আমাদের কথা খুঁজে নিন

   

কুরবানী : পশু হত্যা নয়, ঈমানী শক্তির উদ্বোধন-

মানব জাতির মহান পিতা হযরত আদম (আ -এর সময় থেকে পশু কুরবানী করা শুরু হলেও হযরত ইব্রাহীম (আ -এর পুত্র- কুরবানীর প্রতীকী ঘটনার মাধ্যমে তা মুসলিম জাতির কাছে একটি স্থায়ী ইবাদতে পরিণত হয়। এই কুরবানী শব্দটি মূলত ‘কুরবত’ শব্দ থেকে এসেছে। এর অর্থ-নৈকট্য, ত্যাগ ইত্যাদি। পশু যবেহ’র মধ্যে দিয়ে আল্লাহর সন্তুষ্টি ও নৈকট্য লাভের চেষ্টা করা হয় বলেই একে কুরবানী বলা হয়। হযরত ইব্রাহীম (আ তাঁর জীবনে অনেক কঠিন পরীক্ষার সম্মুখীন হন।

এসবের মধ্যে আল্লাহর সন্তুষ্টির লক্ষে তাঁর একমাত্র পুত্রকে যবেহ করার ঘটনাটি অন্যতম। উল্লেখ্য যে, এ পরীক্ষায় তিনি সফলভাবে উত্তীর্ণ হয়েছিলেন। তবে পুত্রকে নিজ হাতে যবেহ করানো আল্লাহর উদ্দেশ্য ছিল না। এ পরীক্ষার মাধ্যমে তিনি যা চেয়েছিলেন তা পেয়েও ছিলেন। কেননা কুরআন মাজীদে উল্লেখ আছে, “আর আমি তাকে আহ্বান করে বলেছিলাম, হে ইব্রাহীম! তুমি তো স্বপ্নাদেশ যথাযথভাবে পালন করেছ- এভাবেই আমি সৎকর্মপরায়ণদের পুরু®কৃত করে থাকি।

নিশ্চয় এটি ছিল এক স্পষ্ট পরীক্ষা। ” (সূরা সাফফাত ৩৭ : ১০৪-১০৬) তবে আল্লাহর এহেন একটি কঠিন নির্দেশ পালনে এত বড় ত্যাগের ঘটনা কালের স্রোত ভেসে যাবে তা তিনি কখনো চাননি। তিনি এ ঘটনাকে পরবর্তীকালের লোকদের জন্য ত্যাগের প্রেরণা হিসেবে চিরস্মরণীয় করে রাখার ব্যবস্থা করেন। তিনি বিকল্প হিসেবে প্রতীকি ব্যবস্থা স্বরূপ পশু কুরবানীর নির্দেশ দিলেন। এখন পুত্র যবেহ নয়Ñপশু কুরবানী করে হযরত ইব্রাহীম ও ইসমাঈল (আ -এর ত্যাগের শিক্ষাকে স্মরণ করে নিজ জীবন ও চরিত্রকে আল্লাহর অনুগত করে গড়ে তুলতে পারলেই আল্লাহর সন্তুষ্টি ও নৈকট্যো দ্বার উন্মুক্ত হয়ে যাবে।

শুধু গোশত খাওয়ার ভেতরে কুরবানীকে আবদ্ধ করে রাখলে আনুষ্ঠানিকতা হবে, নৈকট্য অর্জন ও হবে না এবং ত্যাগ স্বীকার ও হবে না। কুরবানীর মূল ইতিহাস সৃষ্টিকারী হযরত ইব্রাহীম (আ -এর ঈমানী দৃঢ়তা ও আপোসহীন ভুমিকা যেন কুরবানীদাতা ভুলে না যায় সে জন্য দ্ব্যর্থহীন ভাষায় কুরআন মাজীদে ঘোষিত হয়েছে, “তোমরা একনিষ্ঠভাবে ইব্রাহীমের ধর্মাদর্শের অনুসরণ কর”। (সূরা আলে ইমরান ৩:৯৫)-এর মর্মার্থ দাঁড়ায়, কুরবানীর অনুষ্ঠানের মধ্য দিয়ে ইব্রাহীমের গোটা জীবনের অনুসরণ করো। অন্যায় ও অসত্যের বিরুদ্ধে তিনি যে কোন শক্তির কাছে মাথা নত করেননি, তোমরা সর্বদা সেই আদর্শ অনুসরণ করে যাবে। মনে রাখতে হবে, মোটা-তাজা পশু কুরবানী করার মধ্যে বিশেষ কোন কৃতিত্ব নেই।

কেননা পশুর গোশত-রক্ত কোনটাই আল্লাহর কাছে পৌঁছে না, পৌঁছে আনুগত্য ও ত্যাগের নজরানা। কেননা কুরআন মাজীদে উল্লেখ আছে, “আল্লাহর নিকট পৌঁছায় না তার গোশত এবং রক্ত, বরং পৌঁছায় তোমাদের তাকওয়া”। (সূরা হজ্ব ২২:৩৭) নিজের কামনা বাসনা, কষ্টার্জিত সম্পদ ও প্রাণাধিক প্রিয় বস্তুকে আল্লাহর সন্তুষ্টির লক্ষে নিবেদন করার উদাত্ত আহ্বান নিয়েই প্রতি বছর কুরবানীর ঈদ আমাদের সামনে উপস্থিত হয়। কুরবানী একদিকে যেমন আমাদের জন্য ইব্রাহীম (আ -এর অভূতপূর্ব ত্যাগী জীবনের কথা স্মৃতিপটে জাগিয়ে দেয়, তদ্রƒপ প্রতিটি মুমিনের অন্তরকে ঈমানী চেতনায় উজ্জীবিত করে তোলে। কুরবানীর পশু যবেহকালে আমরা পাঠ করে থাকি, “বল, আমার সালাত, আমার ইবাদাত (কুরবানী), আমার জীবন ও আমার মরণ জগতসমূহের প্রতিপালক আল্লাহরই উদ্দেশ্যে।

” (সূরা আনআম ৬:১৬২) এ কথার দ্বারা একজন কুরবানীদাতা মূলত নতুন করে আল্লাহর সাথে এই অঙ্গীকারেই আবদ্ধ হয় যে, হে আল্লাহ! হযরত ইব্রাহীম (আ যেভাবে তাঁর পারিবারিক, সামাজিক, রাষ্ট্রীয় এক কথায় সর্বপ্রকার বাধা বিপত্তি ও অমানবিক যুলুম-অত্যাচার উপেক্ষা করে তোমার নির্দেশের উপর পাহাড়ের ন্যায় অবিচল ছিলেন এবং বাতিলের সাথে আপোস করে নিজের জীবনকে অনিবার্য মৃত্যুর দিকে সঁপে দিতে কুন্ঠিত হননি, আমিও ব্যক্তি, পরিবার, সমাজ ও রাষ্ট্রীয় জীবনে তোমার বিধান প্রতিষ্ঠায় যাবতীয় প্রতিকূলতাকে উপেক্ষা করতে দৃঢ় প্রতিজ্ঞ। এজন্য যদি আমাকে তাঁর ন্যায় দেশান্তরিত হতে হয় তাতেও আমি প্রস্তুত। আর যদি রাষ্ট্রীয় রোষাণলে পড়ে জেল-জুলুম এমনকি নির্মম প্রাণদন্ডাদেশের ন্যায় চরম সংবাদও শোনতে হয়, সেজন্যও আমি মানসিকভাবে প্রস্তুত। এ ছাড়া আমার প্রিয়তম সন্তান যাকে আমি নিজের প্রাণের চেয়ে অধিক ভালবাসি, তোমার নির্দেশকে সকল কিছুর উপরে তুলে ধরতে গিয়ে তারও যদি প্রাণহানি ঘটে, সে অবস্থাকেও আমি হাসি মুখে মেনে নিতে প্রস্তুত। তেমনিভাবে তোমার পথে চলতে গিয়ে যদি প্রিয়তম স্ত্রী থেকে বিচ্ছিন্ন হবার মতো পরিস্থিতির উদ্ভব ঘটে, স্বাভাবিক অবস্থায় যা কোন স্বামীই মেনে নিতে প্রস্তুত নয়, আমি অনুরূপ পরিস্থিতিও তোমার দ্বীনের স্বার্থে প্রসন্নচিত্তে তা করে যাবো।

কুরআন মাজীদে বহু স্থানে হযরত ইব্রাহীমের (আ অনেক বৈশিষ্ট্য উল্লেখ থাকলেও তাঁর দু’টি বৈশিষ্ট্য বিশেষত আলোচনার দাবি রাখে। ১. হানিফ। অর্থাৎ তিনি ছিলেন আল্লাহর প্রভূত্ব গ্রহণে দ্বিধাহীন এবং তাঁর দাসত্ব পালনে একাগ্রচিত্ত। তাঁর সমগ্র জীবনই এ কথার সাক্ষ্য দেয় যে, তিনি আল্লাহর সন্তুষ্টির উদ্দেশ্যে গোটা সমাজ থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়েছিলেন, পিতাকে ত্যাগ করেছিলেন, দেশান্তরিত হয়েছিলেন, নিজ পুত্রকে যবেহ করতে সার্বিক প্রস্তুতি গ্রহণ করেছিলেন, স্ত্রী পুত্রকে নির্জনবাস দিয়েছিলেন, এক কথায়-এমন কোন ত্যাগ তিনি বাকি রাখেননি যা তিনি আল্লাহর উদ্দেশ্যে নিবেদন করেননি। ২. দ্বিতীয় বৈশিষ্ট্য হল এই যে, তিনি জীবনের কোন পর্যায়ে এমনকি চরম মুহূর্তেও আল্লাহর প্রতি আস্থার ব্যাপারে দ্বিধা-সংকোচের শিকার হননি।

আল্লাহর তা‘আলা তাঁর প্রতি ঈমানের দাবিদার বান্দার মধ্যে সেই ইব্রাহীমি গুণাবলি ও ঈমানী দৃঢ়তাই দেখতে চান। একারণেই ইব্রাহীম (আ -এর সংগ্রামী জীবনের অনুসরণ করার জন্যেই আল্লাহ কুরআন মাজীদে আহ্বান জানিয়েছেন। কিন্তু আমরা কুরবানীদাতারা এই আহ্বানে কতটুকু সাড়া দিচ্ছি? আসুন আত্মপর্যালোচনা করে দেখি, প্রতি বছর কুরবানী আসে, কুরবানী চলে যায়, আমাদের ব্যক্তি, সমাজ ও মুসলিম উম্মাহর জীবনে তার কী প্রতিফলন ঘটছে। এটা চিন্তা করে দেখার বিষয় নয় কি? পৃথিবীর যে দিকেই তাকাই সেখানেই দেখতে পাই, কোন না কোন জনপদে মুসলিমগণ নিগৃহীত হচ্ছে, দেশ থেকে বিতাড়িত হচ্ছে, মা-বোনেরা সতীত্ব হারাচ্ছে, নিষ্পাপ শিশুরা প্রাণ দিচ্ছে, ভূখন্ড বেহাত হযে যাচ্ছে, এ সবের মূলে নিহিত রয়েছে আমাদের ইব্রাহীমী চেতনা সমৃদ্ধ ঈমানের দুর্বলতা। ইব্রাহীম (আ নমরুদী দুঃশাসন সমাজ থেকে উৎখাত করতে যে ত্যাগ স্বীকার করেছিলেন, আজও বিশ্বের বিভিন্ন জনপদে নমরুদের বংশধররা সে দুঃশাসন চালাচ্ছে, তা থেকে মুক্তির জন্য প্রয়োজন ইব্রাহীমী ঈমানের দৃঢ়তা।

আমরা যে সময় কুরবানীর পশুর গলায় ছুরি চালাই, সে মুহূর্তে বিশ্বের বিভিন্ন জনপদে আমাদের মুসলিম ভাই-বোনেরা নমরুদী শক্তির দেয়া মিথ্যা মামলায় জেলখানায় মানবেতর বন্দী জীবন কাটাচ্ছে এবং কখনো অকাতরে যবেহ হচ্ছে। ঈদুল আযহার কুরবানীর অনুষ্ঠান সফল ও স্বার্থক করে তুলতে হলে প্রতিটি কুরবানীদাতাকে আগে নিজের আল্লাহদ্রোহী ও স্বার্থপর কুপ্রবৃত্তিকে ‘কুরবানী’ দিয়ে নিজ সমাজ থেকে যাবতীয় অন্যায় ও অবিচারকে উৎখাত করতে হবে এবং হযরত ইব্রাহীম (আ -এর ন্যায় ঈমানী তেজ ও সংগ্রামী চেতনা নিয়ে নমরুদী পশুত্বের হাত থেকে মানবতা বিশেষ করে মুসলিম উম্মাহকে বাঁচাতে হবে। পরিশেষে বলতে চাই, মোটা-তাজা পশুর গোশত খেয়ে ঢেকুর তোলার মধ্যেই যেন কুরবানী অনুষ্ঠান সীমাবদ্ধ হয়ে না পড়ে সে দিকে ঈমানী চেতনা নিয়ে লক্ষ রাখতে হবে এবং ইব্রাহীম (আ -এর ঈমানী চেতনা ও দৃঢ়তা বক্ষে ধারণ করে যেন আমরাও আদর্শ সমাজ বিনির্মাণে নিজ নিজ অবস্থান থেকে যথাযথ ভূমিকা পালন করতে পারি এটাই হোক আমাদের কুরবানীর মূল শিক্ষা, হোক আমাদের ঈমানী শক্তির শুভ উদ্বোধন। ।

অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।

প্রাসঙ্গিক আরো কথা
Related contents feature is in beta version.