আমাদের কথা খুঁজে নিন

   

রেমা কালেঙ্গার জঙ্গলে............

যদিও নামটা বেশি একটা চেনা না অনেকের কাছেই, কিন্তু রেমা কালেঙ্গা বন্যপ্রাণী অভয়াশ্রমকে অনেকেই বলেন, বাংলাদেশের বৃহত্তম হিল ফরেস্ট (পাহাড়ি বন)। হবিগঞ্জ জেলার চুনারুঘাট উপজেলায় ভারত সীমান্ত ঘেষে প্রায় ১৭০০ হেক্টর আয়তনের এই রিজার্ভ ফরেস্ট অবস্থিত। এই বনে চিতা এবং কালো ভালুকের উপস্থিতির কথা অনেকে বললেও সিলেটের আর সব বনের মত বানর, বন্যশুকর, হনুমান, জায়ান্ট কালো কাঠবিড়ালী, মেছো বাঘ আর উল্লুকই এখানকার প্রধাণ প্রাণী......... পাখি আছে অনেক আর আছে সাপ। পূজোর ছুটি আর ঈদের বন্ধ, পকেটে টাকা পয়সার অবস্থাও মন্দ। বান্দরবান বা সুন্দরবনের প্ল্যান করে পোষানো যাবে না, তাই সিলেট।

এদিকে আবার রাতারগুলের পানি গেছে শুকিয়ে, সব মিলে অনেকটা হুট করেই সিলেটের বাসে উঠে পড়লাম বিকেল চারটায়, গন্তব্য হবিগঞ্জের শায়েস্তাগঞ্জ। ব্লগ আর ফেবু ঘেটেঘুটে মোটামুটি একটা ইটিনিয়ারি করে নিয়েছি, সে মোতাবেক রাত কাটানোর কথা রেমা কালেঙ্গার কোলে একমাত্র ইকো কটেজে। সেখানকার ম্যানেজার রহমান ভাইয়ের সাথে আলাপ হলো......... চার জনের রুম এক হাজার টাকা মাত্র, খাওয়া পারহেড ২০০ !!!! রাতটা কাটলেই হলো, যা আছে কপালে......... শায়েস্তাগঞ্জ নেমে সিএনজি নিয়ে চুনারুঘাট। সেখানে আগে থেকেই বলে দেয়াতে দু’টো বাইক নিয়ে রহমান মিয়া হাজির। শুরু হলো দুর্দান্ত বাইক যাত্রা............ ঘন কুয়াশার মাঝে আকা বাকা বালুর রাস্তা, নির্মাণ কাজ চলছে আর উপরে অদ্ভুত সুন্দর তারাখচিত আকাশ।

কমপক্ষে সাত - আটবার নেমে উঁচু নিচু রাস্তায় গর্তে বাইক ঠেলে ঠুলে আমরা হাজির হলাম কালেঙ্গা বিট অফিসের পাশেই, ইকো কটেজে। খাওয়া দাওয়া আগেই সেরে নিয়েছি আসার পথে “উজান-ভাটিতে”, কালকের জন্য নিয়ে নিয়েছি শুকনো খাবার। সোলার এনার্জির টিমটিমে আলোতে ভোরে ভোরে জঙ্গলে ঢোকার প্ল্যান করতে করতে ঘুম...............। সরু ট্রেইল চলে গেছে দূরে ভোরে দশ টাকার টিকেট কেটে আমরা ঢুকলাম বনে। কালেঙ্গা দিয়ে ঢুকে রেমা দিয়ে বেরোব, এমনটাই ইচ্ছা।

(বনের নাম রেমা কালেঙ্গা হলেও এটা মূলত চারটা বিটের সমন্বয়ে একটা সুবিশাল ব্যাপার-স্যাপার............ রেমা বিট, কালেঙ্গা বিট, ছনবাড়ি বিট আর রশিদপুর বিট - এ চারটা বিট নিয়ে টোট্যাল বন)। ট্যুরিস্টদের জন্য তিনটা ট্রেইল......... আধা ঘণ্টার, এক ঘন্টার আর তিন ঘন্টার। আমরা কিছুদূর ট্রেইল ধরে এগিয়ে গিয়ে এরপর ঢুকে গেলাম কাঠুরিয়াদের সরু পথে। বানর আর হনুমানের পালের সাথে সাক্ষাত হল বেশ কয়েকবারই, আর দেখলাম বিশালাকার কাঠবিড়ালি (এটা নাকি এই বনের এক্সক্লুসিভ !!!) আর চেনা অচেনা পাখি । একেই বলে ক্যামোফ্লেজ !!! ছোট ছোট টিলা, দুর্দান্ত উঁচু গাছের সারি আর মাঝে মাঝে দুএকটা ছড়া, তাও শুকনো সিজন বলে পানি খুবই কম।

ঘন্টা তিনেক বনে ঘোরাঘুরি করে আমরা এবার ট্রেইল ধরলাম রেমা যাবার জন্য। বনের চারপাশে ধানখেত, পথের দিশা নেয়ার জন্য চাষীদের কাছ থেকে ডিরেকশন নিয়ে হাটা শুরু হলো আবার। তক্ষকের ডাক শুনতে শুনতে চলছি, চেনা অচেনা নানারকম পাখির ডাক। ঘন সবুজের মধ্য দিয়ে স্রেফ হেটে যাওয়ার মধ্যে এতো রিফ্রেশিং পাওয়ার আছে, জানতাম না। গাছ পড়ে ব্রীজ............ একটু ভাব সাব নিতেই হয় হেটেই পার হয়ে যাওয়া যায় খোয়াই নদী দু-আড়াই ঘন্টা পর আমরা হাজির হলাম রেমা বিট অফিসে।

কিছুক্ষণ বিরতি নিয়ে এবার চা বাগান আর লোকালয়ের মধ্য দিয়ে পথ চলা, গন্তব্য গুদারাঘাট। খেয়া নৌকায় খোয়াই নদী পার হয়ে চলে আসলাম আসামপাড়া, সেখান থেকে জনপ্রতি পচিশ টাকায় আবার চুনারুঘাট। ফ্রেশ হয়ে টয়ে অস্বাভাবিক ঝাল রুই মাছ, শিং মাছ আর গরু দিয়ে খাওয়া সেরে প্ল্যান হলো পপুলার স্পট সাতছড়ি ন্যাশনাল পার্ক যাওয়ার। সাতছড়ি পিকনিক স্পট হিসেবে লাউয়াছড়ার মতই জনপ্রিয়। সুতরাং মানুষ ছাড়া এখানে অন্য কোন প্রাণী দেখার আশা খুবই কম।

আর শুকনো সিজন, বনের প্রকৃতি এখন অনেকটাই রুক্ষ। তবুও ট্রেইল ধরে ঘন্টাখানেক ঘুরে ফিরে টিপরা পাড়ার মধ্য দিয়ে একটা সুবিশাল শুকনা ঝিরির মধ্য দিয়ে চলে আসলাম রাস্তায়। বাস ধরে শায়েস্তাগঞ্জ, সেখান থেকে ঢাকা। সাতছড়ির শুকনো ঝিরি সবুজ প্রকৃতি যাদের টানে না, তাদের কাছে এইটা একটা বোগাস ট্যুর মনে হতে পারে, কিন্তু বনের নিস্তব্ধতায় আকা বাকা সরু পথে ঝিরঝিরে ঠান্ডা বাতাসে শুধু হেটে যাওয়ার মধ্যে যে কি আনন্দ আছে, সেটা সবাই বুঝতে পারবে না। আর রেমা কালেঙ্গায় অনেক ভালো ক্যাম্পসাইট আছে, টেন্ট পিচ করে দারুণ অভিজ্ঞতা নেয়া সম্ভব (তবে অবশ্যই হইহল্লা করে না)।

আর উঁচু নিচু টিলায় সরুপথে মাউন্টেন বাইকিং করতে পারাটা মনে হয় একটা শ্রেষ্ঠ অ্যাডভেঞ্চার হবে। যারা যেতে চান প্রথমে বাসে বা ট্রেনে শায়েস্তাগঞ্জ। বাসে গেলে সাড়ে চার - পাঁচ ঘন্টা, ভাড়া ২২০-৩০০। ট্রেনে গেলে চার ঘন্টা, ভাড়া ৯০-১৫০। শায়েস্তাগঞ্জ নেমে সিএনজি নিয়ে চুনারুঘাট, শেয়ারে ভাড়া পচিশ টাকা।

সেখানে বাইক পাওয়া গেলে ভালো, দেড়শো-দুইশো লাগবে। সিএনজিতেও যাওয়া যায় তবে স্পষ্ট করে বলে দিতে হবে রেমা, না কালেঙ্গা কোন বিট অফিসে যেতে চান। রেমা দিয়ে ঢুকে কালেঙ্গা দিয়ে বেরোতে পারেন, উলটোটাও করা যায় সময় লাগবে আড়াই-তিন ঘন্টা। থাকার ক্ষেত্রে টেন্ট থাকলে ভালো, আর না হলে ইকো কটেজ, রুমা চার জনের জন্য ১০০০, তবে ফ্লোরিং করে থাকা যেতে পারে। ব্যবস্থা খুবই ভালো।

(আব্দুর রহমান - ম্যানেজার ০১৭৩১৯৭৭৮০৭)। বনে ঢুকতে চাইলে গাইড নিয়ে ঢোকাই ভালো, রহিম ভাই ওখানকার সবচেয়ে ভালো গাইড (আব্দুর রহিম - ০১৭৪১১৪৪১৭৪) তবে তার চার্জ বেশি (হাজার-বারোশ), সেক্ষেত্রে অন্য গাইডও পাবেন শপাঁচেক এর মধ্যে। ফেরার সময় কালেঙ্গা দিয়ে ফিরতে পারেন, রেমা দিয়ে ফিরলে গুদারাঘাটে খোয়াই নদী পার হয়ে চুনারুঘাট চলে আসতে পারবেন। ইকো কটেজ যদি কেউ যান, একটি বিনীত অনুরোধ............... দয়া করে বনে কোন প্ল্যাস্টিক প্যাকেট বা পানির বোতল ফেলে আসবেন না। আমাদের প্রকৃতির সৌন্দর্য রক্ষার দায় আমাদেরই।

হ্যাপি হাইকিং ।

অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।