আমাদের কথা খুঁজে নিন

   

রমনার রাতের স্টার বনাম লাক্স চ্যানেল আই সুপার স্টার ।।

টেক্সটাইল প্রকৌশলী হিসাবে কর্মরত । সেই মেয়েটার কথা বলি। বিশাল একটা ট্যুর দিয়ে বান্দরবন থেকে ফিরছি। চিটাগাং শহরে খুব দুঃসম্পর্কের এক রিলেটিভ আছে। তার বাসায় গেলাম।

তার একটাই মেয়ে- ভাল একটা কলেজে পড়ে- ইন্টারমিডিয়েট সেকেন্ড ইয়ারে। শ্যামলা গায়ের বর্ণ- কিন্তু বড় বড় মায়া কাড়া চোখ- মেয়েটাকে অনিন্দ্য সুন্দরী বলা যাবে না হয়তো কিন্তু বেশ আকর্ষণীয়। বাড়িতে বুয়েটের ভাইয়া এসেছে- আশা করলাম সে তার ক্লাসের কোন প্রবলেম দেখাবে, লেখাপড়া সংক্রান্ত কোন প্রশ্ন করবে। আমাকে দেখে তার প্রথম অভিব্যক্তি হলো- ইসস! বাইরে ঘুরে ঘুরে ভাইয়া কি কালো হয়ে গেছেন!তার মনে অনেক দুঃখ- সেই সব দুঃখ সে আমার সাথে শেয়ার করলো! কি সেই সব দুঃখ- পরীক্ষায় নাম্বার কম পেয়েছে? ফার্স্ট হতে পারে নি? স্যার বকেছে? না, তার দুঃখ হলো- বাসার সবাই এত ফর্সা, সে কেন শ্যামলা হলো! আমার ইন্টারে পড়ার সময় একটাই টার্গেট ছিলো কি করে বুয়েটে চান্স পাওয়া যাবে, যারা আরো উন্নত শ্রেণীর তারা হয়তো তখন স্বপ্ন দেখত এম আই টি হাভার্ডে পড়ার। তার জীবনের একটা টার্নিং পয়েন্টে, যে সময়ের উপর তার সমগ্র ভবিষ্যৎ নির্ভর করছে- সেই সময়ে সে ভাবছে কি করে তার চামড়াটা আরো সাদা করে ফেলা যায়! সে ভাবছে না কি করে আরো ভাল রেজাল্ট করা যায়, কি করে একজন বড় বিজ্ঞানী হওয়া যায়, ডাক্তার হওয়া যায়, লেখক কিংবা প্রকৌশলী হওয়া যায়! সে ভাবছে কি করে আরো সুন্দর হওয়া যায়! চামড়াটা আরো ফর্সা করা যায়।

কি ভাবছেন? অবাক হলেন? দাড়ান দাড়ান- আপনার জন্যে আরো বড় বিস্ময় অপেক্ষা করছে! এ বছর লাক্স-চ্যানেল আই সুপারস্টার প্রতিযোগিতায় অংশ নিতে গিয়ে আই বি এর ছাত্রত্ব হারিয়েছেন সোমা নামের এক মেয়ে। আই বি এ থেকে বহিষ্কারের বিনিময়ে তিনি নিঝের ঝুলিতে ভরতে পেরেছেন প্রথম পাচজনের মধ্যে অবস্থান, পেয়েছেন লাক্সের একটা বিজ্ঞাপনের কাজ করার সুযোগ। বাংলানিউজের অনুসন্ধানে জানা গেছে, সাদিয়া আর্জুমান্দ বানু সোমা ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ব্যবসায় প্রশাসন ইনস্টিটিউটের (আইবিএ) ১৮ ব্যাচের বিবিএর ছাত্রী। সোমার গ্রামের বাড়ি খুলনা সদরের মুন্সীপাড়ায়। ঢাকার আইডিয়াল স্কুল এন্ড কলেজ থেকে ২০০৭ সালে জিপিএ-৫ নিয়ে এসএসসি এবং ২০০৯ সালে জিপিএ-৫ নিয়ে এইচএসসি পাস করেন।

ভর্তি পরীক্ষায় যোগ্যতার প্রমাণ রেখে পরে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের আইবিএতে ভর্তি হন। কিন্তু বিশ্ববিদ্যালয়ের তৃতীয় বর্ষে এসে লাক্স-চ্যানেল আই সুপারস্টার প্রতিযোগিতায় টিকে গেলে তার নিয়মিত লেখাপড়ায় ব্যাঘাত ঘটতে থাকে। আইবিএর নিয়ম ভঙ্গ করায় শিক্ষা প্রতিষ্ঠানটি তাকে ড্রপ আউট হিসেবে চিহ্নিত করে নোটিশ দেয়। সোমা পুনরায় আইবিএতে ছাত্রত্ব রক্ষার আবেদন করলে কর্তৃপক্ষ তার আবেদন নাকচ করে। ফলে তার আইবিএ‘র বিবিএর ছাত্রত্ব হারায়।

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অন্যতম প্রেস্টিজিয়াস শিক্ষা কার্যক্রম থেকে সোমার এই মাঝপথে ঝড়ে পড়ার পেছনে দায়ী ওই সুপারস্টার প্রতিযোগিতা। সেই খবর নিয়ে ব্লগে আধখানা চাঁদ নামে একজনের কমেন্ট পড়ুনঃ যে ইউনিলিভারের সামান্য একটা রিয়েলিটি শো এর জন্য এত বড় ত্যাগ স্বীকার করল সোমা, আই বি এ থেকে পাস করলে এই ইউনিলিভার তাকে সালাম করে নিত এবং চাকরি দিত। আর সে হয়ত তখন নিজেই ইউনিলিভার থেকে এমন ফালতু রিয়েলিটি শো এরেঞ্জ করতে পারত। সোমা অনেক বড় বোকামি করল। হায়রে বাংলাদেশের অন্যতম সম্মানিত প্রতিষ্ঠান, লাখ লাখ ছাত্রছাত্রী যেখানে পড়ার স্বপ্নে বিভোর- সম্মান ও নিশ্চিত ভবিষ্যত ছেড়ে দিয়ে আসতে কি পরিমান ব্রেন ওয়াশের দরকার- কল্পনা করা যায়? এরকমই হবে।

যতদিন ফেয়ার এন্ড লাভলী আপনাকে সাতদিনে আরো ফরসা কর তোলার গ্যারান্টি দিয়ে ব্যবসা করে যাবে, যতদিন লাক্স ঘষলেই আপনি স্টার হয়ে যেতে পারবেন, যতদিন টিভিতে বিজ্ঞাপন আসবে অসুন্দর মেয়ের বিয়ে হয় না, তারা চাকরী পায় না, তারা অবলম্বন হতে পারে না- ততদিন এ ধারা চলতেই থাকবে। তাই কিনে আনুন লাক্স, গায়ে মাখুন পন্ডস- হয়ে যাবেন সাদার চেয়েও বেশি সাদা। শর্টস পড়ে সাদা চামড়া দেখিয়ে হেটে আসুন মঞ্চে- আধবুড়ো কিছু পারভার্টদের সামনে। তারা আপনাকে ঘুরে ঘুরে দেখবে। মঞ্চের সামনে দেখবে- পেছনে দেখবে, দিনে এবং রাতের অন্ধকারে দেখবে।

এই রকম অনেককে অনেক ভাবে আপনার ফর্সা শরীর দেখিয়ে আপনি হবেন স্টার। চোখ সামনে রেখে, বুক ফুলিয়ে, কোমর দুলিয়ে আপনি হেটে যাবেন- দর্শকরা আপনাকে কামনা করবে, সিটি বাজিয়ে উৎসাহ দেবে!- আপনি জানেন না দেশের জাতীয় পাখির নাম। আপনি দেখলে চিনতে পারেন না জাতীয় ফুল- কিন্তু তবুও আপনি স্টার। আপনি শোনেন নি লালনের নাম, পড়েন নি রবিঠাকুরের কোন কবিতা- তবু আপনি স্টার। রমনার প্রস্টিটিউটদের খদ্দের রিকশাওয়ালারা, তাদের রেট বিশ টাকা- তাদের কেউ স্টার বলে না।

কারন তাদের এই পেশায় নামতে একের পর এক চামড়া দেখিয়ে প্রতিযোগিতা করে বেড়াতে হয় নি। তাদের জোর করে এই পেশায় নামানো হয়েছে। তারা কেউ স্বেচ্ছায় আসে নি। কিন্তু আপনি স্বেচ্ছায় এসেছেন, এ জন্যে বছরের পর বছর ধরে আয়নায় দাঁড়িয়ে প্রাকটিস করেছেন, একের পর এক লাক্স ঘষেছেন, এই মেখেছেন, সেই মেখেছেন- তারপরে কত রাউন্ড পরীক্ষা দিয়ে আজ এখানে এসে দাঁড়িয়েছেন- আপনি তাই স্টার। প্রকাশ্যে হয়তো আপনি বছরে গোটা কয়েক বিজ্ঞাপন আর নাটক করবেন।

পেছনে হয়তো আপনি বড় বড় ব্যবসায়ীদের শয্যাসঙ্গিনী হবেন, তাদের সাথে ঘুরতে যাবেন থাইল্যান্ড, মালয়েশিয়া কিংবা সিংগাপুর। বি জি এম ই এর অনুষ্ঠানে অর্ধ নগ্ন হয়ে খেমটা নাচবেন। শেরাটনে অর্ধ-লক্ষ টাকা রেটে দেহ বিক্রি করবেন। এ জন্যেই হয়তো আপনি স্টার! আপনি আরো এগিয়ে যান, কর্পোরেট বেনিয়াদের কাছে নিজেকে তুলে দিন, পণ্যের মত বিক্রি করে দিন আপনার শরীরটাকে। আখের মত করে নিংড়ে তারা রস উপভোগ করুক, বিনিময়ে ছুড়ে দিক কিছু ডলার, যেমন মানুষ পোষা কুকুরের দিকে রুটি ছুড়ে দেয়- সেই ডলার কুড়িয়ে আপনি দামী পোশাক, গাড়ি আর ফ্লাট কিনুন! মেধা আর বুদ্ধি দিয়ে নয়, শিক্ষা আর প্রজ্ঞা দিয়ে নয়- শরীর দিয়ে হয়ে উঠুন অবলম্বন! আপনি হয়ে উঠুন স্টার, হয়ে উঠুন রোল মডেল- অল্প বয়েসী মেয়েরা আপনাদের ফলো করুক, বই দূরে ঠেলে টেনে নিক প্রসাধনের বক্স, সারাদেশ ভরে যাক নর্তকী আর উচ্চবিত্ত প্রস্টিটিউটে, আর অসুন্দর মেয়েগুলো জীবনটা কাটিয়ে দিক অবহেলায়! আমরা অশিক্ষিত থাকি, আমরা নির্বোধ থাকি- তাও আমাদের হট হতে হবে, সেক্সি হতে হবে।

যেদিন এই দেশের প্রত্যেকের চামড়া সাদা, প্রতিটা মেয়ে হট, সেক্সি এবং হর্নি, প্রতিটা ছেলে সিক্সপ্যাক-ম্যাচো হবে সেদিন আমরা সবাই না খেয়ে মরে গেলেও নিজেদেরকে আধুনিক এবং উন্নত বলে দাবি করতে পারবো! আমরা আপনাদের দিকে তাকিয়ে সেই দিনের প্রত্যাশায় আছি! স্বপ্নের দেশ আমেরিকায় অনেক কালো নিগ্রো মার্সিডিজে চড়ে, আর অনেক সাদা চামড়া ভিক্ষা করে। করুক- তাও আমরা মার্সিডিজে চড়া কালো না হয়ে পথের পাশের সাদা ভিকিরি হতেই চাই। আমরা জাতি গত ভাবে কালোফোবিয়ায় আক্রান্ত হয়ে আছি, আমাদের চিকিৎসা করবে কে? যতদিন আমরা মানুষের বাইরের সৌন্দর্যকে তার ভেতরের সৌন্দর্য থেকে বড় করে দেখবো, যতদিন উচ্চ শিক্ষিত এবং মেধাবী একটা ছেলে বা মেয়ের তুলনায় ৩৬-২৪-৩৬ ফিগারের কোন নির্বোধ সুন্দরী কিংবা কোন এক উচ্ছৃঙ্খল ম্যাচো সিক্স প্যাকের ছেলে আমাদের কাছে বেশি আদরণীয় হবে যতদিন- ততদিন আমরা নিজেদের সভ্য বলে দাবি করতে পারব না। আমরা মধ্যযুগীয় বর্বরই থেকে যাবো! আর ততদিন এইসব কর্পোরেট বেনিয়াগুলো আমাদের সাদা চামড়ার লোভ দেখিয়ে লাখ লাখ টাকা ব্যবসা করে যাবে। তাদের এই রেসিজমের কোন সাজা হবে না, কেউ প্রশ্ন তুলবে না গায়ের রঙ কালো হলে তাকে নিন্দে করা রেসিজম জেনেও তারা বছরের পর বছর কেন এই সব বিজ্ঞাপন দেখিয়েছে, সরকার কেনই বা তাদের বাধা দেয় নি! এইভাবে এইসব নষ্টরা দখল করে নিচ্ছে সব কিছু- আমি জানি সব কিছু নষ্টদের অধিকারে যাবে।

সবচে সুন্দর মেয়ে দুইহাতে টেনে সারারাতচুষবে নষ্টের লিঙ্গ; লম্পটের অশ্লীল উরুতেগাঁথা থাকবে অপার্থিব সৌন্দর্যের দেবী। চ’লে যাবে,কিশোরীরা চ’লে যাবে, আমাদের তীব্র প্রেমিকারাওষ্ঠ আর আলিঙ্গন ঘৃণা ক’রে চ’লে যাবে, নষ্টদেরউপপত্নী হবে। এই সব গ্রন্থ শ্লোক মুদ্রাযন্ত্রশিশির বেহালা ধান রাজনীতি দোয়েলের স্বরগদ্য পদ্য আমার সমস্ত ছাত্রী মার্ক্স-লেনিন,আর বাঙলার বনের মত আমার শ্যামল কন্যা-রাহুগ্রস্থ সভ্যতার অবশিষ্ট সামান্য আলোক-আমি জানি তারা সব নষ্টদের অধিকারে যাবে। (হুমায়ুন আজাদ) একটা মানুষের সৌন্দর্য কখনো শুধুমাত্র তার গায়ের বর্ণে নির্ধারিত হতে পারে না। আর তেমনি একটা মানুষের যোগ্যতা পারেনা তার সৌন্দর্য দিয়ে নির্ধারিত হতে।

সৌন্দর্য নশ্বর, একটু বয়স হলেই চলে যায়। কিন্তু তার অর্জিত জ্ঞান, তার বিচার বিবেচনা, তার যুক্তিবোধ, তার প্রাজ্ঞতা- বিচক্ষণতা, তার মূল্যবোধ এগুলো নশ্বর নয়, এগুলো বয়সের সাথে সাথে বাড়ে। এগুলোই তাকে মানুষ করে তোলে। যে ছেলেগুলো বা মেয়েগুলো নিজেদের রূপ নিয়ে দুশ্চিন্তায় ভোগে তাদের জন্যে করুনা অনুভব করা ছাড়া আর কিইবা করার আছে? এ দেশে সবচেয়ে সস্তা হচ্ছে নারীর শরীর, দু বেলা খাওয়ার টাকা দিয়েই সারারাতের জন্যে একটা সুন্দর শরীরের জোগাড় হয়ে যায়। কিন্তু মেয়েগুলো কি বোঝে? স্বয়ং ভার্সিটি পড়ুয়া মেয়েদের মাঝেই রূপ নিয়ে যে ধরনের অহংকার, সুপিরিয়রটি/ইনফিরিয়রিটি কমপ্লেক্স দেখি তাতে অবাক হই।

সে কি জানে তার চেয়ে অনেক সুন্দর একটা শরীর সামান্য কয়েক হাজার টাকায় পাওয়া যায়। সে যদি শরীর সর্বস্ব হয়, তার চিন্তা যদি শুধু নিজের শারীরিক সৌন্দর্যকে কেন্দ্র করে ঘুরতে থাকে তাহলে সে খুবই সস্তা। কিন্তু তার যোগ্যতা, গুণাবলী, মনুষ্যত্ব, রুচি-বোধ এগুলো অমূল্য- টাকা দিয়ে কেউ কেনার দুঃসাহস করবে না। তার উচিত নিজেকে উন্নত করা, বিকশিত করা- শুধু শরীরটাকে নয়। মানুষ অমূল্য- শরীরের মূল্য খুবই সামান্য! যদি কেউ সুন্দর শরীরের অধিকারী হয়ে জন্মায় সেটা একটা বোনাস- কিন্তু তাকে সেটা পূঁজি করেই বসে থাকলে চলবে না।

শিক্ষা-জ্ঞান ও গরিমায় অপরকে ছাড়িয়ে যাবার লড়াই চালিয়ে যেতে হবে। যদি অনন্ত জনম থাকতো প্রতিবারই আমি বুদ্ধিমান- মেধাবী- জ্ঞানী হয়ে জন্মাতে চাইতাম-হোক কুদর্শন তাও নির্বোধ সুন্দর হয়ে নয়! collected from .. মিজানুর রহমান পলাশ নজরুল ইসলাম হল বুয়েট, ঢাকা। ।

অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।