আমাদের কথা খুঁজে নিন

   

আই সি ইউ (করুন অভিজ্ঞতা)

আমার বাচ্চাটি প্রিমেচুউর বেবী ছিল। জন্মের সময় তার ফুসফুসের পূর্ণাঙ্গ গঠন হয়নি। বেবী ছিল ধানমন্ডির নামকরা এক বেসরকারি হাসপাতালে। অনেক দিন আইসিইউ তে ছিল। সেসময় আমি অনেক করুন ও ভয়াবহ অভিজ্ঞতার মুখোমুখি হই।

এমন দুইটি অভিজ্ঞতা এখন সবার সাথে শেয়ার করছি। (১) আইসিইউ এর বাইরে দুঃচিন্তায় সময় কাটাচ্ছে রোগীর স্বজনেরা। রোগী সকলেই শিশু বিশেষতঃ সদ্যজাত শিশু। স্বজনদের বেশিরভাগই শিশুর বাবা। সদ্য বাবা হয়েছেন কিন্তু কারো মুখে হাসি নেই।

সন্তানের মূমুর্ষ অবস্থা। বাচবে কি মারা যাবে ঠিক নেই। বেশিরভাগ শিশুই জন্মের পরপরই জটিল সমস্যায় ভুগছে। চিকিৎসা দীর্ঘমেয়াদি ও ব্যয়বহুল। মায়েরা কেবিন বা ওয়ার্ডে অসহ্য মানুষিক যন্ত্রণায় দিন কাটাচ্ছে।

আইসিইউ তে সন্তানের কাছে যাবার অনুমতি কারো নেই, এমন কি মায়েরও না। বিকেলে কিছুক্ষন আইসিইউ এর একপাশে গ্লাসের পর্দা সরিয়ে দেওয়া হয়। বাবা - মা হুমরি খেয়ে গ্লাসের সামনে দাড়ায়। দুর থেকে শিশুর মুখ দেখতে না পেলেও অবয়ব দেখতে পায়। শিশুগুলোর নাকে নল, মুখে নল, হাত-পায়ে স্যালাইনের পাইপ।

কোন শিশু হাত – পা নাড়া চড়া করলে বাবা-মা র চোখে আনন্দের অশ্রু চিক চিক করে উঠে। বিভিন্ন রোগীর স্বজনদের মধ্যে সুসম্পর্ক গড়ে উঠছে। ঝড়ের মধ্যে সকলে একই নৌকার যাত্রী। সকলে নিজের কষ্টের কথা বলছেন, একে অপরকে সান্তনা দিচ্ছেন। এক বাবাকে দেখলাম এক মাস যাবৎ বাচ্চাকে ভেন্টিলেটর (লাইফ সাপোর্ট) চালিয়ে যাচ্ছেন।

৩২ দিন পর ডাক্তাররা নিশ্চিত করলেন বাচ্চা বাচবে না। বাবা তখনো ভেন্টিলেটর চালিয়ে যেতে বলল। প্রতিদিন শুধু ভেন্টিলেটর খরচ ১০,০০০ টাকা। অন্যান্য খরচতো আছেই। জমি বিক্রি করে তিনি খরচ চালাচ্ছিলেন।

বাবার মুখে শুনলাম, “বাচ্চা বাচবে না, কিন্তু ডাক্তারদের কিভাবে বলব এখনি লাইফ সাপোর্ট বন্ধ করে আমার বাচ্চাটিকে মেরে ফেলেন”। ৩৮ দিনের মাথায় বাচ্চাটি মারা গেল। মা উচ্চ স্বরে কাদছে। মায়ের মতো বাবা উচ্চ স্বরে কান্না করেনি। চোখ মুছতে মুছতে তিনি হাস্পাতাল হতে বিদায় ব ।

যাবার সময় আমার বাচ্চার আরোগ্য কামনা করয গেলেন। উল্লেখ্য তার হাসপাতাল বিল(ঔষধ, প্যাথলজিকেল টেস্ট ছাড়া) হয়েছিল সাত লক্ষ টাকার উপর। হাসপাতাল এক টাকাও কনসেশন করেনি। অবশ্য অধিকাংশ টাকা পূর্বেই শোধ করা হয়েছিল। ২/৩ দিন পর পর হাসপাতাল কর্তৃপক্ষ তাগাদা দেন ডিও পরিশোধের জন্য।

(২) আমার বেবী আইসিইউ তে থাকার সময়কার আর একটি ঘটনা। তখন একই সাথে বঙ্গবন্ধু শেখমুজিব বিশ্ববিদ্যালয় হাসপাতাল ও শিশু হাসপাতালের আইসিউ তে ইনফেকশন প্রতিরোধের জন্য বিশেষ কার্যক্রম (ফিউমেগেশন) চলছে। ঢাকার আর কোথাও সরকারী হাসপাতালে শিশুদের জন্য ভেন্টিলেশন মেশিন নেই ( ২০০৯ সাল)/ একদিন দেখলাম হাসপাতাল গেইটে এক সিএনজি থেকে দুই মহিলা ও এক পুরুষ নামছে। এক মহিলার কোলে ছোট এক শিশু। নাকে নল, অক্সিজেন দেওয়া হচ্ছে।

অক্সিজেনের সিলিন্ডার পুরুষটি বহন করছে। শিশুটি যে নলের মাধ্যমে পর্যাপ্ত অক্সিজেন নিতে পারছে না তা স্পষ্ট। শরীর নীল বর্ণ ধারন করেছে। অক্সিজেনের অভাবে ছোট্ দেহটি মোচড় খাচ্ছে। ভেন্টিলেটর প্রয়োজন।

ঢাকা মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালে ছিল। সেখানে ভেন্টিলেশনের ব্যাবস্থা না থাকায় এখানে নিয়ে এসেছে। পোশাক ও চালচলনই বলে দিচ্ছে তারা আর্থিকভাবে স্বচ্ছল নয়। হাসপাতালের রিসেপ্সনে বসা টাই পরা ভদ্রলোক নড়ে চড়ে বসলেন। তাদেরকে প্রথমেই জানিয়ে দেওয়া হল, প্রতিদিন ভেন্টিলেটর খরচ ১০,০০০ টাকা ও আইসিইউ চার্জ ৫০০০ টাকা।

ঔষধ, প্যাথলজিকেল টেস্ট ও অন্যান্য খরচ বাবদ প্রতিদিন আরো পাঁচ-দশ হাজার টাকা খরচ হতে পারে। আর ভর্তির সময় প্রায় ৩০,০০০ টাকা অগ্রিম দিতে হবে। পরিবারটি সিদ্বান্ত নিতে পারছে না। এমন ব্যায়বহুল চিকিৎসা তাদের সাধ্যের বাইরে। ফিরে গেলে বাচ্চার মৃত্যু (কষ্টকর মৃত্যু) নিশ্চিত।

মা শুধু চিৎকার করে কাদছে। বাবা শেষ পর্যন্ত সিদ্বান্ত নিলেন। রিসেপ্সনে বসা ভদ্রলোককে পাঁচ হাজার টাকা দিয়ে অনুরোধ করলেন বাচ্চাটিকে ভর্তি করতে। পরদিন সকালে বাকি ২৫০০০ টাকা দিবেন। ভদ্রলোক রাজী হলেন না।

আমরা অনেকে অনুরোধ করলাম, চাপ দিলাম। শেষ পর্যন্ত ভদ্রলোক কর্তৃপক্ষের সাথে ফোনে আলাপ করে কিছু শর্ত আরোপ করে বাচ্চাটিকে ভর্তি করালেন। বাবা ধার কর্জ করে চার দিন পর্যন্ত বাচ্চার চিকিৎসা চালাতে পারলেন। একদিন দেখলাম অসুস্থ বাচ্চাটিকে হাসপাতাল থেকে বের করে নিয়ে যাচ্ছেন। মা বাচ্চাটিকে শক্ত করে বুকে ঝড়িয়ে ধরেছেন।

নাকে অক্সিজেন নল। অক্সিজেনের অভাবে দেহটি কুকড়ে যাচ্ছে। শোনা যায় অতি শোকে পাথড়। মা আর চিৎকার করছে না। নীরবে চোখের পানি ফেলছেন।

তার ভেতরতা যে ক্ষতবিক্ষত তা সহজে অনুমেয়। সন্তানকে কোলে করে নিয়ে যাচ্ছে মৃত্যুপুরীতে। বাবার চোখে মুখে দেখলাম কষ্ট আর পরাজয়ের বিষাদ। নিজেদের কষ্টের মাঝেও আমরা সবাই হতবিহবল। আমাদের অনেকের চোখ অশ্রুতে ভিজে গেল।

অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।