আমাদের কথা খুঁজে নিন

   

প্রতীকীপনার প্রগাঢ় ব্যঞ্জনা

আমি বিস্মরণ...আমি অন্ধকার...আমি নৈঃশব্দ্য নক্ষত্রকে বিয়ে করে বগলে ময়লা দেখে ভিরমি খেয়েছি। নক্ষত্রও খায়, ঘুমায়, বাথরুমে যায়— দাঁত ব্রাশ করার সময় মাড়ি দিয়ে রক্ত বের হয়, উরুতে ফোঁড়া উঠলে কোঁকায়, গোঙায়। রহস্য-টহস্যের কিছু নেই— নক্ষত্রের মাথায়ও বিষ্ঠা ত্যাগ করে নাগরিক কাক। মাহবুব কবিরের এই কবিতাটি ২০১২ সালের অমর একুশে গ্রন্থমেলায় ভাষাচিত্র থেকে প্রকাশিত তাঁর তৃতীয় কাব্যগ্রন্থ ‘বেসরকারি কবিতা’র অন্তর্ভুক্ত। কবিতার নাম ‘নক্ষত্র’।

লক্ষণীয় যে, এই কবিতার ভাষা অতি সহজবোধ্য ও বক্রতাহীন। তবু এর অর্থ খুঁজতে গিয়ে কিছু পাঠক হয়ত-বা ‘ভিরমি’ খেতে পারেন, ঠিক যেভাবে কবি ‘ভিরমি’ খেয়েছেন নিজেরই সঙ্গে বিবাহবন্ধনে আবদ্ধ নক্ষত্রের বগলে ময়লা দেখে! আবার সম্ভবত বেশ কিছুদিন নক্ষত্রের সঙ্গে সাংসারিক জীবনে অভ্যস্ত হয়েই বলেছিলেন, “রহস্য-টহস্যের কিছু নেই”। ঠিক সেভাবে আমরা পাঠকরাও এর অভিন্ন কথাটিই বলতে পারি। কবিতার ভেতরে, তার তল খুঁজে বের করতে। মাহবুব কবির নব্বইয়ের কবি।

নব্বই দশকের গোড়া থেকেই কবিতায় ধীরে ধীরে ঢুকতে থাকে বহুরৈখিকতা। যদিও এ কবিতাটি সরলরৈখিক। মানুষকে তাঁর কবিতায় খুঁজে পাওয়া যায় নানাভাবে— বহুরূপে। ‘নক্ষত্র’-ও আমাদের দেখিয়ে দেয় মানুষ এবং পারিপার্শ্বিক বিমুগ্ধকর সব আলিম্পনের মাঝে যেন লুক্কায়িত ক্লেদ; কিছু মানুষের নির্জলা মনোহর দৃষ্টির অন্তরালে জমে থাকা অশ্রুপাথার। যেন অনন্তযৌবনা প্রকৃতির প্রতিটি অংশের প্রতি গভীর প্রেম-ঘৃণা, নৈকট্য এবং সমীক্ষণই তাঁর এ কাব্যকর্মের ভিত।

কবি তাঁর সমীক্ষণগুলোকে কাব্যসম্ভাষণায় সংরক্ষণ করে তা জানিয়েই স্ফূর্ত হয়েছেন প্রবল সমুচ্ছ্বাসে। সে সম্ভাষণায় থাকে নি বিমূর্ততা; যা অবসান ঘটাতে সক্ষম, পাঠকের কিংকর্তব্যবিমূঢ়তার। নক্ষত্রকে বিয়ে করার কথা জেনেই, কবিতার পরিপূর্ণ স্পর্শ না-পেয়েই অনেকে পেতে পারেন পরাবাস্তব ঘ্রাণ। কিন্তু আদৌ কি এ এক পরাবাস্তব কাব্যপ্রয়াস? আপাতত না। কেননা পরাবাস্তবতা অতল।

এ কথা জেনে ভাবনা হবে যে, এর তল খুঁজে পাওয়া সম্ভব কি না। সম্ভব; আমাদের তাকাতে হবে না, এ কবিতার তল যেন স্বয়ং আমাদের দিকে তাকিয়ে আছে। অতিবাস্তবতার দরজা বন্ধ থাক, এবার আমরা বাস্তবতায় আসি। বাস্তবে কি শূন্যে ভাসমান নক্ষত্রকে বিয়ে করে ফেলা সম্ভব? এমন প্রশ্ন নিতান্তই হাস্যকর। কিন্তু একটু চিন্তা করে কবির অবচেতন থেকে চেতনসম্পন্ন অভিব্যক্তিকে ধরে আনার চেষ্টা করা যেতে পারে।

নক্ষত্রকে ভেবে নেওয়া যায় অতি সুদর্শন বা মূল্যবান কোনো বস্তু। ধরি অর্থ বা টাকা; যার দ্বারা বর্তমান বিশ্বে বস্তুগত সকল প্রকার সুখ ক্রয় করা সম্ভব। যা এখন ভালো থাকার অনন্য সূত্র। আর তাকে বিয়ে করা মানে অঢেল অর্থসম্পত্তির কর্ণধার হওয়া। লক্ষণীয় যে, এই কাগজে তৈরি বস্তুটির এত গুণ, অথচ তা নোংরা।

নর্দমায় পড়ে যাওয়া অর্থসম্পদ তো আর ওভাবে পড়ে থাকতে দেওয়া যায় না। সেটাকেই তুলে শুকিয়ে নেওয়া হয়। মাছ-ব্যবসায়ী ও মেথরের নোংরা হাতেও থাকে টাকা। শ্রমিকের ঘর্মসমন্বয়ে টাকা হয় ক্লেদাক্ত। কিংবা জবাফুল।

দেখতে কি সুন্দর— মনোহর; অথচ নাকে নিলে বোঝা যায়— গন্ধহীন। এমনি করে এ-ও মানা যায়, বিশ্বের যতো সেলিব্রেটি; তা তিনি যে-ই হোন না কেন, তিনিও মানুষই। তিনিও সবার মতোই খান, ঘুমান, জরাগ্রস্ত হন, ঘুম থেকে উঠে প্রাতঃক্রিয়া সারতে শৌচাগারে যান, তিনিও ক্ষেত্রবিশেষে অশ্লীল। অতএব, সবকিছুকে কাছ থেকে দেখতে এবং পরখ করতে চাওয়ার প্রগাঢ় অভীপ্সা থেকেই কবির সৃষ্টিগুলো হয়ে উঠেছে অন্তঃসংবেদী, এবং কবিতার ভাব হয়েছে গভীরতার অধিকারী। যার ভেতর রয়েছে অসামান্য বিস্তার।

তাঁর কাব্যে অপরূপ সুন্দরভাবে প্রস্ফুটিত হয়েছে কথাদের কলা; ভাষা না হোক, কিংবা শব্দ না হোক; কথা। দর্শনে কাব্য নেই, কিন্তু কাব্যে থাকতে পারে অন্তঃসংবেদী দর্শন। নিম্নের উদ্ধৃতি থেকেই ব্যাপারটি স্পষ্ট হয় : “নক্ষত্রের মাথায়ও বিষ্ঠা ত্যাগ করে নাগরিক কাক” বেসরকারি কবিতার ফ্ল্যাপে কবি মুজিব মেহদী লিখেছেন : “বস্তুত বইটির মূল উৎপাদন গভীর ও নরম এক দেখবার ভঙ্গি, যা তৈরি হয় অন্তঃসংবেদী-নিস্পৃহতার অন্তরঙ্গ স্পর্শে, যেটা নিতান্তই মাহবুব কবিরীয়। আমাদের চেনা পরিমণ্ডলের অতি নৈমিত্তিক ও নৈমিত্তিক ঘটনাবলিই মাহবুব কবিরের কবিতার প্রিয় বিষয়। ” আমরা দেখছি, ‘নক্ষত্র’ কবিতাটিও আমাদের চেনা পরিমণ্ডলের বহির্ভুক্ত বৈশিষ্ট্যসম্পন্ন নয়।

সত্যিই যেন এক গভীর সংবীক্ষণের ভাষিক ক্ষরণ ঘটেছে তাঁর এই কবিতায়। আর ভাষায় ধরা পড়েছে সূক্ষ্ম এক বুননশৈলী, যার তলে সুপ্ত রয়েছে অতল গাম্ভীর্য, ভীষণ গতির সঞ্চার এবং নান্দনিক সব অভিজ্ঞান। কবিতায় প্রতীক নিয়ে এক নিদারুণ সুন্দর খেলায় মেতেছেন মাহবুব কবির। এক সুদৃঢ় শক্তিমান নান্দনিক প্রতীকীময়তায় উত্তীর্ণ হয়েছে ‘নক্ষত্র’ নামক এই কাব্য। প্রতীক দ্বারা যে কী লীলাময় মনোভাব বোঝানো সম্ভব, তা এই কবিতাটির গভীরে গেলে বোঝা যায় বটে।

আবার এমন কিছু প্রতীকীপনাও থাকতে পারে যা ভয়ানক দুর্বোধ্য। ফ্রান্সে ১৮৮৫ সাল থেকে ১৮৯৫ সাল পর্যন্ত যে প্রতীকবাদী শিল্পের আন্দোলন সংঘটিত হয়, তা যে সত্যিই সার্থক, সে কথার অন্যতম দৃষ্টান্ত হয়ে দণ্ডায়মান থাকবে মাহবুব কবিরের ‘নক্ষত্র’ নামের এই সৃষ্টি। [নিবন্ধটি গ্যাব্রিয়েল সুমন সম্পাদিত অনলাইন ছোটকাগজ 'দ্বৈরথ] '-এ প্রকাশিত। ।

অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।

প্রাসঙ্গিক আরো কথা
Related contents feature is in beta version.