আমাদের কথা খুঁজে নিন

   

শিবলি, জেমস ও ফিলিংস এর ‘জেল থেকে বলছি’ গানের পেছনের অজানা গল্প ঃ

উৎসর্গ ঃ বাংলা ব্যান্ড ও আধুনিক গানের বহু জনপ্রিয় ও কালজয়ী গানের গীতিকার ,সুরকার জীবন্ত কিংবদন্তি প্রিয় লতিফুল ইসলাম শিবলি ভাইকে যিনি শত ব্যস্ততার ফাঁকে আমাকে তাঁর কালজয়ী গানটির গল্প শুনিয়ে এই লিখাটি তৈরি করায় সহযোগিতা করেছেন , তাঁর কাছে অনেক কৃতজ্ঞতা , শ্রদ্ধা ও ভালোবাসা প্রকাশ স্বরূপ এই লিখাটি উৎসর্গ করলাম। ১৯৯৩ সালে সারগাম থেকে প্রকাশিত তৎকালীন জনপ্রিয় ব্যান্ড ‘ফিলিংস’ এর ২য় অ্যালবাম এর শিরোনাম সংগীত ‘জেল থেকে বলছি’ গানটির কথা শুনেনি এমন মানুষ বাংলাদেশে পাওয়া যাবে না। বাংলা ব্যান্ড ও আধুনিক গানের বহু জনপ্রিয় ও কালজয়ী গানের গীতিকার ও সুরকার লতিফুল ইসলাম শিবলি ভাইয়ের লিখা ‘জেল থেকে বলছি’ গানটি ছিল ‘ফিলিংস’ এর ২য় অ্যালবাম এর শিরোনাম ও প্রথম গান । যারা খুব অল্প হলেও বাংলা গান শুনেছেন তারাও জানেন সেই ‘ফিলিংস’ এর জ েল থেকে বলছি গানটির কথা। শুনেছেনও সবাই।

এই একটি গান ও অ্যালবাম দিয়ে বাংলা ব্যান্ড সঙ্গীতের জীবন্ত কিংব্দন্তি ‘জেমস’ ও তাঁর দল ফিলিংস কে নিয়ে আসে পাদপ্রদীপের আলোয়। অথচ এর আগেও জেমস এর একটি একক ‘অনন্যা’ ও ফিলিংস এর ‘ স্টেশন রোড’ নামের দুটি অ্যালবাম প্রকাশিত হয়েছিল। সেই দুটি অ্যালবাম দিয়ে জেমস ও ফিলিংস কে যত মানুষ চিনেছিল তাঁর চেয়ে কয়েক গুন মানুষ শুধু ‘ জেল থেকে বলছি’ অ্যালবাম দিয়ে জেমস ও ফিলিংস কে চিনেছিল। এর আগে যারা কখনও জেমস ও ফিলিংস কে চিনতো না তারাও ২ য় অ্যালবাম ‘জেল থেকে বলছি’ দিয়ে জেমস ও ফিলিংস এর ভক্ত হয়ে যায়। এরপরের ইতিহাসটা সবারই জানা।

জানা নেই যেটুকু সেটুকু নিয়েই আমার আজকের এই গল্প । । ১৯৮৭/ ৮৮ সালের যে সময়টা ছিল ‘স্বৈরাচার বিরোধী’ আন্দোলনের অগ্নিঝরা সময়। ধীরে ধীরে স্বৈরাচার সরকার এর বিরুদ্ধে বাংলার মানুষ ফুঁসে উঠছিল । বাংলাদেশের একটি ছোট্ট জেলা শহর নওগাঁ ।

সেই শহরের উচ্চ মাধ্যমিকে নাটোর কলেজে ভর্তি হয় লতিফুল ইসলাম শিবলি নামের এক টগবগে তরুন। যে মাঝে মাঝে আনমনে উদাস হয়ে কাগজে কিসব লিখতে থাকে। একদিকে ভাবুক মন আর অন্যদিকে রক্ত টগবগ করা জ্বলে উঠার বারুদ দুটোই নিয়েই বেশ থাকা তরুণটি সেই উচ্চ মাধ্যমিকে পড়ার সময়ে ছাত্র রাজনীতিতে সক্রিয় হয়ে পড়ে। কলেজের মাঠে, রাস্তাঘাটে তৎকালীন স্বৈরশাসকের বিরুদ্ধে মিছিলে শ্লোগানে মুখরিত করছেন শিবলি তরুন ভাবুক ও প্রতিবাদী শিবলি । চোখের সামনে দিয়ে মিছিল যেতে দেখলেই আর রক্ষা নাই, দৌড়ে গিয়ে মিছিলে যোগ দিতো ছেলেটি ।

ছাত্র রাজনীতিতে সক্রিয় ভুমিকা দেখে অল্প দিনেই ছেলেটি কলেজের একজন তুখোড় ছাত্রনেতা হিসেবে পরিচিত হয়ে উঠলেন। যার ফলে সেই সময়ে নাটোর কলেজের ছাত্র সংসদ নির্বাচনে শিবলি ভাইকে সাংস্কৃতিক সম্পাদক পদে মনোনয়ন দেয়া হয় যার মুল পরিষদ ছিল সরকার বিরোধী ছাত্র সংগঠনগুলো। নির্বাচনের আগের দিন কলেজ থেকে আরও বিরোধী নেতাকর্মীদের সাথে শিবলিকে পুলিশ গ্রেফতার করে নিয়ে যায়। কবি ও ছাত্রনেতা শিবলি তখন জেলে। জেলের এক কামরায় ঠাসাঠাসি করে জড়সড় হয়ে সবাই বসে আছেন।

তবু স্বৈরাচারের সাথে কিছুতেই হাত মেলাবেন না। সকাল হলেই নির্বাচন অথচ সকল প্রার্থী ও কর্মীরা জেলে। সেই সময়ে জেলে কলেজের সাধারন ছাত্রছাত্রীদের ব্যনারে একদল ছাত্রছাত্রী এলেন সবাইক দেখতে। কিভাবে নির্বাচনে জিতবেন সেটা নিয়ে ভাবছেন। সবার চোখে মুখে অন্ধকার।

শিবলি ভাই ও উনার বন্ধুদের সাথে জেলে তখন একই দলের আরেক বড় ভাই ও সিনিয়র ছাত্রনেতাও ছিলেন যিনি শিবলি ও তাঁর বন্ধুদের নেতৃত্ব দিতেন। বড় ভাই সহ সবাই আলোচনা করে সাধারন ছাত্রছাত্রীদের হাতে শিবলি একটা চিঠির মতো লিখে সবার কাছে ভোট চেয়ে আকুল আবেদন লিখে কাগজটা ধরিয়ে দিলেন যার শিরোনাম ছিল ‘’জেল থেকে বলছি ‘ .........। । শিবলি'র হাতে লিখা সেই ‘জেল থেকে বলছি’ শিরোনামে আকুল আবেদন এর কথাগুলো সেদিন রাতেই পুরো নাটোর জুড়ে রাস্তা ঘাটে, কলেজ প্রাঙ্গনে পোস্টার হিসেবে ছড়িয়ে গেলো। সকাল বেলায় যা দেখে পুরো নাটোরবাসি অবাক।

সেই আবেদনেসারা দিয়ে সাধারন ছাত্রছাত্রীরা শিবলি ও তাঁর পরিষদ/ প্যানেল কে ছাত্র সংসদ নির্বাচনে বিপুল ভোটে জয়লাভ করালেন। সেই নির্বাচনের ফলাফলে দেখা যায় সভাপতি, সাধারন সম্পাদক এর প্রাপ্ত ভোটের চেয়ে বিজয়ি প্যানেলের সাংস্কৃতিক সম্পাদক লতিফুল ইসলাম শিবলি সর্বাধিক ভোট পেয়েছে। সেদিনের সেই শিবলির মনে রয়ে যায় ‘জেল থেকে বলছি ‘ শিরোনাম এর চিঠিটি । সেই চিঠিটির কথা শিবলি কোনদিন ভুলতে পারেনি । ৯০ দশকের শুরুতে স্বৈরাচার এরশাদ সরকার এর পতনের পরপরেই জেলা শহর ‘নাটোর’ এর সেই প্রাণবন্ত ও প্রতিবাদী তরুন প্রিয় নাটোর ছেড়ে ও পরিবার পরিজন ছেড়ে ঢাকা শহরে আসে লিখাপড়া করার জন্য।

প্রিয় নাটোর শহর ছেড়ে ঢাকায় আসার পর ছেলেটি সারাক্ষণ নাটোরের স্মৃতিগুলো ভাবতে থাকে। ভাবতে থাকে ফেলে আসা নাটোরের দিনগুলো । ছেলেটি ঢাকায় যে বাসায় ভাড়া থাকতো সেটা ছিল একটি বাসার ছাদের উপরের একটি ছোট্ট ঘর যেটিকে আমরা বলি ‘চিলেকোঠা’ । ঘরের ভেতরের একটা জানালা ছিল । সেই জানালার পাশে ছেলেটির বিছানা যেখান থেকে বালিশে মাথা রাখলেই পুরো আকাশটা দেখা যায় আর বাপাশে ছিল ছাদ এর পাকা আঙ্গিনার সাথে দুরের আকাশের একাকার হয়ে যাওয়ার অপরুপ দৃশ্য।

একদিন দুপুরে ছেলেটি বিছানায় শুয়ে ডান পাশের জানালা দিয়ে আকাশের দিকে তাকিয়ে আকাশ দেখছিল। তখনই শিবলি'র মনে জেলে থাকার সেই দিনটির কথা মনে পড়লো , যেখানে আকাশ দেখা যেতো না। ধীরে ধীরে শিবলি ভাই ভাবতে লাগলেন অসুস্থ অবস্থায় শুয়ে থাকা কোন রোগীর কথা যে বহুদিন আকাশ দেখেনি। আবার কখনও মনে ভিড় করলো কনডেম সেলে থাকা কোন খুনের দায়ে ফাসির আসামী’র কথা যে বহুদিন আকাশ দেখেনি। শিবলি তখনই শোয়া থেকে উঠে বসলেন ।

হুট করে কাগজ কলম নিয়ে লিখতে থাকলেন...। ‘ দিন রাত এখানে থমকে গেছে কনডেম সেলের পাথর দেয়ালে প্রতি নিঃশ্বাসে মৃত্যুর দিন আমি গুনছি শোন জেল থেকে আমি বলছি ............’’ এভাবে এক লাইন লিখেন আর গুনগুন করে নিজের মতো করে গাইতে থাকলেন । ৫ মিনিট পর লিখা যখন থামলো তখন আবার সেই লিখাটা টেবিলে উপর রেখে দু হাত দিয়ে টেবিল বাজিয়ে নিজের মতো করে গাইতে গাইতে সুর ঠিক করে ফেলেন। মাত্র ৫ মিনিটেই একটি গান লিখা ও সুর করা হয়ে গেলো যা পরবর্তীতে হয়ে যায় বাংলা ব্যান্ড সঙ্গীতের ইতিহাসের একটা অংশ। গানটি যেদিন লিখেন ও সুর করেন তখন পর্যন্ত গানটির শিল্পী জেমস এর সাথে শিবলির কোন পরিচয় নেই।

কেউ কাউকে তখনও চিনেন না। পরের দিন সকালে গ্রিন রোড এর একটি টং দোকানে বসে শিবলি চা নাস্তার অর্ডার দিয়ে অপেক্ষা করছিলেন আর টেবিলে হাত দিয়ে বাজিয়ে গানটি গুনগুন করছেন। সেই সময়ে সেখানে ঢুকলেন জেমস এর পূর্ব পরিচিত ও অথিতি ড্রামার শহীদ মাহমুদ ভাই। যিনি শিবলি ভাইকে আগে থেকে চিনতেন। শিবলিকে গাইতে দেখে জিজ্ঞেস করলেন ‘ কিরে শিবলি? এটা কার গান গাচ্ছিস? ‘’ শহীদ ভাইয়ের কথা শুনে শিবলি হো হো করে হেসে উঠে বললেন ‘’ শহীদ ভাই এটা কারো গান না।

কেউ গায়নি এখনও। আমি লিখেছি তাই আমিই গাইছি’। শিবলি ভাইয়ের কথা শুনে শহীদ ভাইয়ের গান টি পছন্দ হয়ে যায়। উনি তখন শিবলি ভাইয়ের কাছ থেকে গানটি নিজের আগামির অ্যালবাম এর জন্য চেয়ে নিলেন। শিবলিও হাসিমুখে দিয়ে দিলেন পরিচিত বড় ভাই শহীদ ভাইকে গানটি।

গানটি নিয়ে শহীদ ভাই প্র্যাকটিসে গিয়ে জেমস কে দেখালে জেমস গানটি শহীদ ভাইকে গাইতে নিষেধ করে দেন। কারন গানটি জেমস এর পছন্দ হয়েছে । তাই জেমস শহীদ এর গানটি নিজের ব্যান্ড ‘ফিলিংস’ এর আগামী অ্যালবামে রাখতে চাইছেন। গানটি দেখেই শহীদ ভাইকে বললেন ‘এটা কার লিখা গান? ছেলেটাকে একবার আমার কাছে নিয়ে এসো। পরিচয় করিয়ে দিও।

কথা আছে তাঁর সাথে’। শহীদ ভাইও জেমস অনুরোধ ফেলতে পারেননি। তাই দিয়ে দিলেন গানটা ‘ফিলিংস’ ও জেমস এর হাতে। পরেরদিন জেমস এর বাসায় শহীদ ভাই নিয়ে গেলেন গানটির গীতিকার শিবলি কে । শিবলি ও জেমস এর সেই প্রথম পরিচয়।

সেই প্রথম গান দেয়া এবং সেদিনই নতুন অ্যালবাম এর জন্য আরও গান থাকলে দিতে বললেন। এরপর একে একে সেই ‘জেল থেকে বলছি ‘ অ্যালবাম এ ঠাই করে নিলো একেবারে নতুন একজনের একাধিক গান যেগুলো হলো ‘ নীলাকাশ যতদূর দেখা যায়’, ‘প্রানের শহর ঢাকা’, ‘পেশাদার খুনি’ ‘জোসি প্রেম’ গানগুলো। যার সবগুলো গানই হিট হয়েছিল আর হিট হয়েছিল ‘ফিলিংস’ ও জেমস । সারা বাংলাদেশে তখন চারিদিকে ‘জেল থেকে বলছি ‘ আর জেমস এর ঝড় শুরু হয়ে গেলো। যা আজ একটা ইতিহাস যা চিরকালের জন্য বাংলা ব্যান্ড সঙ্গীতে ঠাই করে নিয়েছে ।

। আর জন্ম হলো বাংলা ব্যান্ড ও আধুনিক সংগীতে বহু জনপ্রিয় ও কালজয়ী গানের স্রস্টা লতিফুল ইসলাম শিবলি'র যিনি বহু সংগীত শিল্পীর তারকা হওয়ার পেছনের অবদান রাখা একজন জীবন্ত কিংবদন্তী। বাংলা ব্যান্ড সংগীত সারাজীবন গীতিকার ও সুরকার লতিফুল ইসলাম শিবলি ভাইয়ের কাছে কৃতজ্ঞ থাকবে। । জেল থেকে বলছি - জেমস ও ফিলিংস , কথা ও সুর ঃ লতিফুল ইসলাম শিবলি বাংলার সব অসাধারন গানগুলো শুনতে ও গানের পেছনের এমন আরও অনেক গল্প জানতে ক্লিক করুন ঃ RaDiO bg24  ।

সোর্স: http://www.somewhereinblog.net     দেখা হয়েছে ১১ বার

অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।