আমাদের কথা খুঁজে নিন

   

আমার দুলাভাই আমার বস আর আমার লাল, নীল, কর্পোরেট কালার কষ্ট

কার্ণিশ ভাঙ্গা জানালার ফাঁক দিয়ে রাতের আকাশের যেটুকু অংশ দেখা যায়, অইটাই আমার পৃথিবী। যে বয়সে আবেগ, অভিমান, ক্রোধ ঠ্যাঁ ঠ্যাঁ করে, হরমোন সিক্রিয়েশনের তাড়া থাকে, না সে সব কিছুই নেই। শালা বাইন্‌চোত কিছিমের গালিগুলা বমি করতে ইচ্ছে করে। গলা বরাবর এসে আটকে যায়। অভিমানশূণ্য হয়ে গেলাম বুঝি।

মাঝরাতে ঘুম ভেঙ্গে গেলে হাজার বছরের অরব অন্ধকার, তীব্র একাকীত্ব আক্রমণ করলে, নিজের দিকেই একটা গালি ছুটে আসে, শালা বাইন্‌চোত। রোঁয়া উঠা শরীরের একটা নেড়িকুত্তা তেড়ে আসে। আমার চাকরিটা দরকার ছিল; দুটি কারণে। একটি আমার নিজের বেঁচে থাকা অন্যটি খুব গতানুগতিক, প্রেম ও প্রেমিকা টিকিয়ে রাখা। আন্তর্জাতিক সম্পর্ক বিষয়ে অনার্স পাশ করে একটা ফ্যাশন ম্যাগাজিনের সহকারি সম্পাদক হিশেবে শুরু করলাম।

সহকারি তো! লোকে বলে, যার নাই কোন গতি, সে হয় সহ-সভাপতি। সহকারিও ঐ একই জিনিস। রাত জেগে কাজ করি। সম্পাদক ও প্রকাশকের ফুট-ফরমায়েশ খাটি, থাকতে খাইতে দেয়। সুন্দর সুন্দর মেয়ে মানুষ দেখি, বিয়ারটা, মদটা দেয়, কিন্তু মাইনেটা শালা দিতে চাই না।

প্রথম ছয় মাস এই এরকমই চলছিল। পেট গরম করে তো লাভ নাই, প্রেম যখন চেঁচিয়ে উঠে- অকর্মণ্য বলে, প্রেম বিষয়ে কাহ্‌লিল জিব্রানের অমোঘ বাণী যখন অক্ষরে অক্ষরে ফলে যেতে দেখি, তখন ত্রাহি ত্রাহি অবস্থা, ছেড়ে দে মা, কেঁদে বাঁচি। কী করি। আমার কিছু অতীব ভালো বড় ভাই আছে। তাঁদের মধ্যে দু’জন-অপু ভাই অন্যজন আনন্দ ভাই।

এই যাত্রায় অপু ভাই অবতার হিশেবে উপস্থিত। দ্বিতীয় অধ্যায়। ফ্যাশন ম্যাগাজিনের সহকারি সম্পাদকের পদ ছেড়ে দিয়ে, একটা বিদঘুঁটে পরীক্ষা শেষে, দেশের সবচে’ বড় আইটি কোম্পানিতে (সিএসএল) মার্কেটিং বিভাগে বিজনেস ম্যানেজার গ্রেড-৯ এই পদে কাজ করতে শুরু করি, বেতন ৭০০০ টাকা। এখানে একটা বিষয় বলে রাখা ভালো, আমি গিয়েছিলাম চাকরির জন্য, তাঁরা বললেন, চাকরি না, ইন্টার্ন। আমার বস, আমার দুলাভাই।

অর্থাৎ আমার ইউনিভার্সিটির এক ব্যাচ সিনিয়র আপুর হাজব্যাণ্ড, সেই সূত্রে। তিনি বললেন, ঝামেলা করো না, শুরু কর, পরে আমি দেখবো। উনাকে আমি আগে থেকে জানতাম। মানুষ হিশেবে যথেষ্ট ভালো, সমঝদার, পড়ুয়া এবং মেধাবীও। আমি শুরু করলাম।

ছয় মাস পরে প্রবেশনে গেলে বেতন বাড়বে। বাহ্‌ কী সুখ! কী মজা! ছয় মাস পর। বললেন। তোমার এটা প্রসেসিং এ আছে। চিন্তা করো না।

মনোযোগ দিয়ে কাজ কর। ততদিনে আমি ধরেই নিয়েছি/আসলে স্থির সিধান্তে পৌঁছে গেছি, হ্যাঁ আমি মার্কেটিংয়েই কাজ করবো পেশা হিশেবে। যথাযথ মনোযোগ, কায়িক ও মানষিক শ্রম, ভাই বলেছিলেন, কাজে ডেডিকেশন থাকলে, উপরে উঠার সিঁড়ি খুব কুসুমাস্তীর্ণ হয়, সুতরাং ডেডিকেশন দিয়ে কাজ করতে থাকি, প্রবেশনে গেলে বেতন বাড়বে এই আশায় আট মাস, সাত হাজার টাকায়। ভাইকে বললাম, ভাই। ভাই বললেন, তোমাকে প্রবেশনে দেব না, একেবারে পার্মানেন্ট।

কাজ কর। আট মাস পর ১২ হাজার টাকা বেতনে পার্মানেন্ট। আমি প্রথমে একটু গাঁইগুই করলাম, অনেক অনুনয় বিনয়ের সাথে ভাইকে বললাম, একটু বাড়িয়ে দেন। সচরাচর আমি উনার সাথে দ্বিমত পোষণ করি না। এটা একেবারে মন থেকে, শ্রদ্ধার বশে।

মাস শেষে দেখি বেতন পাই, ১০৮০০ টাকা। ছেঁড়ে দেয়া যাবে না চাকরিটা, ভাই রাগ করবেন, আমার প্রেম, আমার ঢাকা শহরে বেঁচে থাকা, সব সব এই চাকরির উপর। যে বয়সে আবেগ, অভিমান, ক্রোধ ঠ্যাঁ ঠ্যাঁ করে, হরমোন সিক্রিয়েশনের তাড়া থাকে, না সেসব কিছুই নেই। শালা বাইন্‌চোত কিছিমের গালিগুলা বমি করতে ইচ্ছে করে। গলা বরাবর এসে আটকে যায়।

অভিমানশূণ্য হয়ে গেলাম বুঝি। তৃতীয় অধ্যায়। বারো মাসের মাথায় চাকরিটা ছেঁড়েই দিলাম, অনেক বুঝালাম ভাইকে, বেতন একটু বাড়িয়ে দেন। এই দুর্মূল্যের বাজারে চলছে না। যে ডেডিকেশন, আগ্রহ, শ্রম দেয়ার স্বতস্ফূর্ততা সব ধীরে ধীরে মিঁইয়ে পড়তে শুরু করল।

ভাইকে সরাসরি, অন্যকারো মাধ্যম দিয়ে অনবরত বুঝাতে চেষ্টা করলাম। এর মধ্যে মাস্টার্স দিয়ে দিলাম। চাকরির মধ্যে থেকেই। ভাই আমাকে এই সুযোগটা দিলেন এবং এইসব বিষয় তিনি উদার। ছাত্রজীবনে আন্তর্জাতিক সম্পর্ক বিষয়ে যত নেগোসিয়েশন্স থিওরি রপ্ত করেছিলাম, সবই কপচাঁনো কমপ্লিট।

মনে হয় পড়াশুনাটা ধান দিয়ে পড়া, চাল দিয়ে না। যখন দেখলাম আমার পরে যারা জয়েন করছে, তাঁরা সবাই , একই গ্রেডে আমার চেয়ে বেশি বেতনে। আমাকে নিয়ে আমার সিনিয়র কলিগদের সাথে নিয়ে কাউন্সেলিং করলেন অনেকবার। এটা উনি আমার প্রতি ভালোবাসা থেকেই। এরমধ্যে ডেস্টিনির হাত ধরে প্রেম উড়াল দিছে।

প্রেমিকার ব্যাকগ্রাউন্ড শুনলে কেউই বিশ্বাস করবেন না, এই মেয়ে ডেস্টিনি করতে পারে না, আর যেই করুক। শান্ত-মারিয়ম থেকে ফ্যাশন ডিজাইনে অনার্স করে, একটা ফ্যাশন হাউজে কাজ করতে করতে হঠাৎ ডেস্টিনি এসে হাজির। আমাকে কয়, চাকরি ছাড়ো, আমার সাথে এসে ডেস্টিনি করো। আমারও একটু ঝামেলা আছে। আমি বদমেজাজি, নেগোসিয়েশনের সময় একরোখা, সবসময় ইউ ম্যাসেজ দিয়ে কথা বলা (কনফ্লিক্ট ম্যানেজমেন্ট এ একটা থিওরি আছে, আলোচনার সময় “আই ম্যাসেজ ও ইউ ম্যাসেজ” এর ক্ষেত্রে আই ম্যাসেজ দিয়ে কথা বলা, অর্থাৎ আমরা এই ভুলটা করেছি, আমরা এই বিষয়ে আলোচনায় বসতে পারি, আমরা এভাবে করি ইত্যাদি, ইউ ম্যাসেজ হচ্ছে, তুমি এমন, তুমি তেমন, তুমি এটা কেন করেছ) কিছুটা চারিত্রিক স্খলন (মাঝে মাঝে মদ খাওয়া, সিগারেট খাওয়া, পর নারীর প্রতি দৃষ্টি দেয়া কিছিমের, কিন্তু ঐ এটুকুই, দৃষ্টি দেয়াটাই) আছে।

তিনি ভাবলেন, ছেলেটা ছ্যাঁকা খেয়ে, এপোড় ওপোড় হয়ে গেছে। কিন্তু আমি মালডা ঘটনার আকষ্মিকতায় তাজ্জব বনে এমন হয়ে গেলাম যে, আসুক শালা চোখের পানি, কাঁদব না। বল্লেন, তুমি আগের মত কাজ করছ না। মনে মনে বললাম, ভাই আপনি ২২ জনের একটা টিমের বস, সবই বুঝেন, এটা বুঝেন না, যে ছেলেটা ১৮০ কিমি গতিতে কাজ করত, সে হঠাৎ ৭০কিমি গতিতে দৌঁড়ছে কেন? এতে তার নিজেরও ভাল্লাগছে না। ভাইকে বললাম, না ভাই, টাকা দেন কাজে গতি আসবে আগের মত।

হলো না। ছেঁড়ে দিলাম। ভাইকে বললাম, ছেঁড়ে দিচ্ছি। ভাইকে বললাম ওয়াইকেকে তে চাকরি হইছে। ভাই বল্ল, ওরা আমাদের পার্টনার।

ঠিক আছে। ভালো তো, যাও। দোওয়া থাকল। আসার দিন, সকালে, ভাই আচ্ছা মত ঝাড়ল। মানে বুঝি নাই।

আগের দিন তো সবাই মিলে মজা করলাম। আমি চলে যাচ্ছি, এটা নিয়ে সবাই মন খারাপ করল। কিন্তু আজ? মাথার উপর দিয়ে গেল। পুরোদিন অফিস করে, সাড়ে ছয়টায় আমার সিনিয়র কে ল্যাপটপ, আইডি কার্ড, আমার কাজ বুঝিয়ে দিলাম। ভয়ে, লজ্জায়, কিছুটা অভিমানে ভাইয়ের সাথে দেখা না করেই চলে এলাম।

চলে আসার দ্বিতীয় দিন পর আমার বড় আপু, অপু ভাই এবং আরো কেউ কেউ ফেবুতে আমার বিরুদ্ধে মাল্টিকালার অভিযোগ উপস্থাপন করল, যার জবাব আমি দিয়েছিলাম চলে আসার দিনই, ফেবুতে, ফোনে, সামনা-সামনি। যাইহোক, কোন এক অজ্ঞাত কারণে আমার ওয়াকেকের চাকরিটা হয়নি, আমার প্রথম লাল রঙের কষ্ট। এরপর অনেকদিন ধরে আমার শালা কোন চাকরি হয় না। আমি তো অবাক। এত বড় জায়গায় কাজ করার অভিজ্ঞতা, তবু চাকরি হয় না।

মানে কী। একদিন আমার মত পলাতক পুরনো কলিগের সাথে দেখা। জিজ্ঞাসা করলে বললাম, না হচ্ছে কিছুই। বল্ল, সিএসএল’ র রেফারেন্স বাদ দাও। আমি বললাম, না, ভাই আমার সাথে একাজটা অন্তত করবে না।

তাছাড়া আমি এমন কিছু তো করিনি উনার সাথে। গত সপ্তাহে একটা ভাইভা দিলাম। নানা প্রশ্ন, সঠিক উত্তর। একপর্যায়ে বললেন, সবই ঠিক আছে আপনার, তবে আপনার আগের বসের সাথে একটু কথা বলে নিই। আমি ফুল কনফিডেন্স নিয়ে বললাম, আমি তো ভেবেছি আপনারা আগেই খোঁজ-খবর নিয়ে, কথা বলে তারপর আমাকে ডেকেছেন, তো ঠিক আছে।

কিন্তু আমার সামনে বলবেন? বল্ল, হ্যাঁ। কেন, আপনি কী কোন আকাম করে এসেছেন না কী? আমি ঘটনার আকষ্মিকতায় পুরাই, ঠাস্কিত। নীল কষ্টে জর্জরিত। কয় কী! বললেন, ঠিক আছে আপনি চুপ করে থাকেন, আমরা সবাই মিলে শুনব, লাউডস্পিকারে কথা হবে। আপনি যে সাথে আছেন এটা ও যেন না বুঝে।

বুঝলাম, এরা পূর্বপরিচিত, পরে জানলাম বন্ধু। লাউডস্পিকারে কথা শুরু হলঃ ঃ আচ্ছা অমুক, তোমার কাছে অমুক দীদার নামে যে ছেলেটা কাজ করত, ছেলেটা কেমন? ভাই ওপার থেকেঃ কেন, ছেলেদের খোঁজ নেয় তো, বিয়ে দেবার জন্য, ওরে কী তোমার মেয়ে বিয়ে দিবা না কী? - না, অরে আমার এখানে একটা চাকরি দেব। - কীসের? - লেখালেখির - চাকরিটা কী দিয়া দিছ? - না। - ও তো ভালো না। পুরাই ইরেস্পন্সিবল।

আমার এখান থেকে আকাম করে চলে গেছে। হঠাৎ লাউডস্পিকার অফ। ঠিক আছে, আমি রাত্রে কথা বলব এবিষয়ে। আমার তখন খুব বলতে ইচ্ছে করছিল, ভাই, আমি আপনার সাথে একবছরে, আপনাকে জানিয়ে চাকরি ছেঁড়েছি, চলে আসার দিন না বলে চলে এসেছি, এটা ছাড়া আর কোন আকাম করেছিলাম। আকাম কী এটাই যে, সদা-সর্বদা আপনার বাধ্যগত ছিলাম, বেতনের জন্য দ্বিমত পোষণ না করে, বাড়াবাড়ি না করে কাজ করেছি।

কোন কাজটা ইরেস্পন্সিবিলিটিতে পড়ে বলবেন কী? শেষের দিকে আমার কাজের গতি কমে যাওয়ার মানে তো আপনাকে বলেই এসেছিলাম। কিন্তু না, আমার, কিছুই বলা হয়নি। একটা কর্পোরেট কালারের কষ্ট নিয়ে অভিমানশূন্য হয়ে চলে আসি। ভাইভা অলারা আমাকে বলেছিল এক সপ্তাহ পর বেতন নিয়ে কথা বলার জন্য ডাকবে। ডাকেনি।

সোর্স: http://www.somewhereinblog.net     দেখা হয়েছে ১৫ বার

অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।

প্রাসঙ্গিক আরো কথা
Related contents feature is in beta version.