আমাদের কথা খুঁজে নিন

   

জামায়াত-আওয়ামী জোট নাকি জামায়াত-জাতীয় পার্টি জোট!

লেখার চেয়ে পড়ায় আগ্রহী। ধার্মিক, পরমতসহিষ্ণু। “বেশ্যাকে তবু বিশ্বাস করা চলে, বুদ্ধিজীবীর রক্তস্নায়ুতে সচেতন অপরাধ বেশ্যাকে তবু বিশ্বাস করা চলে, রজনীতিবিদদের ধমনিশিরায় সুবিধাবাদের পাপ!” (রুদ্র মুহাম্মদ শহিদুল্লাহ) অভিনব একটি শিরোনাম বটে। এর পেছনে কারণ আছে। সম্প্রতি বিএনপির নেত্রী খালেদা জিয়া বলেছেন, আওয়ামী লীগের সঙ্গে জোট গড়ার জন্য আওয়ামী লীগ জামায়াতকে গোপনে চাপ দিচ্ছে।

প্রথমত, তিনি শীর্ষস্থানীয় রাজনৈতিক ব্যক্তিত্ব, তিনি একান্ত কল্পনায় ভর করে চলেন, এমনটা ভাবলে ভুল হবে। হয়ত তার ভক্ত গোয়েন্দা সদস্যদের মাধ্যমে তা তিনি জানতে পেরেছেন। দ্বিতীয়ত, বাংলাদেশ প্রতিদিন (১২/১১/১২) এ নিয়ে একটি জরিপ প্রকাশ করেছে। একটি পত্রিকা তো এমনি এমনি জরিপে যায় না। তৃতীয়ত, জরিপেও প্রায় ৮০% মানুষ এ ধরনের ষড়যন্ত্রের সম্ভাবনাকে স্বীকার করেছেন।

আর আমি তো কোন ছার! চতুর্থত, সাঈদীকে গ্রেফতার করার পরপরই জামায়াত ভেঙে নতুন একটি ইসলামী দল গঠন করার প্রস্তাব তাকে দেওয়া হয়েছিল। এ কথা দু-একজনের মুখে শুনেছি। তখন কান দিই নি। এখন মনে হচ্ছে, সে গুজব একবারে মিথ্যে হবার নয়, গজব হওয়ার সম্ভাবনা ফিফটি ফিফটি! আমি এ সব সম্ভাবনাকে নাকচ করছি না, করতে পারি না, অন্তত আমার ক্ষুদ্র অভিজ্ঞতার পরিপ্রেক্ষিতে। খুব সামান্য সামান্য মনে পড়ছে, ৯৪-৯৫-এর দিকে আওয়ামী লীগ বিএনপি বিরোধী জোট বাঁধতে গিয়ে জামায়াতকে কাছে টানার চেষ্টা করছে।

জাহানারা ইমামের কারণে তখনই যুদ্ধাপরাধ বিষয়টি কর্ণগোচর হয়। তাই ক্ষমতায় যাওয়ার আওয়ামী এই পন্থায় কিশোর মনেও ভীষণ ব্যথা লেগেছিল। আর ছিয়ান্নব্বইতে ক্ষমতায় গিয়ে সম্মিলিত সাংস্কৃতিক জোট যখন আওয়ামী লীগের মাঝেই লীন হয়ে যায় এবং ঘাদানিক দুর্বল ও নিষ্ক্রিয় হয়ে পড়ে, তখন একেবারে বিমূঢ় হয়ে পড়ি। বুঝতে পারি, আমার মতো নাবালগদের সাবালক করার জন্যই এত সব অভাবিত কাণ্ড ঘটানো হয়! ২০০১ সালে আবার জামায়াত যখন বিএনপির আঁচলে ধরে ক্ষমতার ভাগিদার হয়, তখন আওয়ামী লীগের বুঝতে বাকি থাকে না যে, জামায়াত বাংলাদেশে একটি ফ্যাক্টর বটে। একে রাখলেও সমস্যা, না রাখলেও সমস্যা।

কেন এমন হয়? তা পরে বলছি। কিন্তু তখন থেকেই মূলত আওয়ামী লীগের মাঝে জামায়াত-বিরোধী মানসিকতা তীব্র আকার ধারন করে এবং একে সাইজ করার নানা ফন্দি-ফিকির চলতে থাকে। জামায়াতকে রাখলে সমস্যা যা হয়, তা হল, তা প্রায়ই বিএনপির আঁচলে নিচে আশ্রয় নেয়। কিন্তু যদি এমনভাবে গড়া যায় যে, তা বিএনপির আঁচলের নিচে আর কখনোই যাবে না, বরং আওয়ামী লীগের কোলেই থাকবে, তাহলে কেমন হয়? যেই ভাবনা সেই কাজ। যুদ্ধাপরাধের গণদাবি তো ছিলই।

তাওয়া নিতান্ত গরম। এখন শুধু সেঁকে নেওয়া। তাই জামায়াতের নেতাদের গ্রেফতার চলতে থাকে। প্রধান আসামি, সেই গোলাম আজম গ্রেফতার হলো অনেক পরে। এমন কি যার অপরাধের ফিরিস্তি অনেকের মুখেই শোনা যায়, সেই মীর কাসে আলী গ্রেফতার হলো আরো পরে।

সাঈদীর পূর্বেই গ্রেফতার হলো নিজামী-মুজাহিদ। না, অন্য কারো বিচার কার্যে এত ত্বরা নেই, ত্বরা শুধু সাঈদীর ক্ষেত্রে। কিন্তু কেন? সাঈদীর সব চেয়ে বড় সম্পদ, তার কণ্ঠ। এ কণ্ঠ দিয়ে এ দেশের ধর্মান্ধ মানুষদের খুব সহজেই কাবু করা যায়। তাই তাকে টার্গেট করে যদি এগোনো যায়, তাহলে স্বার্থোদ্ধার হতেও পারে।

সে হিসাবেই তাকে দিয়ে যুদ্ধাপরাধের বিচার শুরু হয়। তাকে নানা প্রস্তাব দেওয়া হয়। শোনা কথা, একবার সাঈদী এমন প্রস্তাবে সায় দিয়েছিল, কিন্তু বড় ছেলের হঠকারিতায় তা থেকে পিছিয়ে আসে। সাঈদীকে আমির বানিয়ে মাসিক মদিনার সম্পাদক মুহিউদ্দীন খানকে সেক্রেটারি করার সিদ্ধান্ত হয়েছিল। মাওলানা মহিউদ্দীন খান এ প্রস্তাব প্রত্যাখ্যান করে এই বলে যে, ‘যেহেতু মতাদর্শিক কারণে মূল জামায়াতে যোগ দিই নি; এখন শেষ বয়সে নকল জামায়াতে যেতে চাই না।

’ এরপর নতুন করে সলতে পাকানো শুরু হয়। জামায়াতের কোনো সমালোচনায় যেতে চাই না এ-জন্য যে, এ দলটির কাছে আমার কোনো প্রত্যাশা-ই নেই। ধর্মবিষয়ক চিন্তাধারায় দলটি মওদুদির কাছে জিম্মি। এর বাইরে ইসলামের যে কত উদার এবং মানবিক ব্যাখ্যা রয়েছে, তাতে এরা কান দেয় না। দেবেও না।

এদের ধারনা ইসলাম টিকে থাকবে একমাত্র মাওদুদির চিন্তাধারার বাস্তবায়নে! এর বাইরের সকল ব্যাখ্যা ও বিশ্লেষণকে যেভাবে ওরা নাকচ করে, তাতে রাগ হয় না। বরং এদের নির্বুদ্ধিতায় বিষ্ময় জাগে। রাজনৈতিকভাবে এত কাঁচা ও ঘৃণ্য মানসিকতার হলে রাজনীতি করা যায়? ক্যাডারবেষ্টিত হয়ে এর নেতারা ভাবে, এমন সুরক্ষা বোধহয় আর কোথাও নেই। একাত্তরের ঘৃণ্য অপরাধের কথা মনে হলে আমি এদের কোনোভাবেই ক্ষমা করতে পারি না। আবার অপরাধ করা এক জিনিশ, অপরাধ করেও তাকে বৈধতা দানের প্রয়াস আরেক জিনিশ।

অর্থাৎ তা দ্বিগুণ অপরাধ। জামায়াত বাংলাদেশের সূচনা থেকে একাজটিই করে আসছে। শুধু তাই নয়, এরা কোমলমতি শিশুদের কাছে ধর্মের অজুহাতে, ভারতের হিন্দুদের জুজু দেখিয়ে স্বাধীনতার সময়ে তাদের অবস্থানকে যৌক্তিক করছে। তাদের বিভ্রান্ত করে চলেছে। বাস্তবতা হল, এ জামায়াতই আড়ালে-আবডালে আমাদের তাবড় তাবড় দলের করুণা পেয়ে থাকে।

একাত্তরের পরপর এদের কোনো অস্তিত্বই থাকতো না, যদি শাসকগোষ্ঠীর হঠকারী সিদ্ধান্তগুলো না হত। যেভাবেই হোক জামায়াত এখন শক্তপোক্ত দল। প্রথমত, এরা অহরহ পেট্র-ডলারের যোগান পেয়ে থাকে। তাছাড়া বিশ্বের অন্যান্য মুসলিম সোসাইটির আর্থিক সাহায্যও ওরা গ্রাস করে থাকে। দ্বিতীয়ত, এটা ক্যাডারভিত্তিক সংগঠন।

একটি নির্দিষ্ট নিয়মের ভেতর দিয়ে পার্টির শৃঙ্খলা রক্ষিত হয়। তৃতীয়ত, নানাভাবে সারা দেশে এরা এখন শিকড় ছড়িয়ে দিয়েছে; তা সামাজিক, অর্থনৈতিক যে কোনো দিক থেকেই বলি না কেন। চতুর্থত, ধর্মীয় অন্য কোনো দল রাজনৈতিকভাবে এতটা লাভজনক নয়, যতটা জামায়াত। তাই এর থেকে ফায়দা নেওয়ার জন্য সবাই এক পায়ে খাড়া। আওয়ামী লীগের নামও এ সারিতে আছে।

এবারে নির্বাচনের পরপর শেখ হাসিনা বলেছিলেন, ‘জনগণ যুদ্ধাপরাধীদের প্রত্যাখ্যান করেছে। এতেই এদের বিচার হয়ে গেছে। ’ এ বাক্যটা তখন অনেকের নজর কেড়েছিল। দ্বিতীয়ত, যুদ্ধাপরাধের বিচারের জন্য সেক্টর কমান্ডারদের যে আন্দোলন, তা তো কোনো স্বার্থসংশ্লিষ্ট ছিল না। বরং পেছনের অবদানকে অক্ষত রাখার জন্যই শেষ বয়সে তাদের এ নিবেদন।

কিন্তু একে খন্দকারকে মন্ত্রিত্ব দেওয়া হল। তাও মুক্তিযুদ্ধবিষয়ক মন্ত্রণালয় নয়। তখনই মনে প্রশ্ন জেগে ছিল, আওয়ামী লীগ কি পালানোর বা এড়ানোর পথ খুঁজছে? ঘনিষ্ট এক আওয়ামী লীগের নেতাকে প্রশ্ন করেছিলাম, একে খন্দারকে মন্ত্রিত্ব দিয়ে পরিস্থিতিটা ৯৬-৯৭ সনের ঘাদানিকের মতো করা হচ্ছে না তো? উনি আমার হিতাকাক্সক্ষী, বলেন যে, ‘নির্বাচনে জেতার পেছনে সেক্টর কমান্ডারস ফোরামের তো যথেষ্ট অবদান রয়েছে। তাই এ মূল্যায়ন। আর হ্যা, আওয়ামী লীগ যদি যুদ্ধাপরাধের বিচারে গাফিলতি বা শিথিলতা দেখায়, ইতিহাস তো তাদের ক্ষমা করবে না।

’ যুদ্ধাপরাধের বিচার একটি গণদাবি। কিন্তু এটি বাস্তবায়ন করতে কত রকমের তালবাহানা দেখতে হচ্ছে। যখন রাজনৈতিক ভাগ-বাটোয়ারা নিয়ে বিএনপি-আওয়ামী লীগ দ্বন্দ্ব হচ্ছে, সংঘাত হয়, আর সরকারি মন্ত্রী ও দল-নেতারা বলতে থাকেন যে, যুদ্ধাপরাধের বিচার বাধাগ্রস্ত করতেই এই পায়তারা! কোনো এলাকায় নদীভাঙন শুরু হয়েছে তো, সরকারের পক্ষ থেকে বলা হচ্ছে, তা হল যুদ্ধাপরাধের বিচারকে নস্যাৎ করার ষড়যন্ত্র! মাঠে-ঘাটে কেউ পা পিছলে পড়ে যাচ্ছে, আর বিবৃতি আসছে যে, এ হল যুদ্ধাপরাধের বিচারকে ভণ্ডুল করার উদ্যোগ। অর্থাৎ অযৌক্তিকভাবে নানা অজুহাত তুলে ধরা হচ্ছে। বলেছি, জামায়াত হল দুধ-ওয়ালা গাই।

সবাই এর এর ভাগ নিতে চায়। তাই গোপনে এমন যোগ-সাজশের সংবাদে বিমূঢ় হই না। আওয়ামী লীগ যদি কোনোভাবে বলে-কয়ে জামায়াতকে মহাজোটের অন্তর্ভুক্ত করতে পারে, তাহলে বিএনপি নির্ঘাত কিক খাবে। মানে আওয়ামী লীগের কেল্লা ফতেহ। তখন বিএনপি হয়ত, বা নিশ্চিতই বিলীন হয়ে যাবে, অস্তিত্ব হারিয়ে মুসলিম লীগের মতো হয়ে যাবে।

বাংলার মাঠে আওয়ামী লীগকে চ্যালেঞ্জ করতে পারবে, এমন কোনো শক্তি তখন আর থাকবে না। জামায়াত তো তখন থাকবে কোলে বসানো বা গৃহপালিত পার্টি হিসাবে। অন্যদিকে তাদের যুদ্ধাপরাধের কঠিন বিচারের ভীতি তো থাকবেই। তাই জামায়াত খুব একটা নড়াচড়া করবে না। এমনটি হলে আওয়ামী লীগ হয়ত বিজয়ী হবে।

শেখ হাসিনা আবারো ক্ষমতায় বসবেন। কিন্তু দেশের বারোটা বেজে যাবে। একাত্তর-নিবেদিত তরুণ সমাজের আত্মহত্যা ছাড়া কোনো গত্যন্তর থাকবে না। আর ইতিহাসের বিচারের অপেক্ষা কেউ কি করে? অন্তত আমাদের দেশে? বিকল্প একটি জোট হতে পারে, যা জামায়াতকে আওয়ামী লীগের সঙ্গে যুক্ত না করে জাতীয় পার্টির সঙ্গে যুক্ত হতে উদ্বুদ্ধ করতে পারে। জামায়াতের পক্ষ থেকে এখানে কোনো বাধা থাকার কথা নয়।

কারণ, জামায়াতের এই ফুলে-ফেঁপে উঠা তো এরশাদের আমলেই। রাষ্ট্র-ধর্মের প্রবর্তকের সঙ্গে গাঁটছড়া বাঁধায় খুব একটা লজ্জাও পাবার কথা নয় তাদের। অথচ বিএনপির সঙ্গে জোট বাঁধলে তাদের নানা প্রশ্নের সম্মুখিন হতে হয়, অন্তত নারী-নেতৃত্বের বিষয়ে। আর জামায়াতের তো এখন ঠিকে থাকার প্রশ্ন। তাই বিএনপি যা, জাতীয় পার্টিও তা।

বরং এখানে লাভ হল আওয়ামী লীগের নিপীড়ন (?) ও যুদ্ধাপরাধের বিচার থেকে মুক্ত হওয়া। এখানে আওয়ামী লীগের লাভ হল, ক্ষমতার মাছটি তাদের বড়শিতেই গেঁথে যাবে। অথচ পানি ছুঁইতে হল না। এ সব সমীকরণকে একেবারে উড়িয়ে দেওয়া যায় না। আর জামায়াতকে না রাখলে সমস্যাটা কোথায়, তাও স্পষ্ট করা দরকার।

যে-কোনোভাবে জামায়াতকে যদি ভেঙে দেওয়া হয় বা এ পার্টিটাকে বিলুপ্ত করা হয়, তাহলে এর সুফল কোনোদিন আওয়ামী লীগ ঘরে তুলতে পারবে না। বরং জামায়াতি মানসিকতার লোক ও এর সমর্থকরা সব সময়ের জন্য এন্টি-আওয়ামী লীগ হয়ে যাবে। দ্বিতীয়ত, এরা যদি আন্ডারগ্রাউন্ডে চলে যায় বা চরমপন্থার আশ্রয় নেয়, তাহলে এর সকল ক্ষতি বর্তাবে আওয়ামী লীগের ঘাড়েই। তৃতীয়ত, বিএনপি জামায়াতের উপকার করুক বা না করুক, নানা সুবিধার প্রত্যাশায় তা বিএনপির ভোট ব্যাংক হিসাবেই রয়ে যাবে। সেখানে আওয়ামী লীগের আর কোনো আশাই বাকি থাকবে না।

তাই নিরাপদ ও সুদূরপ্রসারী লাভ হবে, একে নানা মামলায় জড়িয়ে ও শক্ত রশি পরিয়ে বশ মানানো। দেখা যাক, ভবিষ্যৎ কি বলে? ।


এর পর.....

অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।