আমাদের কথা খুঁজে নিন

   

আধা ভৌতিক আধা বাস্তবতার গল্প। (শেষ অংশ)

প্রথম অংশ মোবাইলের আলোর ওপাশে গাঢ় অন্ধকারের মাঝে একটা কাটা মুন্ডু পেন্ডুলামের মত দুলছে। সমস্ত শক্তি দিয়ে রিয়া রিক্সার হূডটাকে আঁকড়ে ধরে। অন্য হাতে মোবাইলের আলোটা ভালো করে তুলে নেয়। পরিস্থিতিটাকে সে বোঝার চেষ্টা করে। ছেলেটির পরনের কালো শার্ট, কালো প্যাণ্ট আঁধারের সাথে মিশে গেছে।

ফলে মাথাটায় ঝুলন্ত পেন্ডুলামের অবয়ব ফুটে উঠেছে। ফিক করে হেসে ফেলে ছেলেটি। মোবাইলের আধো আলোয় তার দাঁতগুলি চিক চিক করে ওঠে। রিয়াকে অবাক করে দিয়ে ছেলেটি নিজেকে তার ছাত্র বলে পরিচয় দেয়। সে অবশ্য তাকে চিনতে পারেনাই।

এই কয়দিনে কটাই বা ক্লাশ পেয়েছে সে। মনের অবস্থা কত ক্ষণে ক্ষণেই না পালটায়! টিচার্স ডরমেটরিতে থাকার সময় শেয়ালের হুক্কাহুয়া শুনে কি মজাই না সে পেত। কিন্তু এখন? বুকের রক্ত হিম করে দিয়ে নদীর দিক থেকে একটা শেয়াল দৌড়ে রাস্তা পার হয়ে গেল। সম্ভবতঃ পথের ওপাশের জঙ্গলটায় তার কোন আস্তানা আছে। বেশ হাসি খুশি আর প্রাণবন্ত ছেলেটি।

ওর সাথে দেখা হতে পেরে যেন নিজে কে ধন্য মনে করছে। কথা বলে যাচ্ছে আনমনে যেন নিজেই নিজেকে শুনিয়ে চলছে। তার নিজের গল্প, পরিবারের গল্প, অভাব অনটনের গল্প। দিনের পর দিন না খেয়ে বড় হবার গল্প। বাবা আরেকটা বিয়ে করে তাদের ফেলে চলে যাবার পর কি করে সংসারের রঙ পালটে গেল তার গল্প।

তাকে মানুষ করার জন্যে মায়ের প্রাণান্ত কষ্টের গল্প। তারপর রিয়ার দিকে ঘাড় ঘুরিয়ে বলল, আফা জানেন, “আমার মা না খেয়ে খাবার গুলো নিত্যি আমার পাতে তুলে দ্যায়। কি করে দিনের পর দিন না খেয়ে বাঁচে ঐ মানুষটা। চেয়েছিলাম একদিন তার কষ্টগুলো ঠিক মুছে দেব। ” একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে ছেলেটি হঠাত করেই চুপ করে গেল।

যেন তার সমস্ত গল্পের ইতি ঘটে গেছে। তারপর প্যাডেল ঘুরিয়ে আনমনে কেবল সামনের দিকে এগিয়েই যেতে লাগল। আবার সেই শুনশান নীরবতা। পথটাও আজ বড্ড দীর্ঘ লাগছে। ।

নদীর ধার ঘেঁষে চলছে তারা। ওদিকে যাওবা দুই একজন মানুষ ছিল এদিকে কারো টিকিটাও দেখা যাচ্ছেনা। তাকাবেনা তাকাবেনা করেও নদীর দিকে তাকালো রিয়া। একরাশ থমথমে কালো ছাড়া নদীটার কোন অস্তিত্বই সেখানে নেই। বুকের ভিতরটা কেঁপে ওঠে রিয়ার।

লক্ষ্য করে দেখল ঝি ঝি পোকাদের সেই ভয়ংকর একটানা ডাকটাও আজ নেই। গাছের পাতারা যেন কারো ভয়ে নড়াচড়া করতে ভুলে গেছে। ফিস ফিস করে তারা যেন একে অন্যকে কিছু বলছে। কোন অশরীরি আত্মারা যেন দাপিয়ে বেড়াচ্ছে তাদের অভিশপ্ত নিঃশ্বাস ফেলে ফেলে। অনেকদিনের অনেক না পাওয়া ক্ষোভে যেন তারা এ পথে চড়ে বেড়াচ্ছে অনন্ত কাল ধরে।

গোরস্তানের পাশ দিয়ে যাবার সময় মনে হল হঠাত একদল লোক হুড়মুড় করে নদীর ওপাশটায় মিলিয়ে গেল। তারপর হঠাত করেই সব চুপ। চারিদিকে হিম নিশির নিবিড় ঘন আঁধার চাঁদর বিছিয়ে দিয়েছে। নীরবতার ভয়াল থাবা ক্রমশ যেন গ্রাস করে নিচ্ছে। রিয়ার শরীরটা ভীষণ ভারী ঠেকছে।

ভৌতিক কোন ব্যাপারে সে কখনই ভয় পায়না। সেই রিয়ারই এই মুহুর্তে মনে হচ্ছে বাহ্যিকভাবে কেউ তাকে নিয়ন্ত্রণ করছে। একটু নড়ে চড়ে বসতে চাইল সে কিন্তু পারলনা। তার সমস্ত সত্ত্বা কঠিন শক্ত হয়ে আসছে। ঃআফা ভাড়াডা দ্যান।

ছেলেটির কথায় সম্বিত ফিরে আসে রিয়ার। ভাড়া মিটিয়ে রিক্সা থেকে নামতেই ছেলেটি হেসে ফেলল। বলল, ঃআফা আমার মা-ডার জন্যি দোয়া কইরেন। তারপর উত্তরের প্রতীক্ষা না করেই অন্ধকারে মিলিয়ে গেল। মাঠটা পেরিয়ে আরো কিছুটা পথ হাঁটলেই কলেজের পিছনে তাদের হোস্টেল।

হোস্টেলের ডান দিকে প্রিন্সিপ্যাল স্যারের বাসা। কলেজের গেইটটা ঠেলে ভিতরে ঢুকতেই গুণ গুণ শব্দে রিয়ার ঘোর কেটে যায়। যেন হাজারটা মৌমাছি নীচে নেমে এসেছে তারা একই সাথে অথচ ভিন্ন সুরে কথা বলছে। হঠাত করে চারিদিক আলোকিত করে বিদ্যুৎ ফিরে আসে। কলেজ মাঠে হাজার হাজার মানুষ।

। মানুষ ঠেলে ঠেলে হাঁটতে থাকে রিয়া। টুকরো টুকরো কথা কানে ভেসে আসে। সারা বছরের বেতন আর ফরম ফিল আপের টাকা যোগাড় করতে না পেরে একটা ছেলে সন্ধ্যায় স্যারের বাসার সামনে আত্মহত্যা করেছে। সে নাকি আজই স্যারের পা ধরে খুব কান্নাকাটি করছিল।

। সমাপ্ত রাতের আঁধারে ভালো থাক সব বিদাহী আত্মারা। । ।

সোর্স: http://www.somewhereinblog.net     দেখা হয়েছে ১০ বার

অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।