আমাদের কথা খুঁজে নিন

   

বিএটিবির ধোঁকা ৫ লাখ টাকার সিএসআর, ১ কোটি টাকার বিজ্ঞাপন

আমি একজন পর্যটন কর্মী। বেড়াতে, বেড়ানোর উৎসাহ দিতে এবং বেড়ানোর আয়োজন করতে ভালোবাসি। কর্পোরেট সোস্যাল রেসপনসিবিলিটির (সিএসআর) নামে ৫ লাখ টাকায় বিশুদ্ধ পানির প্ল্যান্ট স্থাপন করে নিজেদের সাফাই গেয়ে ১ কোটি টাকার বিজ্ঞাপন প্রচার করেছে ব্রিটিশ আমেরিকান টোবাকো বাংলাদেশ (বিএটিবি)। এমনকি বিভিন্ন জেলায় প্ল্যান্ট স্থাপন করা হয়েছে বলে বিজ্ঞাপন ও প্রচার চালানো হলেও সে ধরনের কোনো প্ল্যান্টের অস্তিত্ব নেই। বিএটিবি জানায়, ‘প্রবাহ’ নামের এ প্রকল্পের মাধ্যমে সারা দেশে মোট ৩৮টি বিশুদ্ধ পানির প্ল্যান্ট স্থাপন করা হয়েছে।

সাতক্ষীরা জেলাতেও প্ল্যান্ট স্থাপন করা হয়েছে বলা হলেও বাস্তবে সেখানে কোনো প্ল্যান্টের অস্তিত্ব খুঁজে পাওয়া যায়নি। আবার আর্সেনিক উপদ্রুত এলাকায় প্ল্যান্ট স্থাপনের কথা বললেও সে এলাকা আর্সেনিকমুক্ত বলেও জানা গেছে। সরেজমিন ঝিনাইদহ জেলায় স্থাপন করা বিএটিবির পানির প্ল্যান্ট পরিদর্শন করে দেখা যায়, জেলা প্রশাসক কার্যালয়ে স্থাপন করা হয়েছে এ প্ল্যান্ট। সেখানে ৬টি পানির কল রয়েছে। কিন্তু সাধারণের প্রবেশাধিকার নেই।

জেলা প্রশাসন সূত্র জানায়, ঝিনাইদহে বিপুল পরিমান তামাক উৎপাদন করা হয়। তামাক উৎপাদন প্রক্রিয়ায় সরকারি কর্তাব্যক্তিরা যাতে বাধা হয়ে না দাঁড়ান সে কারণেই জেলা প্রশাসক কার্যালয়ে এ প্ল্যান্ট স্থাপন করা হয়েছে। সেখানে প্রায় ১ ঘণ্টা পর্যবেক্ষণ করেও এ প্রতিবেদক কোনো সাধারণ মানুষকে পানি নিতে আসতে দেখেননি। প্ল্যান্টে পানি পানের জন্যে কোনো গ্লাস নেই। তাছাড়া প্ল্যান্টটিকে লোহার খাঁচায় এমনভাবে রাখা হয়েছে যে সেখানে পানি পাওয়া যায় এটা বোঝাই মুশকিল।

জেলা প্রশাসন সূত্রে জানা যায়, ২০১১ সাল থেকেই স্থানীয় কর্তাব্যক্তিদের সঙ্গে এ প্ল্যান্ট বসানোর জন্যে কথাবার্তা চালাতে থাকে বিএটিবি। ২০১২ সালের জানুয়ারিতে একটি জাতীয় বাংলা দৈনিক ও ইংরেজি দৈনিকের প্রথম পাতার অর্ধেকজুড়ে বিজ্ঞাপন দেওয়া হয়। এরপর ১২ এপ্রিল জেলা প্রশাসক খাজা হান্নানকে দিয়ে এখানে বিশুদ্ধ পানির প্ল্যান্ট উদ্বোধন করানো হয়। বিএটিবি জানায়, আর্সেনিক ঝুঁকিতে থাকা এলাকাগুলোতে এ প্ল্যান্ট স্থাপন করা হয়েছে। কিন্তু ঝিনাইদহ পৌরসভায় আর্সেনিকের কোনো ঝুঁকি নেই বলে বাংলানিউজকে জানিয়েছেন জেলা জনস্বাস্থ্য প্রকৌশল অধিদপ্তরের প্রধান নির্বাহী প্রকৌশলী ওমর আলী।

এদিকে জেলা কৃষি অধিদপ্তরের উপসহকারী কৃষি কর্মকর্তা বিধান চন্দ্র বাংলানিউজকে জানান, ২০১১-১২ অর্থবছরে জেলার ১২১৫ হেক্টর জমিতে তামাকের চাষ হয়েছে। চাষের সঙ্গে জড়িত প্রায় সাড়ে আট হাজার কৃষক। অথচ ঝিনাইদহে তামাক চাষীদের নিয়ে ব্যবসা করলেও প্ল্যান্টের পানি পান না এ কৃষকেরা। প্রশাসনিক জায়গাগুলোর আশপাশে স্থাপন করা হয়েছে পাম্প। জেলার যে তিনটি স্থানে প্ল্যান্ট আছে সেখানে তামাক চাষ হয় না।

খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, জেলা প্রশাসকের কার্যালয় ছাড়াও ‘প্রবাহ’ পানির প্ল্যান্ট রয়েছে- নগরবাথান উপজেলায় এবং শৈলকুপার দেড়বাড়ি এলাকায়। কৃষি অধিদপ্তর কর্মকর্তা জানান, এসব এলাকার আশপাশে কোনো তামাক চাষ হয় না। কৃষকদের জন্যে নয় বরং জেলা প্রশাসক কার্যালয়ে এ ধরনের প্ল্যান্ট স্থাপনের ব্যাপারে রোববার বাংলাদেশ ব্যাংকের সাবেক গভর্নর ড. সালেহউদ্দিন আহমেদের কাছে জানতে চাইলে তিনি বাংলানিউজকে বলেন, “তামাক কোম্পানি যেহেতু জনস্বাস্থ্যের জন্যে ক্ষতিকর তাই তাদের অবশ্যই আরো ভালো কিছু করতে হবে। তবে তাদের সিএসআর- এ বাধা নেই। কিন্তু যদি সাধারণ মানুষের উপকারের কথা না ভেবে নিজেদের ব্যবসার কথা ভেবে কোনো কিছু করে তবে সেটি সিএসআর নয়।

” তিনি বলেন, “প্রশাসনকেও খেয়াল রাখতে হবে সিএসআর করার পেছনে প্রশাসনকে নিয়ন্ত্রণের চেষ্টা রয়েছে কি না। ” যেহেতু ঝিনাইদেহে তামাক উৎপাদন হয় এবং এর সঙ্গে বিপুল সংখ্যক কৃষক জড়িত তাই কৃষকদের উপকারে আসে সিএসআরের মাধ্যমে এমন প্রকল্প নিতে হবে বলে পরামর্শ দেন তিনি। জেলা প্রশাসক কার্যালয়ে বিএটিবির বিশুদ্ধ পানির প্ল্যান্ট স্থাপনের ব্যাপারে ঝিনাইদহ জেলার এডিশনাল ডেপুটি কমিশনার এসকে রফিকুল ইসলাম বাংলানিউজের কাছে স্বীকার করেন, এখান থেকে আর্সেনিকমুক্ত পানি সরবরাহ করা হয়। তবে পৌরসভায় আর্সেনিক নেই। তাহলে জেলা প্রশাসক কার্যালয়ে এটি কেনো স্থাপন করা হলো- জানতে চাইলে তিনি বলেন, “এটি তাদের (বিএটিবি) সিএসআর কর্মসূচির অংশ।

” তবে তামাক চাষের ব্যাপারে তিনি বলেন, “তামাক চাষে কৃষকের লাভের চেয়ে ক্ষতি বেশি হয়। তামাক কোম্পানিগুলো যে রাজস্ব দেয় তার চেয়ে অনেক বেশি ক্ষতি হয় ধূমপানের কারণে বিভিন্ন রোগে আক্রান্তদের চিকিৎসা বাবদ। ” এদিকে গত বৃহস্পতি ও শুক্রবার সাতক্ষীরা জেলার বিভিন্ন স্থান ঘুরে কোথাও বিএটিবির বিশুদ্ধ পানির প্ল্যান্টের খোঁজ পাওয় যায়নি। সাতক্ষীরা জেলা প্রশাসক ড. মুহাম্মদ আনোয়ার হোসেন জানান, এখানে আহছানিয়া মিশন, বিশ্বস্বাস্থ্য সংস্থা ও সরকারি পর্যায়ে কয়েকটি বিশুদ্ধ পানির প্ল্যান্ট রয়েছে। কিন্তু বিএটিবির কোনো প্ল্যান্ট নেই।

অথচ বিএটিবি প্রচার করছে তারা এসব স্থানে প্ল্যান্ট স্থাপন করেছে। এ ব্যাপারে বিএটিবির প্রধান কার্যালয়ের কর্মকর্তা (জনসংযোগ) আনোয়ারুল আমিন রোববার দুপুরে বাংলানিউজকে বলেন, “আর্সেনিকপ্রবণ এলাকাগুলোতে সিএসআর কর্মসূচি হিসেবে বিশুদ্ধ পানির প্রকল্প চালু রয়েছে। ” ঝিনাইদহ জেলা প্রশাসক কার্যালয়ে প্ল্যান্ট স্থাপন ও এখানকার পানিতে আর্সেনিকের ঝুঁকি নেই বলে জানালে তিনি কোনো সদুত্তর দিতে পারেননি। তিনি জানান, সারা দেশে তাদের ৩৮টি পানির প্ল্যান্ট রয়েছে। সাতক্ষীরার কোন জায়গাটিতে পানির প্ল্যান্ট রয়েছে- জানতে চাইলে তিনি উল্টো জিজ্ঞেস করেন, “নির্দিষ্ট করে আপনি সাতক্ষীরার কথা জানতে চাইছেন কেনো? আমি সঠিকভাবে বলতে পারবো না।

” পরে মেইলে পাঠিয়ে দেওয়া হবে বলে জানালেও আর কোনো যোগাযোগ করেননি আনোয়ারুল। তবে প্ল্যান্ট যেখানেই স্থাপন করা হোক বা কারো উপকারে লাগুক না লাগুক, দেশের একটি বাংলা ও ইংরেজি দৈনিকে ৫৭ লাখ টাকা খরচ করে বিজ্ঞাপন প্রচার করেছে বিএটিবি। দেশের ওই দু’টি দৈনিকে গত জানুয়ারিতে তিন দিন করে বিজ্ঞাপন দিয়েছে তারা। জানা যায়, বাংলা পত্রিকাটিতে প্রথম পাতায় ৬৪ ইঞ্চি বিজ্ঞাপনের খরচ পড়েছে প্রতিদিন ১১ লাখ ৮৪ হাজার টাকা। ইংরেজি দৈনিকটিতে প্রথম পাতায় ৬৪ ইঞ্চি বিজ্ঞাপনের জন্যে প্রতিদিন দিতে হয়েছে ৭ লাখ ৪ হাজার টাকা।

দু’টি পত্রিকাতেই মোট ৫৬ লাখ ৬৪ হাজার টাকার বিজ্ঞাপন দিয়েছে বিএটিবি। তবে অন্যান্য পত্রিকার বিজ্ঞাপন মিলে এ অর্থের পরিমান কোটি টাকা বলে জানা যায়। এ ব্যাপারে জানতে চাইলে তামাক নিয়ন্ত্রণের কাজ করা বেসরকারি সংস্থা মানস এর প্রতিষ্ঠাতা সভাপতি ডা. অরুপ রতন চৌধুরী বাংলানিউজকে বলেন, “সিএসআরের নামে মাদক কোম্পানিগুলো প্রশাসনকে এক ধরনের প্রলোভন দেখিয়ে নিজেদের কাজ উদ্ধার করে। কোম্পানি যখন দেখছে, তামাক নিয়ন্ত্রণ আইন হতে যাচ্ছে, তখনই প্রশাসনকে প্রলুব্ধ করার জন্যে এ ধরনের কর্মসূচি নিচ্ছে তারা। ” তামাক নিয়ন্ত্রণে স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের টাস্কফোর্সের এ বিষয়টিতে নজরদারি করা প্রয়োজন বলে মনে করেন তিনি।

বাংলা নিউজের সৌজন্যে ।

অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।

প্রাসঙ্গিক আরো কথা
Related contents feature is in beta version.