আমাদের কথা খুঁজে নিন

   

হররঃ ফাটল ২য় পর্ব

আমি লেখক খারাপ হতে পারি কিন্তু ছেলে ভাল মিষ্টি একটা কন্ঠ ওকে ডাকছে। কে ডাকে? শফিককে কেউ একজন ধাক্কা দেয়। শফিক চোখ মেলে দেখার চেষ্টা করে। ও বুঝতে পারে না ও কোথায় আছে। সেই কন্ঠটা আবার শোনা যায়।

“এই তো চোখ খুলুন। খবর্দার ঘুমিয়ে পড়বেন না। চোখ খুলে তাকান। আমার কথায় মনোযোগ দিন। হ্যা এই তো, চোখ খোলা রাখুন।

আমার সাথে কথা বলুন। আপনার নাম কি বলুন তো...” শারমিন ডাকছে। শফিকের ঘোরের মত লাগছে। আবার চোখ বুজে ঘুমিয়ে পড়তে মন চাইছে। কিন্তু শারমিন ওকে কিছুতেই ঘুমাতে দেবে না।

ও একটু চোখ বন্ধ করতেই বারবার ঠেলা দিয়ে জাগিয়ে দিচ্ছে। আশ্চর্য, শারমিন ওকে আপনি আপনি করছে কেন? শফিক কি জেগে জেগেই স্বপ্ন দেখছে? কেমন ছাড়া ছাড়া স্বপ্ন। স্বপ্নের মাঝে সে টুকরো টুকরো শারমিনের কথা শুনতে পাচ্ছে। “এই যে আমার দিকে তাকাও। কতদিন আমার দিকে ভালো করে একটু তাকাও না বলত? আমি কি দেখতে খুব কুতসিত হয়ে গেছি? আমার দিকে আর তাকানো যায় না?” শফিক অপ্রস্তুত হয়ে পরে।

শারমিন হেসে ফেলে। “দেখ দেখ কেমন মুখ কালো করে ফেলছে। আরে আমি তো মজা করছিলাম। এতো অল্পেই এমন মুখ কালো করলে চলবে?” শফিক উত্তর দেয় না। শারমিন বলে, “কিন্তু আমি আসলেই দেখতে অনেক বদলে গেছি তাই না? কতদিন আয়না দেখি না।

প্লিজ আজকে আমায় একটু নিজের মুখটা দেখতে দেবে? জানি দেবে না। কি যে অসুখ হল। আমাকে আর কতকাল এভাবে বিছানায় শুয়ে থাকতে হবে বল তো? আমি কি আর ভাল হব না?” দৃশ্যপট পালটে যায়। হাসপাতাল কেবিন। বেডে শুয়ে আছে শারমিন।

দৃষ্টি ছাদের দিকে স্থির। ওর পায়ের কাছে বসে আছে শফিক। তাকিয়ে আছে শারমিনের দিকে। মেয়েটার চোখ দুটো দেখতে লাগছে মড়া মাছের চোখের মত। স্থির, পলকহীন।

খুব ধিরে ধিরে ওর চোখের কোনে একবিন্দু অশ্রু জরো হচ্ছে। অশ্রু ফোঁটাটা একটু একটু করে বড় হচ্ছে। শফিক অপেক্ষা করছে অশ্রুটা শারমিনের গাল বেয়ে নেমে আসার। কিন্তু অশ্রুটা ঝরে পড়ছে না, শারমিনের চোখের কোনে ঝুলে আছে বেহায়ার মত। দৃশ্যপট আবার পালটে যায়।

আশুলিয়া লেকের পার। শারমিন ওর হাত ধরে হাঁটছে। ওর মুখে একটা চঞ্চল হাসি লেগে আছে। বাতাসে ওর চুল আর ওড়না যেন পাল্লা দিয়ে উড়ছে। চুল সামলাতে সামলাতে উচ্ছ্বসিত কন্ঠে শারমিন বলল, “ইস কতদিন পর এই জায়গাটায় আসলাম, তাই না? আগে তো প্রতি সপ্তাহেই আসতাম।

... আচ্ছা ওই জায়গাটা কি এখনও আগের মত আছে? ওই যে পাথরটার উপর আমরা সব সময় বসতাম। চল না দেখি... আজ কিন্তু একটা বিশেষ কারনে তোমাকে এখানে নিয়ে এসেছি, বল তো কি? আমার দিকে ভালো করে তাকাও, তারপর অনুমান কর.... কি বলতে পারছ না? যাও না বলতে পারলে নাই, কি আর করা। আচ্ছা যাও তো দেখো আশেপাশে কোথাও আচার পাওয়া যায় কিনা। খুব টক কিছু খেতে ইচ্ছে করছে... আর শোন, তুমি একটা বুদ্ধু...। ।

” ...... “আপনার তেমন কিছু হয়নি। মাইনর কঙ্কাশন। দুই দিন কমপ্লিট বেডরেস্ট আর ভালমত খাওয়া দাওয়া, ব্যাস এটাই আপনার চিকিৎসা। মাঝে মাঝে একটু মাথা ঘুরতে পারে, বমি বমি লাগতে পারে ভয় পাবেন না। একটা পেইন কিলার লিখে দিচ্ছি।

কাল সকালে ব্যথা থাকলে এটা নাস্তার পর খেয়ে নেবেন। ” ডক্টর খস খস করে একটা ওষুধের নাম লিখল প্যডে। তারপর কাগজটা ছিঁড়ে শফিকের দিকে বাড়িয়ে দিল। শফিক কাগজটা হাতে নিয়ে ঝিম মেরে গেল। এখন কি করবে বুঝতে পারছে না।

“ডক্টর নাতাশাকে ডেকে দিচ্ছি। উনি আপনার সাথে দেখা করতে চাইছিলেন। ” “ডক্টর নাতাশা...?” “হ্যাঁ, উনিই আপনাকে হাসপাতালে নিয়ে এসেছেন। ” “আমি কি উনার গাড়ির সাথেই...” “হুম, ঠিক ধরেছেন। ” ডক্টর বের হয়ে গেলেন।

কিছুক্ষণ পর পর্দা সরিয়ে লম্বা একটা মেয়ে কেবিনে উঁকি দিল। মেয়েটির পড়নে ডক্টরদের সাদা ল্যবকোট। লম্বা কালো চুল শক্ত করে পনিটেইল করা। মেয়েটি হাসি মুখে বলল, “কি অবস্থা আপনার, এখন কেমন লাগছে?” প্রচন্ড বিস্ময়ে শফিক একেবারে স্থানুর মত হয়ে গেল। মেয়েটি একটা চেয়ার টেনে শফিকের পাশে বসে বলল, “ব্যথা ট্যথা আছে এখনো?” শফিক বিড়বিড় করে বলল, “শারমিন...?” “উহু, আমার নাম নাতাশা হায়দার।

এই হাসপাতালের গায়নোকোলজিতে আছি। ” “এটা কিভাবে সম্ভব?” শফিকের ঘোর কাটে না। “কেন আমাকে দেখে কি ডাক্তার মনে হয় না?” নাতাশা কপট রাগে ভ্রু কুচকাল। শফিক উত্তর না দিয়ে তাকিয়ে রইল। নাতাশা বলল, “দেখুন, আমি খুবই সরি যে আপনার গায়ে গাড়ি তুলে দিয়েছি।

ভাগ্যিস সময় মত ব্রেক করতে পেরেছিলাম। না হয় কিযে হত! এই আপনার কাছে মাফ চাইছি। মাফ করেছেন তো?” শফিক কিছু না বলে মাথা নাড়ল। নাতাশা কৈফিয়ত দেয়ার ভঙ্গিতে বলল, “আসলে গভীর রাতে হঠাত কল আসল আমার এক পেশেন্টের সিরিয়াস অবস্থা, তক্ষুনি সিজার করতে হবে। আমিও এমন পাগলের মত গাড়ি ছুটালাম যে...” শফিক দুহাতে নিজের মাথা চেপে ধরল।

নাতাশা ব্যস্ত হয়ে বলল, “সেকি, মাথা ব্যথা করছে?” শফিক বলল, “পানি খাব” কেবিনে জগে পানি নেই। নাতাশা পানি আনতে বাহিরে গেল। শফিক দুই চোখ শক্ত করে বুজে থকল। এসব কি হচ্ছে তার সাথে? সব কিছু এমন এলোমেলো লাগছে কেন? “এই নিন আপনার পানি। মাথা কি খুব বেশি ব্যথা করছে? দেখি আমার দিকে তাকান তো?” শফিক চোখ খুলে দেখল শারমিন ওর দিকে পানি ভর্তি একটা গ্লাস বাড়িয়ে দিয়েছে।

হ্যাঁ, কোন ভুল নেই। সেই চোখ, সেই ঠোঁট। এই চেহারা ভুলে যাবার নয়। শফিক পানির গ্লাস হাতে নিয়ে মুর্তির মত বসে রইল। “আপনার কি মাইগ্রানের সমস্যা আছে?” নাতাশা জিজ্ঞেস করে।

শফিক মাথা নেরে বলে, “না আমি ঠিক আছি। হঠাত মাথাটা যেন কেমন করে উঠল। এখন আর কোন সমস্যা নেই। ” “যাক, আপনি তো ভয় পাইয়ে দিয়েছিলেন। আপনার সিরিয়াস কিছু হয়ে গেলে নিজেকে কিছুতেই ক্ষমা করতে পারতাম না।

ডক্টর জামিল অবশ্য বলেছে ভয়ের কিছু নেই। রিপোর্টে আশঙ্কাজনক কিছু পাওয়া যায়নি। মাথায় হালকা চোট লেগেছে। কয়েক দিন বিশ্রাম নিলেই সেরে যাবে। ” শফিক বলে, “হ্যাঁ আমারও তাই মনে হয়।

আচ্ছা আমি এখন কোথায় আছি বলুন তো? মানে কোন হাসপাতালে আছি?” “কেউ বলেনি আপনাকে? আজব তো। আপনি এখন ইউনাইটেড হসপিটালে। ” “ইউনাইটেড হাসপাতাল...” এজন্যেই কি জায়গাটা এমন পরিচিত লাগছে? এই তো সেই ইউনাইটেড হাসপাতাল যেখানে শারমিনকে নিয়ে... “আচ্ছা আপনি এমন পাগলের মত রাস্তায় দৌড়াচ্ছিলেন কেন বলুন তো? আমি কিন্তু অনেকবার হর্ন দিয়েছি। আপনি শুনতেই পেলেন না!” “ইয়ে মানে আসলে...” শফিকের চিন্তার সুর কেটে যায়। ভেবে পায় না কি উত্তর দেবে।

তার মাথা কাজ করছে না। সামনে শারমিন বসে আছে। অথচ কেমন অপরিচিত মানুষের মত আচরন করছে। নিজের নাম বলছে নাতাশা। কেন? দুটো মানুষের চেহারায় কি এত মিল থাকতে পারে? অসম্ভব! “আচ্ছা আপনি বাসায় খবর দিয়েছেন?” “জি বাসায় তো কেউ নেই।

আমি একা থাকি। ” “ওহ, তাহলে রিলেটিভ বা ফ্রেন্ড কাউকে তো জানানো দরকার। আপনাকে এসে নিয়ে যাক। ” “অমন কেউ নেই। তাতে অসুবিধে হবে না।

আমি নিজে নিজেই যেতে পারব। ” “তা কি হয় নাকি। কঙ্কাশনের পেশেন্ট। একা একা বাড়ি ফিরতে গিয়ে আবার গাড়ির নিচে পড়বেন। আচ্ছা আপনার বাসা কোথায় বলুন তো।

” “মিরপুর ১১ নম্বরে” “আমি থাকি শ্যমলি, চলুন আপনাকে বাড়ি পৌছে দেই। ” “না না আপনি কষ্ট করবেন কেন? আমি নিজেই একটা ট্যক্সি বা কিছু খুঁজে নেব। ” “আমার সাথে গাড়ি আছে। চলুন, অসুবিধে হবে না। আপনাকে তো আরেকটু হলে মেরেই ফেলেছিলাম।

এখন বাড়ি পৌছে কিছুটা পাপ মোচন করি। ” শফিক মানা করতে যেয়েও শেষে কিভেবে থেমে যায়। অবিকল শারমিনের মত দেখতে এই মেয়েটির সাথে আরো কিছু সময় কাটাতে পারলে মন্দ কি? গাড়ি চলছে। নাতাশা বেশ ভালোই ড্রাইভ করে বুঝা যাচ্ছে। শফিক রিয়ারভিউ মিররে নাতাশাকে দেখছিল।

সরাসরি তাকাতে সংকোচ হচ্ছে। মিররে ওর চোখ দুটো খালি দেখা যাচ্ছে। চোখ দুটো অনেক বেশি চঞ্চল। শারমিনের চাহনি আরো শান্ত ছিল। নাতাশা হঠাত তাকাল রিয়ারভিউ মিররের দিকে।

চোখাচোখি হয়ে যেতেই শফিক দৃষ্টি নামিয়ে নিল। নাতাশা হেসে ফেলল, “কি দেখেন?” শফিক কিছুটা ইতস্তত করে বলল, “আপনার নাম কি সত্যি নাতাশা?” নাতাশা চোখ মটকে বলল, “কেন, আপনার সন্দেহ হচ্ছে?” “আমার খুব কাছের একজন মানুষের সাথে আপনার চেহারার খুব মিল। ” “তাই নাকি...” নাতাশা রাস্তা থেকে চোখ সরিয়ে শফিককে এক পলক দেখে নিয়ে বলল, “বেশ মজা তো। কোন দিক দিয়ে মিল?” “পুরো চেহারাই মিল। এমন কি জমজ বোনদের চেহারায়ও এতো মিল থাকে না।

আমার আসলে বিশ্বাস হচ্ছে না আপনি নাতাশা” নাতাশা খুক খুক করে হেসে ফেলল। “নাহ, আপনার কঙ্কাশন্টা মনে হচ্ছে সত্যি সিরিয়াস। চলেন হাসপাতালে গিয়ে সব আবার নতুন করে টেস্ট করাই” শফিকের কপালে চিন্তার ভাঁজ পরে। মেয়েটার শুধু যে চেহারা শারমিনের মত তা নয়, কথাবার্তা এমনকি হাসির ভঙ্গিটাও যেন শারমিনের কার্বন কপি। “আপনার সেই কাছের মানুষটা কে? আপনার স্ত্রি?” “জি, কিভাবে বুঝলেন?” “আপনার বলার ভঙ্গী থেকেই অনুমান করেছি।

সে এখন কোথায়? তাকে এক্সিডেন্টের খবর দিয়েছেন?” “জি না। ” “সেকি কেন? উনি দুশ্চিন্তা করবে না?” “সে বেঁচে নেই। ” “ওহ...” নাতাশা কিছুক্ষনের জন্যে চুপ হপ্যে যায়। যেন ভাষা হারিয়ে ফেলেছে। কিছুক্ষণ পর কথা গুছিয়ে নিয়ে বলে, “আমি খুবই স্যরি...” “না না ঠিক আছে।

এসব অনেক আগের কথা। ” নাতাশা আবার নিরব হয়ে যায়। গাড়ি চলছে। কেউ কোন কথা বলছে না। শফিকের মনে হতে থাকে কি দরকার ছিল নিজে থেকে শারমিনের মৃত্যুর কথাটা বলার।

নাতাশাই এক সময় নিরবতা ভেঙে বলে, “আপনার ওয়াইফের নাম কে ছিল?” “শারমিন সুলাতানা। শারমিন নামেই ডাকত সবাই। ” “কিভাবে... মানে তার মৃত্যুটা...” “অসুস্থ ছিল অনেক দিন। অসুখটা যে কি ডাক্তাররা অনেক গবেষণা করেও বের করতে পারেনি। ... বাচ্চার জন্ম দিতে গিয়ে অসুখটা বাঁধাল।

আমাদের প্রথম সন্তান। বাচ্চাটা বাঁচল না। আর শারমিন সেই যে বিছানায় পড়ল আর ভাল হল না। ... ওই অসুখ থেকেই এক সময়...” ভোরের আলো ফুটতে শুরু করেছে। রাস্তায় একটা দুটা মানুষ দেখা যাচ্ছে।

ভোরের পাখিরা তাদের নিড় ছেড়ে ডানা ঝারা দিয়ে বের হয়ে আসছে। আর কিছুক্ষণ পর গাড়ি শফিকের বাড়ির দোড় গোড়ায় পৌছে যায়। শফিক বলে, “আপনাকে এক কাপ চা খেয়ে যেতে অবশ্যই বলতাম কিন্তু...” “আরে না না ঠিক আছে... শারমিন দ্রুত মাথা নেরে বলে, “আপনি বাসায় গিয়ে রেস্ট নেন, চা আরেক দিন খওয়া যাবে। বাসা তো চেনাই থাকল। ” শফিক দরোজায় দাঁড়িয়ে আবার হাত নাড়ে।

শারমিন গাড়ি ঘুড়িয়ে চলে যায়। আরে!! সে আবারো গুলিয়ে ফেলছে। ও শারমিন নয়, নাতাশা। দুজনের চেহারায় অসম্ভব মিল। কথাবার্তায় ও মিল।

কিন্তু দুজনের পার্সোনালিটিতে বড় ধরনের পার্থক্য আছে। শারমিনের তুলনায় নাতাশা অনেক বেশি সপ্রতিভ আর আত্মবিশ্বাসি। শফিক ছোট্ট একটা নিঃশ্বাস ফেলে ঘরে ঢোকে। প্রচন্ড ঘুম পাচ্ছে। অফিসে একটা ফোন দেয়া উচিত।

কিন্তু শফিক গায়ে আর এক বিন্দু বল পাচ্ছে না। এমনকি জামা কাপড় ও ছারতে মন চাইছে না। শরীরটা কোনমতে টেনে নিয়ে বিছানায় ফেলতে পারলেই হল। শোবার ঘরে পা দিয়েই মাথটা আবার চক্কর দিল। ভীষণ বমি পাচ্ছে।

শফিক দেরি না করে ছুটে গেল বাথরুমে। বেসিনে মুখ গুজে হড়হড় করে বমি করে ফেলল। রাতে কিছু খায়নি, পেট থেকে একের পর এক ঢেউয়ের মত এসিড মিশ্রিত দুর্গন্ধময় তরল উঠে আসছে। শফিক নিঃশ্বাস নিতে পারছে না। মনে হচ্ছে আর বুঝি বাঁচবে না।

মিনিট পাচেক পর পেটের শেষ বিন্দু জলটুকুও বেসিনে উগলে দিয়ে শফিক হাঁটু ভাঁজ করে বসে পড়ল বাথরুমের ভেজা মেঝেতে। শরীর ঘামে ভিজে গেছে। বুকটা হাপড়ের মত উঠা নামা করছে। মুখের ভেতর বমির বিস্বাদ লেগে আছে। ওই তো ওই কোনে, অনেকটা এই ভাবেই বসে ছিল শারমিন।

আজ থেকে প্রায় তিন বছর আগে। পা দুটো বেকায়দা ভাবে সামনে মেলে ধরা। ছিট ছিট রক্তে লাল হয়ে উঠেছিল শারমিনের শাড়ি। শাড়ির পাড় বেয়ে রক্তের ধারা গড়িয়ে পরছিল মেঝেতে। বোবা অসহায়ত্ব ফুটে উঠেছিল শারমিনের মুখ জুড়ে।

ও তখন ছয়মাসের অন্তঃসত্ত্বা। বেঢপ ভাবে ফুলে ওঠা পেটটা বিচিত্রভাবে বেকে ভেতরে ঢুকে গেছে। শারমিনের ঠোঁট দুটো একবারই নড়ে উঠল... শফিক... শফিক উঠে দাঁড়াতে চাইছে। হাত বাড়িয়ে দিতে চাইছে তার স্ত্রীর দিকে। কিন্তু সে পারছে না।

শরিরটা এক চুল নড়াবার শক্তিও যেন অবশিষ্ট নেই। শারমিন উঠে দাঁড়াচ্ছে। তার ফোলা তলপেট বিশ্রীভাবে বেকেচুরে গেছে। শাড়ীর আঁচল লুটিয়ে পড়েছে মেঝেতে। নিতম্ব থেকে গলগল করে রক্তের স্রোত ঠেলে নেমে আসছে।

রক্তে ভেসে যাচ্ছে মেঝে। ইস, এতো রক্ত! পা টেনে এগিয়ে আসছে শারমিন, যেন সুতায় বাঁধা একটা প্রানহিন পুতুল। পেছনে ফেলে আসছে রক্তের চওড়া ছাপ। শফিকের কাছাকাছি এসে কাপতে কাপতে বসে পড়ে শারমিন। দু’হাতে শক্ত করে শফিকের বাহু চেপে ধরে।

দির্ঘ কালো চুলে ওর সুন্দর মুখটা ঢাকা পড়ে গেছে। শুধু চোখ দুটো দেখা যাচ্ছে। সে চোখে আগুন জ্বলছে। “আমাদের বাবুটা মরেনি শফিক। ওকে যখন আমার পেট কেটে নিয়ে গেল তখন ওর ছোট্ট বুকের ধুকপুকানি আমি অনুভব করেছি।

ওর কান্নার আওয়াজ আমি শুনেছি শফিক। আমাদের বাবুটা বেঁচে ছিল। ওরা যাই বলুক আমি কিচ্ছু বিশ্বাস করি না। আমি মড়া বাচ্চার জন্ম দেইনি। ওরা আমার পেট কেটে আমার বাবুটাকে নিয়ে গেছে।

ওরা আমার কলজেটা ছিড়ে নিয়ে গেছে শফিক। তুমি আমার বাবুকে আমার কাছে ফিরিয়ে দেবে। বল, তুমি দেবে না শফিক? তুমি কথা দাও......” ...... দূরে কোথাও কর্কশ শব্দ হচ্ছে। আহ শব্দটা থামে না কেন? শফিক ধিরে ধিরে চোখ মেলে তাকাল। সে শুয়ে আছে বাথরুমের মেঝেতে।

গায়ের কাপড় ভিজে গেছে। শফিকের শীত শীত লাগছে। বাইরে আঁধার নেমেছে। সে কতক্ষন এভাবে বাথরুমে পরে ছিল? কলিং বেল বাজছে। কেউ একজন অস্থির ভাবে এক নাগাড়ে বেল টিপে যাচ্ছে।

একটু পর পর দরোজায় ধাক্কা দিচ্ছে। শফিকের মাথায় ভীষণ যন্ত্রণা হচ্ছে। মাথার ভেতর একটা কিছু যেন ছিড়ে গেছে। শফিক টলতে টলতে বাথরুম থেকে বের হয়ে আসে। দরোজা খুলে দেখে রাহাত দাঁড়িয়ে আছে।

সে শফিককে দেখেই একেবারে হাহা করে উঠে। “আরে শফিক ভাই! এই কি অবস্থা আপনার? চেহারা এমন কেন? কি হইসে?” “ভেতরে আস রাহাত। শরীর ভালো না। একটা এক্সিডেন্ট হয়ে গেসে। ” “এক্সিডেন্ট! বলেন কি!” রাহাতকে বসতে দিয়ে শফিক সোফায় নিজেকে এলিয়ে দেয়।

অল্প কথায় ওকে এক্সিডেন্টের ঘটনা খুলে বলে। কিন্তু কেন যেন পার্কিং লটের ঘটনাটা এড়িয়ে যায়। সব শুনে রাহাত চোখ কপালে তুলে ফেলে। “আপনি একটা মানুষ মিয়া? এমন সিরিয়াস একটা ঘটনা আর আমারে একটা ফোন দিতে পারলেন না? ইস... আপনারে অফিসে না দেখেই মনে কু-ডাক দিল। শফিক ভাই তো অফিস কামাই করে না, তাও আবার কোন নোটিশ ছাড়া।

সারা দিন ফোন দিলাম, ফোন কেউ ধরে না। তাই ছুটি হয়ার পরেই আপনার বাসায় আসছি। আর আপনার বাসা খুঁজে বের করতেও জান বের হয়ে গেসে। আশ্চর্য, একটা বছর হয়ে গেল আপনি অফিসে আছেন, অথচ আমরা কেউ আপনার বাসার ঠিকানাটা ঠিকমত জানি না। ” রাহাত এক নাগাড়ে কথা বলে চলেছে।

ওর কথাগুলো কানে বাজছে। মনে হচ্ছে ঘর অন্ধকার করে শুয়ে থাকতে পারলে ভালো হত। রাহাতকে অবশ্য চলে যেতে বলা যাবে না। কোন এক অজানা কারনে এই ছেলেটা তাকে বেশ পছন্দ করে। “ভাই এখন কি অবস্থা? ডাক্তার ওষুধ পত্র কি দিসে?” “এখন মাথাটা বেশ ব্যথা করছে।

এছাড়া আর কোন অসুবিধা নেই। ওষুধ বলতে একটা পেই কিলারের নাম লিখে দিয়েছে। বলেছে কয়েক দিন বাসায় থেকে রেস্ট নিতে, তাতেই ভালো হয়ে যাব। ” “এহ, গাড়ির তলে পড়া কি যাতা কথা... আর আপনি ওই মহিলারে এত সহজে ছেরে দিলেন? ওইটার নামে মামলা দেয়া উচিত ছিল। ” “অন্য কেউ হলে আমাকে ওই রাতের বেলা রাস্তায় ফেলেই ভাগে যেত।

মহিলা আমাকে নিজের দায়িত্বে হাসপাতালে নিয়ে গেছে। ” “আরে রাখেন, গাড়ি চাপা দিয়া তারপর দরদ দেখাইতে আসছে। ” শফিক একটু উস খুস করে বলল, “আচ্ছা আজকে অফিসে গিয়ে তোমরা অদ্ভুত কিছু দেখেছিলে?” রাহাত অবাক হয়ে বলল, “অফিসে অদ্ভুত জিনিস তো বলতে তো আমাদের রিসেপশনিস্ট মেয়েটা... ওরে তো রোজই দেখি” “আহা ফাজলেমি না... শফিক অসহিঞ্চু কন্ঠে বলে... অদ্ভুত কিছু চোখে পরেনি? কাল আমি যখন অফিস থেকে বের হলাম তখন আমাদের ফ্লোরের বাথরুমের বেসিনটা নষ্ট হয়ে গেছিল। ময়লা পানি দিয়ে বাথরুম ভেসে গেছে। “কই? আজকে তো বাথরুম ঠিকঠাকই দেখলাম।

হয় তো সকালে আর সবাই আসার আগেই মিস্ত্রি ডেকে সারিয়ে নিয়েছে। এতে অদ্ভুতের কি আছে?” আর তোমরা পার্কিং লটে কিছু দেখনি? “না’তো, কি হয়েছে পার্কিং লটে?” “নাহ, কিছু না। ” আরো কিছুক্ষণ বকর বকর করে রাহাত চলে গেল। যাবার আগে বারবার করে বলে গেল কোন অসুবিধা হলেই যেন তাকে ফোন করে। আর তিন চার দিন অফিসে যাবার কোন দরকার নেই।

সে সব সামলে নেবে। রাহাত বিদায় নিলে শফিক সোফায় বসে ঝিম মেরে গেল। আজকে সকালে অফিসে গিয়ে সবাই বাথরুম স্বাভাবিক পেয়েছে? অবশ্য রাহাত যে ব্যখ্যা দিল সেটাও সত্যি হতে পারে। হয়তো খুব সকালে মিস্ত্রি ডেকে সারিয়ে নিয়েছে। কিন্তু শফিক যে অবস্থায় রেখে গেছে, তাতে সারা রাতে পানি পড়ে তো সব কিছু ভেসে যাবার কথা।

এতো অল্প সময়ে সব কিছু সামলে নিল কি করে? তার চেয়ে বড় কথা পার্কিং লতের ঘটনা কেউ কিছু জানে না। তার মানে কি? ওই খুনিটা নিশ্চয় ফিরে গিয়ে সব আলামত মুছে দিয়েছে। লাশটা কি করেছে কে জানে। আচ্ছা পার্কিং লটে তো সব সময় দুইজন সিকিউরিটি আর দারোয়ান থাকে। ওরা ওই সময় কই ছিল? তিনটা মানুষের একজনও ঘটনার সময় উপস্থিত থাকবে না এইটা স্বাভাবিক না।

আচ্ছা ওরা নিজেরাও এর সাথে জড়িত না’তো? শফিক খুনিটার চেহারা অন্ধকারে দেখতে পায়নি। খুনিটা নিজেই গার্ডদের কেউ হয়াটা অসম্ভব না। শফিক খুনির চেহারা না দেখলেও খুনি যে শফিককে ভালো করেই দেখেছে সেটা নিশ্চিত। লোকটা এখন কি করবে? সেকি এখন শফিকের পেছনে লাগবে? খুনের একমাত্র সাক্ষিকে সরিয়ে দিতে চাইবে? সন্দেহ নেই লোকটা কাল রাতে সেই চেষ্টাই করছিল। সে যে সুযোগ পেলে আবার চেষ্টা চালাবে না তার গ্যরান্টি কি? শফিকের এখন কি করা উচিত? তার কি পুলিশকে সব খুলে বলা উচিত? কিন্তু ঘটনার কোন প্রমান নেই, সে ছাড়া আর কেউ ওই সময়ে উপস্থিত ছিল না।

পুলিশ যে ওর কথা হেসে উড়িয়ে দেবে সে ব্যপারে সন্দেহ নেই। তাহলে এখন? এসব চিন্তা মুছে গিয়ে ওর সামনে হঠাত শারমিনের মুখটা ভেসে উঠে। শারমিন নাকি নাতাশা? শারমিনের মৃত্যুর আগে শেষের কয়েক দিন ওর কিছুটা মাথা খারাপের মত হয়ে গিয়েছিল। ও বার বার বলত ওর বাচ্চা মারা যায়নি। ও ওর বাচ্চার কান্না শুনেছে।

ওর বাচ্চাকে ডাক্তাররা চুরি করে নিয়ে গেছে। কিছুতেই বিশ্বাস করতে চাইত না যে ওর বাচ্চা দুনিয়ার আলো দেখার সুযোগই পায়নি। ওর পেট কেটে মড়া বাচ্চা বের করা হয়েছে। বাথরুমে পড়ে গিয়ে বাচ্চাটা মাথায় ভীষণ আঘাত পায়। ভেতরে রক্তক্ষরনের ফলে কিছুক্ষনের মাঝেই বাচ্চাটা মারা যায়।

ডক্টরদের কিছুই করার ছিল না। শফিক মড়া বাচ্চার মুখ দেখেনি। ডাক্তাররাই দেখতে নিষেধ করেছিল। একেই আন্ডার ডেভেলপড বেবি, তার উপর মাথা থেতলে গিয়ে ভয়ঙ্কর অবস্থা। কোন বাবার পক্ষে ওই দৃশ্য সহ্য করা সম্ভব নয়।

বাম হাতের কনুইয়ের উপরটা ব্যথা করছে। কি হয়েছে ওখানে। শার্টের হাতা টেনে উপরে তুলতেই শফিকের চক্ষু স্থির হয়ে গেল। বাম বাহুতে কাল হয়ে আছে। ঠিক সেই জায়গাটা যেখানে শারমিন চেপে ধরেছিল।

হঠাত শফিকের মনে প্রশ্ন জাগে সত্যি কি তার বাচ্চা মারা গেছে? নাকি শারমিনের কথাই সত্যি? *** আজ বাবা বাড়ি ফিরবে। কলেজ পড়ুয়া শফিক তার জন্যে অপেক্ষা করে আছে। শফিকের বাবা মেরিন ইঞ্জিনিয়ার। প্রায়ই তাকে জাহাজে চড়ে দির্ঘ দিনের জন্যে সমুদ্রে ভেসে পড়তে হয়। অনেক দিন পর পর বাবা যখন ফিরে আসে সেই দিনটা যেন শফিকদের বাড়িতে উৎসবের মত।

বাবা প্রায় সব সময়ই বাড়ি ফেরেন বেশ রাত করে। সেই রাতটা শফিক ও তার মা দুই জনেই না খেয়ে বসে থাকে। টেবিলে খাবার সাজিয়ে বাবার জন্যে অপেক্ষা করা শফিকদের পরিবারে একটা রেওয়াজের মত। শফিকের জীবনে সব চেয়ে বড় বন্ধু তার বাবা। সেই ছোট কাল থেকেই তার যত আহ্লাদ, আবদার, বিচার-আচার সব বাবার কাছে।

আর শফিকের বাবাও ছেলের জন্যে অন্তপ্রান। একটাই সন্তান তাদের, ভালোবাসতে কোন কার্পন্য করেন না। শৌশব পেড়িয়ে বড় বেলায় পদার্পন করার পর সময়ের ব্যবধানে সেই বন্ধুত্বের সম্পর্কটা ফিকে হয়ে যায়নি। বরং আরো প্রগাড় হয়েছে। শফিক নতুন কোন মিউজিক শুনেছে।

সেটা বাবাকে শুনাতেই হবে। নতুন কি মুভি দেখেছে, সেটা নিয়ে বাবার সাথে রাত জেগে ঘন্টার পর ঘন্টা আড্ডা চলবে। ক্লাসে কোন মেয়েটা বিশেষ ভাবে তাকিয়েছে, কোন মেয়েটা চিঠি দিয়েছে এসব নিয়ে বাপ ছেলেতে খুনসুটি তো লেগে আছেই। শফিকের মা মাঝে মাঝে কপট রাগ দেখিয়ে বলতেন, “ছেলে তো আর আমার না। ছেলের সব কিছু তার বাপের সাথে।

আমি পেলে পুষে বড় করলাম শুধুশুধুই। ” সেদিনও বাবা অনেক রাত করে বাড়ি ফিরলেন। কিন্তু আর সব বারের মত এবার হাসি মুখে শফিককে জড়িয়ে ধরলেন না। কোন মজার কৌতুক বললেন না। চিরচেনা হাসিখুশি মানুষটাকে আজ কেমন নির্লিপ্ত দেখাচ্ছে।

বাবার কি শরীর খারাপ? শফিক ব্যস্ত হয়ে উঠল। কিন্তু বাবা বেশ রুক্ষ স্বরে জানিয়ে দিলেন তিনি ঠিক আছেন। তাকে নিয়ে ব্যস্ত হবার কোন প্রয়োজন নেই। বাবা খাবার টেবিলে যোগ না দিয়ে সোজা শোবার ঘরে ঢুকে দরোজা লাগিয়ে দিলেন। বাবার কি হয়েছে? শফিকের মা’ও কোন জবাব দিতে পারলেন না।

শফিকের মত তিনিও অবাক হয়েছেন। সব তো ঠিকই ছিল, হঠাত করে মানুষটার কি হল? শফিক গিয়ে শোবার ঘরের বন্ধ দরোজায় ধাক্কা দিল। কোন উত্তর পাওয়া গেল না। শফিকের মা’ও স্বামিকে ডাকলেন। তাকে বের হয়ে এসে কি হয়েছে খুলে বলতে বললেন।

কোন সাড়া নেই। মা ছেলের দুশ্চিন্তা বাড়তে থাকল। এক সময় পাশের বাসা থেকে মজনু চাচাকে ডেকে আনা হল। তিনিও কয়েকবার ডাকাডাকি করলেন। কোন ফল হল না দেখে সিদ্ধান্ত নেয়া হল দরোজা ভেঙে ফেলা হবে।

পুরানো দিনের কাঠের দরোজা ভাঙতে বেশ কষ্ট হল। ভেতরে ঢুকে সবাই দেখল শফিকের বাবার প্রানহীন দেহটা ফ্যনের সাথে ফাঁস দিয়ে ঝুলছে। ঘরে একটা কাগজে ছোট্ট একটা নোট লেখা ছিল, “তুমি কাকে বিশ্বাস করবে?” এইটুকুই... শফিক এই মুহুর্তে সেই নোটটা হাতে নিয়ে বসে আছে। তার সামনে একটা ছোট্ট বাক্স খোলা। তাতে বাবার টুকিটাকি বিভিন্ন জিনিস পত্র, সিগারেট কেস, রুমাল, পেন্সিল এই সব হাবিজাবি।

বাবার স্মৃতি হিসেবে এতকাল শফিক এই সব জমিয়ে রেখেছে নিজের কাছে। সেই সাথে রেখে দিয়েছে এই টুকরো কাগজটাও। তার বাবার শেষ স্মৃতি চিহ্ন। জগত সংসারের উপর তীব্র অবিশ্বাস থেকে তার বাবা আত্মহত্ত্যা করেছিলেন। কি ছিল সেই অবিশ্বাসের কারন? বাবার মত করে আজ শফিকের ভেতরেও একটা তীব্র অবিশ্বাস জন্ম নিচ্ছে।

অথবা বলা যায় অতিতের এক সত্য যাকে সে অসম্ভব বলে দূরে সরিয়ে রেখেছিল, সেই সত্যকেই আজ এক নতুন আলোতে দেখছে। শারমিনের মৃত্যু বার্ষিকী যত কাছে ঘনিয়ে আসছে ততই শফিক ঘন ঘন ওকে স্বপ্নে দেখছে। এখন প্রায় প্রতি রাতেই শারমিন ওর স্বপ্নে ভিড় করে। স্বপ্নটা শুরু হয় সহজ ভাবেই। প্রায় সব সময়েই স্বপ্নে তাদের কোন মধুর পুরনো স্মৃতিতে দুজনে আবার ফিরে যায়।

স্বপ্নের এ পর্যায়টা অনেকটা যেন স্মৃতির সাগরে ভেলায় ভেসে পড়ার মত। ভার্সিটির ক্লাস ফাকি দিয়ে আশুলিয়া ঘুরতে যাওয়া, একাকি পার্কে চুরি করে চুমু খাওয়া, হুড ফেলে দিয়ে ঝুম বৃষ্টির মাঝে রিক্সায় এলোমেলো ঘুরে বেড়ানো। এমনি কত স্মৃতি। কিন্তু একটু পরেই স্বপ্নগুলো বদলে যায়। প্রতিটা স্বপ্নের শেষে এসে শারমিন কান্না ভেজা গলায় অনুনয় করে তার বাচ্চা মরেনি।

ডাক্তাররা তার বাচ্চাকে নিয়ে গেছে। শফিক যেন তার বাচ্চাটাকে খুঁজে আনে। এগুলো কি শুধুই স্বপ্ন? নাকি সত্যি সত্যি শারমিনের বিদেহি আত্মা স্বপ্নের মাঝে তাকে সত্যি কথাটা জানিয়ে যায়। অথবা এমন কি হতে পারে যে সত্যিটা শফিকের অবচেতন মন সব সময়ই জানত? সেই অবচেতন মন থেকে এখন সত্যিটা সামনে বেড়িয়ে আসতে চাইছে। শফিকের সন্তান আসলেই বেঁচে আছে।

রক্তের টান অবিচ্ছেদ্য। শফিক তার শিরায় শিরায় প্রবাহিত প্রতিটি রক্ত কণিকায় সেই টান অনুভব করছে। ..... পরের দুইটা দিন শফিকের এক রকম ঘোরের মধ্যে দিয়ে গেল। এই দিনগুলোতে শফিক প্রচুর চেষ্টা করল শারমিনের অপারেশনের সময়কার ডাক্তার নার্স সবার সাথে কথা বলতে। তবে বেশির ভাগ ক্ষেত্রেই শফিক ব্যর্থ হল।

শারমিনকে দেখেছিলেন ডক্টর ইয়াসমিন। খোঁজ নিয়ে জানা গেল তিনি এখন দেশের বাইরে আছেন। সার্জারির সময় আরো ছিলেন ডক্টর মুস্তাফিজ। এই মানুষটা দেশেই আছেন। কিন্তু অনেক চেষ্টা করেও কেন যেন শফিক তার নাগাল পেল না।

মানুষটা যেন বায়বীয়, যতবার ধরতে যায় প্রতিবারই আঙুলের ফাক গলে বের হয়ে যাচ্ছেন। ডক্টরদের থেকে বেশি নার্সদের সাথে কথা বলা দরকার। শারমিনের অপারেশনের সময় কোন কোন নার্স উপস্থিত ছিল, পরবর্তিতে আইসিইউতে কোন কোন নার্স অর্ডারলি দায়িত্বে ছিল তার একটা লিস্ট তৈরি করে আগানো প্রয়োজন। সমস্যা হচ্ছে নার্সদের প্রায় কারোর নামই জানা নেই। দুই একজনের চেহারা শুধু মনে আছে।

শফিক আন্দাজে দুই একজনের সাথে কথা বলে দেখল। এত আগের ঘটনা সম্পর্কে কেউই পরিষ্কার কিছু বলতে পারল না। হাসপাতালে সব সময়ই নতুন নতুন প্রেগ্নেন্সির রোগি আসছে। তাদের কেউ কেউ মৃত শিশুর জন্ম দিচ্ছে। এখানে এটা স্বাভাবিক ঘটনা।

তিন বছর আগের কথা কে মনে রাখতে গেছে? শফিক সেই সময়কার হাসপাতালের রেকর্ড ডকুমেন্টসগুলো ঘেটে দেখল। এই ব্যপারে আবার হাসপাতাল কর্তৃপক্ষ খুব কড়া, কিছুতেই বাইরের কাউকে ইন্টারনাল ডকুমেন্টস দেখতে দেবে না। অবশেষে একজন অর্ডারলিকে কিছু টাকা ঘুস দিয়ে সেই সময়ের কিছু পেশেন্ট ট্রিটমেন্ট রেকর্ডের ফটোকপি বের করে আনা গেল। কিন্তু সেগুলো থেকে শফিক তেমন কোন তথ্য বের করতে পারল না। শফিকের আশা ছিল যদি সে সেই সময়ের ডাক্তার নার্স সবার সাথে কথা বলতে পারে তবে সে নিশ্চয়ই তার বাবুর অপহরণকারীকে চিহ্নিত করতে পারবে।

কাজে নেমে তার পুরো বিষয়টাকে এখন রীতিমত অসম্ভব মনে হতে থাকে। অন্য কেউ হলে আরো অনেক আগেই হাল ছেরে দিত নিশ্চিত। কিন্তু তখন শফিকের ভয়ঙ্কর রকম জিদ চেপে গেছে। সে এর শেষ দেখে ছাড়বে। আর পুরো ব্যপারটাতেই কোথায় যেন বড় রকমের ঘাপলা আছে।

সে শিশু মৃত্যু নিয়ে যার সাথেই কথা বলতে যায় সেই কেমন যেন চমকে উঠে, কথা বলতে চায় না। সবার মধ্যে কেমন যেন একটা চাপা অস্বস্তি, কি যেন গোপন করে যাচ্ছে এমন একটা ভাব। বিশেষ করে এই বিষয়ে হাসপাতাল কর্তৃপক্ষের সাথে কথা বলতে গেলে তারা রীতিমত রুক্ষ আচরন করল। এতে শফিকের সন্দেহ আরো বেড়ে গেল। তৃতীয় দিন ইনফর্মেশন ডেস্কের লোকটার সাথে ঝগড়া, এরপর এক রকম হাতাহাতি হয়ে গেল।

ওরা সিকিউরিটি ডেকে শফিককে হাসপাতাল থেকে বের করে দিল। সেই সাথে শাশিয়ে দিল, আবার এখানে এসে ঝামেলা করলে তাকে পুলিশে দেবে। টানাহ্যচড়ায় শফিকের শার্টের পকেট ছিড়ে ঝুলছে। শফিক সেই ছেড়া শার্ট নিয়েই রাস্তার পাশের একটা হোটেলে ঢুকে গেল। মেজাজ অত্যন্ত খারাপ।

সেই সাথে মাথাও ধরেছে ভীষণ। হেড়ে গলায় হোটেল বয়কে ডেকে চা আর দুইটা ডালপুরির অর্ডার দিল। চায়ের কাপে মাছি ভাসছে। শফিক দির্ঘ সময় চেয়ে আছে মাছিটার দিকে। চায়ের মধ্যে তার শরীরের অর্ধেকটা ডুবে গেছে।

মাছিটা এখনও বেঁচে আছে। মাঝে মাঝে একটু একটু পা নাড়ছে। আচ্ছা মাছিটার কুকড়ে যাওয়া শরিরটার সাথে ভ্রুনের মিল আছে না! মায়ের গর্ভে একটা শিশু অনেকটা এই ভঙ্গিতেই বুকের কাছে হাত পা ভাঁজ করে গুটিসুটি মেরে থাকে। একটু পর তার কাছে মনে হয় চায়ের কাপে ছোট্ট একটা বাচ্চা হাবুডুবু খাচ্ছে। শফিক দুই আঙুল দিয়ে মাছিটাকে তুলে আনলো চোখের কাছে।

ব্যটা এখনো হাত পা নাড়ছে। আশ্চর্য! চায়ের উত্তাপে তো ওর এতক্ষনে সিদ্ধ হয়ে যাবার কথা! শফিকের টেবিলে কেউ একজন চেয়ার টেনে বসল। “আপনার নাম শফিকুল ইসলাম?” শফিক চমকে মুখ তুলে তাকাল। মাঝবয়েসী একটা লোক তার সামনে বসে আছে। চোখে ভারি চশমা, মাথায় কাঁচাপাকা এলোমেলো চুল।

পড়নে ঢোলা শার্ট। “জি? আমাকে বলছে?” “হ্যাঁ, আপনি শফিকুল ইসলাম তো?” “জি, আপনি আমাকে কিভাবে চেনেন?” “বলছি। আমি আসাদূর রহমান। ” “জি আসাদ সাহেব বলেন...” “আপনাকে আমি দুই দিন দেখেছি ক্রিসেন্ট হাসপাতালে। আপনি কিছু বিষয়ে তথ্য চাইছেন, ঠিক না?” “হ্যাঁ ঠিক।

” “আমি ক্রিসেন্ট হাসপাতালের গায়নোকলজি ডিপার্টমেন্টের ফরমার হেড। আমি হয়তো আপনাকে সাহায্য করতে পারব। ” শফিক ভ্রু কুচকে মানুষটিকে ভালো করে দখে। লোকটার মধ্যে কেমন যেন একটা এলোমেলো খাপছাড়া ভাব আছে। চোখের দৃষ্টি কিছুটা উদভ্রান্ত, অস্থির।

দেখে মোটেই একটা বড় হসপিটালের ডিপার্টমেন্ট হেড বলে মনে হয় না। গায়ে পড়ে সাহায্য করতে চাইছে। ব্যটার অন্য কোন মতলব নেই তো? “কি ধরনের সাহায্য?” “আপনি কিছু কনফেদেন্সিয়াল ডকুমেন্ট চাইছেন। ওরা আপনাকে দিচ্ছে না। আপনি সোজা লাইনে চাইলে কখনো দেবেও না।

আমি আপনাকে অন্য কোন ভাবে ডকুমেন্টগুলো বের করার উপায় করে দিতে পারি। ” “অন্য উপায় বলতে......?” “বলছি। কিন্তু তার আগে বলুন আপনি কি সাংবাদিক?” “না” “তাহলে আপনি এই ডকুমেন্টগুলো দিয়ে কি করবেন? আই মিন আপনার উদ্দেশ্যটা কি?” “উদ্দেশ্য তো একটা আছেই। ” “হুম... আপনার ঠিক কি কি দরকার বলুন তো?” “মার্চের ২৮ তারিখ, ২০০৯ এই সময় অপারেশন থিয়েটারে আর আইসিইউতে কে কে দায়িত্বে ছিল। ওই সময়ের দায়িত্বে থাকা বা অফ ডিউটিতে ওই সময় ফ্লোরে উপস্থিত ছিল এমন সব নার্স ওর্ডারলির নামের লিস্ট।

সম্ভব হলে তাদের পার্সোনাল প্রোফাইল, ওয়ার্ক হিস্টোরি, ফ্যমিলি ব্যকগ্রাউন্ড এইসব। ” “আইসিইউ?... হুম। এগুলো দিয়ে আপনি কি করবেন?” “সেটা আপনাকে এখনি বলতে চাইছি না। ” “আচ্ছা আপনি কি করেন? মানে আপনার পেশাটা কি?” “আমি একটা বেসরকারি ব্যঙ্কে আছি। ” “তারমানে খোজা খুজির কারনটা পার্সোনাল।

হুম। । আপনার কি বিশেষ করে আইসিইউর স্টাফদের তথ্য দরকার?” “হ্যাঁ” “হাসপাতাল খুব বেশি রেকর্ড মেইনটেইন করে না। তবে যা আছে তা আপনি পাবেন হাসপাতালের রেকর্ড আর্কাইভে। ” “রেকর্ড আর্কাইভে যাবার উপায়টা কি? কার কাছে এপ্লিকেশন করতে হবে?” “এপ্লিকেশন করে তো আপনি কোথাও পৌছাতে পারবেন না।

আপনাকে অবশ্যই চুরি করে ঢুকতে হবে। ” লোকটা কি মজা করছে? নাকি উলটা পালটা কথা বলে ওকে কোন ঝামেলায় ফাঁসাতে চাইছে? আসাদ সাহেবের চেহারা ভাবলেশহিন। দেখে বুঝার উপায় নেই সে কতটা সিরিয়াস। “কি বলছেন আপনি? চুরি করে ঢুকব মানে?” “এই জন্যেই জিজ্ঞেস করছিলাম তথ্যগুলো আপনার কেন দরকার। কারনটা জানলে বুঝতে পারতাম এই ব্যপারে আপনি কতটা সিরিয়াস।

” শফিক কিছুটা অস্বস্তির সাথে বলল, “দেখুন, আপনি ঠিকই ধরেছেন। ব্যপারটা পার্সোনাল। সবার সাথে শেয়ার করতে চাই না। ” “কিন্তু আপনাকে সাহায্য করার আগে আমার বুঝতে হবে আপনাকে আমি বিশ্বাস করতে পারি কিনা। আর সেজন্যে আপনার প্রথমে আমাকে বিশ্বাস করতে হবে।

” শফিক কিছউক্ষন উসখুস করে তারপর বলা শুরু করল, “আমার ওয়াইফ ক্রিসেন্ট হসপিটালের পেশেন্ট ছিল। প্রেগ্নেন্সি কেস। প্রি-ম্যচিউরড ডেলিভারি হয়েছিল। শেষ পর্যন্ত আর বাচ্চাটাকে বাঁচানো যায়নি। ” “তারপর?” “।

অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।

প্রাসঙ্গিক আরো কথা
Related contents feature is in beta version.