আমাদের কথা খুঁজে নিন

   

বড় কুরবানি

ছুটতে ছুটতে হয়তো অনেকখানি পেছনে ফেলে এসেছি মুহুর্তগুলোকে; তারপরও সময়ের সাথে থাকার দীপ্ত শপথ মোর, জানিনা এই সময় কি মেনে নেবে সেই আমাকে... ‘তড়াগড়ি উঠছুনো, ও টিপু’ – ঠিক এইডাকেই ঘুম ভাঙতো ঈদের ভোরে। যার মানে তাড়াতাড়ি করে ঘুম থেকে ওঠার তাগাদা। চট্টগ্রামের দাদাবাড়ীতে প্রায় সবাই আমাকে টিপু নামেই চেনে। ঈদ উপলক্ষে পরিবারের সব সদস্যই দাদাবাড়িতে বর্তমান; আর তাও যদি হয় ৭ চাচার পরিবার - আলহামদুলিল্লাহ্! যাক সে কথা; ভোর থেকেই পুকুরঘাটে বিশেষকরে বাড়ির টয়লেটে আর গোছলখানায় ভিড়ের হিড়িক। তাই একটু আগেভাগেই দাদী তার আদরের বড় ছেলের পুত্রকে উঠাতে ব্যস্ত; পাছে না আবার ভিড়ের মধ্যে শামিল হয়।

ওদিকে দাদা ফজরের নামায শেষে ওজু-গোছল করে ঈদগাহে চলে গেছেন। সকাল ৭টাই গ্রামের বাড়ির ঈদ-জামাত। গ্রামের বিশাল ঈদগাহ। দাদা একটু আগেভাগেই চলে যান ঈদগাহ পরিষ্কার করতে। মসজিদ থেকে চুল পরিষ্কার মরা-গাধা ওঠানোর শামিল হলে না জানি ঈদগাহ পরিষ্কার করা কত বড় সওয়াবের কাজ - তাও আবার বয়স যখন ৭০+।

যাক, আমিই প্রথম। আমার পরে যারা চাপকলে আসবে তাদের উপর দখলদারিত্ব করার এটাই মোক্ষম সুযোগ – বাংলাদেশ বলে কথা! যাই হোক - চটজলদি গোছল সেরে নূতন পান্জাবি-টুপি পরে যেইনা ঈদগাহের পথে পা বাড়াবো অমনি দাদীর পিছুডাক – আতর লাগানোর জন্য। ঈদগাহে গিয়ে দেখি দাদা প্রথম কাতারের ঠিক মাঝ বরাবর বসে আছেন। তাঁর পাশে বসার কোন উপায় নেই; তাঁর বাল্যবেলার প্রবীণ বন্ধুরা তাঁর সাথেই উপস্থিত। ঈদের নামায শেষে সবাই কোলাকুলিতে ব্যস্ত।

আমিও কিছুসংখ্যক কোলাকুলি সেরে কুরবানির উদ্দেশ্যে বাড়ির পথে রওয়ানা হই। পাড়ার ইমাম সাহেব ইয়া বড় রাম-ছুরি নিয়ে দাড়িয়ে, পাশে উপস্থিত দলবদ্ধ কসাই সমাজ। তাদের হাতেও মোটামুটি সাইজের সব চাপাতি – কেউ কেউ আবার তাতে শান্ লাগাতে ব্যস্ত। তড়িহড়ি করে বলদ মাটিতে শুয়ানোর কাজে নিয়োজিত হলাম। আমাদের আবার ৩টি বলদ জবাই হয়; ৭ চাচার সংসার নিয়ে কথা! আমরা কাজিনরা সবাই কাটাকুটিতে মন দিলাম।

কে কার আগে বলদের রানের মাংস রান্নাঘরে নিতে পারে তার কম্পিটিশান শুরু হল বলে। এভাবেই একসময় দেখতে দেখতে ৩টি বলদই রান্নাঘরে চালান হয়ে যায়। চামড়াগুলো গ্রামের মাদ্রাসায় পাঠিয়ে দেয়া হয়। মাদ্রাসা কমিটি গ্রামের জবাইকৃত সব বলদের চামড়াগুলো ভালদরে বিক্রি বাবদ অর্থ মাদ্রাসা ফান্ডে জমা করেন। মা-চাচিরা রান্নায় ব্যস্ত হয়ে পড়েন।

আগের রাতের বানানো চালের রুটিগুলো দাদী পরম যত্নে মাটির চুলোতে সেঁকতে থাকেন। গ্রামের গরীর মানুষগুলো দলবেঁধে আসতে শুরু করে আর আম্মা অত্যন্ত সতর্কতার সহিত সমভাবে সবাইকে মাংসের ভাগ-ভাটোয়ারা করে দেন। প্রথম পর্বের মাংস রান্না শেষ হওয়া মাত্রই বাড়িতে এলান পড়ে। আমি সমেত দাদা-দাদীর সব নাতী-নাতনীরা চালের রুটি আর মাংসের পেছনে লেগে যায়। যদিও সবার প্রথম মাংসের টুকরো দাদার পরে আমিই স্বাদ নিই।

দাদীর পারশিয়াল্টির সাইড বরাবরের মতই আমার দিকেই থাকত। বোধশক্তি হবার পর থেকে কুরবানির ঈদগুলো একরকম এইভাবেই কাটছিল। প্রতি ঈদেই কিছু না কিছু অভিজ্ঞতার মাঝে নিজেকে আর বাড়ির মানুষগুলোকে নূতনভাবে আবিষ্কার করছিলাম। আজ প্রায় ৬বছর ধরে পড়াশুনা আর প্রফেশানের তাগিদে দেশ থেকে দূরে। দাদাকে হারিয়েছি প্রায় ১২বছর হল।

গত ৬বছরে চালের রুটির দেখা মেলেনি এই প্রবাসে। দাদীও চলে গেলেন ২বছর পেরোল এই মাসে, তাও আমার জন্মদিনের ঠিক আগের রাতেই। প্রতি বছর ঘুরে ঘুরে ঈদ আসে; আসে আমার জন্মদিনও। নেমে আসে এক বুক নিঃসঙ্গতা আর প্রিয় দাদী হারানোর হাহাকার। পৃথিবী থেকে দোয়াদাতারা দিনদিন হারিয়ে যাচ্ছে।

আরও ব্যস্ত থাকতে চাই; চাই নিজেকে ভুলে থাকতে, নাইবা খেলাম চালের রুটি, ফিরে পেতাম যদি দাদীকে! আই মিস্ ইউ দাদী – প্রিয়জনকে পেয়ে হারানো বুঝি এই জীবনের সবচেয়ে বড় কুরবানি! ।

অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।