আমাদের কথা খুঁজে নিন

   

গন্তব্যঃ লাল দরজা

মিথ্যেবাদী নই, প্রেমিক আমি ! এই শহরটা আর দশটা সাধারন শহরের মত নয়। রাস্তা ঘাটে অতিরিক্ত যানবাহনের ভিড় নেই, বাতাসে কাল ধোঁয়া নেই, মাছের বাজারের মত উচ্চ শব্দের হই চই নেই, চোর-বাটপার বা সন্ত্রাসীদের উৎপাত খুবই কম, সব মিলিয়ে একটা আদর্শ শহরের যা যা গুণাবলী থাকা প্রয়োজন তার সবই এখানে বিদ্যমান। তবে কিছু একটা জিনিসের বড় অভাব আছে এখানে। শহরের প্রত্যেকটা মানুষকে মনে হয় দিশেহারা। সবাই যেন নিজের গন্তব্য ভুলে গেছে! আমি এই শহরের একজন পাহারাদার।

পাহারাদার উপাধিটা অবশ্য আমার নিজের দেয়া। প্রাতিষ্ঠানিক একটা পদবী যদিও আমার আছে- পুলিশ ইন্সপেক্টর! কিন্তু এই পদবীটা আমার পছন্দ নয়। তাই নিজেকে পাহারাদার হিসেবে ভাবি। একটা আদর্শ শহরের একজন আদর্শ পাহারাদার। আমার জীবনটা সব সময় একটা নির্দিষ্ট ছকে বাঁধা।

প্রত্যেকটা দিন একই ভাবে শুরু হয়, সারাটা দিন একটা নির্দিষ্ট রুটিন মেনে চলতে হয়, দিনটা শেষও হয় একই ভাবে। মাঝে মাঝে দু-একটা ব্যতিক্রমি ঘটনার মুখোমুখি হতে হয় অবশ্য। কিন্তু সেগুলো উল্লেখ্য করার মত তেমন কিছু নয়। তবুও এইসব দিনগুলো আমার বেশ ভাল লাগে। প্রচণ্ড একঘেয়েমির মাঝে একটু আনন্দের খোঁড়াক খুজে পাই।

আমার কাছে একটা জিনিস পরিষ্কার হয়ে গেছে যে পুলিশের চাকরীতে জয়-পরাজয় বলতে কিছুই নেই। আছে শুধু প্রচণ্ড একটা যুদ্ধ। এই যুদ্ধ কখনও শেষ হয়না। চাকরীতে জয়েন করার পর মুহূর্ত থেকে রিটায়ার্ড করার আগ মুহূর্ত পর্যন্ত অনবরত যুদ্ধ করে যেতে হয়। এই অন্তহীন যুদ্ধে আমরা কখনও জয়ী হতে পারিনা।

আমরা একটা উদ্দেশ্যহীন পথের পথিক। আর এই পথ যখন একা চলতে হয়, তখন ভয় লাগে। ভীষণ ভয়! আমার সারাদিনের কর্মসূচীতে সর্বশেষে যে কাজটি করতে হয় তা হল টহল দেয়া। রাতে দু ঘণ্টা আমি একটা মটর সাইকেলে চেপে শহরের বিভিন্ন অলি গলি ঘুরি। কোথাও কোনও সন্ত্রাসী কার্যকলাপ হচ্ছে কিনা, কোনও অপরাধ সংঘটিত হচ্ছে কিনা, আইন শৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর কেউ ডিউটিতে ফাঁকি দিচ্ছে কিনা এসব বিষয় অবলোকন করতে।

আগেই বলেছি যে এটি একটি আদর্শ শহর। তাই বলা বাহুল্য যে এ ধরনের কিছু খুব একটা চোখে পড়েনা। এরপর দু ঘণ্টা বাদে কোনও রকম একটা দায়সারা রিপোর্ট করতে হয়। তারপরই আমার ছুটি। আজকের রাতে টহল দেয়ার কাজটা বিরক্তিকর লাগছে! রাস্তার পাশে একটা চায়ের দোকান দেখে বাইক থামালাম।

আমি যে বিশাল চা-প্রেমিক তা নয়। তবে ইদানীং রাস্তার পাশের দোকান থেকে সস্তা চা খাওয়ার একটা বাতিক হয়েছে আমার! চায়ে চুমুক দিয়ে মনে হল অমৃত খাচ্ছি! চা টা অসাধারন হয়েছে। এটা ভাল লক্ষন। মনে হচ্ছে আজ ব্যতিক্রমি কিছু ঘটবে। দেখা যাক! চায়ে চুমুক দেয়ার ফাঁকে ব্যানসনে সুখটান! আহ, জীবনের সব মানেই যেন এখানে।

সিগারেট ফুঁকতে ফুঁকতে লোকটাকে লক্ষ করলাম। অদ্ভুত পোশাক পরে আছে। হাঁটু পর্যন্ত লম্বা ওভারকোট, মাথায় ব্যানানা হ্যাট, গলায় মাফলার, পায়ে গামবুট। লোকটার হাতে বেশ কিছু লিফলেট। সামনে যাকে পাচ্ছে তার হাতেই একটা করে লিফলেট ধরিয়ে দিচ্ছে।

বিলাতে বিলাতে একসময় লোকটা আমার সামনে এসে থামল। একটা কাগজ আমার হাতেও ধরিয়ে দিল। আমি কাছ থেকে লোকটার চেহারা দেখার চেষ্টা করলাম। কিন্তু খুব বেশি বোঝা গেলনা। বড় আকৃতির সানগ্লাস তার মুখের অনেকটা ঢেকে রেখেছে।

কোন ধরনের পাগল এই রাতের বেলা সানগ্লাস চোখে ঘুরতে পারে! লোকটা সামনের দিকে এগিয়ে গেল। আমি দেখলাম লোকজন কেউই লিফলেটটা গুরুত্বের সাথে দেখছে না! কেউ কেউ না দেখেই ফেলে দিচ্ছে, কেউ কেউ পড়ার পর বিরক্ত হয়ে দুমড়ে মুচড়ে ছুড়ে ফেলছে! কি লেখা আছে এতে কে জানে! আমি হাতে লিফলেটের দিকে তাকানর আগে সিগারেটটা শেষ করে নিলাম। তারপর তাকালাম। আরে! অদ্ভুত ব্যাপার! লিফলেটে বড় করে লেখা আছেঃ “!!!লাল দরজা!!!” কি মানে এর? আমি তো কিছু ভেবে পাচ্ছিনা! অদ্ভুত পোশাক পড়া লোকটা একটা অদ্ভুত লিফলেট হাতে ধরিয়ে দিয়ে সটকে পড়েছে। লাল দরজা লেখাটা সবার কাছে গুরুত্বহীন পাগলের প্রলাপ মনে হলেও আমার কাছে ইন্টারেস্টিং মনে হচ্ছে।

এর অর্থ বের করা দরকার। আমি পিছনে ফিরে দেখলাম লোকটা ততক্ষনে হাওয়া হয়ে গেছে। আমি চা-সিগারেটের বিল মিটিয়ে বাইক স্টার্ট দিলাম। একটানে রাস্তার মাথায় চলে এলাম। কিন্তু কোথাও লোকটার হদিস মিলল না।

ব্যাপার কি? কোথায় উধাও হল? আমি লোকটাকে খুজে বের করার সিদ্ধান্ত নিলাম। এভাবে একটা কাগজ হাতে ধরিয়ে দিয়ে ধাঁধায় ফেলে রেখে হাওয়া হয়ে যাবে তা হবেনা! আমি শহরের সব চেনা অলি গলি ঢুঁ মারতে থাকলাম। কিন্তু কোথাও অদ্ভুত লোকটার দেখা মিলল না। একটা সময় ক্লান্ত হয়ে পড়লাম। অনেক রাত হয়েছে।

রাস্তা ঘাট ফাঁকা হয়ে গেছে। বিল্ডিংগুলোয় আলো জ্বলছে না, দোকান পাট প্রায় সবই বন্ধ, রাস্তায় পথচারী নেই বললেই চলে। একটা গলির মাথায় একজন বৃদ্ধ লোককে বসে থাকতে দেখলাম। চেহারার মাঝে একটা দার্শনিক দার্শনিক ভাব আছে। লোকটা ফুটপাতে আরাম করে বসে ঝিমচ্ছে।

আমি এগিয়ে গেলাম। নরম কণ্ঠে বললাম, “কি ব্যাপার চাচা? বসে আছেন কেন? আপনার কি কোনও সাহায্য দরকার?” বৃদ্ধ মানুষটা একটু হাসল। কোনও উত্তর দিল না। “হাসছেন কেন? আমি কি বলছি আপনি কি বুঝতে পারছেন না? আপনি কি কোনও সমস্যায় পড়েছেন? আপনার কি কোনও সাহায্য দরকার?” এইবার লোকটা কথা বলে উঠল। গুরুগম্ভীর কণ্ঠস্বর।

“যার নিজেরই সাহায্য দরকার, সে আমাকে কি সাহায্য করবে?” আমি অবাক হলাম, “কি বলছেন আপনি? আমার সাহায্য দরকার হবে কেন?” “পাহারাদার! তুমি কোনও বিরাট ধাঁধায় পরে পথ হারিয়ে বসে আছ!” এবার আরও অবাক হওয়ার পালা! নিজের দেয়া পাহারাদার উপাধিটা আমি কারও সামনে উচ্চারন করিনা। কিন্তু এই লোকটা তা জানল কি করে? আমি কণ্ঠ স্বাভাবিক রাখার চেষ্টা করলাম। “ঠিক বলেছেন চাচা। কিন্তু আপনি জানলেন কি করে?” “তোমার মুখ দেখেই বোঝা যাচ্ছে। তোমার যদি কোনও সাহায্যের প্রয়োজন হয় তাহলে আমায় বলতে পার”।

“হ্যাঁ আমার সাহায্য দরকার। আমি একটা লাল দরজার সন্ধান করছি। আপনি কি আমাকে বলতে কোথায় গেলে লাল দরজার সন্ধান পাব?” লোকটা আবার হাসল। “মনের চোখে যদি তাকিয়ে দেখ তাহলে সারা দুনিয়ার সব দরজাই তোমার কাছে লাল দরজা মনে হবে”! “কিন্তু আমি মনের চোখে লাল দরজা দেখতে চাচ্ছি না! আমি বাস্তবের লাল দরজার সন্ধান করছি”। “তুমি যখন মনের চোখে দেখা শিখবে তখন বাস্তবে দেখা আর মনের চোখে দেখার মাঝে তুমি কোনও তফাৎ পাবেনা”।

“আপনার হেঁয়ালিপূর্ণ কথাবার্তা আমাকে আরও ধাঁধায় ফেলে দিচ্ছে! আমি দিশেহারা হয়ে পড়ছি!” “এইতো! এবার মনে হচ্ছে তুমি পারবে! একটু চেষ্টা করে দেখ, আমার পিছনে যে বাড়িটা আছে ওতে ঢুকে পর। দেখত কোনও লাল দরজা তোমার চোখে পড়ে কিনা!” আমি কথামত কাজ করলাম। বাড়িটার সদর দরজা পেরিয়ে ভেতর ঢুকে পড়লাম। ভেতরের কেচি গেট খোলাই ছিল। কিন্তু সিঁড়িঘরের কাছটা ভীষণ অন্ধকার।

কোনও লাল দরজা থাকলেও তা বুঝার উপায় নেই। এসময় দোতলা থেকে একটা মেয়েলী কণ্ঠের চিৎকার শুনতে পেলাম। কেউ মনে হয় কাঁদছে। আমি সিঁড়ি দিয়ে দৌড়ে উঠলাম। দোতালায় উঠেই প্রথমে আমার নজরে এল একটা আধ খোলা দরজা।

ভেতর থেকে হালকা আলো আসছে এবং সেই আলোতে আমি দেখতে পেলাম, দরজার রং লাল! আমি ধাক্কা দিয়ে ভেতরে ঢুকে পড়লাম। এটা একটা বসার ঘর। শোয়ার ঘরে আলো জ্বলছে! ওদিক থেকেই একটা মেয়ের কান্নার আওয়াজ আসছে। আমি হুড়মুড় করে ভেতরে ঢুকে পড়লাম। যে দৃশ্যটা চোখে পড়ল তা অত্যন্ত করুন।

একজন বয়স্ক পুরুষ বিছানায় পড়ে আছে, পাশে বসে একটা অল্প বয়সী মেয়ে কাঁদছে। খুব সম্ভবত লোকটা মারা গেছে। আমি বিছানার পাশে এগিয়ে গেলাম। মেয়েটি আমার দিকে তাকাল। তার চোখ দুটিতে গভীর অসহায়ত্ব ফুটে উঠেছে।

আমি জিজ্ঞেস করলাম, “কি হয়েছে ওনার?” মেয়েটি কান্না জড়ান বলে উঠল, “আমাকে একটু সাহায্য করুন প্লিজ! আমার বাবা হঠাৎ অসুস্থ হয়ে পড়েছেন। বাবার কিছু হলে আমি কার কাছে যাব? এই শহরে আমার বাবা ছাড়া আর কেউ নেই”। আমার কাছে মনে হচ্ছে মেয়েটির বাবা ইতিমদ্ধে মারা গেছে। কিন্তু সে কথা মেয়েটিকে বললাম না। দেহটা দু হাতে পাজকোলা করে তুলে নিলাম।

“চল তোমার বাবাকে হাসপাতালে নিয়ে যাই”। এর পর সব কিছু কেমন যেন একটা ঘোর লাগা অবস্থায় কাটল। হাসপাতালে পৌঁছানোর পর ডাক্তার বললেন উনি ইতিমদ্ধে মারা গেছেন। এর পর শুরু হল মেয়েটির একটানা চিৎকার। সারা রাত মেয়েটি বাবার লাশের পাশে বসে কাঁদল।

কয়েকবার চেষ্টা করলাম তাকে সান্ত্বনা দেয়ার। কিন্তু এসব বিষয় আমার দ্বারা হয়না। তাই পাশে বসে বসে মেয়েটির কান্না দেখা ছাড়া আর কিছুই করার থাকল না আমার। বয়স কত হবে মেয়েটির? ১৭? ১৮? ১৯ অথবা ২০ও হতে পারে! অদ্ভুত সুন্দরী সে! এই শহরের অন্যান্য মেয়েরা নিশ্চয়ই তাকে দেখলে হিংসা বোধ করে। মেয়েটি কান্নার ফাঁকে ফাঁকে কিছু কথা বলল।

তা থেকে বুঝতে পারলাম মেয়েটির নাম পল্লবী। বাবার নাম সুভাষ দত্ত। মা মারা গেছেন অনেক আগেই। খুব বেশি নিকট আত্মীয় নেই তার। বাবা সরকারি চাকরি করতেন।

কিছুদিন আগে শহর থেকে বদলি হয়ে এই শহরে এসেছেন। দেশের বাড়িতে জমি জমা, বাড়ি ঘড় কিছুই নেই। এই শহরে মেয়েটি আমার মত সম্পূর্ণ একা। আমি বুঝতে পারলাম পল্লবীর বাবার মৃত দেহ সৎকারের সব ব্যবস্থা আমাকেই করতে হবে। পরের দিনটা খুব দৌড়া দৌড়ির মাঝে কাটল।

হিন্দু নিয়মে মৃত দেহ সৎকার করা সহজ কথা নয়। পল্লবী মেয়ে হওয়াতে ওর বাবার মুখাগ্নি আমাকেই করতে হল। দিন শেষে পল্লবীকে তার বাসায় পৌছে দিচ্ছি আমার বাইকে করে। পেছন থেকে মেয়েটি আমার কাধ ধরে রেখেছে। ঘাড়ের ওপর তার তপ্ত নিঃশ্বাস পড়ছে।

কিছু অবাধ্য চুল উরে এসে আমার চোখে মুখে ঝাঁপটা মারছে। আমার দম বন্ধ হয়ে আসছে। কেমন যেন একটা অনুভুতির সৃষ্টি হয়েছে আমার মাঝে। এই অনুভুতি আমার কাছে সম্পূর্ণ অপরিচিত। তবে এই অনুভুতির নাম জানা আছে- প্রেম।

শহরের রাস্তাগুলোর এক একটা বাঁক পেরিয়ে যাচ্ছি আর একটু একটু করে মনের ভেতর মেঘ জমছে। আর একটু পরই মেয়েটির সঙ্গ ত্যাগ করতে হবে আমাকে। আমি কি মনের কথাটা ওকে বলে দেব? আমি জানি এ কথা বলার জন্য এটা সঠিক সময় না। হতে পারে এটা সঠিক সময় না কিন্তু এটাই শেষ সুযোগ। পল্লবীকে নিয়ে তার বাসায় এলাম।

লক্ষ করলাম মেয়েটির দু চোখে এখনও অশ্রু জমে আছে। “তুমি এখনও কাদছ কেন? তুমি কি বুঝতে পারছ না যা হারিয়ে ফেলেছ তা আর ফিরে পাবেনা! এখন তোমাকে নতুন করে পথ চলার কথা ভাবতে হবে!” মেয়েটি ধরা গলায় বলল, “আমার এ কান্না কখনও থামবে না। আমি একটা স্বপ্নে ভরা সুন্দর জীবনের পথ চলা শুরু করেছিলাম। কিন্তু সেই পথে হঠাৎ করেই থেমে যেতে হল”। আমি যা বলতে চাইছিলাম সেই কথাটি এবার সাহস করে বলেই ফেললাম।

“দেখ, আমি এমন একটা পথে চলতে শুরু করেছি যে পথের কোনও শেষ নেই। যদি তুমি নিজের চলার পথ আমার পথের সাথে মিলিয়ে নাও, তাহলে হয়ত তুমি আবার পথ চলার সাহস পাবে আর আমিও হয়ত নিজের পথ চলার একটা উদ্দেশ্য খুঁজে পাব!” পল্লবী চুপ করে থাকল। আমি তার চোখের ভাষা পড়ার চেষ্টা করছি। এ ভাষা সবাই পড়তে পারেনা। আমিও পারছি না।

বড়ই দুর্বোধ্য। আমি আবার বললাম, “জানি এ কথা বলার সঠিক সময় এটা না। কিন্তু আমি ভয় পাচ্ছি খুব। হয়ত আর কখনও এ কথা বলার সুযোগ পাবনা। তোমার সাথে পরিচয় হয়েছে ২৪ ঘণ্টাও হয়নি।

এর মধ্যে তোমাকে আমার নিজের একটা অংশ বলে মনে হচ্ছে। আমি তোমাকে হারাতে ভয় পাচ্ছি মেয়ে!” পল্লবী নিরবে তাকিয়ে আছে শুধু। আমি বলে চলেছি, “আমি বুঝতে পারছি আমার প্রেম নিবেদন করা তোমার কাছে হাস্যকর ঠেকছে। আমি আসলে জানিনা কীভাবে প্রস্তাব দিতে হয়। শুধু একটা কথা বলি তোমাকে- একা একা পথ চলতে আমার খুব ভয় হয়।

তুমি কি আমার পথ চলার সঙ্গী হবে?” পল্লবী মুখে কিছু বলল না। শুধু উপরে নিচে মাথা ঝাঁকাল। আমি মৃদু হাসলাম। হাত বাড়িয়ে মেয়েটির একটা গাল স্পর্শ করলাম। সে আমাকে দুহাতে আঁকড়ে ধরল।

আমি তার চুলে হাত বুলিয়ে দিতে থাকলাম। মুখে বললাম, “তুমি এদিকে সব কিছু গুছিয়ে নাও। আমি খুব শীঘ্রই তোমাকে নিতে আসব”। বিদায় নিয়ে পল্লবীর ফ্ল্যাট থেকে বেরিয়ে এলাম। আজ থেকে জীবনটা আর অর্থহীন মনে হবে না।

এই প্রথম একটা উদ্দেশ্য দেখতে পাচ্ছি নিজের পথ চলার। অবশেষে আমি আমার গন্তব্য খুঁজে পেয়েছি। এখন আর পথ চলতে ভয় করবে না। হঠাৎ পাশের ফ্ল্যাটের দিকে নজর পড়তেই আমি আঁতকে উঠলাম। পাশের ফ্ল্যাটের দরজার রংও লাল! ওহ মাই গড।

এটা আমি কি দেখছি? দৌড়ে নিচে নামলাম। যা ভয় পেয়েছিলাম ঠিক তাই! নিচের তালার দুটো ফ্ল্যাটেরই দরজার রং লাল! সেই রাতে অন্ধকারের কারনে আমি বুঝতে পারিনি তা। আর কিছুক্ষণের মাঝে আবিষ্কার করলাম এই পাঁচতলা বিল্ডিংটার সব ফ্ল্যাটের দরজার রং লাল! তবে কি আমি ভুল ঠিকানায় চলে এলাম? আমি যে লাল দরজা খুজছিলাম তা আসলে কোনটা? ঐ অদ্ভুত পোশাক পরা লোকটা আসলে কোন দরজার লিফলেট বিলি করছে? বাকিটা সময় চিন্তার ভেতর কাটল আমার। ছোট একটা ধাঁধার সমাধান করতে গিয়ে আমি বিরাট আরেক ধাঁধার ভেতর পড়ে গেছি। সব প্রশ্নের উত্তর পাওয়া যাবে যদি আর একবার ঐ অদ্ভুত পোশাক পড়া লোকটার দেখা পাই।

রাতের বেলা আবার বের হলাম আমি শহরের অলি গলিতে টহল দেয়ার জন্য। অন্যান্যদিন এই সময়টা উদ্দেশ্যহীন ভাবে ঘুরে বেড়াতাম। কিন্তু আজ একটা উদ্দেশ্য আছে আমার। ঐ লোকটাকে খুঁজছি আমি। এই লাল দরজা ধাঁধার সমাধান না হওয়া পর্যন্ত আমি স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেলতে পারছি না।

অনেকক্ষণ ঘুরা ঘুরি করেও আমি লোকটার দেখা পেলাম না। কিন্তু অন্য একজনের দেখা পেয়ে গেলাম। সেই দার্শনিক চেহারার বৃদ্ধ মানুষটি আজও একটা গলির মাথায় ঝিম মেরে বসে আছেন। আমি এগিয়ে গেলাম তার সামনে। আমাকে দেখে সেদিনের মত আজও একটু হাসলেন তিনি।

বললেন, “কি ব্যাপার হে পাহারাদার? তুমি তো তোমার লাল দরজা খুঁজে পেয়েছ। আজ আবার কিসের সন্ধানে বের হয়েছ?” আমিও হাসলাম। “হ্যাঁ...খুঁজে পেয়েছি। কিন্তু আজ আমি সেই লাল দরজার সন্ধানদাতার খোঁজ করছি। আপনি কি এদিকে আজ কোনও অদ্ভুত পোশাক পরা লোককে দেখেছেন?” বৃদ্ধ মানুষটি আবার হাসলেন।

“হাসালে! তোমাকে তো সেদিনই বললাম, মনের চোখে সব দেখার চেষ্টা কর। যে পোশাক তোমার কাছে অদ্ভুত মনে হয়, হয়ত সে পোশাক পরা মানুষটার কাছে ওটাই স্বাভাবিক পোশাক! এভাবে চিন্তা করলে আমাদের সবার পোশাকই কারও না কারও কাছে অদ্ভুত পোশাক বলে মনে হবে। মনের চোখে দেখ, পাহারাদার! মনের চোখে দেখ”। কীভাবে মনের চোখে দেখতে হয় আমি জানিনা। তারপরও চেষ্টা করলাম গভীর ভাবে আশে পাশের সব কিছু দেখতে এবং আমি সেই লোকটাকে দেখতে পেলাম।

ব্যানানা হ্যাট, ওভারকোট, মাফলার, গামবুট আর সানগ্লাস- ঐ লোকটাই! আমি এগিয়ে গেলাম সেদিকে। আজ লোকটার হাতে কিছু লিফলেট। সে রাস্তায় যাকে পাচ্ছে তার হাতেই একটা করে লিফলেট ধরিয়ে দিচ্ছে। আমার সামনে এসে আমার দিকেও একটা লিফলেট বাড়িয়ে ধরল। আমি তাকিয়ে দেখলাম সেই বড় করে লাল দরজা লেখা লিফলেট।

লিফলেট নিলাম না, খপ করে লোকটার গলার মাফলার টান দিয়ে ধরলাম। “কে তুই?” লোকটা ভড়কে গেল। মাফলারে টান লেগে তার দম বন্ধ হয়ে আসছে। “আ...আ...আমি একজন সাধারন পথচারী”। আমি কঠিন কণ্ঠে বললাম, “সাধারন পথচারীর পরনে এই ধরনের পোশাক থাকেনা”।

“আমার কোনও দোষ নাই। ওরা আমাকে এই পোশাক দিয়েছে পড়ার জন্য। বলেছে এই পোশাক পরে লিফলেট বিলি করলে সবাই আগ্রহী হবে”। “ওরা কারা?” “আমি ওদের চিনিনা। প্রতিরাতে লিফলেট বিলি করার বিনিময়ে আমি ২০০ টাকা পাই ওদের কাছ থেকে”।

“কিসের লিফলেট এটা? লাল দরজা কি?” “আমি জানিনা স্যার। ওরা বলল শহরের দক্ষিন প্রান্তে ওরা একটা বড় রেস্টুরেন্ট খুলেছে। অদ্ভুত একটা নাম দিয়েছে- লাল দরজা। তার লিফলেটই আমাকে বিলি করতে হয়!” আমি যেন প্রচণ্ড একটা ধাক্কা খেলাম। “রেস্টুরেন্ট!” “হ্যাঁ স্যার! ওরা তো তাই বলল।

ওরা যদি রেস্টুরেন্টের নামে অন্য কোনও ব্যবসা করে তবে আমার দোষ নেই স্যার। আমি এ সম্পর্কে কিছুই জানিনা। আমি শুধু টাকার বিনিময়ে কাজ করি”। আমার ঠোঁটে মৃদু হাসি ফুটল। লোকটার মাফলার ছেড়ে দিলাম।

“জনাব! আজ থেকে আমি আর এই লিফলেট বিলির কাজ করব না”। “কেন করবে না? অবশ্যই করবে। তুমি তোমার কাজ করে যাও। তুমি জাননা নিজের অজান্তে তুমি আমাকে আমার গন্তব্যে পৌঁছে দিয়েছ। হয়ত এভাবে তুমি আরও অনেক দিশেহারা মানুষকে তাদের গন্তব্যে পৌঁছে দিতে পারবে”।

“আমি আপনার কথা বুঝতে পারছি না, জনাব!” “সব কথা বুঝার দরকার নেই। তুমি যাও। তোমার অনেক কাজ!” লোকটা আর কথা বাড়াল না। আবার লিফলেট বিলি করতে করতে সামনে এগিয়ে গেল। আমি পিছন থেকে তাকিয়ে থাকলাম।

লোকটা হাটতে হাটতে এক সময় দৃষ্টির আড়ালে চলে গেল। আমি একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে ঘুরে দাঁড়ালাম। বাইকে বসলাম। স্টার্ট দিতে যাব এমন সময় কেউ একজন আমাকে ডাকল। “ভাই, আমাকে একটু সাহায্য করবেন কি?” আমি তাকিয়ে দেখলাম একজন যুবক।

গায়ে হলুদ পাঞ্জাবী, অযত্নে বেড়ে উঠেছে চুল দাড়ি। সবচেয়ে লক্ষণীয় ব্যাপার হল সে এই পিচের রাস্তায় খালি পায়ে দাড়িয়ে আছে। চোখের দৃষ্টি দেখে মনে হচ্ছে দিকভ্রান্ত। আমি বললাম, “বলুন কীভাবে সাহায্য করতে পারি?” একজন লোক আমাকে একটা লাল দরজা লেখা লিফলেট ধরিয়ে দিয়ে চলে গেল। আমি সেই লাল দরজার খোঁজ করছি।

বলতে পারবেন কোথায় গেলে আমি সেই লাল দরজা খুঁজে পাব? আমি হাসলাম। “ভাই, মনের চোখে দেখার চেষ্টা করুন। গোটা পৃথিবীতেই আপনি লাল দরজা দেখা পাবেন। কিন্তু আপনাকে বুঝে নিতে হবে আসলে কোন লাল দরজা আপনার গন্তব্য”। লোকটাকে দেখে মনে হচ্ছে যেন বিরাট কোনও ধাঁধায় পড়ে গেছে।

আমি বাইক স্টার্ট দিলাম। তাকে ঐ অবস্থায় রেখেই আমি ফুল স্পীডে উড়ে চললাম। আমার গন্তব্য একটা লাল দরজা। আমি যাচ্ছি আমার পল্লবীর কাছে, আমার গন্তব্যে। ।

অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।