আমাদের কথা খুঁজে নিন

   

আত্মশুদ্ধির সুযোগ হারানো বিএনপি

আল্লাহ মহান, যাহা বলিব সত্য বলিব। প্রধান বিরোধীদল বিএনপি এবং তার শরিক জামায়াতে ইসলাম ও বিজেপি ৮৩ কার্যদিবস পর সংসদে গেছে_ বাংলাদেশের প্রেক্ষাপটে এর কোন সংবাদমূল্য নেই। সংসদীয় গণতন্ত্র প্রবর্তনের পর থেকে দেশের বিরোধীদলের রুটিনওয়ার্ক হচ্ছে, কোন না কোন অজুহাতে সংসদ বর্জন করা এবং সাংবিধানিক নিয়মানুযায়ী সংসদ সদস্যপদ রক্ষার জন্য অনুপস্থিতির ৯০ কার্যদিবস পূরণ হওয়ার আগে কোন একদিন সংসদে যাওয়া এবং আবারও সংসদ বর্জন করা। গত প্রায় দুই যুগে সংসদীয় গণতন্ত্রে যে প্র্যাকটিস চলছে তার বাস্তবতায় এখন কেবল এই খবরের সংবাদমূল্য হতে পারে ৯০ কার্যদিবস পেরিয়ে গেলেও সংসদে যায়নি বিরোধীদল অথবা এক কার্যদিবসের জন্যও সংসদ বর্জন করেনি বিরোধীদল। বিরোধীদলকে চলতি অধিবেশনের প্রথম ৭ কার্যদিবসের মধ্যে সংসদে যোগ দিতেই হতো।

এমন নয় যে, দেশের ইতিহাসে প্রথমবারের মতো একজন নারী স্পিকার সংসদ পরিচালনা করবেন বলে বিরোধীদল ইতিহাসের ভাগিদার হতে সংসদে গেছে। তারপরও দেশের ইতিহাসে এক অনন্য অধ্যায় সংযোজিত হয়েছে। চলতি অধিবেশনের প্রথম কার্যদিবসে সংসদের তিন দিকের নেতৃত্বে ছিলেন তিনজন নারী। স্পিকারের আসনে ছিলেন ড. শিরীন শারমিন চৌধুরী, সংসদ নেতার আসনে ছিলেন শেখ হাসিনা এবং বিরোধীদলীয় নেতার আসনে ছিলেন খালেদা জিয়া। দেশে নারীর ক্ষমতায়নের এক প্রতীকে পরিণত হয়েছেন তারা।

এমন এক সময়ে একজন নারী স্পিকার হলেন যখন হেফাজতে ইসলামসহ ধর্মীয় উগ্রবাদী গোষ্ঠী নারীকে মধ্যযুগীয় বর্বর ব্যবস্থার মধ্যে ঠেলে দেয়ার অপচেষ্টা চালাচ্ছে। দেশের প্রথম নারী স্পিকারকে বিরোধীদল সংসদে অভিনন্দন জানিয়েছে। এটা একটা শুভ লক্ষণ। সরকারের কোন কাজে বিরোধীদল সাধারণত অভিনন্দন জানায় না_ কেবল এ অর্থে শুভ লক্ষণ নয়। হেফাজতের নারীবিরোধী আন্দোলনে বিরোধীদল সর্বতোভাবে সমর্থন দিয়েছিল_ এই অর্থেও এ অভিনন্দন শুভ লক্ষণ।

সংসদের সব অধিবেশনই গুরুত্বপূর্ণ। তবে সঙ্গতকারণেই বাজেট অধিবেশন নিয়ে নাগরিকদের আশা-আকাঙ্ক্ষা- আশঙ্কা বেশিই থাকে। এবারের বাজেটের গুরুত্ব একটু ভিন্নমাত্রার। কারণ এটাই হচ্ছে বর্তমান সরকারের শেষ বাজেট। সবকিছু ঠিক থাকলে আগামী সরকারকে এ বাজেটের ভিত্তিতেই কাজ করতে হবে।

বাজেট অধিবেশনের গুরুত্ব উপলব্ধি করে বিরোধীদল চলতি অধিবেশনের প্রথম কার্যদিবসেই সংসদে গেছে_ তাও নয়। জনগণের আশা-আকাঙ্ক্ষা বাজেটে যথাযথভাবে প্রতিফলিত হয় কিনা সেটা দেখার জন্য বিরোধীদল সংসদে গেলে ভালো হতো। কিন্তু বিগত বাজেট অধিবেশনে তারা যথার্থ ভূমিকা রাখেনি। ২০১০ সালে তারা বাজেট অধিবেশনে মাত্র একদিনের জন্য যোগ দিয়েছিল। সেবার তারা বাজেট উপস্থাপনের আগেই সংসদ বর্জন করেছিল।

বাজেটে জনগণের আশা-আকাঙ্ক্ষা প্রতিফলিত হয়েছে কিনা সেটা নিয়ে সংসদে আলোচনা করার কোন প্রয়োজন বোধ করেনি। তারা যখনই সংসদে গেছে, দলের প্রয়োজনেই গেছে, জনগণের প্রয়োজনে নয়। এবারও তার ব্যতিক্রম ঘটেনি। চলতি অধিবেশনে বিরোধীদল নির্বাচনকালীন সরকার পদ্ধতি নিয়ে আলোচনার সূত্রপাত করতে পারে বলে ধারণা ছিল। সহিংস হরতাল, ৪৮ ঘণ্টার আল্টিমেটাম এবং হেফাজতি অবরোধ মুখ থুবড়ে পড়ার পর বিরোধীদলের আন্দোলন দুর্বল হয়ে পড়েছে।

দলের শীর্ষ নেতাদের গ্রেফতারে একরকম দিশাহীন হয়ে পড়া বিএনপি গত ৫ মের পর রাজধানীতে সভা-সমাবেশও করতে পারছে না। স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীর বেআইনি মৌখিক নিষেধাজ্ঞা উপেক্ষা করার সামর্থ্যও তাদের নেই। এ কারণে দলটিকে সংলাপে বেশ আগ্রহী মনে হচ্ছিল ইদানীং। তাদের এ আগ্রহ দেখে বরং সরকারই এখন নানা উছিলায় সংলাপকে পেছনে ঠেলে দিতে চাচ্ছে বলে অভিযোগ করেছে বিএনপি। এবার সংসদ অধিবেশনে যোগদানকে কাজে লাগিয়ে তারা নির্বাচনকালীন সরকার পদ্ধতি নিয়ে আলোচনার সূত্রপাত করবে বলে আভাসও পাওয়া গিয়েছিল।

বিএনপির সংসদ সদস্য মাহাবুব উদ্দিন দলের পক্ষ থেকে 'নির্বাচনকালীন সরকার ব্যবস্থা নিয়ে আলোচনা' শীর্ষক একটি মুলতবি প্রস্তাব এনছিলেন। জাতীয় সংসদের কার্য উপদেষ্টা কমিটির সভায় এ মুলতবি প্রস্তাব নিয়ে সংসদে আলোচনার সিদ্ধান্তও নেয়া হয়। এই সিদ্ধান্ত নেয়ার পর বিএনপির সংসদীয় দলের এক বৈঠকে সিদ্ধান্ত নিয়ে মুলতবি প্রস্তাবটি প্রত্যাহার করা হয়। অর্থাৎ নির্বাচনকালীন সরকার পদ্ধতি নিয়ে চলতি অধিবেশনে আলোচনার সুযোগ নিচ্ছে না বিএনপি। তাহলে কেন এই অধিবেশনে যোগ দেয়া? কেবল সংসদ সদস্যপদ রক্ষা করা আর সংসদ সদস্য হিসেবে রাষ্ট্রীয় সব ধরনের সুযোগ-সুবিধা ভোগের পথ খোলা রাখার জন্যই বিরোধীদল সংসদে যায়।

চলতি অধিবেশনে নির্বাচনকালীন সরকার নিয়ে আলোচনা প্রশ্নে বিরোধীদলের মধ্যে দুটো ধারা কাজ করছে বলে মনে হয়। মুলতবি প্রস্তাব দেয়া আবার সেটাকে প্রত্যাহার করার মধ্য দিয়ে এটা অনুমান করা যায়। বিএনপিতে দুটো ধারার রাজনীতির কথা শোনা যায় বহুদিন ধরেই। এর একটি উদারপন্থি আর অন্যটি জামায়াত ঘেঁষা বলে পরিচিত। অনেকে মনে করেন বিগত বিএনপি-জামায়াত জোট আমলে তারেক রহমানের প্রশ্রয়ে জামায়াতপন্থিদের উত্থান ঘটেছে।

১-১১'র পর জামায়াতপন্থিরা একটু বেকায়দায় থাকলেও সম্প্রতি বিএনপিতে তাদের প্রভাব বেড়েছে। বিরোধীদলীয় নেতার সাম্প্রতিক রাজনৈতিক সিদ্ধান্ত, কর্মকা- ও বক্তব্যে তাদের প্রভাব স্পষ্ট। সাঈদীকে কেন্দ্র করে সৃষ্ট গুজবে জামায়াত-শিবিরের পরিকল্পিত সহিংসতায় অনাকাঙ্ক্ষিত হতাহতের ঘটনাকে গণহত্যা বলা, শাহবাগে সৃষ্ট স্বতস্ফূর্ত গণজাগরণকে নাস্তিকের অপবাদ দেয়া, সেনাবাহিনীকে নিয়ে উসকানিমূলক বক্তব্য দেয়া, হেফাজতের মধ্যযুগীয় ১৩ দফাকে সমর্থন দেয়া, হেফাজতের ঢাকা অবরোধকে সামনে রেখে ৪৮ ঘণ্টার আল্টিমেটাম দেয়া, হেফাজতের সহিংসতায় দলের নেতাকর্মী ও ঢাকাবাসীকে যোগ দেয়ার আহ্বান জানানো- সবই জামায়াতপন্থির প্রভাবে হয়েছে বলে অনেকে মনে করেন। প্রশ্ন হচ্ছে, নির্বাচনকালীন সরকার পদ্ধতি নিয়ে আলোচনার প্রস্তাব প্রত্যাহারের পেছনে জামায়াতপন্থিদের প্রভাব আছে কিনা? বিরোধীদলীয় নেতার ওপর যদি তাদের প্রভাব এখনও প্রবল থাকে তবে দল হিসেবে বিএনপি যেমন ক্ষতিগ্রস্ত হবে, তেমন দেশের অস্থিতিশীলতাও সহজে দূর হবে না। সাঈদীকে নিয়ে গুজব ছড়ানো থেকে শুরু করে হেফাজতের তা-ব পর্যন্ত যতগুলো ভুল কাজ বিএনপি করেছে সেটা শোধরানোর সুযোগ ছিল সংসদে।

সেখানে নির্বাচনকালীন সরকার পদ্ধতি নিয়ে আলোচনা করলে দলটির এক ধরনের আত্মশুদ্ধি ঘটত। সরকার তাদের প্রস্তাবে সাড়া দিত কি দিত না সে প্রশ্ন পরে। আগের প্রশ্ন হচ্ছে, ভুল শোধরানোর পথ থেকে বিএনপিকে ফিরিয়ে আনল কারা? সরকারকে প্রতিপক্ষ ভাবার আগে দলের ভেতরের সেই অংশটি সম্পর্কে বিরোধীদলীয় নেতাকে ভাবতে হবে, যেই অংশটি ভুল সংশোধন করে দলের আত্মশুদ্ধিতে বাধা দেয়। সরকারকে যদি বিরোধীদল দৃশ্যমান শত্রু মনে করে তবে আত্মশুদ্ধিতে বাধা দেয়া দলের ভেতরের শক্তি হচ্ছে বিএনপির অদৃশ্য শত্রু। গত কয়েক মাসে বিএনপির যত ক্ষতি না সরকার করেছে, তার চেয়ে বেশি ক্ষতি করেছে বিএনপির জামায়াতপন্থি অংশ।

সরকার হয়তো বিএনপির শীর্ষ নেতাদের গ্রেফতার করেছে, রাজধানীতে সভা-সমাবেশ করতে দিচ্ছে না। তবে এতে বিএনপির শাপে বর হয়েছে। কারণ গণতন্ত্রকামী মানুষের সমর্থন বিএনপির পক্ষেই গেছে। এর বিপরীতে জামায়াতিদের প্ররোচনায় চলে গত কয়েক মাসে বিএনপি যা করেছে তাতে জনগণ ক্ষুব্ধ ও হতাশ হয়েছে। হেফাজতের পাশে দাঁড়ানোর যে আহ্বান ঢাকাবাসীর প্রতি খালেদা জানিয়েছিলেন তাতে রাজধানীর একটি মানুষও সাড়া দেয়নি।

এখন সংসদে আলোচনার সুযোগকে কাজে না লাগানোর সিদ্ধান্ত মানুষ কীভাবে নেয় সেটা দেখার বিষয়। বিএনপি বলছে, সংসদে সংখ্যাগরিষ্ঠতার জোরে সরকার তাদের প্রস্তাব বাতিল করে দিত, এজন্য তারা সংসদে মুলতবি প্রস্তাব প্রত্যাহার করেছে। প্রশ্ন হচ্ছে, দিনের পর দিন হরতাল দেয়ার পরও তো সরকার তাদের দাবি মানছে না। কিন্তু এজন্য তো বিরোধীদল একদিনও হরতাল প্রত্যাহার করেনি যে, হরতাল দিয়ে লাভ নেই, সরকার দাবি মানবে না। বরং সংসদে তাদের দাবির যৌক্তিকতা তুলে ধরার পরও যদি সরকার একপেশে কোন সিদ্ধান্ত নিত তাহলে বিএনপির দাবির পক্ষে জনসমর্থন বাড়ত বৈ কমতো না।

তখন তাদের রাজপথের আন্দোলনও বেগবান হতো। সরকার দাবি না মানলে রাজপথে কঠোর আন্দোলন করা হবে_ কেবল এ হুঙ্কারই যথেষ্ট নয়। আন্দোলন সফল করতে হলে, যেকোন দাবি আদায় করতে হলে জনসমর্থনও থাকা চাই। শিবির-হেফাজতের ক্যাডার-অনুসারীদের নিয়ে সহিংসতা করা আর জনগণকে সঙ্গে নিয়ে সত্যিকারের আন্দোলন করার মধ্যে পার্থক্য বিস্তর। গত ৫ মের পরও যদি বিএনপি নেতা এ কথা উপলব্ধি না করে তবে ক্ষতি তার দলেরই হবে।


এর পর.....

অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।