধ হউক এ প্রত্যাশাই থাকবে সবার। জহেদুল ইসলাম ।

সোর্স: http://www.somewhereinblog.net     দেখা হয়েছে বার

অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।