আমাদের কথা খুঁজে নিন

   

সরোদ -মিষ্টি সুরের বাদ্য

একবার আপনারে চিনতে পারলে রে , যাবে অচেনা রে চেনা সরোদ হিন্দুস্তানী রাগ সংগীতে জনপ্রিয় এক বাদ্য যন্ত্র। এর সাথে জড়িয়ে আছে আমাদের বাঙালির গৌরব ওস্তাদ আলাউদ্দিন খাঁ এর নাম। যন্ত্রটি তার হাতেই চূড়ান্ত রূপ পায়। সরোদ একটি তারযন্ত্র। সরোদে তার থাকে ২০ থেকে ২৫ টি।

সেতারের সাথে এর সুরে মিল রয়েছে। বলা হয়ে থাকে হিন্দুস্তানী(উত্তর ভারত, পাকিস্তান ও বাংলাদেশ) রাগ সংগীতে জনপ্রিয়তায় সেতারের পরই সরোদের স্থান। এর সুরটি সেতারের তুলনায় গভীর, মিষ্টি, রেজোনেন্ট(বাংলায় বলা যায় অনুনাদী) এবং কিছুটা ইন্ট্রোস্পেকটিভ বা অন্তর্ঘাতি। সুরের রেশ থাকে একটু কম সময় ধরে। সরোদের সবচেয়ে বড় যে বৈশিষ্ট্য সেটা হলো এই যন্ত্রটিতে ‘মীড়’ ফুটিয়ে তোলা যায় খুব ভাল ভাবে।

‘মীড়’ হিন্দুস্তানী রাগ সংগীতের এক বিশেষ গুরুত্বপূর্ণ বৈশিষ্ট্য। এক সুর থেকে দুরবর্তী আরেক সুরে গড়িয়ে যাওয়াকে হিন্দুস্তানী শাস্ত্রীয় সংগীতের পরিভাষায় ‘মীড়’ বলে। মীড় ছাড়া রবীন্দ্র- নজরুলের গান? ভাবাই যায়না। সরোদ যন্ত্রের উৎপত্তি মধ্য এশিয়া থেকে। `রবাব' নামক এক ধরনের তার যন্ত্র বাজাতো মধ্য এশিয়ার(উজবেকিস্তান, কাজাকস্তান প্রভৃতি) পার্সিয়ানরা।

আফগানরা ও বাজাতো। এই 'রবাব' থেকেই সরোদের উৎপত্তি। রবাবের সুর একটু বেশী তীক্ষণ। রবাবের তুলনায় সরোদের পীচ কিছুটা কম। কেউ কেউ বলেন এটা প্রাচীন বীনা ও রবাবের একটি ফিউশন।

ভারত বর্ষে `রবাব' যন্ত্রটি প্রথম আনেন মোহাম্মাদ হাশমী খান বাঙ্গাস। সেটা অষ্টাদশ শতকের মধ্যভাগের কথা। তিনি ছিলেন একজন যন্ত্রসঙগীত শিল্পী কাম ঘোড়ার ব্যবসায়ী। পরবর্তীতে তিনি মধ্যপ্রদেশের রেবার মহারাজার সভা বাদক হন। তার নাতি গোয়ালিওরের রাজসভার বাদক গুলাম আলী খান বাংগাস দাদার রবাব যন্ত্রটিকে সরোদে রূপান্তর করেন।

সরোদের চূড়ান্ত সংস্করণ করেন ওস্তাদ সুর সম্রাট আলাউদ্দিন খাঁ। শুরুতে ওস্তাদ আলাউদ্দিন খাঁ কলকাতার বিখ্যাত সংগীত সাধক গোপাল কৃষ্ঞ ভট্টাচার্য(নুলো গোপাল নামে বেশী পরিচিত) এর শিষ্যত্ব নিয়েছিলেন। সাত বছর সরগম সাধনার পর হঠাৎ প্লেগ হয়ে মারা গেলেন নুলো গোপাল। এরপর মনের দু:খে গান ছেড়ে দেন আলাউদ্দিন। শুরু করেন বাদ্য যন্ত্র চর্চা।

পরবর্তীতে ওস্তাদ ওয়াজির খাঁর কাছে নাড়া বাঁধেন তিনি। ওয়াজির খাঁ ছিলেন মিয়া তান সেনের বংশধর। ওয়াজির খাঁ তাঁকে ধ্রুপদ,ধামার থেকে শুরু করে সুর শৃংগার, রবাব প্রভৃতি বাদ্যযন্ত্রে পারদর্শী করে তোলেন। সেখান থেকে মাইহার রাজসভা। মাইহারের রাজসভায় থাকার সময়টিতে তিনি সরোদ এর প্রতি আগ্রহী হয়ে ওঠেন।

তিনিই এই যন্ত্রটিকে সংস্কার, জনপ্রিয় ও পরিচিত করে তোলেন। পরে তাঁর ভাই আরেক কিংবদন্তী ওস্তাদ আয়েত আলী খাঁ যন্ত্রটিকে বিশেষ উচ্চতায় নিয়ে যান। তিনি এর অবয়ব ও সুর মাধুর্য বৃদ্ধিতে বিশেষ পরীক্ষা-নিরীক্ষা করেন। সফল হন সেটা বলাই বাহুল্য। আজকের সরোদের আধুনিক রূপটি তাঁরই অবদান।

পরবর্তীতে ওস্তাদ আলাউদিদন খাঁ’র সন্তান আলী আকবর খাঁ হয়ে ওঠেন সরোদের আরেক কিংবদন্তী। এই সময়ে সরোদের সাথে প্রায় প্রতিশব্দের মত উচ্চারিত হয় গোয়ালিওর –বাঙ্গাস ঘরানার সুযোগ্য উত্তরসূরী ওস্তাদ আমজাদ আলী খানের নাম। তিনিও এর কিঞ্চিত সংস্কার সাধন করেছেন। তাঁর দুই ছেলে আমান আলী বাঙ্গাস ও আয়ান আলী বাঙ্গাস পিতার যোগ্য উত্তরসূরী । মূলত মাইহার ঘরানা এবং গোয়ালিওর–বাঙ্গাস ঘরানা এই দুটি ঘরানাই সরোদ বাদনে অনুসারিত হয়।

এর ডিজাইনে ও এই দুইটি ঘরানার আলাদা স্বাতন্ত্র দেখা যায়। যেমন আমজাদ আলী খান এর গড়নে টিক কাঠ এবং নিকেল প্লেটেড স্টিল ব্যবহার করেন। ছাউনি তে ছাগলের চামড়া। মাইহার ঘরানায় তারের আছে ভিন্ন বিন্যাস। পরিবেশন রীতিতে তো ভিণ্ণতা আছেই।

সেই গুরু গম্ভীর আলোচনা থাক। তথ্যসূত্র: উইকিপিডিয়া, http://www.sarod.com/, সংগীতভাব্না-মোবারক হোসেন খান পুনশ্চ: এই কিছুদিন আগে প্রায় নিভৃতে ব্রাহ্মণবাড়িয়া শহরে মারা গেলেন আয়াত আলী খাঁ হেরিটেজের একজন প্রতিভাবান সরোদিয়া ওস্তাদ আফজালুর রহমান। আবাল্য অন্ধ এই শিল্পী ছিলেন আয়াত আলী খানের প্রিয় শিষ্য। তাঁর স্ত্রী (একদা ছাত্রী)কে ও সরোদ বাজাতে দেখেছি স্থানীয় বিভিন্ন অনুষ্ঠানে। তাঁর দুই কন্যা রুবা ও টুংটাং ।

দুইজনই জন্মান্ধ। মেয়ে দুটি অসম্ভব প্রতিভাবান। সরোদ , বেহালা, উচ্চাঙ্গ সংগীত সব কিছুতেই সমান পারদর্শী।  ।

অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।

প্রাসঙ্গিক আরো কথা
Related contents feature is in beta version.