আমাদের কথা খুঁজে নিন

   

তীব্র ভালবাসার অন্ধত্ব ও পক্ষপাতিত্ব

আমি দলে যাই যত বন্ধন, যত নিয়ম কানুন শৃঙ্খল ছোটকালে দেখেছি কিছু কিছু অভিভাবক তাদের সন্তানদের স্কুলে দিয়ে যেতে নিজেরাই আসতেন। তাঁরা কেমন বিরক্তির চোখে দেখতেন আমাদের; আমরা যারা ঐ মুহূর্তে অভিভাবকহীন, স্কুলের বেঞ্চিতে বসে, যারা একাই চলে এসেছি স্কুলে কিংবা মা-বাবারা দিয়ে চলে গেছেন। ঐ অভিভাবকরা তাদের সন্তানদের নিয়ে এসেই চলে যেতেন না। কক্ষের ফার্স্ট বেঞ্চে নিজের ছেলে বা মেয়েকে বসানোর জন্য রীতিমত তোরজোড় শুরু করে দিতেন। যে সময়ের কথা বলছি, আমি তখন টু কি থ্রি’তে পড়ি।

সুতরাং যাদের সাথে সেই ভদ্রলোক বা ভদ্র মহিলা-গুলো নিজেদের বাচ্চাকে ফার্স্ট বেঞ্চে বসানোর জন্য যুঝতেন, তারা ছিল শিশু। এই কাজ তারা করতেন স্কুল-ঘণ্টা শুরু হওয়ার আগে, শিক্ষক-শিক্ষিকা’দের অলক্ষ্যে। আসলে যুঝা ঠিক নয়, তাঁরা ধমকে, ভুলিয়ে-ভালিয়ে, কখনও বল প্রয়োগ করে অন্য বাচ্চাদের উঠিয়ে দিয়ে নিজেরটাকে বসাতেন। আমি তাদের প্রচণ্ড ঘৃণা করতাম। খুব ভয়ও করতাম কারণ তাদের চোখে আমাদের জন্য ছিল তীব্র বিরক্তি আর স্বার্থ লাভের একটা বিজাতীয় অস্থিরতা।

তারা হয়ত ভাবতেন, কেন এই শয়তানগুলা ফার্স্ট বেঞ্চে সিট দখল করে বসে আছে? কেন এমন নয় যে আমার সন্তান ফার্স্ট বেঞ্চে বসে শিক্ষকদের বেশি কাছে থাকবে আর এইসব থাকবে পেছনের বেঞ্চিতে। কেন এমন নয় যে শুধু আমার ছেলেটা/মেয়েটাই ফার্স্ট হবে আর এইসব হাবিজাবি বাচ্চাকাচ্চা হবে লাস্ট! তাদের এই নিজেদের সন্তান’দের জন্য কুৎসিত পক্ষপাত আমার ভেতরে খুব বিশ্রী এক অনুভূতির জন্ম দিত। মনে মনে ভাবতাম আমাকেও’তো আমার বাবা-মা ভালবাসেন। তবে এদের আচরণে কেন মনে হয় আমি অনাহুত আর শুধু ওনার সন্তানরাই স্বাগত; অগ্রাধিকার পাওয়ার যোগ্য? এখন বুঝি যে ঐ অনুভূতিটা ছিল অস্তিত্ব-সঙ্কট। ঐ অভিভাবকরা জানতেন না যে নিজের সন্তানটিকে বেশি সুবিধা পাইয়ে দিতে গিয়ে অন্যান্য শিশুদের মনে তারা তীব্র অস্তিত্ব-সঙ্কটের জন্ম দেওয়ার মত গুরুতর অন্যায় করছিলেন।

তাদের সন্তানদের জন্য তীব্র ভালবাসা, পক্ষপাতিত্ব তাদের তা বুঝতে দেয়নি। পরবর্তীতে স্কুল কর্তৃপক্ষ অভিভাবকদের স্কুলের ভেতর ঢোকা নিষিদ্ধ করে দিয়েছিলেন। এ ধরনের বিশ্রী পক্ষপাত এখনও বিদ্যমান; বিভিন্ন ক্ষেত্রে, বাস্তবতায়, বিভিন্ন মাত্রায়। আমরা নিজেদের সন্তানদের ভালবাসতে গিয়ে ভুলে যাই আমার সন্তানের অধিকতর সুবিধার বিশেষ ব্যবস্থায় ক্ষতিগ্রস্ত যে হতে পারে, সে একটি শিশুই। তারও আমার সন্তানটির মতই সমান অধিকার আছে বাঁচার, শিক্ষা পাওয়ার, ভালবাসা পাওয়ার।

ঠিক একইভাবে বিভিন্ন পরিসরে এই বিশ্রী পক্ষপাতিত্ব বিভিন্ন রূপে সেজে-গুজে আসে আমাদের মাঝে। কখনও আসে স্বজনপ্রীতি হয়ে, কখনও অঞ্চল প্রীতি হয়ে। তারপর জাতীয়তাবাদ’তো আছেই। পক্ষপাত হতে পারে ভাষা-গত অনন্যতার কারণে, হতে পারে চামড়ার রঙের কারণে, হতে পারে জাতিগত ভিন্নতার কারণে। দেশপ্রেম হল দেশের সমগ্র দেশের মানুষের জন্য ভালবাসা, প্রেম।

দেশপ্রেম হল দেশের মানুষের মৌলিক অধিকার রক্ষার সচেতনতা। দেশের উন্নয়ন-চিন্তা ও পদক্ষেপে অবশ্যই থাকবে ন্যায্য প্রতিযোগিতার মানসিকতা। কিন্তু তা যদি পক্ষপাতিত্ব হয়, তা যদি ভারতীয়দের প্রতি ঘৃণা, মায়ানমারের জনগণের প্রতি বিদ্বেষ, আফগান বিতৃষ্ণায় গিয়ে ঠেকে আর তার কারণ হয়ে থাকে "আমার দেশ সবার চেয়ে সেরা" টাইপের অবান্তর বোধ, তবে তা দেশপ্রেম নয়, তা জঘন্যতা, স্বার্থপরতা, নীচতা, পক্ষপাতিত্ব, স্বাজাতিকতা বা রেসিজম। ।

সোর্স: http://www.somewhereinblog.net     দেখা হয়েছে বার

অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।