আমাদের কথা খুঁজে নিন

   

অভিজ্ঞতাঃ 'একুশে ফেব্রুয়ারী'- রহস্যপত্রিকা, অক্টোবর, ২০১২

ভুল করেও যদি মনে পড়ে...ভুলে যাওয়া কোন স্মৃতি.. ঘুমহারা রাতে..নীরবে তুমি কেঁদে নিও কিছুক্ষণ...একদিন মুছে যাবে সব আয়োজন... ‘চিকনী চামেলী ছুপকে আকেলী’- প্রচন্ড শব্দের সংগীতে ঘুমটা চটে গেল। বিছানা ছেড়ে উঠে উৎস অনুসন্ধান করতে গিয়ে দেখি বাসার পাশের খোলা জায়গাটায় বিশাল আকৃতির শব্দযন্ত্রে বাজছে গানটা, চারধারে ৬/৭ থেকে শুরু করে ১৪/১৫ বছর বয়সী কয়েক ছেলের উদ্দাম নৃত্য। জায়গাটায় আগে রিক্সার গ্যারেজ ছিল, স¤প্রতি জমির মালিক কোন এক ভবন-নির্মাণকারী প্রতিষ্ঠানের কাছে জায়গাটা বিক্রি করে দিয়েছেন, এখনও ভবনের কাজ শুরু হয়নি বলে খালিই পড়ে থাকে। আশপাশের কমবয়সী ছেলেরা এখানে খেলা করে। বিশেষতঃ ক্রিকেট, এবং তাদের হাঁকানো ছক্কায় বাসার কাঁচ ভেঙে পড়াটা প্রায় নিত্য দিনের ঘটনা।

মাতৃভাষার সম্মান রক্ষায় আমি নিবেদিতপ্রাণ - এমনটা দাবী করি না। বাসায় ডিশের কানেকশন রাখি, বিজাতীয় চ্যানেলের গান-বাজনা, অনুষ্ঠানও দেখি। চলতি কথায়, আলোচনায় ইংরেজী শব্দ ঢুকেও যায়। হ্যাঁ- কোথাও ভুল বানানের বাংলা ব্যানার-পোস্টার দেখলে, বই বা পত্রিকায় বাংলা রীতির ভুল প্রয়োগ দেখলে বিরক্তি অনুভব করি, টিভি নাটকে-অনুষ্ঠানে বিকৃত বাংলার প্রয়োগে হতাশা বোধ করি, এফএম রেডিওর ইচ্ছাকৃত ও অতিরিক্ত বাংলা-ইংলিশ মিশ্রণে অদ্ভূত উচ্চারণ শুনে বিষণœ হই। ওইটুকুই।

কখনো এসবের প্রতিবাদ করি না। না মুখের ভাষায়, না কলমের লেখনীতে। শান্তিপ্রিয়তা বা কলহবিমুখতার ভোলে লুকিয়ে রাখি কাপুরুষতা। তাই একুশের ভোরবেলায় উচ্চ হিন্দি সংগীতে মেজাজ খারাপ হলেও ঘরেই বসে থাকি। সকালের নাস্তা করি।

পত্রিকাটা হাতে নেই। কিন্তু ঘন্টা দুয়েক ধরে যখন টানা কেবল হিন্দি গানই বাজতে থাকে তখন কাপুরুষতাও যেন লজ্জিত হয়। নিচে নেমে যাই। আগের সন্ধ্যায় ঘরে ফেরার সময় দেখেছিলাম খালি জায়গাটুকুর এক কোণায় মাটি দিয়ে শহীদ মিনার বানিয়েছে ছেলেপিলেরা। এখন দেখলাম শহীদ মিনারের চারদিকে দড়ি দিয়ে ঝুলিয়েছে বাংলাদেশের অসংখ্য পতাকা।

কাগজের তৈরী, ছোট ছোট। তার পাশেই চলছে শব্দযন্ত্রের হিন্দি গান। গানের তালে হিন্দি সিনেমায় দেখা নাচের অনুকরণ। খোলা জায়গাটুকুর এক পাশে দাঁড়িয়ে ওদের একজনকে হাত ইশারায় ডাকলাম। কয়েকজন ফিরে তাকালো।

কিন্তু কেউ এগিয়ে এলো না। বাধ্য হয়ে আমিই এগিয়ে গেলাম ওদের মাঝে। হাত ইশারায় গান বন্ধ করতে বললাম। পরিষ্কার বিরক্তির চিহ্ন চেহারায় ঝুলিয়ে ওরা গানের শব্দ কমালো, কিন্তু পুরোপুরি বন্ধ হলো না। বাধ্য হয়ে ওর মাঝেই গলা চড়ালাম - ‘কি করতেছো তোমরা?’ ওরা উল্টো প্রশ্নবোধক চোখে আমার দিকে তাকালো।

আমি আবারো বললাম - ‘হিন্দি গান বাজাইতেছো কেন? পালন করতেছো একুশে ফেব্র“য়ারী- এইটা কি আনন্দ ফূর্তির দিবস? তোমরা জানো এই দিবস কেন পালন করতেছো? হৈ-হল্লার গান বাজানোর কি আছে? আর গান যদি বাজাও-ই তাহলে বাংলা গান বাজাও!’ কি মনে হয় আপনাদের? একুশ ফেব্র“য়ারী উপলক্ষ্যে পত্রিকায় প্রকাশিত শিশু-কিশোর গল্পের মতো এই শিশু-কিশোররাও আমাকে ঘিরে ধরলো মহান ভাষা দিবসের পটভূমি ও তাৎপর্য বুঝিয়ে বলার জন্য? আমার কথায় উদ্বুদ্ধ হয়ে এবং বাংলা ভাষার প্রতি মমত্ববোধ জাগ্রত হওয়ায় ওরা দ্রুত ক্ষমা চেয়ে ‘আমার ভাইয়ের রক্তে রাঙানো’ গানটি চালু করে দিল? - মোটেও না। এটা গল্প-উপন্যাস না। খাঁটি বাস্তব। এখানকার শিশু-কিশোররা এই দিবসের তাৎপর্য জানতে আগ্রহী হয় না। বরং, কোথাকার কে এসে তাদের ‘আনন্দ’ মাটি করছে দেখে বিরক্তি প্রকাশ করে।

রংচংয়ে জিন্স-টিশার্ট, গলায় মালা, কানে দুল পরনে তরুণ বয়সী ওদের এক বড় ভাইকে ডেকে আনে। সে এসে বলে - ‘ভাই, আপনার সমস্যা কি? পোলাপানের আনন্দ করতে ইচ্ছা হইছে, করতেছে। চুরি-ডাকাতি-সন্ত্রাসী তো আর করতেছে না। আপনার সমস্যা হইলে আপনে কানে তুলা দিয়া থাকেন। ’ অন্যরাও ঘিরে ধরে।

মারমুখী অভিব্যক্তি সকলের। সংগীতের শব্দ আবার তীব্র হয়। আগের চেয়েও তীব্র। আমি আরো কিছু বলতে চাই, কিন্তু মুখ দিয়ে শব্দ বের হয় না। অথবা, শব্দ বের হলেও সংগীতের আওয়াজের নীচে চাপা পড়ে যায়, ওদের কান পর্যন্ত পৌঁছায় না।

অপমানে আহত হয়ে ঘরে ফিরে আসি। দরজাটা চাপিয়ে দিয়ে বিছানায় শুয়ে থাকি। ভাষা দিবস উদযাপিত হতে থাকে বিভাষী সংগীতের বিজাতীয় আনন্দে। মাঝে দু’একটা বাংলা গান ভেসে আসে। তা-ও ‘পাগলু’ , ‘পরাণ যায় জ্বলিয়া রে’- কলকাতার বাংলা সিনেমার গান।

মন বিষণœ হয়। কিছুক্ষণ পর বাসার খোলা জায়গামুখী রান্নাঘরের আরেকটা কাঁচ ভাঙার শব্দ হয়। উঠে দেখতে যেতে ইচ্ছে হয় না কিভাবে ভাঙলো। অথবা সাহস হয় না। ।

অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।

প্রাসঙ্গিক আরো কথা
Related contents feature is in beta version.