আমাদের কথা খুঁজে নিন

   

কচলানো লেবু

বিদ্যুত-পানি-গ্যাস নিয়ে যখন আমি কিছু সাধারণ ও সহজ কথা বলি (ও লিখি), তখন কেউ মুখের উপর বলে না দিলেও আমি বুঝতে পারি আমার কথাবার্তাগুলোকে সবাই পাগলের প্রলাপ হিসেবেই নিচ্ছে। এই যেমন ঘন-ঘন লোডশেডিং এবং লো ভোল্টেজের কারণে হঠাত ভোল্টেজ বেড়ে যাওয়াতে যন্ত্রপাতি নষ্ট হয়ে যাওয়া আমাদের এখানে নিত্যনৈমিত্তিক ব্যাপার। এসব সমস্যার কয়েকধরণের সমাধান আছে। এন্ড-ইউজার বা সাধারণ ভোক্তা হিসেবে আমাদের শুধু একটা করণীয়ই আছে- তা হল যে করেই হোক বিদ্যুতের অপচয় রোধ করা। আমাদের পক্ষে বিদ্যুতের নতুন উৎস অর্থাৎ পাওয়ার প্ল্যান্ট তৈরী সম্ভব নয়; তাছাড়া এক্ষেত্রে প্রাকৃতিক সম্পদের (বিদ্যুত উৎপাদনের কাঁচামাল) প্রচুর সীমাবদ্ধতার জন্যেও আমাদের কিছু করার নেই।

আমরা যা যা করতে পারি তা হলঃ ১) দেশের সব লাইট যেন এল-ই-ডি (লেড) বাল্ব বা সি-এফ-এল (এনার্জি-সেভিং) বাল্ব হয়, কারণ একই পরিমাণ আলো নিঃসরণের ক্ষেত্রে সাধারণ বাল্বের (ইনক্যান্ডেসেন্ট বাল্ব) তুলনায় সিএফএল বাল্ব ৪ গুণ এবং লেড বাল্ব ১০ গুণ কম বিদ্যুত-শক্তি খরচ করে থাকে। ২) “মিউনিসিপ্যাল লোড” বলে একটা টার্ম আছে, যার অর্থ হল নগরব্যবস্থায় সকল নাগরিকেরা যেসব সুবিধা সমানভাবে ব্যবহার করে, সে ধরণের “ইলেক্ট্রিক্যাল লোড”; যেমনঃ রাস্তার ধারের লাইট, ওয়াসার ওয়াটার ট্রিটমেন্ট প্ল্যান্ট-এর মোটর/জেনারেটর, পার্ক-উদ্যানের লাইট, ব্রীজ-কালভার্টের লাইট ইত্যাদি। এসব লাইটের ক্ষেত্রে মানুষ বরাবরই কিছুটা উদাসীন, অনেক জায়গাতে দিনের বেলাতেও লাইট-গুলো জ্বলে। তাই এধরণের লাইটগুলোকে সৌরশক্তির আওতায় এনে এগুলোতে এমন কন্ট্রোলার লাগাতে হবে, যাতে এগুলো দিনের বেলায় সূর্যের আলোয় চার্জ হয়ে রাতে অটোমেটিক জ্বলে উঠে এবং পরে সূর্য উঠলেই বন্ধ হয়ে যায়। ৩) কোনখানেই যেন একই সাথে ফ্যান এবং এসি না থাকে, আর থাকলেও যেন কিছুতেই দুটো একই সাথে না চলে।

৪) আই-পি-এস-এর ব্যবসাকে নিরুতসাহিত করে সোলার সেলের ব্যবসাকে উতসাহিত করতে হবে। যেহেতু, আইপিএস নিজেই বিদ্যুত ভক্ষণ করে অর্থাৎ এটি নিজেই একটি লোড; আইপিএসের সংখ্যা যত বাড়বে যোগানের সাপেক্ষে দেশে বিদ্যুতের চাহিদাও তত বাড়বে। আইপিএস-এর ব্যবহারকে বাসাবাড়িতে সীমাবদ্ধ রেখে অফিস-আদালত-ব্যবসা-কলকারখানায় ডিজেলচালিত জেনারেটরের পাশাপাশি সোলার সেল-কে প্রচলিত করতে হবে। সোলার এনার্জি খুব কম-খরচের, পরিবেশবান্ধব, বিদ্যুত উতপাদনের জন্যে শুধু সূর্যের আলোর উপর নির্ভরশীল। ৫) বাঙ্গালীর ক্ষেত্রে প্রমথ চৌধুরীর লেখা একটা কথা খুব কার্যকর; তা’ হল- “ব্যাধিই সংক্রামক, স্বাস্থ্য নয়!” আমরা আমাদের অবকাঠামোগত উন্নয়নের জন্যে যতটা না সোচ্চার, তার চেয়েও বেশী অলসতা-নির্ভর বিলাসবহুল জীবনের প্রতি আমাদের আসক্তি বেশী।

শীল-পাটা নিয়ে বসতে আমাদের ননীর পুতুল ভাবীদের কোমর ভেঙ্গে যায়, টাটকা খাবার রান্না করতে গিয়ে আমাদের মা-খালাদের সিরিয়াল দেখা মিস হয়ে যায়। তাই তাদের ব্লেন্ডার দরকার, ওভেন দরকার। ভাত রান্না করতে রাইস-কুকার দরকার। তবে যে হারে গ্যাস-সংকটে মেগাসিটিগুলোর বেশীর ভাগ এলাকা জর্জরিত, তাতে গ্যাসের ঘাটতিটা বিদ্যুতচালিত রান্নাবান্নার যন্ত্রগুলো দিয়েই মেটাতে হচ্ছে। তবে মোদ্দা কথা এই যে, বিলাসিতা বা অলসতা পরিহার করে আমাদের সেসব ক্ষেত্রে স্বয়ংক্রিয় বিদ্যুতচালিত যন্ত্র পরিহার করতে হবে, যেসব ক্ষেত্রে একটু পরিশ্রমেই আমরা নিজেরা কাজটা করতে পারব।

মনে রাখতে হবে, বিদ্যুতের ক্ষেত্রে আমরা “গরীব”, এবং অতীব যন্ত্রনির্ভরতা “গরীবের ঘোড়া রোগ”! ৬) ইলেকট্রিক্যাল যন্ত্রের ব্যবহার কমিয়ে ইলেকট্রনিক যন্ত্রের ব্যবহার বাড়াতে হবে, কারণ ইলেকট্রনিক যন্ত্র অনেক কম বিদ্যুতেই চলে। “ডিজিটাল-ডিজিটাল” না চেঁচিয়ে “ন্যানো-ন্যানো” বলে চেঁচালেই বরং ভালো হবে। কারণ ডিজিটাল যুগের সমাপ্তি ঘটেছে অনেক আগেই, এখন ন্যানো-টেকনোলজির যুগ। সহজ ভাষায় বলতে গেলে, ন্যানো-টেকনোলজি হল অনেক বড় ও জটিল কার্যপ্রণালীর যন্ত্রকে আকারে ছোট ও সমন্বিত করে আনা। এখানে একটা উদাহরণ দেওয়া যায়, আয়রনম্যানের প্রথম মুভিটা দেখেছেন নিশ্চয়।

ওখানে আয়রনম্যানের বুকে যে উজ্জ্বল পাওয়ার-কোর বা শক্তি উতস ছিল, তা্র ক্ষমতা একটি ছোটখাট নিউক্লিয়ার রিএক্টরের সমান। আয়রনম্যানের প্রতিপক্ষ বা সিনেমার ভিলেন এই ভেবে উন্মাদ হয়ে যায় যে, আয়রনম্যান কিভাবে এ অসম্ভবকে সম্ভব করল। তবে সিনেমার এই কাহিনী বাস্তবে এখনো অসম্ভব। ৭) ডেস্কটপ কম্পিউটারের ব্যবহার কমিয়ে ল্যাপটপ-এর ব্যবহার বাড়াতে হবে। ল্যাপটপ ডেস্কটপের তুলনায় অনেক কম বিদ্যুত খরচ করে।

ট্রাফিক জ্যামে পরলে জ্বালানী বাঁচাতে ও পরিবেশ দূষণ কমাতে যেমন গাড়ীর ইঞ্জিন বন্ধ রাখতে বলুন; ঠিক তেমনি অফিস-দোকানে বিনা প্রয়োজনে কম্পিউটার, ফটোকপি-ফ্যাক্স-প্রিন্টিং মেশিন বন্ধ রাখতে উদ্যোগ নিন। ৮) পিক আওয়ারে পানি তোলার মোটর বা কাপড়ের ইস্ত্রি ব্যবহার করবেন না। অফ-পিক আওয়ার শুধু মোবাইল টকটাইম খরচের জন্য নয়! ৯) ব্যবসায়ী ভাইরা মনে রাখুন, “চকচক করলেই সোনা হয় না”! মাকাল ফলের মত নিজেদের দোকানের ঔজ্জ্বল্য বৃদ্ধির জন্য মাত্রাতিরিক্ত লাইট না জ্বালিয়ে নিজেদের পণ্যের মান বৃদ্ধির দিকে নজর দিন, ভালো সেবার ব্রত নিয়ে ব্যবসা করুন। ১০) খারাপ কাজের নিন্দা করুন, ভাল কাজের প্রশংসা করুন। বিদ্যুতের অপব্যবহার খারাপ কাজ, সদ্ব্যবহার ভাল কাজ।

উপরের কথাগুলো প্রধানমন্ত্রীর বাসস্থান বা লক্ষ-কোটি টাকার মালিক শিল্পপতির প্রাসাদ থেকে শুরু করে মিউনিসিপ্যালটির পরিস্কার-কর্মচারী বা গ্রামের হতদরিদ্র কৃষকের কুটিরের ক্ষেত্রেও প্রযোজ্য। নির্বাচনে জেতার চাল হিসেবে বা নিজের অসীম ক্ষমতা জাহিরের জন্যে কোন সুবিধাবঞ্চিত বা সেবাবঞ্চিত এলাকায় সেবা পৌঁছে দেওয়াটা খুব বড় অদূরদর্শিতা ও বোকামি হয়ে দাঁড়ায়, যখন সেবার সংস্থানটা অপ্রতুল হয় অর্থাৎ চাহিদার তুলনায় যোগান কম হয়। দেশে এখন রাস্তাঘাটে ইঞ্জিনিয়ার-ইঞ্জিনিয়ার ধাক্কা খায়। বুয়েটের মত ভার্সিটি থেকে তড়িত ও ইলেকট্রনিক প্রকৌশলীরা বের হয়ে বিদেশে পাচার হয়ে যায়। দেশে যারা থাকে তারা বড় বেতনের চাকরি করে নিজেরা শান্তিতে থাকতে চায়।

আর যারা কিছু করতে চায়, তারা ক্ষমতা, অর্থ আর সরকারী সহযগিতার অভাবে কিছুই করতে না পেরে আমার মত শুধু বকর-বকর করে যায়। দেশের এত্তগুলো ভার্সিটিতে ইলেকট্রিক্যাল ও ইলেকট্রনিক ইঞ্জিনিয়ারিং ডিপার্টমেন্টে স্টুডেন্টরা ভাল গ্রেড পাওয়ার জন্য সুন্দর-সুন্দর প্রজেক্ট-থিসিস পেশ করে, এর মধ্যে কিছু আবার আন্তর্জাতিকভাবে স্বীকৃত-ও হয়, কিন্তু এত্ত সুন্দর ও কার্যকরী সব প্রস্তাব-গুলো কখনো আলোর মুখ দেখে না। ।

সোর্স: http://www.somewhereinblog.net     দেখা হয়েছে বার

অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।