আমাদের কথা খুঁজে নিন

   

কুসুম ও কীট নাশক

র্পব/১ ‘একটা জীবন দেখতে দেখতেই কেটে যাবে’... এমনি একটা অস্বচ্ছ ধারনা দীর্ঘ দিন থেকেই কুসুমের মাথায় ঘুরপাক খাচ্ছে। জীবনের দৈর্ঘ প্রস্থ সম্পর্কিত এই অস্পষ্ট ভাবনাকে পাশ কাটাতে না পেরে আবারো সে পাশ ফিরে শোয়। কিছুক্ষণ আগে আলো নিভিয়ে বিছানায় ঢুকে পড়ার সময় তার মনে হয়েছিল ঘরটা বেশ অন্ধকার। শহরের রাত্রি কৃষ্ণপক্ষ শুক্লপক্ষের নিয়ম মেনে চলেনা। তবুও নিজের প্রয়োজনে ঘরের ভেতরে কৃষ্ণপক্ষ তৈরী করে নিলে ক্ষতি কি! কিছুটা সময় এপাশ ওপাশ করে কাটাবার পর কুসুমের মনে হয় অন্ধকার ক্রমশ ফিকে হয়ে আসছে।

ভারি পর্দার পাহারা উপেক্ষা করে রাস্তার ল্যাম্পপোস্ট থেকে ছিটে ফোটা আলো এসে এখানে সেখানে ছড়িয়ে আছে। ঘুম আসবেনা জেনেও জানালার দিকে মুখ ফিরিয়ে ঘুমাতে চেষ্টা করে কুসুম। জানালার ওপারে একটা কুয়াশা ঘেরা রাত ক্রমেই বাড়তে থাকে। দাদাজান ধাপের হাটে গেছেন, ফিরতে রাত হবে। সপ্তাহে একদিন হাটবার, সব দিনতো যাওয়া হয়না।

হাটে গেলে কতকিছু কেনার থাকে... শীতের শুরুতে পাটালি গুড়, এককুড়ি ডিমভরা কই মাছ অথবা মাছ ধরার সরঞ্জাম। দাদাজানের মাছ ধরার নেশা ছিল। ছিপের সুতা, বড়শি-হুইল আর জালের কাঠির জন্যে ধাপের হাটে যেতে হয়। প্রয়োজনীয় কেনাকাটা শেষ করে ফেরার সময় মাটির হাড়িতে চিনির কদমা আর ওট পিঠা নিয়ে আসতে ভুল হয়না। ওট পিঠা মায়ের খুব পছন্দ, ঝালের জন্য খেতে পারেনা কুসুম তবুও দাদাজান হাটে গেলে রাত জেগে বসে থাকে।

ওর জন্যে কিছু না হলেও আসবে বাতাসা অথবা তিলের খাজা । রাত কতো হলো! ঘড়ির কাঁটায় কেউ সময় মেপে দেখে না। আকাশে চাঁদ আছে, হাটুরেরা দল ধরে ঘরে ফিরছে... ভয়ের কিছু নেই। মেজো দাদি রাতের রান্না বান্না শেষ করে চুলার আগুন উস্কে দিয়ে পিঁিড় পেতে চুলার পাড়েই বসে আছে। ছোট দাদি কুপি নিভিয়ে দিয়ে বিছানায় এসে শুয়েছিল।

সারা দিনের বিরতিহীন কাজ কর্মের শেষে এই সাময়িক বিশ্রাম কতটা নিজের জন্যে আর কতটা কুসুমের জন্যে তা আর কেউ না জানলেও কুসুম জানতো। লেপের ভেতরে মাথা ঢুকিয়ে ছোট দাদির বুকের মধ্যে মুখ গুঁজে না শুতে পারলে ঘুম আসেনা। একটা অচেনা সৌরভে সারাক্ষণ ভরে থাকে ছোট দাদির শরীর। বুনো ফুলের গন্ধের ভেতরে তলিয়ে যেতে যেতে কুসুম দাদাজানের ডাক শুনতে পায়। ‘ বুবু...ও কুসুম বু ... এত সকাল সকাল নিন্দালে আজ তোমার জন্যি আনা কাঠি লজেন্সগুলা কে খাবে বুবু...?’ এরপর টুকটাক কথা বার্তা, কুয়াতলায় বালতি ভরে পানি তোলার শব্দ।

‘আজ হাটত থিনি ফিরতে এতো দেরী হলো যে!’ মেজো দাদির কণ্ঠ। দাদাজান হাত মুখ ধুচ্ছেন। ছোট দাদি কখন উঠে গিয়ে কুপি জ্বালিয়ে মাছ কুটতে বসেছে কুসুম জানতেও পারেনা। শীতের রাত, মাছ জ্বাল দেয়ার দরকার নেই। কেটে ধুয়ে উঠানে কাপড় শুকানোর আড়ে শিকায় ঝুলিয়ে রাখলেই চলবে।

মেজো দাদি ধোঁয়া ওঠা গরম ভাত বেড়ে দিয়েছে দাদাজানের সামনে। প্রচুর পেঁয়াজ দিয়ে রান্না করা খলসে পুঁটির চচ্চড়ি আর সঙ্গে শোল মাছের ঘন ঝোল মেখে ভাত খেতে খেতে দাদাজান যখন হাট ফেরত গল্প করছেন কুসুম ততোক্ষণে ঘুমে অচেতন। ঘরটা সম্পূর্ণ অন্ধকার হলে খুব ভালো হতো। নিশ্ছিদ্র অন্ধকারেই কেবল পুরোপুরি একা হওয়া যায়। বিবাহিত জীবনের প্রায় শুরু থেকেই একা থাকতে ভালো লাগে কুসুমের।

কথাটা শুনতে খুব বিসদৃশ্য মনে হলেও সত্যি। একটা লোক কি হঠাৎ করেই একজনের জীবনের ভেতর হুড়মুড় করে ঢুকে পড়তে পারে! কোথাও কোনো প্রস্তুতি ছিলনা। জেলা শহর থেকে ত্রিশ বত্রিশ মাইল দূরের অখ্যাত গ্রামে বিসমিল্লা খাঁর সানাই বেজে উঠবে অথবা রঙিন বিজলী বাতির আলোকমালায় ঝলমল করে উঠবে মুন্সী বাড়ির প্রাঙ্গণ, এমনটা কেউ আশা করেনি। কিন্তু কোনো কিছু বুঝে ওঠার আগেই একজন অপরিচিত মানুষ হাত দিয়ে স্পর্শ করেছিল শরীর, নির্লজ্জ ভাবে ছুঁয়ে ছুঁয়ে দেখেছিল হাত-গাল-চিবুক আর বুক। কুসুম শুধু একবার মরিয়া হয়ে বলেছিল, ‘হেরিকেনের আলোটা কমিয়ে দিলে হয়না?’ হরিণ শিশুর এই আর্তি বাঘের কাছে সম্ভবত ইতিবাচক ঈঙ্গিত মনে হয়েছিল।

আলোটা দ্রুত নিভিয়ে দিয়ে রক্ত লোলুপ বাঘ হরিণ শিশুর উপর ঝাঁপ দিয়ে পড়তে এক মুহূর্ত দেরী করেনি। বাঘ যে রক্তের স্বাদ বহু আগেই পেয়েছিল সে কথা কুসুম জেনেছে অনেক পরে। কিন্তু অস্পষ্ট আলো আঁধারিতে প্রথমবার দেখা সেই অপরিচিত মানুষের সাথে পরবর্তীতে তার কখনোই পরিচয়ের সুযোগ হয়নি। আজকাল কুসুমের মনে হয়, দেখতে দেখতে একুশটা বছর সে একজন অচেনা মানুষের সাথে কাটিয়ে দেয়ার মতো অসাধ্য সাধন করে চলেছে। কাজেই বাকি জীবনটাও এভাবেই কেটে যাবে! একা থাকার সুুযোগ যে খুব একটা পাওয়া যায় তা নয়, তবে যতটুকু সময় পাওয়া যায় তার পুরোটাই সে নিজস্ব শক্তি সঞ্চয়ের জন্য কাজে লাগাতে চায়।

একাকিত্বের মধ্যে প্রায় প্রতিদিনই একটা গরুর গাড়ি দুই চাকায় করুণ আর্তনাদ তুলে ধুলি ধুসর দীর্ঘ পথ পাড়ি দেয়। তালসোন থেকে পাকুড় গাছা দশ বারো মাইলের পথ। তারপরেও সকালে সূর্য ওঠার পরপর রওনা দিলে পৌঁছাতে দুপুর গড়িয়ে বিকেল হয়ে যায়। ভোরবেলা ঘুম থেকে উঠেই বছরকার কিষাণ আকালু গরু দুটিকে জাব খাইয়ে গাড়িতে ছই বেঁধে প্রস্তুত হয়ে বসে আছে। গাড়িতে গরু জুড়ে দিলেই যখন যাত্রা শুরু করা যায়, তখন চোখ ঘষতে ঘষতে বাইরে আসে কুসুম।

অন্য কোনো দিন হলে গাড়িতে উঠে শেষ প্রান্তে পৌঁছে আগাড়ি তুলে ধরতে বলতো। আর তা’না হলে নিজেই দু’চার জন জুটিয়ে পেছনটায় ঝুলে পড়তো। আজ তার কিছুই ভালো লাগছে না। অনেক দিনের জন্য মা চলে যাচ্ছে নানির বাড়ি। মার সঙ্গে পাকুড় গাছা চলে যাবে নাকি ছোট দাদির কাছে তালসোনে থেকে যাবে এই দোটানায় পড়ে মন খারাপ হয়ে আছে।

রাতে ঘুমের মধ্যেও একবার কেঁদে উঠেছিল। ‘ক্যা মা কুসুম... ভাবি বলে তোমাক লিয়া যাবি না?’ কুসুমের কাটা ঘায়ে নুনের ছিটা দেয় আকালু। ‘নিয়ে যাবেনা নয়, আমিই যাবোনা। আমি গেলে বুড়ি থাকবে কেমন করে!’ নিজের না যাবার পক্ষে জোরালো যুক্তি খাড়া করে কুসুম। কাছাকাছি এসে আকালু গলা নামিয়ে বলে, ‘তোমার মাও পাকুড় গাছাত থিনি তোমার এডা ভাই লিয়া আসপি।

’ সাড়ে তিন বছরের কুসুমের পক্ষে রহস্যটা বোঝার কথা নয়। তবে এ বাড়ির সবাই হয়তো আশা করেছিল সাড়ে তিন বছর পরে হলেও এবারের সন্তান নিশ্চিত ভাবেই হবে পুত্র সস্তান। তাই পুত্র লাভের আকাক্সক্ষা নিশ্চিত সম্ভবনা হিসাবে বাড়ির কিষাণ কামলাদের মধ্যেও ছড়িয়ে পড়েছিল। কুসুমের মাকে পাঠাবার বিন্দুমাত্র ইচ্ছা ছিলনা আব্দুর রহমান মুন্সীর। কি আছে পাকুড়গাছার খন্দকারদের! সেই সুদূর গণ্ডগ্রামে যদি কোনো জটিলতা দেখা দেয় তাহলে কি হবে! তালসোন যদিও কোনো শহর নয়, তারপরেও দেড় দু মাইলের মধ্যে তালোড়ায় পৌঁছাতে পারলে ডাক্তার কবিরাজের অভাব নেই।

তেমন সমস্যা হলে যে কোনো ট্রেনে বগুড়ায় নিয়ে যাওয়া যেতে পারে। কিন্তু পনর মাইল গরুর গাড়ির পথ পার হয়ে প্রসূতি বা নবজাতক কাউকেই সুস্থ অবস্থায় কোথাও স্থানান্তর সম্ভব নয়। কুসুমের মা বাপের বাড়ি যাবার ব্যাপারে নিজে থেকে আগ্রহ বা অনীহা কিছুই প্রকাশ করেননি। তবে প্রথম সন্তান নির্বিঘেœ জন্ম দেবার পর সম্ভবত তার সাহস বেড়ে গিয়েছিল। এক সময় কুসুমের নানা দিয়ানত আলী খন্দকারের ধানের জমি, নগদ টাকা পয়সা, দালান কোঠা কোনো কিছুরই অভাব ছিলনা।

এখন পুরোনা দালানের ভাঙ্গাচোরা অংশ বিশেষ আর বংশ গৌরব ছাড়া উল্লেখ করার মতো কিছু নেই। অবশ্য সময়ের তুলনায় বিদ্যাবুদ্ধিতে প্রাগ্রসর দিয়ানত আলী শুধু যে তার গায়ের ফর্সা রংয়ের কারণে ধলা মিয়া নামে পরিচিত হয়েছিলেন তা বলা যাবেনা। নিজের জীবনে কঠোর ইসলামী অনুশাসন মেনে চলেও তিনি ছিলেন একজন মুক্তবুদ্ধির মানুষ। প্রখর আত্ম মর্যাদা বোধই শেষ জীবনে তাকে নিদারুণ অর্থ সংকটে ফেলে দিয়েছিল বলে অনেকের ধারনা। বাবার একমাত্র মেয়ে হিসাবে কুসুমের মা জাহানারা খাতুন ছোট বেলা থেকেই আশেপাশের আর দশজন সাধারণ মেয়ের চেয়ে আলাদা ভাবে বেড়ে উঠেছিলেন।

কিছুটা অহঙ্কারী কিছুটা অভিমানী জাহানারাকে বুঝে ওঠা কুসুমের পক্ষে সম্ভব ছিলনা। মাকে তার কখনোই কাছের মানুষ মনে হয়নি। সেই দূরের মানুষ মায়ের সাথে আরো দূরে পাকুড় গাছায় যাওয়ার চেয়ে ছোট দাদির øেহচ্ছায়া তার কাছে নিরাপদ বলে মনে হয়। তালসোনের মাঠ পেরিয়ে ধান কাটা ধু ধু প্রান্তরের মাঝ দিয়ে ধুলা উড়িয়ে চলে যায় গরুর গাড়ি। পেছনে ছই ঢেকে বাধা হলদে সবুজ শাড়ির আভাস যতক্ষণ দেখা যায় তাকিয়ে থাকে কুসুম।

হলদি গাড়ির পুব পাড়ে ঝুরি নামা বুড়ো বটের আড়ালে হারিয়ে যাওয়ার আগে পর্যন্ত দাঁড়িয়ে থেকে একবুক শূন্যতা নিয়ে ফিরে আসে। বুকের ভেতর থেকে কান্না দলা পাকিয়ে গলা দিয়ে উঠে আসতে চায়। কিন্তু সেই ছোটবেলা থেকেই দুঃখ কষ্ট কান্না লুকিয়ে রাখার স্বভাবটা বোধহয় মায়ের কাছ থেকেই পেয়েছিল কুসুম। সারাদিনে তার মধ্যে কোনো ভাবান্তর লক্ষ্য করা যায়না। গভীর রাতে লেপের ভেতরে মুখ রেখে ফুঁপিয়ে কেঁদে উঠে এক সময় ঘুমিয়ে যায়।

পরবর্তী পর্ব... আগামী শুক্রবার। ।

অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।